ফজলুল হক বাচ্চু
চামড়া শিল্প আমাদের দেশের নিজস্ব শিল্প। একসময় অন্যতম লাভজনক এই শিল্পটি এখন ধুঁকে ধুঁকে কোনোমতে টিকে আছে। ইটিপি প্ল্যান হচ্ছে যে বর্জ্যটা তৈরি হবে সেটা দূষণমুক্ত করে নদীতে ছাড়বে। এই প্ল্যান্টটা বাস্তবায়িত হওয়া দরকার, তবে না হওয়ায় বিদেশে এক্সপোর্ট হয় না, উৎপাদন সক্ষমতার সার্টিফিকেট পায় না। ফিনিশড পন্য তৈরি হয় না। জুতা শিল্প মার খায়। কাচা চামড়া চোরাই পথে চলে যাচ্ছে। অথচ এসব সমস্যার সমাধান করে চামড়া শিল্পটাকে যথেষ্ট মানে নেয়া হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি করা যেতো। চামড়াশিল্প খুবই সম্ভাবনাময় হলেও তা এখনো কাজে লাগানো যায়নি।
মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ পোশাক, আশ্রয়স্থল এবং জুতা তৈরিতে পশুর চামড়া ব্যবহার করে আসছে। আর এদেশের ২০ কোটি মানুষের জুতাতো আর কম লাগে না, তাছাড়া ব্যাগ লাগে, বেল্ট লাগে। বার্মার জুতা বাংলাদেশে আসে আর বাংলাদেশের জুতা শিল্প মার খায়। বিশ^মার্কেটের চাহিদা অন্যরা পরণ করে। বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাওয়া চামড়া খাতের বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। দেশে চামড়া খাতের সাতটি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। সেগুলো হচ্ছে এপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার, সাফ লেদার, সিমোনা ট্যানিং এবং অস্টান লিমিটেড। এর মধ্যে তিনটি কারখানা কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করে।
কুরবানি আসলে বুঝা যায় এই শিল্পে অর্থনৈতিক ডিজাস্টার হচ্ছে। রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে, চামড়ার চাহিদাও কমে গেছে, চামড়ার যেনো কোনো মূল্যই নেই। হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হবার প্রক্রিয়া এখনো সুসম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশ মুসলিম দেশ, কুরবানি করবেই, গোশত খাবেই। চামড়ার প্রোডাকশন বেশি কিন্তু ডিমান্ড কম। ব্যাপারটি গুরুত্বহীনভাবে এভাবে চলতে দিলে শিল্পটি শেষ হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক পরিবেশগত ছাড়পত্র (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট) পাওয়ার ক্ষেত্রে যত বাধা আছে তা দূর করতে হবে।
কিছু কিছু কোম্পানি ফিনিশড চামড়া চামড়াজাত পণ্য আমদানি করে, অথচ এদেশে চামড়া নষ্ট হচ্ছে। এখানে উদ্যোগের অভাব আছে, বড় ধরনের সমস্যা আছে। কাচা চামড়া চোরাই পথে পানির দরে চলে যাচ্ছে। দেশে ফিনিশড গুড উৎপাদনের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। যেহেতু কুরবানির পশুর চামড়ার মূল্যটা পায় গরিব মানুষ, সেহেতু এতে গরিব মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে সহায়ক হবে।
যেহেতু চামড়া মূলত মাংস শিল্পের একটি উপজাত, যার সরবরাহ এবং ব্যাপকতা মূলত মাংস উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। সেহেতু আমি মাংস শিল্প নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আমিষের চাহিদা পূরণে গোশত খায়। গোশত এতই পছন্দনীয় জনপ্রিয় যে না হলে চলেই না। প্রচুর গরু ছাগলের ডিমান্ড আছে। তাই গরুর খামার, ছাগলের খামার অনেক। বহু টাকা এই খামারের পেছনে ব্যয় হচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে। তারপরও গরুর খাদ্যের অভাব, ঔষধের অভাব আছে। গরুর উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বিক্রির দাম কমে যায় অনেক বেশি। অথচ ইন্ডিয়া হিন্দু রাষ্ট্র, গরুকে ভালোবাসে, গরু দেবতা। ওদেশে প্রতিটা ফ্যামিলিতেই ২-৪টা গরু পালা হয়।
কলকাতায় দেখেছিলাম গরুর মাংসের কেজি ২২০ রুপি; বাংলাদেশি টাকায় ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। আর বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এদেশের মানুষ গরুর গোশত খায়, ইন্ডিয়ার মানুষ ধর্মীয় কারণে গরুর গোশত খায় না। এখন বাংলাদেশে গরুর খামার আর গরু উৎপাদনের পেছনে লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কোনোই মানে হয় না। এটার পেছনে যে পুঁজিটা চলে যাচ্ছে, এই বিনিয়োগ অন্য কোনো লাভজনক খাতে করতে পারে। কম দামে সস্তায় ইন্ডিয়া থেকে করে এখানে চাহিদা পূরণ করি আর পুঁজিটা অন্য কোনো সম্ভাবনাময় খাতে কাজে লাগাই।
কেন আমরা বৈধ পথে গরু আমদানি করে দেশের চাহিদা মিটাতে চেষ্টা করি না। যেহেতু ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই সিস্টেমটা হবে বৈধভাবে ইন্ডিয়া থেকে কমদামে গরু আমদানি করে আনা। ভারতের গরু চোরাই পথে আনতে গিয়ে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। আর হিন্দুরাতো গরু উৎপাদন করলেও গোশত খায় না; মুসলিম প্রধান প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারি। ওদের যেহেতু গরুর ব্যাপারে ধর্মীয় সেন্সিভিটি আছে, সেহেতু আবেগে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে। অথচ ২৫০ টাকা কেজি দরে গরু ওদের কাছ থেকে আমদানি করলে বিভিন্ন চার্জ ট্রান্সপোর্ট খরচ মিলে যদি পরে ৩৫০ টাকা; আর সেটি যদি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করা যায়- তাহলে আমাদেরই লাভ। গরুর যে উৎপাদন খরচ তাতে গরু দেশে উৎপাদন না করে ইন্ডিয়া থেকে বৈধভাবে আমদানি করাই ভালো। তবে পুরো উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না, তাহলে সুযোগ বুঝে ইন্ডিয়া আবার দাম বাড়িয়ে দিবে।
বাংলাদেশে রপ্তানি বহুমুখীকরণের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে চামড়া শিল্প অন্যতম যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। চামড়া শিল্প বিকাশে প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ হচ্ছে- চামড়া র্শিপ প্রতিষ্ঠানসমূহের যথাযথ কমপ্লায়েন্স (বিশেষত এলডব্লিউজি) না থাকা, নিরবচ্ছিন্ন ইউটিলিটি সুবিধা না থাকা, কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের যথাযথ ব্যবহার না করার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কোল্ড স্টোরেজ না থাকা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারা, মালিক ও শ্রমিক উভয়পক্ষের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাব ইত্যাদি। মান সম্পন্ন ইটিপি প্ল্যান্ট সরকার ও টেনারি মালিকদের যৌথ উদ্যোগে অতিশীঘ্র তৈরি করা খুবই জরুরি।
সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমির ওপর পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগরে পরিবেশদূষণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে খাতটি ধুঁকছে। ২১ বছর পার করলেও সাভার চামড়া শিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো পরিবেশসম্মতভাবে সম্পন্ন হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থায়ী জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরু না হওয়ায় ধলেশ্বরী নদীও দূষণের শিকার হচ্ছে। ট্যানারি ও চামড়াজাত দ্রব্যের প্রস্তুতকারী শিল্প মালিকদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো কমপ্লায়েন্স। ইএসকিউ (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটি), আইএসও এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই আন্তর্জাতিক ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং তা এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে সহায়ক হবে।
বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডের কাছে বেশি দামে চামড়া বা চামড়াপণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ থাকতে হয়। শিল্পনগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় সেই সনদের জন্য ট্যানারিগুলো আবেদন করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে কমপক্ষে অর্ধেক দামে চীনাদের কাছে চামড়া রপ্তানি করতে হয়। পরিবেশগত মানদণ্ডের চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের কাঁচা চামড়া ও চামড়া পণ্যের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দাম না পেয়ে দেশে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটলেও বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি বাড়ছে।
চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে অর্থায়নের ব্যবস্থা, ডিজাইনারসহ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী তৈরি, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, পাদুকা শিল্পপল্লি স্থাপন, আধুনিক কসাইখানা স্থাপন, দেশে প্রচলিত ছুরি ও যন্ত্রপাতি উন্নয়ন ও কসাইদের প্রশিক্ষণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য অভিন্ন প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন, লেদার টেকনোলজি বিষয়ে শর্ট ডিপ্লোমা কোর্স ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা, হাইড অ্যান্ড স্কিন ব্যবসায়ীদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ, সাভার চামড়াশিল্প নগরীর পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রাপ্তির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, চামড়াশিল্প ব্যবস্থাপনা আইনবিষয়ক জাতীয় কমিটিতে সব অংশীজনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার।
কুরবানির ঈদের সময় ট্যানারি মালিকদের প্রয়োজনীয় পুঁজি ব্যাংকগুলো সময় মতো দেয় না। তাই টেনারী মালিকগণ চামড়া কিনতে না পারায় ক্রেতা সংকটে কাঁচা চামড়ার চাহিদা পড়ে যায় এবং নষ্ট হয়। ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত ওয়েট ব্লু চামড়া বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হতো। কিন্তু ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি বন্ধ করার পর ট্যানারি মালিকরা বিপদে পড়ে। প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে অধিকাংশ টেনারি ফিনিশড গুড উৎপাদনও ঠিকভাবে করতে পারে না।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় চামড়া কিনে হাতেগুনা কয়েকটি ট্যানারি। ২০১৯, ও ২০২০ সালে পবিত্র ঈদুল আজহার পর দাম না পেয়ে অনেকে মাটিতে চামড়া পুঁতে ফেলেছিলেন। ৩০ বছর পর ২০২১ সালের জুলাইয়ে আবার প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) বিরোধিতার কারণেই ২০২২ সালে আবার রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
এমতাবস্থায় দেশে ফিনিশড গুড এর চাহিদা মিটাতে বাইরে থেকে চামড়া আমদানি করা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং দেশেই প্রয়োজনীয় উৎপাদন নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের মানুষের চামড়াজাত পণ্যের বিশাল বাজারের সিংহভাগ যেনো দেশের চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারীগণের মাধ্যমেই মিটানো যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশ থেকেপাকা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি অধিক আমদানি শুল্ক বসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এভাবে যদি দেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাগণকে সুযোগ করে দেয়া হয় তাহলে এ শিল্পের দূরাবস্থা দিনদিন কেটে যাবে।
এসব সমস্যার সমাধান করে বা সংকট নিরসন করে চামড়া শিল্পকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে- যাতে সংরক্ষণের অভাবে কাঁচা চামড়া নষ্ট না হয়। বাজারে চাহিদা বাড়িয়ে চামড়ার উপযুক্ত দাম নিশ্চিত করতে হবে। চামড়াশিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত ও কার্যকর করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের সিইটিপি করা এখন সময়ের দাবি। চামড়াশিল্প নগর পরিবেশবান্ধব করতে না পারার ব্যর্থতার মাশুল দিচ্ছে সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প, এটি যেকোনো উপায়ে দূর করতে হবে।