বিশ্বব্যাপী বহু অস্ত্রের সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি। অমানবীয় বুদ্ধিমত্তা শুধু চালকবিহীন গাড়ি বা কর্মী রোবটে সীমাবদ্ধ থাকছে না। ভয়াবহ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন অস্ত্রের শক্তি আরো বাড়ানো হচ্ছে। স্বচালিত এসব অস্ত্র সমরাস্ত্রের তৃতীয় প্রজন্ম, এটি অস্ত্রের ক্ষেত্রে এক নতুন বৈপ্লবিক ধারণা।
যেমন- আমেরিকার তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মারণাস্ত্র এএন-২ অ্যানাকোন্ডা গানবোট অস্ত্রসজ্জিত সামরিক জলযান, যা স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম। মানুষের কোনো রকম সহায়তা ছাড়াই এটি দীর্ঘ সময় ধরে অপারেশন চালিয়ে যেতে পারে।
রাশিয়ার তৈরি টি-১৪ আর্মাটা ট্যাংকটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। এটি মানুষের সাহায্য ছাড়াই প্রতিপক্ষের গোলার জবাব দিতে সক্ষম। এরকম অনেক অস্ত্র ভয়াবহ শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। এই শঙ্কা থেকেই ‘ঘাতক রোবট প্রতিহত’ করার দাবি ওঠছে।
ঘাতক রোবট কী?
ঘাতক রোবট সম্পূর্ণভাবে স্বচালিত অস্ত্র। মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে বাছাই করতে পারে। লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে। ‘লিথাল অটোনমাস উইপন সিস্টেমস’ ‘প্রাণঘাতী স্বশাসিত অস্ত্র প্রণালী’ ‘বুদ্ধিযুক্ত সমরাস্ত্র’ তথা ‘স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তৈরিতে যথেষ্ট অগ্রগতি-উন্নতি সাধন হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রকে আধুনিক যুদ্ধের পরিস্থিতির উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের বিরল ক্ষমতাকে সংরক্ষণ করার সামর্থ্য বেড়েছে।
বুদ্ধিযুক্ত অস্ত্রে আশঙ্কার দিক
বুদ্ধিযুক্ত সমরাস্ত্র সন্ত্রাসের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। স্বৈরাচারী-অত্যাচারী শাসক ও সন্ত্রাসবাদী-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরা এসব অস্ত্র নিরপরাধ-নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। হ্যাকাররা বুদ্ধিযুক্ত সমরাস্ত্র হ্যাক করে সেগুলি দিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পারে। অনাকাঙ্ক্ষিত উপায়ে ব্যবহার করতে পারে। যেকোনো ধরনের অস্ত্রে বা অস্ত্র ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযুক্তি একে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। একটা সময়ে মানুষের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণে সক্ষম হতে পারে। ফলে স্বচালিত অস্ত্রের ঝুঁকি মারাত্মক।
স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ
স্বয়ংক্রিয় রোবটকে যুদ্ধে মোতায়েনের মানে- যুদ্ধ হবে পরোপুরি স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ। এ ধরনের অস্ত্র যুদ্ধের প্রণালী-অস্ত্রসজ্জায়-যুদ্ধ বিগ্রহে ‘তৃতীয় বিপ্লবের’ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের যত্রতত্র ব্যবহার, হাত ঘুরে উগ্রপন্থী-সন্ত্রাসবাদীদের হাতিয়ার হওয়া অত্যন্ত বিপদজনক। বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী দল এখন হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রকেই সুবিধাজনক মনে করছেন। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মারণক্ষমতা প্রথাগত অস্ত্রের তুলনায় অনেকগুণ বেশি, ক্ষিপ্রতাও বেশি, সহজে বেশি হতাহত করতেও সক্ষম।
নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা
এআই ও রোবটিক্স প্রযুক্তির ভয়াবহতা অত্যন্ত বেশি। ‘খুনি রোবট’ যুদ্ধযাত্রার বিকাশ ঘটলে নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা শেষ হয়ে যাবে, নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে, এর অপব্যবহারে বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একবার স্বচালিত সমরাস্ত্রের পথে গেলে, সেখান থেকে আবার ফেরা কঠিন হবে। তাই সমরাস্ত্র খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ধারণাটি অত্যন্ত বাজে এবং সব ধরনের স্বচালিত অস্ত্র তৈরির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমেই এই ধারণাকে প্রতিহত করা সম্ভব। ক্রমবর্ধমান সামরিক আগ্রাসন, প্রভাব-বলয় বিস্তারের যুদ্ধে অনেক রাষ্ট্রই নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এমতাবস্থায় দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর আত্মরক্ষার কবচ পরতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে হবে এখন এবং এখনই।
বিশেষজ্ঞরা কী ভাবছেন?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি ‘ঘাতক রোবট’ ‘খুনি রোবট’ ‘রোবট সৈন্য’ ‘কিলার রোবট’ ‘হত্যাকারী রোবট’ ‘অস্ত্র ঘাতক’ ‘অস্ত্র পরিচালনাকারী রোবট’ এর উদ্ভাবন-উৎপাদন-ব্যবহার তথা অটোনোমাস উইপন্স সিস্টেমকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে জাতিসঙ্ঘকে খোলাচিঠি পাঠিয়েছিলেন রোবোটিক্স এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ। তারা লিথাল অটোনোমাস উইপন্স সিস্টেম- লজ বা প্রাণঘাতী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পদ্ধতি ব্যবহারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ভয়াবহ বিপ্লবে বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলেন।
ইউএন কনভেনশন অন সার্টেন কনভেনশনাল উইপন্সের (সিসি ডাব্লিউ) জন্য সুপারিশমালায় রোবট অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, রোবটের উন্নয়ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ব্যবহার বন্ধের কথা এসেছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং ব্যবহারকে যুক্তিগ্রাহ্য পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ভবিষ্যত হবে অন্ধকার।
বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলেছিলেন- ‘এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধি চিরকালের সবচেয়ে বড় ভ্রম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগামীর জন্য হবে ভয়াবহ।’ মার্কিন প্রতিষ্ঠান টেসলার সিইও এলোন মাস্ক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মানব অস্তিত্বের পক্ষে সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বর্ণনা করেছেন।
নানা নামে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র
স্বয়ং চিন্তা করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম যন্ত্র হয়েছে এআই এর মাধ্যমে। স্বশাসিত বা স্বচালিত সমরাস্ত্রের বিকাশে কাজ করে রোবটিক্স বা রোবট নির্মাণ প্রযুক্তি। সামরিক অভিযানে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত ড্রোনকেও অনেকে রোবটের আওতায় ধরেন। কিলার রোবটকে সামরিক ভাষায় বলা হয় লিথাল অটোনোমাস উইপোনস (এলএডাব্লিউএস) বা স্বয়ংক্রিয় প্রাণঘাতী অস্ত্র। যেসব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র মানুষ হত্যা করে- সেগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র বলে প্রিডেটর-রিপার, যুক্তরাজ্য বলে তারামাস বা গড অব থান্ডার। লকহিড মার্টিন কোম্পানি ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্রকে বলে দ্য টার্মিনেটর।
যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে- স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড়তে এবং রণতরীতে অবতরণে সক্ষম এক্স ফরটি সেভেন বি, সাড়ে সাতটন ওজনের ট্রাক ও স্বয়ংক্রিয় ডুবোজাহাজ। এ ধরণের অস্ত্র উদ্ভাবনে ব্যাপক গবেষণা করছে- যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, রাশিয়া, চীন, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। অবশ্য কোনো দেশের সরকার বা সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেনি। তথাপি বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় একটি অংশ ইতোমধ্যেই আংশিকভাবে স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে টার্গেট নির্ধারণ ও হামলা চালাতে ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষ ও কম্পিউটারচালিত পদ্ধতির যৌথ ব্যবস্থাপনা।
যেভাবে কাজ করে বুদ্ধিযুক্ত অস্ত্র
এসব অনেক অস্ত্রকে বিবেচনা করা হয় আধা-স্বয়ংক্রিয় হিসেবে, একটি সুইচের ব্যবহারেরই যা ধ্বংসলীলা শুরু করতে পারে। আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে ফ্যালাংস সিস্টেম, স্যামসাং টেকউইনের তৈরি স্যামসাং এসজিআর-এওয়ান, সীমানা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম, ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তারানিস, মার্কিন নৌবাহিনীর এক্স-৪৭বি ইত্যাদি। গোপনে কাজ করতে সক্ষম এমন ড্রোনের নকশা করা হয়েছে। টারানিস নামের এ অস্ত্রটি ব্রিটেনের প্রকৌশল ও বিমান নকশার সর্বোচ্চ অর্জন। নজরদারি, লক্ষ্য নির্ধারণ ও বিমান হামলায় সক্ষম এ রোবট মারণাস্ত্র। টারানিস পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতেও সক্ষম।
‘সেন্ট্রিগার্ড রোবট’ হিসেবে পরিচিত নির্দিষ্ট স্থানে মোতায়েন এসজিআর-১ রোবটটি গ্রেনেড লঞ্চার বা মেশিনগান সজ্জিত। তারা নিখুঁতভাবে মানব শত্রুকে চিহ্নিত ও আঘাত হানতে সক্ষম। নির্দিষ্ট সৈন্য দ্বারা আদেশ পাওয়ার পর এটি এই কাজ করতে পারবে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার সাথে তাদের সীমান্তে এ ধরনের রোবট সৈনিক ব্যবহার করছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা ফার্ম নর্থ্রপ গারমান এক্স৪৭-বি অস্ত্রটির উদ্ভাবন করেছে। মনুষ্যবিহীন এই যুদ্ধবিমানের রয়েছে কোনো যুদ্ধজাহাজে কোনো রকম মানুষের সাহায্য ছাড়াই উড্ডয়ন ও ল্যান্ড করার ক্ষমতা। যদিও এটির পূর্ণাঙ্গ একটি অস্ত্রব্যবস্থা থাকলেও অস্ত্রবিহীনভাবেই নকশা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ এটি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী করা হবে বলে জানা গেছে।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রযুক্তিতে অটোমেটিক টার্গেট রিকগনিশন করে একটি যন্ত্র। সেন্সর বা ক্যামেরা তথ্য পাঠাচ্ছে একটি যন্ত্রে এবং সেখানে তথ্যগুলোর সংকলন এবং বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি মরুভূমির মতো ছিমছাম একটা জায়গায় ট্যাংকের মতো বস্তু অথবা সাগরে একটি জাহাজকে চিহ্নিত করতে পারছে। তবে খুবই জটলাময় পরিবেশে একটি স্কুলবাস বা ট্রাক আর ট্যাংকের পার্থক্য বোঝতে পারছে না, একজন শিশু এবং একজন অস্ত্রধারী সৈন্যের মধ্যে কোনো তফাৎ করতে পারছে না। ফলে অত্যন্ত আতঙ্কজনক এক বিশ্বের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ডেনমার্কের একটি জেলখানায় বাইরে থেকে ড্রোন ব্যবহার করে এক বন্দিকে সেলফোন ও অস্ত্র সরবরাহ করার ঘটনা ঘটেছে। ফলে দূর নিয়ন্ত্রিত বা স্বয়ংচালিত আকাশযান ড্রোন নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিও সামনে এসেছে। অনেক দেশেই ড্রোন লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
উদাহরণ
হারোপ ড্রোন মানুষের দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে ওত পাতার মোক্ষম অস্ত্র। এই ড্রোনের মূল কাজ ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে ঘুরে বেড়ানো। এত উঁচুতে যে নিচে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানরত কারও পক্ষে তাকে দেখা বা তার পাখার শব্দ শোনাও অসম্ভব। দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে এই ড্রোন ওত পেতে থাকে মোক্ষম সুযোগের। কাজ সেরে নিজেই ফিরে যেতে পারে ঘাঁটিতে। করতে পারে সহজ অবতরণ। যদি সে ভুল ঠিকানায় ফেরে, তাতেও সমস্যা নেই সন্দেহজনক বস্তু হিসেবে রাডারের কোপানলে পড়ার আগেই তার সিগন্যাল পড়ে নিয়ে নিজেকে তার মতো করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ‘হারোপ’-এর।
ইসরাইলি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) নির্মাণ করেছে এই ‘হারোপ’ নামের ড্রোন। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই ড্রোন তারা বাজারে বিক্রি করছে। ২০১৬ সালে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাতের সময়ও ‘হারোপ’ ব্যবহৃত হয়েছে। সিরিয়াতেও ‘হারোপ’ তার পূর্ণ সক্ষমতা তথা স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিল। হারোপ একা নয়। এমন অন্তত ৪৯টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এরই মধ্যে বিশ্বের সামরিক বিভাগে যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তাতে আঘাত করার ক্ষমতা রয়েছে কোনো মানুষের সরাসরি নির্দেশ ছাড়াই।
যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদেশগুলোর নৌবাহিনী ‘ফ্যালাংক্স’ নামের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে। এই ব্যবস্থা একবার চালু করে দিলেই এর সামনে অপরিচিত যা আসবে, তাকেই আঘাত করবে। মানুষের পক্ষে মোকাবিলা করা কঠিন এমন দ্রুত ছুটে আসা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জরুরি। একই ধরনের স্বয়ংক্রিয় ‘রোবট গান’ ব্যবহার করা হয় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে। এই প্রযুক্তি এখন আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠছে।
বুদ্ধিযুক্ত সমরাস্ত্র নিয়ে বিতর্ক
যুদ্ধে ঘাতক রোবট ব্যবহারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ঘাতক রোবটের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সামরিক সদস্যরা সম্মুখ সমরের প্রাণহানি বা ক্ষতি এড়াতে পারলেও মানবজাতি হুমকির মুখে পড়বে। কিলার রোবটকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে শত্রু স্থাপনায় ছেড়ে দিলেও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে না। কারণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র কিলার রোবট কোনো শত্রুকে হত্যা করবে কি না নিজেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। লড়াইয়ে বা যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি কিভাবে নিজেই হত্যার মতন সিদ্ধান্ত নেবে বা কিভাবে সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্য চিনবে তা পরিস্কার নয়।
কিলার রোবট ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ বা গণহত্যার মত কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে তার দায়িত্ব কে নেবে? নৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এলএডাব্লিউএস বা স্বয়ংক্রিয় প্রাণঘাতী অস্ত্র রোবটের প্রভাব মোটেই ইতিবাচক হবে না। আমরা জানি- মানুষকে অন্ধ করার ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার অস্ত্র উন্নত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে জাতিসঙ্ঘের অস্ত্রবিষয়ক কনভেশনে। এখন নতুন আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে কিলার রোবটের ব্যবহার নিষিদ্ধ চাওয়াটা তাই মোটেই নতুন ধরণের ঘটনা নয়।
ইউরোপীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এমডিবিএ এমন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র তৈরির গবেষণা করছে, যা কিনা তাকে দেওয়া আদেশগুলো নিজের মতো করে সাজাতে পারবে। এমনকি একাধিক অস্ত্রকে একই আদেশ দেওয়া হলে, তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বয় করে নিতে পারবে। এসব গবেষণার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে, তা হলো নিয়মিত সেনাবাহিনী পোষা বিপুল খরচ। কিন্তু অস্ত্রকে বেতন দিতে হয় না। আর পেনশনের তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
বিপন্ন হবে মানবাধিকার
এধরণের এলএডাব্লিউএস বা কিলার রোবট তৈরি, সামরিক বাহিনীতে সরবরাহ ও তা দিয়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হলে- মানবাধিকার বিপন্ন হবে, জবাবদিহিতা না থাকায় অপব্যবহার বাড়বে, ভবিষ্যৎ অপরাধ রোধের পথ বন্ধ হবে, হামলার শিকার ব্যক্তিরাও পাবে না কোনো ক্ষতিপূরণ, দায়ীদের জন্য সামাজিক নিন্দার পথ রুদ্ধ হবে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশাল প্রভাব ফেলবে।
বিপজ্জনক এলাকায় কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়াই এসব যন্ত্র যেভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ ও হামলা করতে সমর্থ হচ্ছে তাতে তারা হয়তো রিমোট-কন্ট্রোলড ড্রোনকেও পেছনে ফেলবে। এই স্বয়ংক্রীয় যোদ্ধার অপরাধ ও বেআইনি কাজ করার শক্তি রয়েছে কিন্তু সেজন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না। অনেক সময় এমন হতে পারে যে রোবটের কমান্ডার জানেন যে এটি বেআইনি কাজ করবে এবং যদি যোগাযোগব্যবস্থা বিকল হয়ে তাহলে সে এটিকে রুখতে পারবে না।
ফলে রোবট সৈন্য যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করলেও তার কমান্ডারের বিচারকে ফাঁকি দিতে সফটওয়্যারের কিংবা নির্মাণ পদ্ধতির দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাবে। পরিস্থিতি আঁচ করা যায়- যে ডিভাইস ব্যবহার করে রাইফেল দিয়ে প্রতিমিনিটে শতাধিক রাউন্ড গুলি ছুড়তে সক্ষম করে তোলা হয় সেই বাম্প-স্টক ডিভাইসকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক নিষিদ্ধ করা থেকেই।
শুরুর ইতিহাস
ইতোমধ্যে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় ড্রোন হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম মানুষহীন বিমান ড্রোনের মাধ্যমে সন্দেহজনক স্থানগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে শুরু করে এবং সেটা শুরু হয় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে। ড্রোনের জন্য একটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের উন্নয়নে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা।
মার্কিন স্পেস এজেন্সি ভূমি হতে ৪০০-৫০০ ফিট উপরে উড়ন্ত যানবাহনের জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। হাই এরিয়া লিকুইড লেজার এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেম বা হেল্লাডস নামের প্রযুক্তি প্রতিপক্ষের ড্রোন ভূপাতিত করার কাজে ব্যবহৃত হবে। মানুষবাহী ও মানুষহীন এয়ারক্রাফট দিন দিন অত্যাধুনিক হচ্ছে। নিজে নিজে টার্গেট নির্ধারণে সক্ষম এমন মনুষ্যবিহীন ড্রোন ইতোমধ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি স্বচালিত অস্ত্র বা কিলার রোবট এমন সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে যখন- আন্তর্জাতিক সংকটগুলো অবজ্ঞা করে চাঙ্গা হয়ে উঠছে বিশ্ব বিবাদসমূহ। বৈশ্বিক স্বার্থের অনিবার্য সংঘাত বিশ্বকে উপর্যুপরি সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে সামরিক প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত হয়েছেন। যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মোহনায় পতিত পৃথিবী এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ মানবিক সংকটে। ভয়ঙ্কর সমরশক্তি সম্পন্নদের আক্রমণে প্রতিদিন নিরীহ মানুষ মরছে, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল ভেঙে চুরমার হচ্ছে, অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে, শান্তি ও প্রগতি দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
করণীয় কী?
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অধীনে স্বয়ংক্রিয় বোম্বার ড্রোন বা খুনে ড্রোন তৈরির প্রজেক্টে কাজ করা গুগলের উচ্চপদস্থ সাবেক ইঞ্জিনিয়ার লরা নোলান বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র বা খুনে রোবট তৈরির বিরোধিতা করে আসছেন। তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘নতুন প্রজন্মের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলি বা ‘খুনি রোবট’ ভুলক্রমে যুদ্ধ কিংবা গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয় খুনে রোবটগুলিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে কেমিক্যাল ওয়াপনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই রকম চুক্তির মাধ্যমে, মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এমন সব খুনে রোবটের ব্যবহারও বেআইনি ঘোষণা করতে হবে। ড্রোনগুলিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু স্বয়ংক্রিয় খুনে রোবটগুলো এমন ধ্বংসলীলা শুরু করতে পারে, যা করার জন্যে তা তৈরি করা হয়নি। একটি অঞ্চলে কতগুলি খুনে রোবট মোতায়েন করা হবে, তার উপর হতাহতের পরিমাণ নির্ভর করবে।’
শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা
যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো সৈনিক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে তার রোবট সেনাকে নির্দেশ দিয়ে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটায় তাহলে তার দায়ভার সেই সৈনিককেই বহন করতে হবে। কিন্তু কোনো মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই কোনো রোবট সৈনিক যদি একাকী একই কাজ করে তাহলে তার দায়িত্ব সে নেবে না। এ কারণে এ জন্য কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা সম্ভব হবে না। ফলে এসব নতুন ধরণের বিপদ এড়াতে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ চায়- অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বন্ধ হোক, দ্রুততার সাথে সম্পূর্ণভাবে সশস্ত্র স্বয়ংক্রীয় যোদ্ধা (রোবট সৈন্য) নির্মাণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হোক।
লেখক আনিসুর রহমান এরশাদ, গবেষক ও সাংবাদিক