ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট মিজানুর রহমান কিরণ। ব্যতিক্রমী এক লড়াকু। তার এ লড়াই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে। প্রথাগত সামাজিক বিশ্বাস আর গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। এ লড়াই সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ে। বিশ্বাস করেন মানবতাই মুক্তির পথ। তিনি কানেক্টিং ডটস ইন্টারন্যাশনাল- সিডিআই এর প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। এশিয়া-ইউরোপ ফাউন্ডেশন-এসেফ এর এলামনাই। এটলাম ক্রপস এর সাবেক ফেলো। পিএইচডি করছেন ইউনিভার্সিটি অফ ইলিয়ন্স সিকাগো।
২০১৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের তরুণ সামাজিক উদ্যোক্তাদের তালিকায় জায়গা করে নেন মিজানুর রহমান কিরণ। ‘থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া ২০১৭: দ্য সোস্যাল এন্টারপ্রেনারস মেকিং অ্যা বিগ ডিফারেন্স’ শিরোনামে প্রকাশিত তালিকায় স্থান করে নেয়াটা দেশের জন্যও ছিল সম্মানের। সম্প্রতি প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নদর্শী চৌকস এই তরুণের সাথে মাসিক এডুকেয়ারের নির্বাহী সম্পাদক আনিসুর রহমান এরশাদের আলাপচারিতার কিছু অংশ পাঠকদের জন্যে প্রকাশ করা হলো।
আনিসুর রহমান এরশাদ: আপনার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
মিজানুর রহমান কিরণ : ১৯৮৭ সালের ১৬ই জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার আগুরিয়া গ্রামে আমার জন্ম। গ্রামের নাম হরিনাথপুর- বড়বাড়ি। ৬ বছর বয়সে চলে আসি নওগাঁতে। বেড়ে ওঠা নওগাঁতেই। ভর্তি হিই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যমুনা পাড়ে চর এলাকার শিশুরা সাধারণত একজন তাঁত শ্রমিক হওয়ারই স্বপ্ন দেখে। আমিও তাদেরই একজন। কিন্তু আমার স্বপ্নটা ছিল ভিন্ন। সেই স্বপ্নই আমাকে আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছি। স্কুলের এক সহপাঠী বেতন দিতে না পারায় শিক্ষক তাকে প্রহার করেন। এর ফলে ছেলেটি স্কুলে আসাই বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি খুব গভীরভাবে নাড়া দেয় স্কুলপড়ুয়া আমাকে। তখনই সে স্কুলে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করি গরিব ছাত্রদের কল্যাণমূলক একটি সংগঠন ‘ছাত্রছায়া’। এই ছাত্রছায়ায় স্কুলের ছাত্ররা টাকা জমা করত। যখন কোনো গরিব পরিবারের ছাত্র বেতন পরিশোধ করতে পারত না তখন তাকে এই ছাত্রছায়ার ফান্ড থেকে তার বেতন পরিশোধ করা হতো। এভাবে স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
২০০৬ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে ভর্তির সুযোগ পাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সেখান থেকেই স্নাতক সম্পন্ন করি। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান সামাজিক ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সব সময় জড়িত ছিলাম। ২০০৮ সালে সাভারের সিআরপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ভেলরি এ টেইলর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। ওই সেমিনারে ১৬ জন উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদের মধ্যে একজন। সেই সেমিনারেই প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করার চিন্তার বীজ বপণ হয়।
আনিসুর: ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন সম্পর্কে জানতে চাই।
কিরণ: ভেলোরি টেলরের কথায় উৎসাহিত হয়ে প্রথমে ২০০৮ সালের ৬ই জুলাই আমি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু করি। ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন- পিডিএফ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করি। এটি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কার্যক্রম শুরু করে। সংগঠনের ভলান্টিয়াররাই আমাদের সংগঠনের প্রাণ। তাদের আমরা কোনো প্রকার টাকা পয়সা দিচ্ছি না। ওরা নিজেরা খরচ করে এই সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিবন্ধীর কল্যাণার্থে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
দেশের প্রতিবন্ধী তরুণদের কল্যাণে কাজ করছে পিডিএফ। আগে প্রতিবন্ধীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। এ সমস্যাটি অনুধাবন করতে পেরে এই নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে একটি রিট করে পিডিএফ এর ঢাবি শাখার প্রেসিডেন্ট স্বপন চৌকিদার। শুনানি শেষে মহামান্য হাইকোর্ট স্বপনের পক্ষে রায় দেন। এরপর থেকে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীরাও অংশগ্রহণ করে। পিডিএফের পুরো টিম শপনের সাফল্য আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আসলে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। এর জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পিডিএফ’র জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম রয়েছে। কারণ এখনও আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীদেরকে সমাজের বোঝা হিসেবে দেখা হয়, অনেক সমাজে প্রতিবন্ধীতাকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, প্রতিবন্ধীদের সমাজের বাইরের একজন মানুষ হিসেবে কল্পনা করা হয়। প্রতিবন্ধীদেরকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এসবের সবচেয়ে বড় কারণ হল মানুষের মধ্যে গণসচেতনতার অভাব। পিডিএফ প্রতিবন্ধীদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে রক্ষা করে তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির মাধ্যমে সমাজে একটি গণ জোয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলোরি টেইলর আমার আদর্শ। তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় জাবির এক সেমিনারে। ইতিহাস বিভাগে বরকত নামে এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ভর্তি হয়। সে বিকেএসপিতে অ্যাথলেট ছিল। প্র্যাকটিসের সময় মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি ডিপার্টমেন্টের সিআর ছিলাম। এ কারণে বিভিন্ন সময় বরকত আমার কাছে আসত। এবাবে আমার সঙ্গে ওর একটা সখ্য গড়ে ওঠে। সেই প্রথম ভেলোরি টেইলরের নাম আমাকে বলে বরকত। পরবর্তীতে ভেলোরির সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে চাই আমি। সিআরপিতে চলে যাই। ভেলোরি টেইলর আমাকে খুবই এপ্রিসিয়েট করেন।
সিআরপির ভ্যালোরি টেইলর আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিচ্ছি। কিন্তু গণসচেতনতা তৈরি করতে পারছি না।’ এই কথায় উৎসাহিত হয়ে প্রথমে আমি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করি, পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়কেও সম্পৃক্ত করি।
আনিসুর: সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী কাজে আপনার অনুপ্রেরণা কে?
কিরণ: আমি খুব ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কাজে সক্রিয় ছিলাম। আমার অনুপ্রেরণা ছিল আমার মা। আমার শৈশবে এলাকায় খুব বন্যা হতো। আম্মাকে দেখতাম বন্যার সময় অসহায় মানুষের পাশে এগিয়ে যেতে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে। আম্মার কাছ থেকেই আমার ভিতর এই বিষয়গুলো আসে।
আনিসুর: আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
কিরণ: প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন ও শিক্ষা নেয়ার জন্য ২০১৩ সালে যোগ দেই ব্র্যাক-এ। ২০১৫ সালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটস এর আমন্ত্রণে এটলাসকোর ফেলো হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যাই। উদ্দেশ্য ছিল- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে তাদের প্রক্রিয়াটা আয়ত্ত করা। এ সময় আমার সুযোগ হয় বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামি প্রতিষ্ঠানে দেশের কথা তুলে ধরার। পরে প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসে স্থান করে নিই। এশিয়ার সেরা ৩০ জন সামাজিক উদ্যোক্তার একজন হই। এসবের ফলে পিডিএফের কথা মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় ও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আনিসুর: আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
কিরণ: আমি বিশ্বাস করি- লড়াইয়ে জিততে হলে পরিবর্তনটা নিজের মধ্যেই আনতে হবে। তাইতো ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সুরাইয়া আকতার বাবলীকে আমি বিয়ে করি। সেই বিয়েতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল আমার।
মায়ের চোখে-মুখে শত প্রশ্ন। একটা অন্ধ মেয়ে, বাবার কোনো সম্পদ নেই, ভবিষ্যত নাতিপুতি অন্ধ হবার সম্ভাবনা, সংসারের কাজ কীভাবে করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার কথা শুনে বাবলীও প্রায় দ্বিমতের পথে। পুরো বাসায় পিনপতন নীরবতা। কিন্তু শেষমেশ সব বাধা ডিঙাতে পেরেছি।
আনিসুর: আপনি ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে এখনো প্রতিবন্ধী বন্ধু হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিবন্ধীতা নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই।
কিরণ: প্রতিবন্ধী মানুষ বিশ্ববৈচিত্র্যের একটি ভিন্ন রূপমাত্র। তাদের আলাদা কিংবা অবহেলার চোখে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আমাদের পরিবারেরই সদস্য, আমাদের ভাই-বোন, over all a they are a human being।, they deserve the same rights and dignity those all deserve.
শুধু আমাদের সমাজে নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার রয়েছে। প্রথাগত সামাজিক বিশ্বাস আর গোঁড়ামির মানসিকতা থেকেই এর সূচনা। এই নেতিবাচক ধারণাগুলো তাদের অধিকার আদায় এবং নিজের যোগ্যতা প্রমাণের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের মেধা ও মননশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার দৃশ্যমান শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করলেও অনেক সময় সমাজ এবং তথাকথিত আইনের সীমাবদ্ধতা তার প্রতিভা বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পিডিএফের মধ্য দিয়ে আমরা এমন একটি প্ল্যাটফরম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি, যেখানে তরুণ প্রজন্ম শিখবে, কীভাবে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সামর্থ্যের দৃশ্যমান সীমিত সীমাবদ্ধ তাকে বিবেচনায় রেখে তাদের সার্বিক সামর্থ্য মূল্যায়ন করতে হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনে চলার পথে মূল প্রেরণার উৎস তাদের পরিবার। এখন সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। এর জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
খুব কম সংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে, নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরি করতে পারে। কারণ, সমাজের তথাকথিত কিছু মানুষ প্রতিবন্ধী মানুষকে সব সময় বলতে থাকে, কি হবে তোকে দিয়ে! এমন হতাশাব্যঞ্জক কথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে দেয়।
অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করতে গিয়ে তাকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বলেন, আমরা পরিবর্তন করতে চাচ্ছি আমাদের প্রজন্মকে, যারা ভবিষ্যতে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যাবে। একটি প্রজন্মের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আর বেশি অ্যাডভোকেসি করতে হবে না ।
আনিসুর: প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজের প্রতি ভালোবাসা অনেককেই অনুপ্রেরণা যোগায়। অনেকের কাছেই আপনি হিরো। তরুণও নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু বলুন।
কিরণ: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ছিল। তাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে যেটা মনে হয়েছে, শুধু স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করলে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না, তাদের জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করার ইচ্ছে থেকেই কাজের শুরুটা হয়। প্রথম কথা হচ্ছে, মানসিকভাবে সে যে ধরনের কাজে আগ্রহী, কাজের প্রতি যেখানে তার ভেতর থেকে আগ্রহ আছে কি-না সেটা দেখতে হবে।
এমন যেন না হয়, কোনোরকম পরিস্থিতির বাধ্য হয়ে করছে বা তাকে কেউ চাপ দিয়ে করাচ্ছে বা ক্যারিয়ারের জন্য করছে। তাহলে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হওয়া যাবে না। কাজের প্রতি শতভাগ ভালোবাসা থাকতে হবে। সফল উদ্যোক্তার প্রধান গুণ হচ্ছে, কাজের প্রতি শতভাগ ভালোবাসা থাকতে হবে। যেকোনো কাজে লেগে থাকতে হবে, কখনো হতাশ হওয়া যাবে না। যেকোনো বিষয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেই যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আমি যখন এ ধরনের কাজ শুরু করি, তখন অধিকাংশ মানুষ বলত যে, কেন আমি এসব কাজ করি?
উদ্যোক্তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সমালোচনাকে গাঁয়ে না নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। আর এটা নতুনদের ভেতরে হবেই। আমি যে কাজটা করছি, সেই কাজটা সম্পর্কে আগে থেকে জ্ঞান ছিল কি না? এটা নতুনদের জন্য একটা সমস্যা। এ ধরনের কাজের জন্য পড়াশোনা করা দরকার। অথবা যারা এ ধরনের কাজ করেছে তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়াটা জরুরি। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ যে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকলে এ সমস্যাকে ওভারকাম করা যায় না। পড়াশোনা করতে হবে অথবা এই সম্পর্কে জানতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, নতুনদের অনেকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে পারে না। ক্যারিয়ারের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে না। আমার যেটা মনে হয়, উদ্যোক্তাদের জন্য যেটির বড় ঘাটতি আছে, সেটা হলো মানসিকতা। সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তারা খুব কমই এগিয়ে আসে। নতুন যারা করতে চায়, তাদের মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়া খুব দরকার। নতুনদের মধ্যে অনেকে আছে, যারা খুব কাজে আগ্রহী, পরিশ্রমী কিন্তু তারা বোঝে না কাজটা কিভাবে করতে হবে। যারা সফল হয়েছে তারা যদি নতুনদের মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়, অ্যাডভান্স করে দেয়, তাহলে তারা উৎসাহ-উদ্দীপনা পাবে। যারা প্রতিষ্ঠিত এবং যারা নতুন উদ্যোক্তা আছে তাদের মধ্যে যে গ্যাপ তা দূর করা দরকার।
আনিসুর: প্রতিবন্ধীদের সমস্যার সমাধান ও সম্ভাবনার বিকাশ কিভাবে সম্ভব?
কিরণ: জাতিসংঘের তথ্য মতে বাংলাদেশের ১৫% মানুষ প্রতিবন্ধীর শিকার। এদের সংখ্যা এইডস, যক্ষা অথবা বসন্ত রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যার চেয়ে বহুগুনে বেশী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবন্ধীতা বিষয়ক গৃহিত কর্মসূচি সেগুলোর তুলনায় অতিশয় নগন্য। যেমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা, শ্রেণীভিত্তিক সংখ্যা, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের পরিমান, কর্মক্ষম বা দক্ষ জনশক্তির পরিমাণ, অথবা তাদের সমস্যা-সম্ভবনার বিষয়গুলো নিয়ে গ্রহণ করা বিভিন্ন প্রকল্প-উদ্যোগ আশানুরূপ নয়।
দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে চাইলে প্রতিবন্ধী মানুষকে বাদ রেখে তা কখনই সম্ভব নয়। আর্থ-সামাজিক মূল ধারায় তাদের ফিরে আনতে সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যম সহ সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অধিকার বাস্তবায়নে বৈষম্য নিরসনে ব্যাপক গণভিত্তি সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবী, অন্যথায় একটি সমৃদ্ধ ও সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা অলীক বস্তু হয়েই থাকবে অনন্তকালব্যাপী।
আনিসুর: মাসিক এডুকেয়ারের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কী?
কিরণ: যেকোনো ভালো কাজই হচ্ছে সমাজের জন্য একটা কনট্রিবিউশন। প্রত্যেকটা মানুষের উচিৎ এ ধরনের মানসিকতাকে লালন করা। যারা নতুন, যারা কাজ করতে চায় তারা যদি কাজটার সঙ্গে ভালোবাসাকে সম্পৃক্ত করতে পারে তাহলে তারা অনেক বড় কিছু পাবে। আমাদের সমাজে এই মুহূর্তে অনেক ভালো ভালো উদ্যোগের দরকার। কারণ, সমাজে এখন অনেক সংকট দেখা দিচ্ছে।
পাঠকদের প্রতি এটাই বলবো, কাজের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসাটা সময়ের দাবি। সবগুলো ছোট মানুষ মিলিয়ে, সবগুলো ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট উদ্যোগ মিলিয়ে বড় কিছু হবে। প্রতিবন্ধী মানুষ বিশ্ববৈচিত্র্যের একটি ভিন্ন রূপমাত্র। তাদের আলাদা কিংবা অবহেলার চোখে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
7bkld4
Your comment is awaiting moderation.