তরুণ কবি, ছড়াকার ও গল্পকার সুলতান মাহমুদ। সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। পেশায় ব্যাংকার হলেও লিখেন কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প ও গান। পড়াশুনা করেছেন টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। ভালোবাসা দিতে চান, ভালোবাসা পেতে চান। খারাপের সাথে সঙ্গ সচেতনভাবে এড়িয়ে যান। বইপড়া ও লেখালেখিতেই তার আনন্দ। প্রথম ছড়াগ্রন্থ অদম্য আবেগে অবগাহন এবং ২য় বই শিশুতোষ ছড়ার বই সাহস থাকলেই জয় ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। ৩য় বই ‘সাপের বাসায় ইঁদুর ছানা’ হচ্ছে শিশুদের শিক্ষামূলক গল্পের বই। জন্ম ৮ মার্চ ১৯৮৫ সালে, টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের তক্তারচালা গ্রামে। বর্তমানে স্ত্রী জেসমিন মাহমুদকে নিয়ে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীতে বসবাস করছেন। এই তরুণ কবির মুখোমুখি হয়েছিল পরিবার ডটনেটের সম্পাদক আনিসুর রহমান এরশাদ।
মাসিক এডুকেয়ার: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুলতান মাহমুদ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এ আমার নিজের কিছু কথা তুলে ধরার সুযোগদানের জন্য।
আসলে আমার শৈশব এবং বেড়ে ওঠা সবুজ পাতায় আচ্ছাদিত, পাখ-পাখালির কোলাহলে মুখরিত, অতি স্বচ্ছ জল ও বিশুদ্ধ বায়ুর অপরূপ সমন্বয়ের সহজ সরল গ্রামীণ আবহের এক সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে। আমার বেড়ে ওঠার সময় মানে আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে আমাদের গ্রামের পরিবেশ বেশ পরিপাটি এবং মনোরম ছিল। যদিও তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুতের আলো ছিল না, তবু মানুষের মাঝে মানবিক আলো জ্বলতো উজ্জল শিখার মতন।
আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা-মায়ের সাথে পারিবারিক কাজে সাহায্য করে নিজের পড়ালেখা গুছিয়ে তারপর স্কুলে যেতাম। পাড়ার সব ছেলে মেয়ে দল বেধে স্কুলে যেতাম। স্কুলে যেতে যেতে গ্রামের পথের ধুলো উড়ানো আর দুষ্টুমি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। স্কুল থেকে ফিরেই যে যার মতন খেলার মাঠে ছুটে যেতাম। সন্ধ্যা হলে নিজেই হারিকেনের চিমনি মুছে আলো ধরিয়ে পড়তে বসতাম। কাজের দিনে বাবা-মায়ের কাজে যে যার মতো সাহায্য করতাম।
মাসিক এডুকেয়ার: আগের প্রজন্ম ও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কেমন পার্থক্য লক্ষ্য করছেন?
সুলতান মাহমুদ: আগের প্রজন্ম আর বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বিভিন্ন দিক হতে অনেক পার্থক্য দৃশ্যমান। আগে আমরা বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন রকমের মজার মজার খেলায় সময় কাটাতাম। বন্ধু-বান্ধব মিলে গল্প, আড্ডায়, গানের আসরে, বিভিন্ন সামাজিক,পারিবারিক উৎসবে মজা করে দিনাতিপাত করেছি।
বিশ্বায়নের যুগে বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল প্রীতিতে অতিমাত্রায় আসক্ত। ফলে তথ্য-প্রযুক্তির সুফলকে কুফলে রুপান্তরিত করছে। বেশিরভাগ সময় মোবাইল গেমস খেলছে, বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগ করছে আর মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে। সহজ প্রাপ্য বিভিন্ন নেশার দ্রব্যে পারিবারিক সম্প্রীতি ও বন্ধনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। আগের মতো বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার ব্যাপারটা কেমন যেন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে।
মাসিক এডুকেয়ার: সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় প্রাধান্য দেয়া উচিত?
সুলতান মাহমুদ: সন্তান লালন-পালন করা বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তান কার সাথে মিশে, কেমন আচরন করে, কিভাবে কথা বলে, কোন জিনিসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট, পড়ালেখার মান কেমন, স্কুলে তার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ব্যবহার কেমন, কোন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে,খেলাধুলায় মনোযোগ কেমন ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রেখে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। মোট কথা সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
মাসিক এডুকেয়ার: সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কি ভূমিকা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সুলতান মাহমুদ: সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। পরিবার থেকেই একটি সন্তান তার আচার ব্যবহার শিখে থাকে। তাই পারিবারিকভাবে ভালো পরিবেশে বেড়ে ওঠা যেকোনো সন্তানের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
মাসিক এডুকেয়ার: আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব পরিবার ব্যবস্থার উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলছে?
সুলতান মাহমুদ: আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি পরিবার ব্যবস্থার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মোবাইল ও কম্পিউটারে ইন্টারনেটের নেতিবাচক ব্যবহারের প্রভাবে পারিবারিক বন্ধনে অনেকাংশে শৈথিল্যতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে সহজেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে নানা অপসংস্কৃতি। যার ফলে মানুষের মাঝে অস্থিরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, কলহের মতো নানান ধরনের সামাজিক ব্যধি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সমাজে মারাত্মকভাবে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়েছে অপসংস্কৃতির ফলে । যার ফল ভোগ করছে ছোট্ট ছোট্ট শিশু কিশোরসহ পরিবারের সবাই।
মাসিক এডুকেয়ার: আপনি কি মনে করেন বর্তমান পারিবারিক অবক্ষয় চলছে? উত্তরনের উপায় কি বা কিভাবে উত্তরন সম্ভব?
সুলতান মাহমুদ: অবশ্যই,বর্তমানে পারিবারিক অবক্ষয় চলছে। পারিবারিক অবক্ষয় হতে সহজে উত্তরনের কোনো পথ নেই । তবে কিছু কিছু কাজ করলে হয়তো অনেকেরে চেয়ে ভালো থাকা যাবে। যেমন-পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে, পরিবারের সবার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে, পরিবারের সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে হবে, পরিবারের সদস্যদের জন্যে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন-গান, গল্প, কবিতা, সুন্দর সিনেমা, নাটক ইত্যাদি পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করতে হবে।
ইন্টারনেট তথা মোবাইলের উপর অতিরিক্ত আসক্তি প্রত্যাহার করতে হবে। কুরুচিপূর্ণ,পারিবারিক বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো নাটক, সিনেমা, গল্প ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। পরিবার এবং বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন বিনোদন পার্কসহ দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করতে হবে । সুযোগ থাকলে মাঝে মধ্যে পরিবার নিয়ে বাইরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।
মাসিক এডুকেয়ার: একটি সুখী পরিবার তৈরিতে কোন বিষয়গুলো জরুরি, আপনার নিজের পরিবারের আলোকে বলুন।
সুলতান মাহমুদ: একটি সুখী পরিবার তৈরিতে জরুরী বিষয় হচ্ছে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত করা এবং সম্পর্কটাকে যথাযথ সম্মান বা যত্ন করা। আমার পরিবারের আলোকে বলতি পারি-পরস্পরের মধ্যে সহমর্মিতা থাকতে হবে। বাচ্চাদের সময় দিতে হবে, তাদের মজার মজার শিক্ষনীয় গল্প শুনাতে হবে, তাদের পড়ালেখার খোঁজখবর নিতে হবে এবং বিভিন্ন উৎসব পার্বনে পবিবারকে সময় দিতে হবে । সর্বোপরি ছাড় দেওয়ার মন-মানসিকতা থাকতে হবে।
মাসিক এডুকেয়ার: মাসিক এডুকেয়ারের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন…
সুলতান মাহমুদ: মাসিক এডুকেয়ারের পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো-আপনারা পরিবারকে যথাযথ সময় দিন, পরস্পরকে সম্মান করুন, পরিবারের সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন এবং পারিবারিক বিষয়ে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা বজায় রাখুন। সবাই ভালো থাকবেন। পরিবার ডটনেটের প্রিয় সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি রইলো অসংখ্য শুভকামনা এবং আন্তরিক ধন্যবাদ।