মো. ফজলুল হক বাচ্চু
‘রিকশা’ শব্দটি এসেছে জাপানি ‘জিন্রিকিশা’ শব্দ থেকে। যেখানে জিন্ অর্থ মানুষ, রিকি অর্থ শক্তি এবং শা অর্থ বাহন। শব্দগুলোকে যোগ করলে রিকশার আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় মানুষের শক্তিতে চলা বাহন বা মানুষ চালিত বাহন। শুরুর দিকে কোন রিকশাই তিন চাকার ছিল না। সেগুলো মূলত দুই চাকায় ভর করে চলতো এবং সামনে ছিল লম্বা হাতল। এই হাতল ধরে একজন মানুষ ঠেলাগাড়ির মতো হেঁটে বা দৌড়ে এই রিকশা টেনে নিতেন। সে সময় ‘রিকশা’ বলতে এ ধরনের হাতে টানা রিকশাকেই বোঝানো হতো। পরে দুই চাকার রিকশার ডিজাইন তিন চাকার রিকশায় বিকশিত হয়। বাংলাদেশের পঞ্চম অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে ‘ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র’ ইউনেস্কোর স্বীকৃতিও লাভ করেছে।
১৮৬৯ সালের দিকে জাপানে কাহার-টানা পালকির বিকল্প হিসেবে এই হাতে টানা রিকশার উদ্ভব হয়। শুরুর দিকে কেবল ভারী মালপত্র বহনের জন্য রিকশা ব্যবহৃত হতো, যা ১৮৭০ সালের পর মানুষের চলাফেরার জনপ্রিয় বাহন হয়ে ওঠে। এসব রিকশা চীন (১৮৭৩) , হংকং (১৮৭৪), সিঙ্গাপুরে (১৮৮০), ছড়িয়ে পড়ে। পরে রিকশা জাপান থেকে ভারত, চীন, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪১ সালেও ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৭টি। ঢাকাতে প্রথম রিকশার লাইসেন্স দেয়া ১৯৪৪ সালের দিকে। ১৯৪৭ সালে সেটি বেড়ে ১৮১টিতে দাঁড়ায়। ১৯৯৮ সালে ঢাকাতে নিবন্ধভুক্ত রিকশার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১২৫৭২, অন্যান্য সব জেলায় রিকশার সংখ্যা ২৭৪২৬৫ এবং গ্রামাঞ্চলে এর মোট সংখ্যা ছিল ৯১,০৪০টি। এরপর ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়তেই থাকে। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০১৪ সালের ২২শে নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকাকে রিকশার নগরী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
পায়ে চালিত রিকশা অমানবিক, এটি বন্ধ করতে হবে। রিকশা সমাজকে পিছন দিকে ঘুরায়, তাই রিক্সাকে নিষিদ্ধ করতে হবে। রিকশাওয়ালার সামাজিক সম্মান নেই; এই অভিজ্ঞতার আলাদা মূল্য নেই। একজন ৩০-৪০ বছর যতদিন গায়ে জোর আছে, ততদিন রিকশা চালায়। রিকশাচালানোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে ভিন্ন কিছু করারও সুযোগ নেই, অভিজ্ঞতাটা কোথাও কাজে লাগে না, কোথাও মূল্যায়ন হয় না। এটা আসলে কোনো পজিটিভ ওয়ার্ক না। একজন ভালো-সুস্থ মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে অমানবিকতা আর হয় না। পুরোপুরি কায়িক পরিশ্রম ভিত্তিক কাজে একজন রিকশাচালককে সর্বনিম্ন ৬ ঘণ্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৬ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। অনেক রিকশাচলকও রিকশায় প্যাডেল দেয়াটাকে অমানবিক ও অসম্মানজনক মনে করেন। অবশ্য গত কয়েক বছরে ঢাকার অধিকাংশ রিকশাই ব্যাটারিচালিত হয়ে যাবার ফলে এখন প্যাডেলচালিত রিকশার সংখ্যা খুবই কম।
একটি ভারী রিকশা প্যাডেল করে চালানোর ফলে চালকদের শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে যা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার জন্ম দেয়। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার রাইটস বা বিলস এর জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার ৯৪% রিকশা চালকই অসুস্থ থাকেন। বিশেষ করে জ্বর-কাশি, ঠাণ্ডা, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা লেগেই থাকে। সেইসঙ্গে ৩০ শতাংশ জন্ডিসে আক্রান্ত। রিকশা চালকরা সুপেয় পানি, পুষ্টিকর খাবার ও টয়েলেটের তীব্র সংকটে ভোগেন। অনেকে বেশিরভাগ সময় ড্রেনে বা গাছপালার আড়ালে টয়লেটের কাজ সারেন। বেশিরভাগ রিকশাওয়ালা তাদের দিনের খাওয়া সারেন বিভিন্ন টংয়ের দোকানে রুটি, কেক ও চা খেয়ে। যেন তারা ভাত খাওয়ার পয়সা সাশ্রয় করতে পারেন। সব মিলিয়ে এই রিকশা চালকরা বড় ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। অনেক শ্রমিকের গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা থেকে শুরু করে তাদের কাজ করার ক্ষমতা আগের চাইতে কমে যায়। বেশিরভাগ শ্রমিক দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে পারে না।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলস এর হিসাবে ২০১৯ সালে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ১১ লাখের মতো। দিনে একটি রিকশা দুই শিফটে চলে। এর চালকের সংখ্যা সেই হিসেবে আনুমানিক ২২ লাখের মতো। জ্যামের সংস্কৃতির জন্য সবচেয়ে সহায়ক রিক্সা। রাস্তায় যানজট বাড়ে, পায়ে হাটার আগ্রহও কমে; যারা পায়ে হেটে পথ চলতে চায় তাদেরও অসুবিধা হয়; না হেটে রোগ-ব্যাধি বাড়ে। জীবন-যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। রিকশাচালকের এই কাজে সমাজে খুব একটা উপকারে আসে না। বাংলাদেশে ধরো নামে-বেনামে বৈধ-অবৈধ মিলে ১ কোটি রিকশাওয়ালা আছে। এই রিকশাওয়ালাদের যেই পুঁজিটা বিনিয়োগ হচ্ছে, কত হাজার লক্ষ কোটি টাকা। যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হলে রিকশা বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। তবে তখন তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
যে পরিমাণ শ্রমিক রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তারা যদি কৃষি বা শিল্পে কাজ করতো তবে দেশের উৎপাদন ও উন্নতি ত্বরান্বিত হতো। দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারতো। প্রশ্ন ওঠতে পারে- তাহলে রিক্সার বিকল্প কী? রিক্সা নিষিদ্ধ হলে এই বাহনটির ওপর নির্ভরশীল একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর কী হবে? ৮/১২/১৫/২০/২৫ সিটের গাড়ি দিয়ে মোটামোটি সবল ও বুদ্ধিসম্পন্নদেরকে কাজে লাগানো যায়। হতে পারে ১টি গাড়ি ২ জনে শিফটিং করে চালাবে। রেগুলেটরির মাধ্যমে এগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। বাকি রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে কিংবা কৃষি ও শিল্পে নিয়োজিত করে এভাবে পুনর্বাসিত করার পদক্ষেপ নিলে তাদের সামাজিক মানসম্মান বাড়বে।
সাধারণত একজনকে রিকশা নামাতে যে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করা লাগতো, তা এককালিন বা জামানত হিসেবে নিয়ে নিতে হবে। বাকি টাকাটা ১০-১৫ বছরে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিলে লোকটার সম্মানজনক কাজ জুটলো, সে গাড়ির ড্রাইভার হলো, এই ড্রাইভিংয়ের অভিজ্ঞতার মূল্য আছে। তাহলে জ্যামও কমে যাবে। যেখানে অল্পগতির এই যানে ১ জন যেতো সেখানে দ্রুতগতির যানে যাবে কমপক্ষে ৮/১০ জন। লোকটার বেকারত্বও ঘুচলো। রাজধানীতে চলাচলের জন্য গণ পরিবহন হিসেবে রিক্সার উপর নির্ভরশীল প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের সময়ও বাঁচলো। এক্ষেত্রে সরকার বিনিয়োগ করলে ১০/১৫ বছরের মধ্যে রিকশা বন্ধ করা সম্ভব।
নিষেধ সত্ত্বেও মূল সড়কে অসংখ্য রিকশা চলে দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি হয়। অলিগলিতেও সারা দিন থেমে থেমে যানজট লেগেই থাকে। যেসব সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ সেখানেও সড়কের দুপাশেই অবাধে রিকশা চলে। রিকশাজট ও অতিরিক্ত রিক্সার চাপের সমস্যার মাঝে এখন মরার উপর খারার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা। যানজটের অন্যতম কারণ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের অবাধ চলাচল। ফলে যানজটের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। শহরের ব্যস্ত সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত ও পা চালিত রিক্সা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। এমনিতেও বিকল্প পেলে পায়ে চালিত রিকশায় কেউ উঠতে চায় না।
অনেক সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণও ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইক। ইঞ্জিনচালিত যানবাহন হঠাৎ থামিয়ে দেয়ায় মারাত্মক অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, কোটি কোটি কর্মঘন্টা নষ্ট হয়, মূল্যবান জ¦ালানির অপচয় হয়, পরিবেম দূষণ হয়। রাজধানী ঢাকা শহরে ফিডার রোডে তথা মূল সড়ক নয় এমন রাস্তায় এই তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা চালুর কথা থাকলেও এরা ঠিকই মূল সড়কে ওঠে যাচ্ছে। কাঠামোগত কারণেই সড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব রিকশা অনিরাপদ অবস্থায় চলাচল করে। তবে পায়ের রিকশার তুলনায় এসব বাহনে ভাড়ার ক্ষেত্রে আর্থিক সাশ্রয় এবং সময়ও বাঁচার কারণে যাত্রীরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গণপরিবহনসেবা না থাকায় অবৈধ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধে কাজ করছে না।
বিকল্প তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অটোরিকশা যদি মহাসড়ক এবং মূল সড়কে না ওঠে ছোট রাস্তা এবং অলি-গলির ভেতরে চলাচল করে; যদি তারা বেপরোয়া গতিতে না চালায় তাতে দুর্ঘটনার কোনও শঙ্কা তৈরি হয় না। বরং একদিকে মানুষের যাতায়াত সহজ হবে, সময় বাঁচবে এবং অন্যদিকে অনেক লোকের কর্মসংস্থানও হবে। অবশ্য বিকল্প ঠিক না করে কোনোভাবেই অটোরিকশা বন্ধ করে রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি করা যাবে না।
রিকশার কারণে শহরের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। সড়কে ধীর গতির যানবাহন চলাচল করলে শহরের গতি বাধাগ্রস্ত হয়। রিকশার জন্য কোনো গাড়ি নির্দিষ্ট গতিতে চলতে পারে না। রিকশা একটা লেনে চলে না। রাজধানী শহরে মানব-চালিত রিকশা, যেটা পৃথিবীর কোনো রাজধানী শহরে নেই, সেটা থেকে একটা না একটা সময়ে বের হয়ে আসতেই হবে। ঢাকায় ৯০-এর দশক পর্যন্ত সকল সড়কে রিকশা চলতো। শুরুতে ভিআইপি রোড তারপর মিরপুর রোড থেকেও রিকশা তুলে দেয়া হয়।
কাঠামোগতভাবে পায়ে চালিত রিকশাগুলোতে মোটর লাগানোর সক্ষমতা একেবারেই নাই। কারণ মোটর লাগানোর ফলে যে গতিতে এগুলো চলে কাঠামোগতভাবে এটা সমর্থন করে না। যেসব বাহনের দুর্বলতা নিরসন করে পরিবর্তন করে নিরাপদভাবে চলার উপযোগী করা হয়নি সেসবে বিনাবাধায় চলা মানেই দুর্ঘটনার আশংকা। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে মানব-চালিত মানববাহী এই বাহন রিকশার ব্যবহার উঠে গেছে। বাংলাদেশেও এর বহুল প্রচলন বর্তমান সময়ে আর কাম্য নয়। ঢাকা রিকশার নগরী হওয়ার মধ্যেও আর কোনো কল্যাণ নেই।