মার খাচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা: চাই উদ্যোগবান্ধব পরিবেশ

small entrepreneurs

অধ্যক্ষ মো. ফজলুল হক বাচ্চু

এসএমই-৭৮ লাখ কোম্পানি। এর মধ্যে ৭৮ হাজার জীবিত আছে কিনা। উদ্যোক্তা ৯০% রুগ্ন, মরে শেষ; কিন্তু কেন তাঁরা সাপোর্ট পায় না? তাঁরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মার্কেটিং করে বাজারজাত করতে পারতেছে না। জ্ঞানের স্বল্পতা আছে। পুঁজির অভাব আছে। চায়নার মাল, ইন্ডিয়ার মালের সাথে কম্পিটিশনে টিকতে পারতেছে না। উদারনীতি থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কার্যকর থাকতে হবে। প্রয়োজনেও সার্ভিস পাচ্ছে না। যথাযথ গাইডলাইন পাচ্ছে না। বেকাররা জমি বিক্রি করে বা ধারদেনা করে ছোট উদ্যোগ নিয়ে থাকে। উদ্যোক্তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হবে, লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে।

অথচ উদ্যোক্তারা যদি মরেও যায় তবু কেউ সাপোর্ট করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে না। লাইসেন্স নিতে গেলে ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে। জায়গা নিতে গিয়েও অনেকে ধরা খায়। স্থায়ী গুন্ডা-মাস্তানরা চাঁদা চাইবে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন উপলক্ষে করা কালেকশনে বা ফান্ডে টাকা দিতে হবে। কয়েকজন মিলে জমি কিনে, কারখানা বানায়; পরে পুঁজির সংকটে পরে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পাওয়াও অনেক কঠিন। ঋণের জন্য নথিপত্র জোগাড় করতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায়। উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের উদার নীতি থাকতে হবে।

যেসব উদ্যোক্তার কাছে ব্যবসা নেশার মতো, ব্যবসাটাই ধ্যানজ্ঞান এবং রাত-দিন, শয়নে-স্বপনে শুধু ব্যবসা নিয়ে ভাবেন- এদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে বুঝে-শোনে হিসাব-নিকাশ করে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজারের চাহিদার বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনা না করে আইডিয়া নিয়েই আবেগে তড়িঘড়ি করে ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়লে ব্যর্থও হতে হয়। কোনো কারণে উদ্যোক্তা আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও কিছুদিন যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে উদ্যোগ। ব্যবসা শুরুর আগেই ব্যবসায়ে আয় শুরু হতে যে সময় লাগবে, সেই সময়ে ব্যবসার ও সংসারের খরচ কিভাবে চলবে তা ভেবে পরিকল্পনা করতে হবে, বিনিয়োগযোগ্য অর্থ ফুরিয়ে ফেলা যাবে না।

চায়নাতে সহজেই উদ্যোক্তারা ফান্ড পেয়ে যায়, ফলে পুঁজির সংকটে ভোগে না। নতুন উদ্যোগটিকে সফল করার জন্য তারা গাইডলাইন দেয়, তত্ত্বাবধান করে, প্রশিক্ষণ দেয়, প্রয়োজনীয় কিছুর যোগান দেয়। তারপরও যদি কেউ ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে চাকরি করে হলেও এই দায়-ণ শোধ করতে হয়। বাংলাদেশে যেমন অভিজ্ঞতা অর্জনের পরও, সম্ভাবনা থাকার পরও অনেক সময় পুঁজির অভাবে বা অর্থসংকটে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়; চায়নাতে এমনটি কখনোই হয় না।

আমি মালয়েশিয়াতে গিয়েছি। অনলাইনে খোঁজখবর নিয়ে বাংলাদেশে কিছু প্রোডাক্ট এনে মার্কেটিং করতে চেয়েছিলাম। যেয়ে দেখি ফ্যাক্টরিটি খুব ছোট। আসলে ওরা এক্সপোর্ট করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখে। আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য বাইরে রপ্তানি করার নানা প্রতিবন্ধকতা; আর ওরা এই ব্যাপারে যথেষ্ট উদার, আরো উদ্বুদ্ধ করে। কম কোয়ালিটির কোন মাল উৎপাদনই করতে পারে না, কারণ রেগুলেটরি অনেক শক্তিশালী।

অথচ বাংলাদেশে নিম্নমানের পণ্যে উৎপাদিত হয়। ফলে মার্কেটিংয়ে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে মানহীন পণ্য, কোয়ালিটি ঠিক না রেখে শুধু ফাঁকিঝুঁকির চিন্তা। কোনোরকমে মার্কেটে টিকে থাকতে চায়, কোনোরকমে ব্যবসা করার চিন্তা করে। ১০০ টাকার পণ্য ৯০ টাকায় বিক্রি করতে চেয়ে, পণ্যের মান খারাপ করে। দেখতে দেখা যায় একইরকম, কিন্তু মানে আসলে ভালো না। মানুষ চায় দেখতে-শোনতে ভালো, দামেও কম। কিন্ত বাস্তবে সার্ভিস ভালো পায় না, টেকসই হয় না, ফিনিশিং ভালো পায় না। এখানে এসেই পুঁজির অপচয়টা হয়।

আমি গ্রামে থাকতাম লুঙ্গি ও স্যান্ডেল পরে। ১৯৮০ সনে ঢাকায় আসি। আমার মেঝো ভাই তখন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে, আমার চাচাত ভাই ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে। গুলিস্তান এসে একটি প্যান্ট কিনে সেলাই করে ফিটিং করে দিয়েছিল, আর ফুটপাথ থেকে জুতা কিনে দিয়েছিল। জুতাটা পরে রায়ের বাজার মেসে আসার আগেই তলিটা খুলে পরে গেছে। এখানে ঠিকই বিনিয়োগকারীর পুঁজি লেগেছে, উৎপাদন খরচ ১০০ টাকার জায়গায় হয়তো ৭০ টাকা করেছে। এই ৭০ টাকার সার্ভিসটা আসলে কী হলো? -জিরো। তাহলে ঠকবাজির পেছনেই পুঁজিটা চলে গেল, নষ্ট হলো, অপচয় হলো। এভাবে পুঁজির বিনিয়োগটা অর্থহীন।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা অনেক সময় বুঝেন না পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিয়ে উন্নত না করলে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা টেকসই হয় না। ফাঁকি দিয়ে পণ্য বিক্রি বা সেবা দিলে সেই ব্যবসা শেষ পর্যন্ত টিকে না। ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে যথাযথ গবেষণা ও প্রয়োজনীয় বিপণনে দেশের উদ্যোক্তা পর্যায়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে, অনেকেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না। আয়-ব্যয়ের নথি সংরক্ষণ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ না করার বিষয়গুলো ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে। পণ্য সম্পর্কিত তথ্যের সঙ্গে যথাযথ মান নিশ্চিত করা জরুরি। গ্রাহককে যেন সব সময় সঠিক পণ্য সরবরাহ করা হয়। পণ্য কিনে গ্রাহকের জানানো প্রতিক্রিয়াও বিবেচনায় নিতে হবে।

উদ্যোক্তা এমনি এমনি তৈরি হয় না, পরিবেশ লাগে। ২০ কোটি মানুষের মার্কেট বাংলাদেশ। আমি ইন্ডিয়াতে গেছি, দেখেছি জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশে বেশি। এই আমরা একজনেই পাঞ্জাবি, শার্ট, গেঞ্জি, ফতুয়া- কত ধরনের জামা পরি; বিদেশিরা এতো পরে না। সৌখিনতা কমাতে হবে। লৌকিকতা বেশি হলে চলবে না। অর্থ ব্যবহারে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন কী সুযোগ আসে, সে ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে, ঝুঁকি দেখলে যথাযথ প্রতিরোধব্যবস্থা না নিলে প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটে টিকে থাকা যাবে না।

শুধু শখের বশে কোনো ব্যবসা হাতে নিলে হবে না, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও প্রশিক্ষণও নিতে হবে। মুনাফার জন্য শুধুই ধান্ধাবাজি করলে চলবে না। কোয়ালিটি ধরে রাখলে আস্থা অর্জন করা যায়। যে আস্থা অর্জন করতে পেরেছে সে মার্কেটে টিকে থাকতে পেরেছে। মানহীন পণ্য উৎপাদনই করতে দেয়া ঠিক না, পুঁজির অপচয় হয়। এসব কম দামে বিক্রি হয়, আর মানুষের মধ্যে মানহীন পন্য কেনার প্রবণতা বাড়ে। গুণে-মানে ভালো পণ্যের উৎপাদনকারীরা মার খায়। বিদেশে খারাপ কোনো খাবার নেই, খারাপ কোনো পণ্য নেই।

প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড় উদ্যোক্তাদের নিজস্ব মিডিয়া আছে, আর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অন্য মিডিয়াতেও প্রচার চালায়। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রচার প্রচারণা ঠিকঠাকমতো না চালানোর কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো মার খায়। কেন একজন উদ্যোক্তার উদ্যোগটি বন্ধ হয়েছে- তা তার সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যাটি খুঁজে বের করে সমাধানেও ভূমিকা রাখবে রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ। ভিজিট করে সার্ভাইব করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করবে।

এছাড়া ব্যবসায় সঠিক মডেল না থাকা, যথাযথ বিপণন করার কৌশল না জানা, ক্রেতা-গ্রাহকের প্রতিক্রিয়াকে মূল্যায়ন না করা, সঠিক পণ্য সময় বুঝে বাজারে না ছাড়তে পারার কারণেও অনেকে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় বিনিয়োগকারী বা সহপ্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে বা ভুল নেতৃত্বের কারণেও উদ্যোগের ১২টা বাজে। ক্রিয়েটিভিটি বা নিত্যনতুন আইডিয়া সৃষ্টির ক্ষমতা না থাকায এবং প্রয়োজনীয় যোগাযোগ দক্ষতার অভাবেও বহুবিধ সংকট তৈরি হয়।

আন্তরিক-নিবেদিতপ্রাণ দক্ষ-অভিজ্ঞদের নিযে সঠিক টিম গঠন করতে না পারলে তারা কাজের প্রতি মনোযোগী হয় না, একাগ্রতা থাকে না এবং সমস্ত অন্তর দিয়ে কাজ করার ইচ্ছা জাগে না। বাজারে অন্যদের হালকাভাবে নেয়ার কারণেও অনেকে ধরা খায়। যারা পণ্যের জন্যে সঠিক দাম নির্ধারণ করতে পারেন না, ব্যবহারকারী-ক্রেতার চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ব্যবহারবান্ধব পণ্য উৎপাদন করতে পারেন না- তারা ভালো করেন না।

প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ বা চাপ সহ্য করতে না পারায় লাভের মুখ দেখার আগেই ছেড়ে দেয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। আসলে ব্যবসায়ে তীক্ষè মেধার চেয়ে লেগে থাকার গুণ বেশি লাগে। যার টাইম ম্যানেজমেন্ট ও যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা নেই তার ক্রিয়েটিভিটি কোনো কাজে লাগে না। সফল হবার জন্য আইকিউ এর চেয়েও ধৈর্যশীল ও ডিসিপ্লিনড হওয়া বেশি দরকার। উদ্যোক্তাদেও সহায়তার জন্য সরকারী ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top