মানসম্মত গাড়ি দেশেই উৎপাদন হোক

car made by Bangladesh

অধ্যক্ষ ফজলুল হক বাচ্চু

শিল্পোন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগুতে হবে। সিঙ্গাপুর জার্মানিসহ উন্নত বিশ^তো শিল্পে উন্নত দেশ নিয়েই। জাপানে বা সিঙ্গাপুরেতো দুর্নীতি নেই। বাংলাদেশে টয়েটা থেকে শুরু করে জাপানি গাড়ি চলে। অথচ শিল্পপতিরা কেন এই খাতে গাড়ি উৎপাদনে বিনিয়োগ করে না! গাড়ির কারখানাতো বালাদেশ করতেই পারে এবং শিল্পটির চাহিদা আছে, লাভজনক।

গাড়ির ব্যবসা জমজমাট ব্যবসা এই দেশে। বাংলাদেশে যত গাড়ি চলে এর তিনভাগের একভাগও নেই ইন্ডিয়ান রাস্তায়, এতো দামি গাড়ি ওখানে রাস্তায় দেখা যায় না। ইন্ডিয়াতে বাইরের দামি ব্রান্ডের গাড়ি চলে না, ইন্ডিয়ার মানুষকে ইন্ডিয়ার উৎপাদিত গাড়িই কিনতে হয়। মানসম্মত গাড়ি উৎপাদন করতে পারলে দেশের টাকা দেশেই রাখা যেতো।

আসলে পানি বিক্রি করা যেমন সালমান এফ রহমান এর কাজ না, মুড়ি বিক্রি করা তেমনি বসুন্ধরা গ্রুপের কাজ হতে পারে না। বড় বড় শিল্প গ্রপগুলো গাড়ির কারখানা করায় এগিয়ে আসতে পারে, মানসম্মত গাড়ি। আসলে এদেশে উদ্যোক্তা কম। আর বড় বড় আমলারা গাড়ি ইমপোর্ট করতে গিয়ে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে ফ্যাসিলিটিজ পায়।

চায়না বিশে^র নামি-দামি ব্রান্ডের প্রোডাক্ট উৎপাদন করার জন্য বিদেশি বড় বড় কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীদের অনুমোদন দেয়। দেড়শো কোটি মানুষের মার্কেট চায়নাতে তোমাদের প্রোডাক্টের মার্কেটিং করতে পারবে তবে শর্ত হচ্ছে দু’টি। একটি হচ্ছে- আমার দেশে ফ্যাক্টরি করতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে যত শ্রমিক-লেবার বা কর্মকর্তা- কর্মচারী লাগবে সবই আমার দেশ থেকে নিতে হবে। এতে চায়নার দুটি লাভ হয়। একটি হচ্ছে- বাইরের পুঁজি দেশটিতে আসে। আরেকটি হচ্ছে- দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশেও এমনটি হতে পারে।

এদেশে ফ্যাক্টরি করবে, এদেশের মানুষ কাজ করবে, এদেশের মার্কেটে বিক্রি করবে। মালয়েশিয়াতেও এই সূত্রে উন্নয়ন হয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চায়নার সাথে জয়েন ভেঞ্চারে এই ধরনের উদ্যোগের বাস্তবায়ন হতে পারে। মাহাথির মুহাম্মদ চায়নার বিনিয়োগে দেশে এ ধরনের অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। জাপানের গাড়ি আমদানি না করে আমার দেশে ফ্যাক্টরি বানালে, ভালোমানের মানসম্মত গাড়ি উৎপাদন করলে আর আমদানি করলে বিরাট পরিমাণ ট্যাক্স আরোপ করি- তাহলে বিশাল পুঁজি বাইরে চলে যাওয়ার পথ বন্ধ হবে।

পশ্চিমা দেশগুলির মতো বাংলাদেশেও ক্রমশ বড় হচ্ছে গাড়ি বাজার। নামি দামি ব্রান্ডের গাড়ি এসে ভিড় করছে দেশে, প্রতিদিন শত শত ক্রেতা হাতে গাড়ির চাবি তুলে নিচ্ছে। গাড়ির বাজার বড় হচ্ছে। মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে বাজারে একাধিক গাড়ি নামছে। এর মধ্যে বহু ভারতীয় ও জাপানি সংস্থার তৈরি গাড়িও রয়েছে। বাংলাদেশে বিক্রি হয় টাটা মোটরস এবং মারুতি সুজুকির সবচেয়ে সস্তা গাড়ি টাটা ন্যানো এবং মারুতি অল্টো। এগুলি ছাড়াও রয়েছে মারুতি সুইফট, টয়োটা ভিটস, এবং রেনল্ট কুইডের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হওয়া গাড়িও। এই দেশে বেশ কিছু অটোমোবাইল কোম্পানি কাজ করছে। যেমন- বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেডের (এর একটা সম্পুরক হোন্ডা), বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, যমুনা অটোমোবাইল, আফতাব অটোমোবাইল, নিলয়-হিরো মোটরস (হিরো মোটরকোরপ এবং নিলয় মটরসের যৌথ উদ্যোগ), পিএইচপি অটোমোবাইল, প্রগতি, রোডমাস্টার মোটর, রানার অটোমোবাইল এবং ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

দেশে নিকট ভবিষ্যতে রিকন্ডিশন্ড (ব্যবহৃত) গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় কারখানায় তৈরি নতুন গাড়ির বাজার সম্প্রসারিত করতে হবে। শিল্পপতিরা এগিয়ে এলে শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে তৈরি গাড়ি রপ্তানিও হতে পারে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্র্যান্ড হুন্দাই গাড়ির উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে সম্ভব হলে গুণমান সম্পন্ন দেশীয় ব্রান্ড তৈরির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। যাতে দেশেই জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে বিশ্বমানের গাড়ি উৎপাদন করা যায়।

দেশের বাজারে মূলত দু’ধরনের গাড়ি পাওয়া যায়- নতুন ও রিকন্ডিশন্ড। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের পছন্দ রিকন্ডশন্ড গাড়ি। বর্তমানে দেশের বাজারে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আছে। মূলত যেসব গাড়ি জাপানে ১-৫ বছর চলার পরে বাংলাদেশের বাজারে আসে, সেগুলোকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি হিসেবে ধরা হয়। বাজারে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম কম বলেই চাহিদা বেশি। কিন্তু দিনকে দিন বাজারে বাড়ছে নতুন গাড়ির চাহিদা। ক’বছর আগেও রাজধানীর রাস্তায় এত মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, অডি বা রেঞ্জ রোভার দেখা যেত না, যা এখন সচরাচর দেখা যায়।

বাংলাদেশের রাস্তায় ১০টা গাড়ির মধ্যে অন্তত ৭টা গাড়ি থাকে টয়োটা ব্রান্ডের। আমাদের দেশে সাধারণত বেশ কয়েকটা দেশ থেকে টয়োটার গাড়ি আসে। যেমন, জাপান, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া। এইগুলোর মধ্যে জাপানী গাড়িগুলো ছাড়া অন্যদেশে তৈরি সব গাড়িগুলো ব্রান্ড নিউ অর্থাৎ জিরো মাইলেজ হিসেবে আসে। জাপান থেকে রিকন্ডিশন গাড়ি আসে বেশি। জাপান ডোমেস্টিক মার্কেট বা ঔউগ মার্কেটের গাড়িগুলোরই জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে কিছু জনপ্রিয় জেডিএম গাড়িগুলো হলো, টয়োটা এক্সিও, এলিয়েন, প্রিমিও, নোয়া, হায়েস, করোলা, প্রোবক্স, একুয়া, সিএইচআর, প্রিয়াস ইত্যাদি। এইগুলো লফস মার্কেটের গাড়ি।

বাংলাদেশের রাস্তায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় টয়োটা ব্রান্ডের গাড়ি এবং সেগুলোই বেশিরভাগই বাংলাদেশে রিকন্ডিশন গাড়ি হিসেবেই আসছে। এই গাড়িগুলো মূলত জাপানে চলাচলের জন্য বানানো হয়ে থাকে এবং এইগুলোর বিল্ডকোয়ালিটি, ডিউরাবিলিটি, ডিজাইন সবকিছুই অন্যান্য দেশের টয়োটা থেকে অনেক বেশি ভালো হয়। যার কারণে একটা জাপানী টয়োটা গাড়ি কোনো ঝামেলা ছাড়াই ১৫-২০ বছর খুব ভালো সার্ভিস দিতে পারে। বাংলাদেশের রাস্তায় এখনো প্রচুর নব্বই দশকের টয়োটা গাড়ি দেখা যায়। যেইগুলো গত ২৫-৩০ বছরে কয়েক লাখ কিলোমিটার চলানো হয়েছে। তারপর ও এখনো গাড়িগুলো ঠিকঠাক!

টয়োটা শুধুমাত্র বাংলাদেশে না, সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। বাংলাদেশে যত মডেলের গাড়ি বিক্রি হয় তার প্রায় সবটাই আমদানি করা। আমদানি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ৫টি গাড়ি হচ্ছে টয়োটা করোল্লা,টয়োটা নোয়া, টয়োটা এক্সিও, টয়োটা অ্যালিয়ন/হাইএস/অ্যাকুয়া, নিশান এক্স ট্রেইল ইত্যাদি। টয়োটার উপর মানুষদের আস্থা অন্যান্য ব্রান্ডের চেয়ে অনেক বেশি। টয়োটা একটা গাড়ি বানানোর আগে রিসার্চের জন্য প্রচুর খরচ করে। অনেক সময় নিয়ে অনেক রিসার্চ এবং পরীক্ষায় পাশ করার পর টয়োটার গাড়ি বাজারে আসে। টয়োটা যেই গাড়িই বাজারে আনুক, সেই গাড়িটা ভালো হবেই। কারণ, এটা টয়োটা। গুণমানসম্মত গাড়ি এদেশে উৎপন্ন করতে পারলে দাম কম হওয়ায় আরও বেশি চাহিদা তৈরি হবে; যেহেতু বাজার ও চাহিদা ইতোমধ্যেই রয়েছেই।

দেশের বাজারে গাড়ির দাম বেশি হওয়ার মূল কারণ উচ্চ করহার। যারা গাড়ি কিনতে পারে তাদেরকে স্বচ্ছল হিসেবে ধরা হয়। গাড়ির দাম কম হলে, সবাই চাইবে গাড়ি কিনতে। এতে করে রাস্তাঘাটে জ্যাম আরও বাড়বে। তাই দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক রাখার স্বার্থেই এই উচ্চ করহার বলে যুক্তি দেখানো হয়। বাংলাদেশে যত মডেলের গাড়ি বিক্রি হয় তার প্রায় সবটাই আমদানি করা। আমদানি করা গাড়ির দামও অত্যাধিক। কেননা, উৎপাদনকারী দেশ থেকে এ দেশে গাড়ি আমদানি করতে চড়া শুল্ক দিতে হয়। ফলে গাড়ির উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে শুল্ক যোগ হয়।

ইতোপূর্বে দেশীয় গাড়ির শিল্প কারখানা গড়ে উঠায় গুরুত্ব দিয়ে সরকার বিদেশ থেকে ব্যবহৃত গাড়ি বা রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানি বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনাও করেছে। দেশি সংযোজিত গাড়ির বাজার উৎসাহিত করতে দেশের স্বার্থেই অটোমোবাইল ইন্ড্রাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি-২০২০ এ স্থানীয়ভাবে সংযোজিত গাড়ির বাজার তৈরি করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত গাড়ির আমদানি আস্তে আস্তে কমিয়ে দিবে।

বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ডড ভেহিকেল ইমপোর্টারস এন্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা) এর হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর যাত্রীবাহী ১৫ হাজার গাড়ির চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদার ৮৫ শতাংশই রিকন্ডিশনড গাড়ি পূরণ করে। বাংলাদেশে মূলত জাপান থেকে ব্যবহৃত গাড়ি আমদানি করা হয়। এসব গাড়িতে পাঁচ বছর পর্যন্ত অবচয় সুবিধা পাওয়া যায়। জাপানের মানে তৈরি হওয়া এসব গাড়ি টেকসই হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের কাছে পুরনো বা ব্যবহৃত হলেও এসব গাড়ির জনপ্রিয়তা রয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয় সক্রিয় ভুমিকা রাখলে অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে প্রণীত নীতিমালা আরো সময়োপযুগী করে বাস্তবায়ন করতে পারে। এ শিল্পের উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং টেকসই বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক অটোমোবাইল শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্রে উন্নীত করা সম্ভব। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মোটরগাড়ি শিল্প দক্ষিণ এশিয়ার মাঝে তৃতীয় বৃহত্তম। বাংলাদেশে কয়েকটি বড় গাড়ির কারখানা রয়েছে যা মিৎসুবিশি এবং প্রোটনের যাত্রীবাহী গাড়ি এবং হাইনো ও টাটার বাণিজ্যিক যানবাহনগুলো সংগ্রহ করে সংযোজন করে থাকে। শুধু সংযোজনের বাইরেও নিজস্ব ব্রান্ড, নিজস্ব উৎপাদন ও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে রপ্তানির টার্গেট নিয়ে এগুলো অচিরেই মোটরগাড়ি শিল্প আরো অনেক এগিয়ে যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top