বেকারত্ব নিরসন কোন পথে?

unemployment in Bangladesh

অধ্যক্ষ ফজলুল হক বাচ্চু

যেসব তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন, তাদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের চাহিদানুযায়ী দক্ষতা সম্পন্ন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের সংখ্য বাড়াতে হবে। যে যে কাজে দক্ষ তাকে সে কাজে নিয়োগ দিতে হলে পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্রও থাকতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষা দরকার। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তুলনামূলক কম শিক্ষাগত যোগ্যতার চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।

বাংলাদেশের আর্থিক দুর্গতি নতুন নয়। বাংলাদেশে আর্থিক এই দুর্গতির কিছু কারণ দীর্ঘদিনের। যখন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি ছিল সোস্যালিজমের পক্ষে, রাশিয়া কেন্দ্রিক; তখন রাশিয়া ছিল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। আর এই দুর্বলতার পেছনে মূল কারণ হলো- তাদের দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না। সোস্যালিজম মানুষের ব্যক্তি অধিকার খর্ব করে। ইন্ডিয়া ছিল রাশিয়ান ব্লকে। পাকিস্তান ছিল চায়না-সৌদি আরব মিডল ইস্টের ব্লকে। চায়না-রাশিয়ার ঐক্য ছিল।

যার দরকার হলেও চাকরি মিলছে না, সেই চাকরিপ্রার্থীর দুর্ভোগ সীমাহীন। কর্মসংস্থান চাহিদানুযায়ী না বাড়লে বেকারত্ব বাড়বেই। শারীরিক সামর্থ্য ও আর্থিকভাবে প্রয়োজনীয় হলেও কর্মহীন থাকার সমস্যার সমাধান আমজনতা দিতে পারবে না। কার্যত নীতিনির্ধারক ও সামর্থ্যবানদেরই সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার বেশি। যুবসমাজ যেহেতু বেশি কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল, সেহেতু তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

যেভাবে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে, তাতে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হতেই হবে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতে হবে এবং সময়োপযুগী উদ্যোগ বাড়াতে হবে। শুধু রিয়াল ইস্টেট, প্লট-ফ্ল্যাট তৈরি করে মাটির ভিতরে টাকা ডুকালে দীর্ঘমেয়াদে অনেকেই বিপাকে পড়বে। ১ কোটি বাড়িওয়ালা, বাড়িতেই পুঁজি ইনভেস্ট করে ফেলতেছে। উন্নত দেশের অনেক শহরের চেয়ে ঢাকা শহরে জায়গার দাম বেশি। জায়গার দাম বেশি হবার কারণ নিরাপদ বিনিয়োগ ভাবে হাউজিংয়ে।

অভিবাসী শ্রমিকও ৫ লাখ টাকা খরচে করে বাইরে যাচ্ছে। দেশে ৩০ হাজার টাকাও নিয়মিত আয়ের নিশ্চয়তা থাকলে এদের অনেকেই পরিবার-পরিজন-স্বজন-দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতো না, জমি বিক্রি করে ধারদেনা করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রবাস জীবন বেছে নেয়ার চিন্তা মাথাই ঢুকতো না। এমনকি একজন লেবার-শ্রমিকের মাসে ১৫ হাজার টাকা আয়ের নিশ্চয়তা থাকলেও দেশ ছাড়তো না। আমি সৌদি আরবে দেখেছি ক্লিনারটা বাঙালি, সুইপারটা বাঙালি, রাস্তার ঝাড়ুদারটা বাঙালি, হেলপার বাঙালি।

ভালো দিক হচ্ছে সে চুরি করছে না, পরিশ্রম করে আয় করতেছে। বাংলাদেশিরা পরিশ্রমী এতে কোনো সন্দেহ সংশয় নেই। শুধু নিরুপায় হলেই কেবল অলস বসে থাকে, তাছাড়া সবাই কিছু কাজ কর্ম করে খেতে চায়। কিন্তু যে ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গেল, সেই টাকাটা দেশে বিনিয়োগ করলে আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা হতে পারতো। শ্রমবাজারের অবস্থা যাতে দিনদিন আরো খারাপ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বাংলাদেশে যদি সত্যিকারেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হয় বা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্ব করতে হয় তাহলে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ হলে দেশের টাকা দেশে থাকবে, বিনিয়োগ বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে। শুধু চাকরি করার চিন্তা না করে চাকরি দেয়ার চিন্তাও করতে হবে। যার উদ্যোগ নেই, তাঁর ঝুঁকিও নেই, বেনিফিটও নেই।

বেকারত্বের হার বৃদ্ধির মানেই হচ্ছে- অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ: সেটা হোক ইন্ডিয়ায়, হোক মালয়েশিয়ায়, হোক সৌদি আরবে, হোক চীনে, হোক আমেরিকায়, হোক কাতারে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে, উদ্যোক্তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে যাকাত ব্যবস্থা ও ওয়াকফ সম্পদের সঠিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।

দেশ কৃষিনির্ভর হবে নাকি শিল্পনির্ভর হবে-তা ঠিক করতে হবে। কৃষি থাকবে, তবে বাংলাদেশকে হতে হবে শিল্প উন্নত দেশ। অর্থনৈতিক ভাবনা সঠিক না হলে কখনোই যথাযথ ও প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসবে না। উন্নয়ন ভাবনা সুপরিকল্পিত ও সুচারুরুপে হলেই কেবল টেকসই অগ্রগতি সম্ভব হবে। চোরের খনি উৎপন্ন হবার সব পথ বন্ধ করতে হবে। সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে, নিয়োগের শ্লথ গতিকে পরিবর্তন করে উত্তরোত্তর বেগবান করতে হবে।

ঢাকাবাসীর কর্মে গতিশীলতা ফেরাতে যানজট নিয়ন্ত্রণ জরুরি, শহরকে যানজট মুক্ত করতে হবে। এজন্য প্রাইভেটকারে নিয়ন্ত্রণারোপ করতে হবে। ভালোমানের বাস চালু করতে হবে; যাতে এক শ্রেণি দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে হলেও এটা ব্যবহার করে। আয় না বাড়িয়ে চাহিদা মেটাতে ব্যয় বাড়ানোর মতো বিড়ম্বনা আর নেই। বেকারত্ব জিইয়ে রাখলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না। এদেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যত দ্রুত মুক্ত করা যায় ততই মঙ্গল।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, রিলায়েন্স ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (আরপিএল)

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top