ফুটপাথ ব্যবসা কেন বন্ধ করতে হবে?

street-footpath

অধ্যক্ষ ফজলুল হক বাচ্চু

ফুটপাথে ব্যবসা তথা হকারদের দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে; বাংলাদেশ ছাড়া এমনটি কোথাও নেই। ফুটপাথে ব্যবসায়ীরা উন্নয়নের চাকা পেছন দিকে ঘুরায়, দেশের উন্নতি-অগ্রগতিকে পেছনে টানে। ফুটপাথের কোনো আয় সরকার পায় না; স্থানীয় পুলিশ, স্থানীয় কমিশনার, স্থানীয় মাস্তানরা টাকাটা ভাগ করে পায়। ফুটপাথে ব্যবসায়ে কোনো ট্যাক্স নেই, কোনো লাইসেন্স নেই। ফুটপাথের ব্যবসায়ীর কোনো ইমেজ নেই, সামাজিক সুনাম নেই, মানবিক মান-সম্মান নেই। কেউতো আর ফুটপাথে ব্যবসা করে এই পরিচয়ে মেয়ে বিয়ে দেয় না, সামাজিক গ্রহণযোগতা বা স্বীকৃতি নেই।

অথচ ফুটপাথ ব্যবসা পরিবেশ নষ্ট করে, যানজট বাড়ায়, মানুষ ঠিকমতো হাটতে পারে না। এখানে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে- ফুটপাথে যে পাঞ্জাবিটা বিক্রি হচ্ছে, কোয়ালিটি কম হওয়ায় কম দামে; সেটি ভালো কোয়ালিটিরটা বেশি দামে মার্কেটে বিক্রি করা যাচ্ছে না। নাজিম ভাই দেলোয়ার ভাই একদিন লাল রংরের একইরকমের চেকের দুটি শার্ট কিনেন। মাস খানেক পরে পুরো রং ওঠে পরার অযোগ্য হয়ে গেছে। কিছুদিন পরে ফুটপাথে দেখি ঐ শার্ট দেড়শো টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।

ফুটপাথে যে জিনিসটি বিক্রি হয় সাধারণ ধরেই নেয়া হয় তা নিম্নমানের বা ত্রুটিপূর্ণ। সবারই ধারণা হলে সস্তা দামে কম মানের কমদামি জিনিস। কেউ না কেউ এটি উৎপাদন করেছে। যে শিল্পপতির বা উৎপাদনকারির পণ্যটা ফুটপাথে পাওয়া যায়, তার সেই পণ্যের গুড উইল সৃষ্টি হয় না। আসলে পণ্যটি উৎপাদনেতো আর এত কম খরচ হয়নি। ফুটপাথে ছেড়ে দিয়ে কম দামে বেঁচে লস করে অথবা মুনাফা তার এতই কম যে সে আর কুলিয়ে ওঠতে পারে না।

ফুটপাথে পাওয়া না গেলে ঠিকই মার্কেট থেকে কিনতো। দোকান থেকে কিনলে না হয় ৫০ টাকা বেশি লাগলো। এ+ বা এ এর নীচের মানহীন পণ্যের কী দরকার? কোনো দরকার নেই। মানহীন পণ্য তৈরি করাই ঠিক না, তৈরি করতে দেয়াও অনুচিত। সেদি আরবের মানুষ নিশ্চিত এই দেশে কোনো খারাপ জিনিস খাওয়ায় না। গুণমানহীন পণ্য মার্কেটে ঢুকতেই পারে না। রেগুলেটরি এতো স্ট্রং, শত চেষ্টা করলেও দুই নম্বরি করার সুযোগই পাবে না। সরকারিভাবে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কোয়ালিটি সম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। নিম্নমানের পণ্য এদেশে যাতে পাওয়া না যায়।

শিল্পগুলো মার খায় কী জন্য? যেটি মানসম্মত বানালে খরচ হয় ৫০০ টাকা, সেটি যদি ফুটপাথের রেটের কারণে কম দামে বেঁচতে হয়- তাহলেতো সে টিকতে পারবে না; আবার যদি বেঁচতে না পারে তাহলেতো পুঁজি পরে থাকবে। ফুটপাথে পাওয়া যায় মানেই কম দামের, কম মানের; গুড উইল শেষ, গুড উইল তৈরিই হয় না। অথচ এদেশেও ফুটপাথ বন্ধ হয়ে গেলে ফুটপাথের ক্রেতারা মার্কেট থেকে কিনবে।

এসব কারণে ফুটপাথ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। ফুটপাথ ব্যবসায়ীরা যাতে কর্মহীন ও বেকার হয়ে না পরে সেজন্য বিকল্প হচ্ছে- এদের জন্য সুপার মার্কেট বানানো। প্রত্যেক শহরে বহুতল সুপার মার্কেট বানিয়ে দিলে এসব ব্যবসায়ীদের ভালো হবে। যেহেতু এদের পুঁজি আছে, ফুটপাতেও পজিশন নিতে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তাই মর্কেটে দোকানের জন্য প্রথমে ৩ লাখ টাকা নিয়ে নেয়া যেতে পারে এবং আরো ৩ লাখ একটা সময় পর্যন্ত কিস্তি দিয়ে শোধ করবে। এতে সে দোকানের মালিক হবে, ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে। এরকম বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা শহর পর্যন্ত হতে পারে।

হকারদের পুনর্বাসনে এসব মার্কেট তৈরিতে খাসজমি ও সহায়তাও বরাদ্দ দিতে পারে সরকার। তারা যখন দেখবে মার্কেটে দোকানের মালিক তারা, তারাই বিক্রি করবে- তখন সেখানে যেতেও দ্বিধা করবে না। সাপ্তাহিক, মাসিক, দৈনিক চাঁদা দেয়ার বিড়ম্বনাও থাকবে না। কোনো সিন্ডিকেটের কারণে নতুন নতুন সমস্যায় পড়তে হবে না। আর যেহেতু ফুটপাথের দোকান নেই, তাই বাধ্য হয়ে ফুটপাথের ক্রেতারা ঐখানেই যাবে, না গিয়ে উপায়ও নেই। মার্কেটগুলো জমজমাট হবে। হকার্স মার্কেটের মতো সেখানেও ক্রেতারা যাবে, কম দামে পণ্য পায় বলেই বঙ্গবাজারে এতো ক্রেতার ভিড়। বঙ্গবাজারে সব জিনিসই পাওয়া যায়, দামটা একট কমে পাওয়া যায়।

ব্যস্ত সড়কের মাঝের ফুটপাথ এভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় যানবাহনের সঙ্গেই রাস্তার উপর দিয়ে চলাচল করতে হয় পথচারীদের। এতে প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনার সঙ্গে ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। ফুটপাথের দোকানের ভিড় চলে আসে মেইন রাস্তার ওপর। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। হকার সরিয়ে আমজনতার চলার পথ তৈরি করার মাধ্যমে যানজট কমিয়ে আনা যাবে। ফুটপাথ পথচারীদের জন্য। হকার উচ্ছেদের মাধ্যমে সেটার দখল ওঠাতে হবে, তবে তা হবে বিকল্প ব্যবস্থা করেই। কারণ এই দোকান ছাড়া তাদের বিকল্প আয় নেই। ব্যবসা বন্ধ মানে তাদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়া, পরিবারের সবাইকে নিয়ে কষ্টে থাকা, মানবেতর জীবন-যাপন করা। তাই যত দ্রুত সম্ভভ বিকল্প দিতে হবে, আর ফুটপাথ ব্যবসা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, রিলায়েন্স গ্রুপ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top