খলনায়কের ভিড়েও খুঁজি প্রকৃত নায়ক

real hero

আনিসুর রহমান এরশাদ: ভিলেনের বিবেচনায় প্রতিটি ভিলেনই নায়কোচিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ভিলেনের নিকট ভিলেনই হিরো, মন্দব্যক্তি নয়। ভিলেনও নিজেকে হিরো কল্পনা করেই মানসিক প্রশান্তি পায়। স্ক্রিনে ভিলেন কাল্পনিক চরিত্রের হলেও বাস্তবে চলতে ফিরতে এমন স্বভাবের মানুষের অস্তিত্ব অনেক দেখা যায়।

ভিলেনের ষড়যন্ত্র মানেই মারাত্মক ষড়যন্ত্র। ভিলেনের অফার মানেই ধ্বংসাত্মক অফার। অধিকাংশের কাছে দুর্জন ও খলনায়ক হিসেবে পরিচিতদের দৃশ্যত সম্মান দেখালেও সাধারণত মন থেকে সবাই ঘৃণা করে। ঘৃণাই এদের প্রাপ্য, এদের সাথে সম্পর্কে উপজীব্য স্বার্থ, স্বার্থ হাসিলেই এদের পরিপূর্ণ মনোযোগ।

ভিলেনেরা যতটুকু ভালোবাসা পায় তার পুরোটাই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত। ফলে এরা যেখানে জিতে যায় সেখানে হেরে যায় সমাজ, হেরে যায় সংস্কৃতি, হেরে যায় মানবতা। ভিলেনের বিজয়ে মিলে শয়তানের অট্টহাসি, তাদের পা চাটা কুকুরের মুচকি হাসি; কিন্তু তাতে বৃহত্তর জনসমাজের গৌরব করার কিছুই থাকে না। তারা খোলসে ঢেকে পথ চলে, তবে খোলসটা খসে পড়লেই কুৎসিত-কদর্য রূপ সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়।

রুক্ষতা হলো ভিলেনের বৈশিষ্ট্য, অশ্লীল গালিগালাজ হচ্ছে ভিলেনের অস্ত্র, আক্রমণাত্মক আচরণই তার শক্তি। নর্দমার কীটকে কেউ স্পর্শ না করার অর্থ সে মর্যাদা ও সম্মানে সবাইকে ছাড়িয়ে এমনটি বোঝায় না। ভাগাড়ের দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতে নাকে রুমাল চেপে ধরে চলে যাওয়া ভদ্রলোক ভীরু কাপুরুষ নয়; বরং এই কদর্যতাকে সে সহ্য করতে পারে না, সহঅবস্থান মেনে নিতে পারে না।

কিছু ভিলেন যেমন নিম্ন শ্রেণি থেকে উঠে আসে, কিছু ভিলেন তেমনি ভদ্র শ্রেণীতেও বেড়ে ওঠে। মূলত এরা বিভিন্ন স্বার্থে জড়িয়ে ইতর শ্রেণীতে যোগদান করে। জুতা কে মাথার মুকুট বানানো যেমন স্বাভাবিক হতে পারে না, তেমনি মাথার মুকুট দিয়ে জুতা বানিয়ে পরিধানও শোভনীয় নয়। যার স্থান যেখানে, যে যেখানকার উপযুক্ত তাকে সেখানেই থাকতে দেয়া উচিত।

ভিলেনের কাজ হচ্ছে অন্য চরিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার চেষ্টা করা। এরা অপরাধ করেও তৃপ্তির ঢেকুর গিলে। মন্দদের সংগঠিত করে ভালোদের কুন্ঠাসা করে। এরা নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে আনন্দ খুঁজে। এরা মনের বিষবাষ্প উগরে দিয়ে চারপাশকে দূষিত করে ফেলে।

সবাই ভিলেনকে দুর্বৃত্ত মনে করলেও ভিলেন সব সময় নিজেকে হিরোই ভাবে; কারণ অন্যের বিবেচনা বা সার্টিফিকেটের প্রয়োজন তার হয় না। যা কিছু ভালো সবকিছুই ভিলেনের প্রতিদ্বন্দ্বী। শয়তানকে খোদার আসনে বসিয়ে পথ চলে ভিলেন, ফলে ভিলেন কখনোই নিজের ভুল দেখে না, ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয় না, অনুশোচনায়ও ভুগে না। ভিলেন নিজের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে কাজ করে; ফলে আল্লাহ নবী জান্নাত এসব অদৃশ্যের-পরকালের পরোয়া সে করে না।

ভিলেনরা নিজেদের মুক্ত বিহঙ্গের মতো ভাবে, তারা নীতি বিধি-বিধানের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। দুর্নীতি তার কাছে সাহসী বুদ্ধিমানের কৌশলী আচরণ মাত্র! মূলত সৎ ও ভালো মানুষ যা করে তার উল্টোটা করাতেই তাদের সাফল্য-সার্থকতা নিহিত। ভিলেনের চালচলনই হিরোর বিপরীতধর্মী। ভিলেনের প্রতিশোধ নেয়ার ধরন হিরোর বিপরীত পথে।

ভিলেনরা ভিলেন তকমাকে উপভোগও করে। এরা ওর শক্তি প্রদর্শনে ভেবে নিয়োগ কায়দা কানুন প্রয়োগ করে তবে আমজনতা নেক নজর ও সুদৃষ্টি পেতে মাঝে মাঝে খোলস পাল্টাতে চেষ্টা করে। প্রকৃত ভিলেনরা আচমকায় ভিলেন হয়ে যায় এমন নয়, দীর্ঘদিনের ভিলেনিয় চর্চার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মাত্র! অনেক সাজানো ও বেচতে যায় এদের ছোটলোকির কারণে ইদানিং ভিলেনরাও সুদর্শন হয়, পোশাক কেতাদূরস্ত হয়। চেহারা দেখে পরিপাটি ভদ্রলোক মনে হলেও তার ভেতরের খারাপ মানুষটি নিৎকৃষ্ট জন্তু-জানোয়ারকে ছাড়িয়ে যায়।

খলনায়কও যখন শুধুমাত্র নায়কের মুখোশেই সীমাবদ্ধ না থেকে হিরোকেই ভিলেন সাজাতে সক্ষম হয়- তখন সে চূড়ান্ত সফলতা খুঁজে পায়। যে কলুষিত সমাজ খলনায়ককে নায়কের আসনে বসায়, নায়কোচিত চরিত্রের ব্যক্তিত্ব সেখানে হয় নিরব দর্শক কিংবা নিষ্ক্রিয় বোবা কিংবা অন্যত্র প্রস্থানকারী!

আত্মসমালোচনার অভাবে পরের ওপর দোষ চাপানোর সুযোগে বাল্যপ্রেমীরাও বাল্যবিয়ের জন্য অভিভাবককে দায়ী করে! নিজ সন্তানকে হত্যাকারীও অক্ষমতায় পার্টনারকে দোষ দেয়! লোভী চরিত্রহীন অর্থের ও ক্যারিয়ারের লোভে রাতে বিছানা পর্যন্ত শেয়ার করে!

স্বার্থপর সম্পদ ও ক্ষমতার কাছে সম্পর্কের বিশ্বস্ততা-পবিত্রতাকে মেরে ফেলে! এভাবে হওয়া অমানুষেরা মানুষকে জানোয়ারের চেয়ে নিকৃষ্ট এবং পশুকে মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবতে শুরু করে। শয়তান যে সমাজে চারিত্রিক সনদ দেয়, অমানুষের সেখানে পোয়াবারো হলেও মানুষের দুর্ভোগ সেখানে সীমাহীন।

অকৃত্রিম আয়োজন হয় অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে। সম্পত্তির স্বার্থে যে সম্পর্কে ফাটল ধরায়, মনে বিষ নিয়েও দুষ্কর্ম ঢাকতে তার মুখে মধুর দেখা মিলে! কৃত্রিম আচরণ দিয়ে অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ বা অকৃত্রিম স্নেহ কোনোটাই পাওয়া যায় না। নিজ স্বার্থে যে অন্যের ঘাড়ে সওয়ার হয়, স্বার্থ ফুরালেই সে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে কেটে পড়ে।

অকৃত্রিম চাটুকারিতা দিয়ে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা কখনোই মিলে না। বরাদ্দে-ভাগে যে চরম বৈষম্যমূলক, ক্ষণিক মিষ্টি হাসিতেই সেই অপরাধী-পাপী পূণ্যবানে বদল হয় না। অকৃত্রিম বন্ধুত্বের জন্য অকৃত্রিম বিশ্বাস লাগে, অকৃত্রিম আন্তরিকতা লাগে। সম্পর্কই যার কাছে সম্পদ; অধিকার দিয়ে সে তা কেড়ে নেয় না, উপহার দিয়েও সে তা ফিরিয়ে নেয় না।

আমাদের আসলে প্রকৃত নায়ক প্রয়োজন, ভিলেন নয়। সত্যিকারের হিরো যত বাড়বে, সমাজ ততোই এগোবে। আর ভিলেন যত বাড়বে, সমাজ ততই পেছাবে। ভিলেন স্বকীর্তিতেই ভিলেন, তাকে ভিলেন হবার জন্য অন্যের স্বীকৃতি বা সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। মানুষ সাধারণত হিরো বানানোর চেষ্টা করে সচেতনভাবে। কিন্তু ভিলেনরা বেড়ে ওঠে যত্ন-পরিচর্যা-পরিকল্পনা ছাড়াই, ফসলের ক্ষেতে জন্মানো আগাছার মতো। ভিলেন মুক্ত সমাজ প্রয়োজন।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top