আনিসুর রহমান এরশাদ
একটি সমৃদ্ধ বুক রিভিউ হচ্ছে- লেখক-পাঠকের যোগসূত্র। লেখক ও পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করে বুক রিভিউ। বুক রিভিউর মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক গড়ে দেয়া হয়। বইয়ের অতি অন্তঃজ কিছু বিষয়ের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। বুক রিভিউর উপর ভিত্তি করে বই বিক্রি কম কিংবা বেশি হয়। রিভিউর কারণে বই বিক্রি বাড়ে ও প্রচার প্রসার হয়। সচেতন পাঠকেরা বই কেনার আগে পাঠকের রিভিউ দেখে কিনবেন নাকি কিনবেন না সিদ্ধান্ত নেন।
বুক রিভিউ কী?
বই পাঠপর্যালোচনা, বুক রিভিউ, গ্রন্থালোচনা, গ্রন্থ সমালোচনা, পুস্তক পর্যালোচনা বা পাঠ প্রতিক্রিয়া যাই বলুন না কেন, মূল বিষয় হলো একটি বইকে অন্যের কাছে আপনার নিজস্ব মনোভঙ্গি অনুযায়ী উপস্থাপন করা। কোনো একটা বই পড়ার পর বইটি সম্পর্কে পাঠকের অভিজ্ঞতা-ভালোমন্দ প্রকাশ করা।
বুক রিভিউতে সংক্ষিপ্তভাবে বইটির মূলভাব তথা সিনপসিস বা সারাংশ তুলে ধরা হয়, বইয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়, সহজেই উপজীব্য বুঝাতে পাঠকের কাছে বইটিকে বর্ণনা করা হয়, পর্যালোচনা করা হয় এবং মূল্যায়ন করা হয়। লেখক তার গ্রন্থে স্বীকৃত কোনো কনসেপ্ট উল্লেখ করলে সেটি সঠিক ও সার্থকভাবে চরিত্রায়নে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হয়।
বইয়ের টাইটেল বা নামকরণ থেকে শুরু করে বইয়ের মোটিভ বা উপজীব্য, লেখকের রচনাশৈলী-রচনারীতি-লেখার ভঙ্গি ও উদ্দেশ্য, শব্দচয়ন-ভাষা-অলংকার-সাহিত্যমান, লেখকের নিজস্বতা ও মান, সময় বা কাল, মূলভাব বা প্রধান বিষয় বা মূল বিষয়বস্তু উপলব্ধি, সাহিত্যিক উপাদান অনুধাবনপ্রক্রিয়া, বিষয়ের সঙ্গে সমসাময়িকতার নানা বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষন করে নাতিদীর্ঘ আলোচনাই হচ্ছে বুক রিভিউ।
বুক রিভিউ কেন?
বুক রিভিউয়ের মাধ্যমে-
- বই পাঠের তৃপ্তি-আনন্দ অন্যকে জানানো যায়।
- বইটির বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে অন্যকে মূল বইটি পড়তে উৎসাহিত করা যায়।
- ভালোলাগা জানিয়ে কিনতে উদ্বুদ্ধ করা যায়।
- বই পাঠশেষে প্রাপ্ত নিজের অনুভূতি উৎসাহ নিয়ে অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়া যায়।
- নিজের বিচার-বিশ্লেষণের যথার্থতা যাচাই করতে অন্যকে আহ্বান জানানো যায়।
বুক রিভিউয়ের গুরুত্ব
আলোচনা-পাঠোদ্ধারমূলক বুক রিভিউ-
- বইটি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পেতে সাহায্য করে।
- মূল বইয়ের পাঠ, পুনঃপাঠ, পুনঃপুনঃপাঠ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দেয়।
- গুরুত্বপূর্ণ বই-গ্রন্থগুলো অনালোচিত রয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়।
- সমালোচনা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে।
- কখনো কখনো লেখকের মূল্যায়িত হবার পথ প্রশস্ত করে।
- সৃজনশীল-মননশীল সাহিত্য নতুন করে পাঠের প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে।
- ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ টেক্সটের প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করে।
কিভাবে লিখবেন?
কোনো বইয়ের রিভিউ লেখার জন্য প্রথমে যথেষ্ঠ মনোযোগের সাথে বইটি পুরোটা ভালো করে পড়ুন, প্রয়োজনে বারবার পড়ুন। আগে বইয়ের ভূমিকা পড়ে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে একটি কাগজ কলম বা নোটবুক নিয়ে বইটি পড়তে বসুন। ভূমিকা পড়ে তৈরী হওয়া প্রত্যাশার একটা তালিকা করে নিলে বইটি পড়ার সময় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব মেলানো সহজ হয়ে যায়। ভালো পড়াশোনা না থাকলে বইয়ের সুন্দর রিভিউ লেখা যায় না। এজন্য নিয়মিত পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হয়।
রিভিউ সাধারণ পাঠকদের জন্য, ক্রেতাদের জন্য, বইয়ের তথ্য শেয়ার করার জন্য নাকি বই সম্পর্কে আগ্রহী করার জন্য লিখবেন তা নির্ধারণ করে সেই আলোকে প্রয়োজনীয় নোট নিন। এরপর ধারাবাহিকভাবে বইটি পড়ার সময় কোনো ভালো বা মনে লাগা পয়েন্ট কথা বা লেখা দাগ দেয়া বা নোট নেয়ার অভ্যাস করুন।
লেখক-পাঠক-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে হলে বুঝে-শুনে পাঠপর্যালোচনা করুন। কোনো ভুল বা অসঙ্গতিটা বুঝুন। নিজের স্টাইলে বইকে না বুঝে, লেখকের স্টাইলে বুঝুন। লেখকের ইন্টেনশন ধরার চেষ্টা করুন।
বই থেকে নির্দিষ্ট কোনো লাইন কোড করে অথবা বই সম্পর্কে দুটো দারুণ লাইন লিখে রিভিউ শুরু হতে পারে। যেন পাঠক রিভিউ পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বইটির ভালমন্দ দুটি দিক নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখে-শুনে-সম্যক উপলব্ধি করে ইতিবাচকভাবে ও মার্জিত-পরিশীলিত ভাষায় তুলে ধরবেন। রিভিউর টার্গেট পাঠককে খেয়াল রেখে সেই অনুযায়ী বইটির পাঠপর্যালোচনার ভাষা ও শব্দ নির্বাচন করুন।
রিভিউর শব্দসংখ্যা বইয়ের ধরণ ও পৃষ্ঠার উপরে নির্ভর করে। এ বিষয়ে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। চেষ্টা করুন একটি ইতিবাচক বাক্য দিয়ে রিভিউ শেষ করতে। ভালো কোনো প্রকাশনার জন্য লিখলে-বই পর্যালোচনা কীভাবে সাজাতে হবে, নির্ভুল করতে হবে এবং উপস্থাপন করার আগে কি কি কাজ করা আবশ্যক এসব সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণার চাইতেও বেশি জ্ঞান থাকতে হবে।
কী লিখবেন?
বইয়ের রিভিউতে থাকে প্রথমে বইটির প্রাথমিক কনটেন্ট। যেমন বইয়ের শিরোনাম, লেখকের নাম, অনুবাদ বই হলে অনুবাদকের নাম, প্রকাশক বা প্রকাশনা সংস্থার নাম, প্রকাশকাল, এডিশন, পৃষ্ঠাসংখ্যা আইএসবিএন নম্বর, প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম, দাম ইত্যাদি উল্লেখ করবেন। বইটি পড়তে গিয়ে সবচেয়ে ভালোলাগা বাক্য বা বিষয় দিয়ে শুরু করুন, যা পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেবে।
মূল রিভিউয়ে বইয়ের মোরাল, সারমর্ম বা সংক্ষিপ্তসার, বই সম্পর্কে নিজের মন্তব্য, বইয়ের ভালো দিক ও খারাপ দিক, কেন বইটি অন্যদের পড়া উচিৎ এবং লেখক-অনুবাদকের পরিচিতি ও কর্মযজ্ঞ ইতাদির দিকে খেয়াল রাখুন ।
বইয়ের সঙ্গে যায়, লেখকের এমন কিছু ব্যক্তিক বিষয়- যেমন তার অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, বিদেশ ভ্রমণ, পেশা, অন্যান্য ইতিবাচক গুণ যা কিনা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে বলে আপনি মনে করেন, তাও উল্লেখ করবেন।
সফল রিভিউ লেখতে বইটির টাইপ বা ধরন কিংবা সেটি সাহিত্যবিচারে কোন বিভাগে পড়ে তা বুঝে উল্লেখ করুন। বইটির মূলভাবের সঙ্গে বিশেষভাবে সংগতিপূর্ণ কিছু কিছু লাইন বা বিষয় কোট করতে পারেন। লেখকের রচনারীতির কি মোটিভ বা বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন, তাও লিখবেন।
উত্তম পুরুষ, নাম পুরুষ নাকি সর্বজ্ঞ লিখনরীতিতে লেখক বইটি লিখেছেন তাও বলা যেতে পারে। লেখকের ‘পয়েন্ট অফ ভিউ’ বুঝে সেই ভিউপয়েন্টের সঙ্গে একমত কিনা, বা দ্বিমত হলে কেন, তাও বলতে হবে। লেখকের বই আগে পাঠ করে থাকলে এবং তা ইতিবাচক হলে পূর্বের সঙ্গে তুলনা করে বইয়ের বিচার করুন।
বইটি কি আপনি পছন্দ করেছেন? করে থাকলে, কেন? বইটিতে কী কী ত্রুটি ধরা পড়েছে উল্লেখ করুন। বইটি কি অন্যদের পড়ার জন্য উৎসাহিত করবেন? বইটির সামাজিক ও সাহিত্যমূল্য কতখানি? লেখা সুখপাঠ্য না হলে অথবা তথ্যে ভুল থাকলে রিভিউ শেষের দিকে বইয়ের দূর্বলতা থাকলে তা উল্লেখ করুন। রিভিউর সাথে বইয়ের ছবিও প্রকাশ করুন।
বুক রিভিউয়ে কী লিখবেন না
একজন দক্ষ সাহিত্যসমালোচকের সমালোচনা নিছক খুঁত ঘাঁটা নয়, ভুল-ত্রুটি খোঁজা নয়। বইয়ের বাহ্যিক গুণাগুণ তথা লিখনশৈলী, আঙ্গিক বা ফরম্যাট বলাটা রিভিউর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। খুব প্রয়োজন মনে করলে শুরুতেই না বলে একেবারে শেষের দিকে প্রডাকশন সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। তুখোড় সমালোচকের চোখে বইটি ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে না বুঝে মিছে লেখকের মানহানি ঘটানো ঠিক না।
রিভিউতে বাজে ও অশ্লীল মন্তব্য করবেন না। এতে আপনার রুচি ও ব্যক্তিপরিচয় এমনভাবে প্রতিফলিত হবে যে, পাঠক ভাববে কাজটি আপনি শত্রুতাবশত করেছেন। সরাসরি বাজে মন্তব্য করে লেখকের প্রতি অকারণ অবিচার করবেন না। লেখক অথবা বই থেকে যা আপনি প্রত্যাশা করেছিলেন তার রিভিউ লিখবেন না।
রিভিউ প্রবন্ধের ভাষায় জটিল করে লিখবেন না। বইটি সুখপাঠ্য মনে না হলে বা ভালো না লাগলেও লেখকের মুখ চেয়ে মিছেই লেখার গুণগান করবেন না। লেখক-অনুবাদক কাছের ও পছন্দের লোক হলেই কিংবা প্রকাশনীর প্রতি মোহ ও ভালোবাসার টানে আবেগের বশে রিভিউ লিখলে লেখক তার অক্ষমতা বা ত্রুটি বুঝতে পারবে না। অহেতুক-অনর্থক-অধিক-ইচ্ছেমতো প্রশংসা পরিহার করুন।
বুক রিভিউয়ে খেয়ালের বিষয়
বই পড়ার সময় নির্মোহ থাকুন। বই, বইয়ের লেখক এবং প্রকাশনী সংস্থার ব্যাপারে প্রিডিটার্মাইন্ড ভালো লাগা, খারাপ লাগা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন। পাঠপর্যালোচনা শুধুমাত্র বইয়ের সারাংশ তৈরির ব্যাপার নয়, এমনটি হলে তাকে পাঠ মূল্যায়ন বলা চলে না।
বইয়ের ভালো রিভিউ লিখতে হলে- বইয়ের সারসংক্ষেপ স্মার্টলি দক্ষতার সাথে তুলে ধরুন, যথাসম্ভব বেশিসংখ্যক পাঠকের মানসপটে বইটি সম্পর্কে নিখুঁত চিত্র আঁকুন, ইলাস্টিকের মতো টেনে বড় না করে লেখক ঠিক যতটুকু লিখেছেন ঠিক ততটুকুই রিভিউ করুন।
লেখক ও বইয়ের মূল ফোকাসটা ধরুন।কোনো বিদ্বেষ-ঈর্ষা-হিংসার জায়গাটা ভুলে যান। রিভিউকৃত বই কী ধরণের প্রভাব তৈরি করছে, কারা এই বই দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, প্রভাবে কারা বেনিফিসিয়ারি হচ্ছে তা খুবই কম শব্দে লিখুন। আপনি ‘বর্ণনামূলক আলোচনা’ নাকি ‘সমালোচনামূলক আলোচনা’ করবেন তা বিবেচনা রাখুন।
লেখকের লেখার শেষভাগ সামারি বা মূল বিষয়ের সঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নাকি খাপছাড়া তাও বিবেচনায় নেবেন।ইলাস্ট্রেশন থাকলে অবশ্যই ইলাস্ট্রেশনের ‘কোয়ালিটি ও ক্লারিটি’ বিচার করবেন।
লেখকের নিজস্ব অভিমত-মনোভাব সমাজঘনিষ্ঠ নাকি গ্রহণযোগ্যয় নয় তা বুঝুন। লেখককে বুঝুন, তিনি কোন সমাজে বা ক্লাসে বিলং করেন তাও বুঝুন। কোথাও চুলচেরা বিশ্লেষণের দরকার আছে কিনা তা চিন্তা করুন।নেতিবাচক হলে রিভিউ পাঠকগণ লেখাটি পড়ে লেখক সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পাবেন।
অবশ্য প্রকৃত মনস্বী লেখকেরা শ্রেণি-আবাস-লেবাসের উর্ধ্বে উঠেও পুরো সমাজকে দেখতে পারেন।
কে লিখবেন বুক রিভিউ
বইয়ের বোদ্ধা কিছু পাঠক সমাজে আছে। যারা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সমলোচক। যারা বই পাঠের পর বুক রিভিউ বা পাঠপর্যালোচনা করতে পারেন, পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। একটি ভালো বই প্রকৃত পাঠক পড়লে বিষয়ের মর্ম অনুধাবন করেন এবং অধিক পাঠের পাশাপাশি বই নিয়ে আলোচনা করেন।
শেষ কথা
বই লেখার মতই বইয়ের রিভিউ ভালোভোবে লেখাও একটা সাহিত্যকর্ম। এজন্যও মুন্সিয়ানা থাকতে হয়, বই পড়ার পর রিভিউ লিখতে দারুণ সক্ষমতার দরকার হয়। মাথায় রাখুন- অনেক সময় বই আলোচনাটিও একটি সাহিত্যকীর্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। আর এর জন্য সমস্ত কৃতিত্ব দিতে হবে রিভিউয়ারের ইচ্ছা, জানার আগ্রহ, মৌলিক কিছু করার প্রচেষ্টা তথা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকে।