মো. তৌহিদ হোসেন : স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে গড়তে সর্বজনগ্রাহ্য সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। সরকার পরিবর্তনে জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বার বার পরিবর্তন এসেছে; যা হওয়া অনুচিত। আমাদের আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমী করে গড়তে এমন সুশিক্ষা দরকার- যা প্রকৃতার্থেই জাতির মেরুদন্ড হবে, জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করবে এবং জাতির উন্নতির জন্য উপযুক্ত তরুণ সমাজ তৈরি করবে।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূলভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। ভিত্তি মজবুত হলে ভবনের স্থায়িত্ব যেমন বেশি, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষা সঠিক হলে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নির্মিত সুশিক্ষার বিশাল প্রাসাদ উন্নত জাতি গঠনে অধিকতর সফল। তাই উন্নত দেশের শিক্ষা পরিচালনা পদ্ধতি এদেশে প্রয়োগে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানীতি প্রণয়নের নীতি নির্ধারকগণ কিছু বিষয় বিবেচনা করতে পারেন।
২০১৮ সালের ৩১ নভেম্বর জাপানের নিজিগাওকা প্রাথমিক বিদ্যালয় (Nijigaoka Elementary School) পরিদর্শন করি। টোকিও’র পাশে কানাগাওয়া কেনের কাওয়াসাকি শহরে অবস্থিত স্কুলটিকে জাপানিজরা বলে নিজিগাওয়াকা শোগাক্কো। ফুটবল-বাস্কেটবল-বেসবল খেলার মাঠ, মিউজিয়াম, একাডেমিক ভবন, ব্যবহারিক ক্লাসরুম, সুইমিং পুলসহ প্রায় ১০০ বিঘা আয়তনের ক্যাম্পাস রয়েছে। শারীরিক শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়।
সকাল সাড়ে আটটায় সাক্ষাতের সময় ছিল। পূর্বনির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পূর্বে পৌঁছি। সাথে ছিল জাপানে আইটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত শ্যালক মো: সাইদুজ্জামান (শিমুল)। ঠিক সাড়ে ৮টায় একজন জাপানি জিজ্ঞালেন- বাংলাদেশি? আমরা ইয়েস বলার সাথে সাথে অধ্যক্ষ ইমানো তাদাশির রুমে নিয়ে গেলেন। তিনি সহকারি অধ্যক্ষ ইতো ইচিরোর সাথে পরিচয় করালেন। এরপর চা আপ্যায়ন করিয়ে আন্তরিকভাবে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিলেন।
জাপানে ছয় বছরের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় (shogakko), তিন বছরের জন্য নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় (chugakko), তিন বছরের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (kotogakko, or Koko), দুই অথবা চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় (Daigakko)। প্রাথমিক শিক্ষার পূর্বে শিশুদেরকে কিন্ডারগার্টেন (yochien) আর ডে-কেয়ার সেন্টারে (Hoikuen) পাঠানো হয়। বয়স বিবেচনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী প্রবেশের পূর্বে (৩-৫) বছর এই সময় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (৬-১১) বছর, জুনিয়র হাইস্কুলে/মিডল স্কুলে (১২-১৪) বছর এবং সিনিয়র হাইস্কুলে (১৫-১৭) বছরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেয়া হয়। আর ভোকেশনাল স্কুলে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় (২-৪) বছর মেয়াদী হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক, বাধ্যতামূলক এবং সরকারি। সারাদেশে একই শিক্ষা, একই মানের শিক্ষা, একইভাবে পরিচালিত। প্রতিষ্ঠানের মান বিভিন্ন রকম না হওয়ায় ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। পঞ্চম শ্রেনিতে নেই পিইসি এর মতো পরীক্ষা। সারা বছরই মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী ক্লাসে শিক্ষার্থীরা প্রমোশন পায়। আলাদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষা নেই। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সকলের জন্য ইতিহাস, নৈতিকতা, আর্ট, জাপানি ভাষা, বিজ্ঞান শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ৪র্থ শ্রেণি থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত এর পাশাপাশি ইংরেজি, গণিত, মিউজিক এবং গার্হস্থ অর্থনীতি রয়েছে।
শিক্ষার কারিকুলাম জানানোর পর ক্লাসরুম ভিজিটে নিয়ে যান অধ্যক্ষ। প্রতিটি ক্লাসই যেন ব্যবহারিক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় এবং আনন্দঘন পরিবেশে চলছে। বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাস রুমে অণুবিক্ষণ যন্ত্র, মানুষের কংকাল, টেলিস্কোপসহ মহাকাশ গবেষণার আধুনিক অনেক যন্ত্রপাতি দেখলাম। মিউজিক ক্লাসে মঞ্চসহ কঙ্গো, তবলা, হারমোনিয়াম, গিটার ইত্যাদি দেখলাম। ব্যাচভিত্তিক শিক্ষার্থীদের তালিকাসহ গ্রুপ ছবি রয়েছে।
গার্হস্থ্য অর্থনীতির ব্যবহারিক ক্লাসে রান্নার চুলা, হাঁড়ি, প্লেট ও সেলাই মেশিনের মতো ব্যবহারিক উপকরণ রয়েছে। রয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে তৈরি রুমাল ও পোশাক। আর্টের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি, ছবির নিচে নাম ও আইডি নং লেখা আছে। ইতিহাসের ক্লাসরুমের বাইরে জাপানের সম্পূর্ণ ইতিহাস, শাসকদের ছবি সম্বলিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দেওয়ালের গায়ে আর্ট পেপারে সেঁটে দেয়া আছে।
এক রুমে তিনজন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য সাতজন শিক্ষক থাকার বিষয়ে অধ্যক্ষ জানান, এরা পিছিয়ে পড়া ছাত্র। এদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষকের সাথে বাহিরের প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ এসেছেন পিছিয়ে পড়ার কারণ জেনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে। প্রতিবন্ধিদের ক্লাসে টিভি ছাড়া ছিল এবং গানের তালে শিক্ষক ও প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী নাঁচছিলেন।
এভাবে সব ক্লাসে তত্ত্বীয় বিষয়ের চেয়ে ব্যবহারিক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানে টিম স্পিরিট ভালো মানের। শিক্ষক মিলনায়তনে একজন শিক্ষককেও বসে থাকতে দেখলাম না। আর যে ক্লাসে গিয়েছি শিক্ষকদের স্বত:স্ফূর্ত অভিবাদন চমৎকার টিম স্পিরিটের সাক্ষ্য দেয়। অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে ছবি তুলতে বলায় জুতা খুলে ক্লাসরুমে ঢুকলাম। বের হবার সময় দেখলাম একজন শিক্ষিকা অধ্যক্ষের জুতা ঠিক করে দিলেন। লাইব্রেরীতে ছেলে-মেয়েদের স্বতস্ফূ:ভাবে লাইব্রেরী ওয়ার্ক করতে দেখলাম।
মানুষদেরকে সম্মান দেওয়ার অপরূপ শিক্ষা এখানে রয়েছে। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য অধ্যক্ষ ছবি তুলতে চাইলে ওনার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এরপর নিজের চেয়ারে জোর করে আমাকে বসিয়ে অধ্যক্ষ পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। বাইরের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক আসার পর ওনার কোট খুলে নিয়ে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখেন সহকারী অধ্যক্ষ। এক ঘন্টা সময় নির্ধারিত থাকলেও দুই ঘন্টা সময় দিলেন এবং স্কুল থেকে গাড়িতে ফিরে আসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
গভীর মমতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে স্কুলবাসে সবাইকে আসতে হয়, বাবা-মায়ের গাড়ি থাকলেও নিজ গাড়িতে আসা যায় না। সকলের জন্য একই স্কুলবাস, একই ড্রেস, স্কুলে একই খাবার এবং একই রকম স্কুলব্যাগ। যাতে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে একই মানের হয়ে গড়ে উঠে।
জাপানে আমি যে বাসায় ছিলাম তাঁর উপর তলায় এক বাংলাদেশি মেয়ে ঐ স্কুলের ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ঐ ক্লাসে যেয়ে অধ্যক্ষ তার ব্যাগ ও তিনজন ফিলিপাইনের শিক্ষার্থীর ব্যাগ দেখালেন। একজন অধ্যক্ষ একই ধরনের ব্যাগের মধ্যে নাম না দেখেই শিক্ষার্থীর ব্যাগ দেখিয়ে দিলেন! এদের সিস্টেম উন্নত। শিক্ষকগণ পড়ান অপরিসীম আন্তরিকতা নিয়ে। কোনো কোচিং-প্রাইভেটের ব্যবস্থা নেই।
কোনো শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়লে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক পেরেশান থাকেন। অযত্নে-অবহেলায় শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ছে কি-না! শিশুর শিক্ষা তার ভবিষ্যৎ জীবনের বুনিয়াদ তৈরি করে। নৈতিক কøাসের মাধ্যমে এরা অপরূপ ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি হয়। মিথ্যা কথা, প্রতারণা, মানুষকে ঠকানো এরা বুঝেই না। দেশের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে এরা বেড়ে উঠে।
স্কুলের নৈতিক শিক্ষা সারাজীবন পালন করে। বাসে-ট্রেনে উঠতে লাইনে দাঁড়ানো, বাসট্রেনে টেলিফোন করা অথবা কথা বলা থেকে বিরত থাকে অন্যের ডিসটার্ব হবে এইজন্য। কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধে কখনো কেউ ঝামেলা করে না। এই শিক্ষা তারা পায় শিশু বয়স থেকে। কারো দ্বারা কারো ন্যূনতম ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে জাতিটিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে ফেলে দেওয়ার অবস্থা করা হয়েছিল। সেই জাতি আজ পৃথিবীর উন্নত জাতি। যারা আজ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে সাহায্য পাঠায়। এর পিছনে মৌলিকভাবে কাজ করছে তাদের শিক্ষা।
আমাদের উন্নয়নের বাধা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশে ১৩ রকমের প্রাথমিক শিক্ষা রয়েছে। যেমন- ধর্মীয় ক্ষেত্রে আলিয়া নিসাবের ইবতেদায়ী শ্রেণি, কওমী নিসাবের প্রাথমিক শিক্ষা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয় পরিচালিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই পরিচালিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেনের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ইত্যাদি।
ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাক্রমের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি ভিন্ন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরি করে। যারা বড় হয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনার পরিবর্তে পরস্পর সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে যা জাতীয় উন্নয়নের বড় অন্তরায়। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে এদেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল; যা ধর্মের প্রয়োজন পূরণ করতো এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনও পূরণ করতো। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে লর্ড ম্যাকলে প্রবর্তিত দ্বিমুখী শিক্ষা অর্থাৎ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং স্কুল-কলেজ কেন্দ্রিক সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলো। আর মূল সাধারণ শিক্ষায় ধর্মকে বাদ দেয়া হলো। এদেশের কিছু লোককে দোভাষী ও কেরানী তৈরির জন্য এ ব্যবস্থা করা হলো।
এই ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি তথা ভাগ কর শাসন কর নীতিতে শিক্ষাব্যবস্থা দ্বিধা বিভক্ত করা হলো। আজও ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার নামে দেশে গড়ে উঠা বিভিন্ন রকমের প্রতিষ্ঠান দেশপ্রেমী প্রজন্ম গড়ে তোলে সমৃদ্ধ ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে একই শিক্ষাক্রমের অধীনে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হওয়া জরুরি।
যে শিক্ষায় মানুষ উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে এবং আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বমানের সুযোগ্য নাগরিক হবে। এক্ষেত্রে জাপানসহ উন্নত দেশগুলোর মডেলকে সামনে রেখে ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিত। সঠিক প্রাথমিক শিক্ষায় জাতির মজবুত ভিত্তি তৈরিতে সফল ভূমিকা পালন করতে পারে।