মায়ের ভালোবাসার কাছে হেরে যায় সব সংকীর্ণতা

আনিসুর রহমান এরশাদ

মা সবচেয়ে সুন্দর ও মিষ্টি-মধুর শব্দ। সবারই তুলনাহীন প্রিয় শব্দ মা। তাইতো দেশকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে বলেছে দেশমাতা, কবি কবিতাকে-প্রকৃতিকে ভালোবেসেও বলেছে মা। মা মানে সততা, মা মানে নিশ্চয়তা, মা মানে নিরাপত্তা, মা মানে অস্তিত্ব, মা মানে পরম আশ্রয়, মা মানে একরাশ অন্ধকারে এক বুক ভালোবাসা। ‘মা’ যেন একশব্দের পৃথিবী; মা’তে শুরু এবং মা’তেই শেষ। মা মমতাময়ী, চিরসুন্দর, চির শাশ্বত। মা হচ্ছেন- সন্তানের টোল গড়া গালের হাসি, দুষ্টুমির আদরমাখা বকুনি, সমস্ত বায়না পূরণের স্টোর হাউজ, স্নেহ ভালোবাসায় ভরা মুখ। মায়ের দিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন ভালোবাসার গভীরতার কাছে, সমুদ্রও হেরে যায়, হেরে যায় সব সংকীর্ণতা। মা সন্তানের শিক্ষক, প্রশিক্ষক এবং বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা। হযরত হাওয়া (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মরিয়ম (আ.) এবং অতঃপর..। মা যেভাবে সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখেন, পাশে থেকেও মায়ের প্রতি তেমনভাবে খেয়াল রাখতে কখনো পারে না সন্তান। সবসময় এগিয়ে থাকেন মা, ত্যাগ স্বীকার করেন মা; আর ঋণী করেন সন্তানকে। দূরে কিংবা কাছে সবসময় মায়ের ভালো থাকা কামনা করে সন্তান, জানায় সশ্রদ্ধ সালাম।

সন্তানের স্বপ্ন দেখার উৎস মা

সৌন্দর্য, মুক্তি, অধিকার ও সম্মানের প্রতীক মা। মা সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার উৎস, সবচেয়ে আপন। মাকে ঘিরে থাকা অজস্ত্র স্মৃতিতে মনের ভিতর সৃষ্টি হওয়া অনুভূতির কাছে আকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মা মানসিক প্রশান্তির অসাধারণ উৎস। জাতি, ধর্ম, দেশাচার সবকিছুর উর্ধ্বে মা। মায়ের নেই কোনো উপমা, তুলনা।  প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার মা অদ্বিতীয়। মা উচ্চারণের সাথে সাথেই সন্তানের মনের ভিতর এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। যে অনুভূতি মায়ের সাথে সন্তানের মনের বিনি সুতার মালা সৃষ্টি করে। জন্মের পর প্রথম আমরা কেউ আকাশ দেখিনি, মাকেই দেখেছি। পৃথিবীতে আর কাউকেই এত কষ্ট দেইনি, যত কষ্ট মাকে দিয়েছি। শিশু পৃথিবীতে তার মাকে চিনেই জন্মগ্রহণ করে, এরপর মা তাকে তার বাবাকে চেনায়।

মা কখনো সন্তানকে ছেড়ে যান না

লুসিয়া মে অরকটের বলেন, ‘মা সব কিছু ক্ষমা করে দেন। পৃথিবীর সবাই ছেড়ে গেলেও মা কখনো সন্তানকে ছেড়ে যান না।’

মেসুত ওজিল বলেন, ‘আমার মা আমাকে প্রতিদিন বেঁচে থাকা শিখিয়েছেন।’

আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘যার মা আছে, সে কখনো গরীব নয়।’

রবার্ট ব্রাউনিং বলেন, ‘সব ভালোবাসার শুরু এবং শেষ হয় মাতৃত্বে।’

এডউইন চ্যাপিন বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো শক্তি, সৌন্দর্য কিংবা বীরত্ব মায়ের ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়।’

এরিচ ফ্রম বলেন, ‘মায়ের ভালোবাসাতেই শান্তি। এটা অর্জন করতে হয় না। এটার জন্য যোগ্যও হতে হয় না।’

সাব্বির রহমান বলেন, ‘মায়ের ভালোবাসা হয়তো পৃথিবীর কোনো দাড়িপাল্লায় মাপা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সব কিছু পরিবর্তনশীল কিন্তু মায়ের ভালোবাসা কখনো পরিবর্তন হয় না।’

মার্ক জাকারবার্গ বলেন, ‘মা হওয়া খুবই কঠিন বিষয়। যখন আমাদের সন্তান পৃথিবীতে এলো, তখন থেকেই প্রিসিলা চ্যানর রাতে ঘুমানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল।’

সবচেয়ে দক্ষ অলরাউন্ডার মা

মাকে নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মা অনেক কষ্ট করেছে কিন্তু কখনো তা মুখ খুলে বলেনি।’

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বলেন, ‘মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমার মা ও অন্যান্য মায়েরা যারা আমার জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। আপনার মাকে বলুন, তাকে আপনি ভালোবাসেন, তাকে জড়িয়ে ধরুন। আর ভালোবাসা অনুভব করুন।’

শবনম ফারিয়া বলেন, ‘আমার কাছে সৃষ্টির সেরা নেয়ামত হচ্ছে আমার আম্মু।’

চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘মায়ের মুখের হাসিটাই আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ, সকল মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।’

সাকিব আল হাসান বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ অলরাউন্ডার আমাদের এই মায়েরাই। পরিবারের সবদিক ঠিকঠাক রাখতে মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।’

মুশফিকুর রহিম বলেন, ‘মা মানেই বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও অনিন্দ্য আশীর্বাদ।’

প্রিন্স হ্যারি বলেন, ‘আমার মা ছিলেন ভেতর ও বাইরে শিশুর মতো।’

রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘সুযোগ পেলে অন্যকে সাহায্য করতে ছোটবেলা হতেই শিখিয়েছে মা।’

হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ‘মা হলো পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যেখানে আমরা আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট জমা রাখি এবং বিনিময়ে নেই বিনাসুদে অকৃত্রিম ভালোবাসা।’

মিচ আলবোম বলেন, ‘মায়ের চোখে তাকালেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ আর নিখাদ ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়।’

আব্রাহাম লিঙ্কন বলেন, ‘মা আমার কাছে দেবদূত। আমি যা হয়েছি কিংবা যা হতে চাই সব কিছুর জন্যই আমার মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ।’

মায়ের মতো ত্যাগী আর কেউ নন

মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া আনন্দের, মায়ের বকুনিও মিষ্টি। মাকে কেন্দ্র করে অজস্র স্মৃতি সন্তানের হৃদয়ে ঘুরপাক খায়। মায়ের ত্যাগ-অবদান সীমাহীন। মাকে ছোট করে কেউ বড় হতে পারে না, মাকে হারিয়ে জিততে পারে না কোনো সন্তান। কারণ মায়ের সন্তুষ্টি সন্তানের জীবনের সার্থকতার মানদণ্ড, মাকে ভুলে যাওয়ার মানে এই জগৎকেই ভুলে যাওয়া। যে মায়ের মন চিনে না, মায়ের আবেগ-অনুভূতিকে বুঝে না, মায়ের চোখের ভাষাকে সম্মান করে না- সে নিজের অস্তিত্বকেই অবমূল্যায়ন করে। যখন সন্তান থাকে অসহায়, মা সহায় হয়। মায়ের স্বপ্ন-বিশ্বাস জুড়ে সন্তানের দৃপ্ত পদচারণা থাকে। সন্তানের সুখ-শান্তি-সাফল্যের জন্য যত মা নিজের ভালোলাগা-পছন্দ-আরাম ত্যাগ করেছেন, অত ত্যাগী আর কেউ নন। সন্তানের কারণে মায়ের যত নির্ঘুম রাত কেটেছে, যত অশ্রু আর রক্ত ঝরেছে- আর কারো ততটা নয়। একজন মা যতটা মুগ্ধ হন জোৎস্না রাতে চাঁদ-তারায় ভরা নীলাকাশ দেখে, সাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার ঢেউ দেখে, সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির রূপ দেখে; তার চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্ত হন সন্তানের মুখ দেখে। তাইতো রজব তাইয়েব এরদোগান বলেন, ‘মাতৃত্বকে অস্বীকারকারী নারীরা অকার্যকর এবং অসম্পূর্ণ। পেশাগত সফলতা সন্তান ধারণের পথে বাধা হওয়া উচিত নয়।’

প্রত্যেক সন্তানই মায়ের কাছে ঋণী

যখন সন্তানের মুখে অর্থপূর্ণ কোনো ভাষা থাকে না, তখনো মা বুঝেন তার প্রয়োজন-চাহিদা। সন্তানের বলার আগেই যিনি নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে প্রস্তুত থাকেন তিনি মা। মা এই জগৎ থেকে চলে গেলেও সন্তান আমরণ অন্তরে লালন করে মায়ের স্মৃতি। সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক শুনে আনন্দিত হয় না, এমন কোনো মা নেই; আবার মাকে কাছে পেয়ে আনন্দিত হয় না এমন কোনো  সন্তানও স্বাভাবিক নয়। মায়ের অধিকারকে উপেক্ষাকারী বড়ই অকৃতজ্ঞ ও পাপিষ্ঠ। সু সন্তান যেমন স্রষ্টার পক্ষ থেকে মায়ের জন্য সেরা উপহার, তেমনি মাও সন্তানের জন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে এক মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ  দান। নিঃসন্তান মা বা সন্তান হারানো মায়ের মনের মাঝেও সন্তানের স্মৃতি চির জাগরূক থাকে। আর সন্তানতো মায়ের ভালোলাগার অফুরন্ত উৎস, নতুন কোনো সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখায় মানসিক প্রশান্তির ছোঁয়া, অর্জনের আনন্দ বা প্রাপ্তির গর্ব। এমন কোনো সন্তান নেই যার পেছনে মায়ের ভূমিকা নেই, কিন্তু এমন অনেক মা আছেন যাদের পেছনে সন্তানের কোনো ভূমিকা নেই। প্রত্যেক সন্তানই মায়ের কাছে ঋণী, কিন্তু কোনো মা সন্তানের কাছে ঋণী নয়। মা হওয়ার মাঝে আছে সৃষ্টির আনন্দ, জীবনের এক ধরনের পূর্ণতা।

সন্তানের মানসিক প্রশান্তির উৎস মা

মা ভালোলাগা এক মমতার বন্ধন। অধিকাংশ সন্তানের কাছেই তার মা-ই আদর্শ মা। মায়ের কথা, মায়ের হাসি শয়নে-জাগরণে সন্তানের মানসপটে ভেসে উঠবেই। মায়ের আদর আজীবন লেগে থাকে সন্তানের গায়ে, শরীরে, মুখে। মায়ের সাথে সন্তানের থাকে নিবিড় সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক। এই সম্পর্ক গর্ভধারিণী মাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর মা নিমিষে ভুলে যান যন্ত্রণা, সন্তানের মুখ দেখে মার মুখে ফুটে ওঠে স্বর্গীয় হাসি। প্রতিটি মায়ের কাছে তার সন্তানের- হাসিমুখই সবচেয়ে সুন্দর। সন্তানের মানসিক প্রশান্তির উৎস মা আর মায়ের মানসিক প্রশান্তির উৎস সন্তান। অধিকাংশ মা সন্তানের জন্য বড়ই স্নেহশীলা, খুব ধৈর্যশীল, দায়িত্বপরায়ণ ও সহজ-সরল নারী। মায়ের মতো এত আদর, স্নেহ, অগাধ ভালোবাসা আর কলিজা উজার করা প্রেম কোথাও পাওয়া যায় না। মায়ের অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সন্তানকে মুগ্ধ করে, মর্মে মর্মে অনুভব করায়, মনে প্রশান্তি আনে। তাই মা ও সন্তান একে অপরের পরিপূরক। একজন ছাড়া অপরজন অপূর্ণ। সন্তানের আনন্দ-সুখ-ব্যথা-বেদনার মাঝে একাত্ম হয়ে থাকে মায়ের আনন্দ-বেদনা সবকিছু।

সন্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মা

সর্বংসহা মায়ের স্নেহময় শীতল ভালোবাসা সন্তানকে নতুন গতি দেয়। সন্তানকে মানব সম্পদে উন্নয়নে মায়ের চেষ্টা চলে অবিরাম। মা তার জীবন-যৌবন প্রচেষ্টার শেষ বিন্দুটুকু বিলিয়ে দিয়ে সন্তানের জন্য অসামান্য-অমূল্য-অপরিশোধ্য অবদান রাখেন। মা সন্তানের জন্য পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক-অভিভাবক। মাতৃত্বের শীতলতা এমন যার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। মা-ই সুখ দুঃখের নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পরম আশ্রয়, জীবনের সবচেয়ে বড় পাথেয়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার উৎস। প্রগাঢ় আদর ও মমত্ববোধের কারণে মা প্রতিকূল পৃথিবীতে সন্তানকে ছায়া দেন। জন্মদায়িনী মা জননীর উষ্ণগর্ভ, বুকের দুধ, স্নেহ-মমতা-সোহাগে জীবন হয় বিকশিত। সন্তানের হৃৎস্পন্দন মা সুখ-দুঃখ আর আশা-আকাক্সক্ষার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। মায়ের আশা-প্রত্যাশা সন্তানকে ঘিরে। মায়ের সান্নিধ্য দুঃখ ভোলায়, হালকা হয় অনেক কষ্ট। মা পাশে থাকা মানে পৃথিবীতে স্বর্গীয় সুখ পাওয়া, মনের সতেজতা বৃদ্ধি। মায়ের সান্ত্বনা আর আশার বাণীতে মন সতেজ হয় ভোরের আলোর মতো। মা মানসসত্তার বিকাশে সহায়ক। বিশ্বের সব সভ্যতার বিকাশের পথে রয়েছে মাতৃত্বের অপরিমেয় অবদান।

মায়ের ভালোবাসা সীমাহীন

সন্তান-মায়ের সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। মায়ের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রতিটি সন্তানেরই কাম্য হওয়া উচিত। মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসলে বার্ধক্যেও তাকে অসুস্থ-দুর্বল দেখে সন্তান নীরব থাকবে না। মায়ের দিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন ভালোবাসা ও নিরাপত্তার মাঝে থেকে তার যথাযথ মূল্যায়নের অনুভূতি সক্রিয় হোক, সচল হয়ে উঠুক সবার হৃদয়ের গভীরতা। সন্তানের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায় মায়ের ভালোবাসার কাছে। সন্তানের সব দুঃখ দূর হয়ে যায় মাকে পাশে পেলে। মা চোখের অশ্রু আঁচলে মুছে মুখে হাসি ফুটায় এবং পিঠ চাপড়ে উৎসাহ জুগিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখায়। মা সন্তানের চোখের মণি, ভালোবাসার ধন, পৃথিবীর সব মণি মুক্তা রত্নের থেকেও দামি। মা সন্তানের হৃদয় মন জুড়ে থাকে। আর কেউ নেই মায়ের মতন, সবচেয়ে প্রিয় মা।  মার কাছে গেলে সবচেয়ে সুখী মনে হয়। মার হাত মাথায় পেলে স্বর্গসুখ পেয়েছি বোধ হয়। মা ছাড়া আর কেউ অমন করে সন্তানকে নিয়ে ভাবে না। তাইতো মায়ের ভালোবাসার কাছে জগৎটাকেই তুচ্ছ মনে হয়। সন্তানের সুখেই মায়ের অন্তহীন সুখ, সন্তানের হাসিমুখ ভোলায় মায়ের দুঃখ। সন্তানের পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলানো, স্বপ্ন আশা ভরে বুকে জড়ানোতো মায়েরই কাজ। মমতাময়ী নয়ন সদা খুঁজে ফিরে, তার প্রিয় সন্তান কখন বাড়ি ফেরে।

সন্তানকে গড়ার নিপুণ কারিগর মা

মেধা, শ্রম ও মমতা দিয়ে সন্তানদের বড় করে তোলার সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব মায়ের। সন্তানকে সুশিক্ষিত-সুনাগরিক-সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম নিপুণ কারিগরও মা। সন্তান  প্রতিষ্ঠিত হলে মাকে সফল মা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজ। সন্তানদের ‘মানুষের মতো মানুষ’ করাতেই মায়ের বড় আনন্দ। অনেক বাবা সারাজীবন ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সময় দিতে না পারলেও যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের জন্য সময় বের করার অলৌকিক ক্ষমতা মায়েদের রয়েছে। সন্তানকে জন্ম দিয়েই মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছেন। যে ঋণ কোনোদিনই পরিশোধ করার মতো নয়। তাই সন্তানের উচিত মাকে বেশি বেশি ভালোবাসা, সময় দেয়া, মায়ের প্রতি আরো যত্নবান হওয়া, বার্ধক্যেও মাকে মায়ার বন্ধনে আগলে রাখা, মায়ের সেবা-যত্নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়া। কোনো মায়ের  ঠিকানা যেনো না হয় বৃদ্ধাশ্রম। যে সন্তানের আগমনে মা হেসেছিলেন, সেই সন্তানের কর্মকাণ্ডে যেন কোনো মাকে কাঁদতে না হয়। যাকে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন তার কারণেই দুঃখ নিয়ে যাতে চিরবিদায় নিতে না হয়। একে একে একটি একটি করে জীবনের সিঁড়ি পার হয়ে কোনো সন্তানের মায়ের অবদানকে ভুলে যাওয়া অমানবিক। সন্তানের খুশিতেই যাদের আনন্দ, সন্তানের দুঃখেই যাদের বেদনা- তাদেরকে সন্তান অসম্মান করবে এটা অযৌক্তিক। সন্তান যদি একজন ভালো মানুষ হয় তবেই মা তার মাতৃত্বকে সার্থক মনে করে, গৌরবে চিরভাস্বর হয়।

মাকে মনে পড়ে

আদিফার দোলনা ঠেলতে ঠেলতে অকারণেই আমার দোলনা ঠেলার সময় মায়ের গুনগুনিয়ে গাওয়া সুর কানে বাজে! আমার মাকে এখন আর গান গাইতে শুনি না। তবে ছোটবেলায় ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতেন বলে মনে পড়ে! ঘরে ছনের ছাউনি, মাটির বেড়া, সময়মত নতুন ছন লাগাতে না পারায় ঘরের ভেতরে বৃষ্টির পানি; তবু কেরোসিনে জ্বালানো হারিকেন আর কুপির নিভু নিভু আলোতেই লেখাপড়া করিয়েছেন মা। সলতেটা ঠিক করা, কালো চিমনিটা পরিষ্কার করা, কেরোসিন মজুত আছে কিনা তা নিয়ে মাকে ভাবতে হয়েছে। মা কখনো কোনো সৌখিনতা করেননি, সংসারের প্রয়োজনে নিজের গহনাও হাসিমুখে বিক্রি করেছেন।

সন্তানদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে হাস-মুরগি-গরু পালন, ফলের গাছ লাগানো ও শাক-সবজি নিজে চাষ করেছেন। নিদারুণ সংকটের মধ্যেও সন্তানদের জন্য দুধ-ডিম-মাছের ব্যবস্থা করেছেন। আব্বা বিদেশে থাকা অবস্থায় ধান মাড়াই, ধানের মলন দেয়া, খড়ের পালা দেয়া কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ নিয়েও চিন্তা করতে হয়েছে মাকে। মাকে সাহায্য করার মতো বড় হবার পর আমাকে পড়ালেখার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছেন। ৮-১২ টাকা কেজি দুধ কিংবা ৬-৮ টাকা হালি ডিম নিয়ে যাকে ভাবতে দেখতাম তিনিই মাসে কয়েক হাজার টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। আজো বিদায় বেলায় মায়ের চোখের অশ্রু দেখি, নিজে বাবা হবার পরও আমাকে নিয়ে মায়ের উদ্বেগে পরিবর্তন দেখি না।

ঠিকমতো খেয়ে নিও, শরীরের প্রতি খেয়াল রেখো ইত্যাদি। দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে আমার যে উদ্বেগ আর আমাকে নিয়ে এখনো মায়ের যে উদ্বেগ তাতে তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না। ইলেট্রিসিটি আসার আগে গ্রামে বৃক্ষের ছায়াঘেরা নির্জন বাড়ির নিঝুম বারান্দায় মায়ের পাশে বসে অন্ধকার রাতে কেরোসিন তেল দিয়ে জ¦লা কুপির আলোয় পুথি পড়ার আসর ভুলিনি। গভীর রাতে ভূতের আনাগোনার ভয়, ঘরের দরজায় খিল এঁটে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো, ঈদে  নতুন জামা-জুতা পরে মাকে সালাম করার স্মৃতি আজো মনে পড়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top