সাখাওয়াত হোসেন মিজান : আল্লাহর নেয়ামতগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট নেয়ামত হলো শিশু। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও আর্কষনীয় বিষয়ও হলো শিশু। শিশু এক অপার বিস্ময়। তার সেই বিস্ময়ের জগৎ নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, শিশুবিশেষজ্ঞ,মনোবিজ্ঞানীসহ অসংখ্য বিজ্ঞজন শিশুকে নিয়ে ভেবেছেন। শিশুর অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতুহল, অফুরন্ত আনন্দ ও উদ্যমের মতো মানবিক বিকাশ সাধনের জন্য পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা অপরিসীম। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পিতা-মাতাতো বটেই, আত্মীয়স্বজন, ও পাড়াপ্রতিবেশীদেরও শিশু সর্ম্পকে সম্যক ধারণা থাকা অতিব জরুরি।
শিশু কারা
শিশুর ইংরেজী শব্দ চাইল্ড। সাধারণত ০ থেকে ১৮ বছর বয়সের সকল ছেলে মেয়েকে শিশু বুঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় – মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়:সন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রুপ হচ্ছে শিশু। আর্ন্তজাতিক আইন – অনুসারে ১৮ বছরের নীচে প্রতিটি মানুষই শিশু। সর্বস্মতিক্রমে এই সংজ্ঞাটি গ্রহন করা হয়েছে এবং শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে গৃহীত সনদে (ইউএনসিআরসি) এ কথা বলা হয়েছে।
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। শিশুর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে চাইলে, শিশু জন্মের পর থেকে বয়:সন্ধিকাল পর্যন্ত পিতা – মাতা ও শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। একটি শিশুকে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমেই তার উজ্জল ভবিষ্যত নিশ্চিত করা সম্ভব। শিশু জন্মের প্রাক্কালেই তার ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে বাবা -মাকে বিশেষ কিছুদিকে সর্তক থাকতে হয়। শিশুর অধিকাংশ বাবা-মা শিশুর শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে অতিব সর্তক থাকেন কিন্তু অন্যান্য দিক বেমালুম ভুলে থাকেন। যা একটি শিশুর জন্য অতিব জরুরি।
দার্শনিক John Milton বলেছেন – “The childhood shows the man, as morning shows the day.” এই উক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের শৈশবকালের গুরুত্ব অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে শৈশবকালীন আচার- আচরণ, অভ্যাস, মনোভাব, আবেগ পরবর্তীতে ব্যক্তি জীবনে সুষ্ঠ-স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব গঠন ও সামঞ্জস্য বিধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
E.B. Hurlock (1978:4) এর ভাষায়- ‘’Early foundation are likely to be persistent. It is important that they be of the kind that will lead to good personal and social adjustment as the individual grows older.” এই উক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের শৈশবকালের গুরুত্ব অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, শৈশবকালীন আচার- আচরণ, অভ্যাস, মনোভাব, আবেগ পরবর্তীতে ব্যক্তি জীবনে সুষ্ঠ-স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব গঠন ও সামঞ্জস্য বিধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
এছাড়া শিশুর শারীরিক,মানসিক, আবেগিয়, সামাজিক বিকাশের জটিল কার্যক্রমের ভিত্তি এই স্তরেই গড়ে ওঠে। তাই, এই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্পর্শকাতর পর্যায়ে যদি কোনরুপ বাধা বিপত্তি বা অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাহলে বিকাশের ধারাও মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। দীর্ঘদিনের বৈজ্ঞানিক গবেষকরা তাই শৈশবকালকে ‘’More critical period” বলে অভিহিত করেছেন।
বিভিন্ন শরীরতত্ত্ববিদ ও মনোবিজ্ঞানিদের গবেষণাতে এই সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় । যেমন- S. Freud সর্বপ্রথম গবেষণাতে দেখিয়েছেন যে, শৈশবকালের বিরুপ অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে ব্যক্তিত্ব গঠনে অসামাজ্ঞস্যতা সৃষ্টি করে।
E.H. Erikson এ ক্ষেত্রে বলেছেন – শৈশবকাল হচ্ছে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার এমন একটি ঘটনাস্থল যেখানে আমাদের দোষ ও গুণগুলো ধীরে অথচ স্পষ্টভাবে বিকশিত এবং অনূভূত হয়।
Kaplan and Pokorny এ ক্ষেত্রে আরও দেখিয়েছেন- যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্করা শিশুকালে উপহাস, শাস্তি বা অন্যান্য অসুখকর অভিজ্ঞতায় ভীতু ছিলো তারা পরবর্তীতে নিজেদের আত্বমর্যাদাহীন মনে করে এবং নিজেদের সর্ম্পকে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতো।
উপরোক্ত বিভিন্ন গবেষণার প্রেক্ষিতে H.B. hurlock ব্যক্তি জীবনে শৈশবকালের প্রয়োজনীয়তার ০৪টি গুরোত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন- এগুলো হলো:-
০১. শিশুর শৈশবকালীন শিক্ষণ অভিজ্ঞতা বিকাশসূচক কার্যক্রম করে সমগ্র জীবন ব্যবস্থা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত করে।
০২. শৈশবকালীন যে কোন আচরণ খুব দ্রুত অভ্যাসে পরিণত হয়।
০৩. শিশুর আচরণ মনোভাব, বিশ্বাসের ভিত্তি শৈশবকালেই দৃঢ় হয়। এক্ষেত্রে পারিবারিক পরিবেশ ’ভালো’ বা ’খারাপ’, ’হিতকর’,বা ’অহিতকর’ হওয়ার শিক্ষা প্রদান করে।
০৪. শিশুর শৈশবকালীন কোন শিক্ষা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে পরবর্তী শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং সহযোগিতার দ্বারা পরিবতর্ন করা সম্ভব। শৈশবকালীন ভিত্তি পরিবর্তন অত্যন্ত কঠিন কাজ হওয়ায় এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় অর্থাৎ নির্দেশনা, বিকল্প পন্থা, শক্তিশালী প্রণোদনা সহায়তা করতে পারে।
অতএব, এ কথা স্পষ্ট যে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে আনন্দদায়ক শৈশব অতিব প্রয়োজন। শিশুর শৈশব যেন আনন্দদায়ক হয় সে জন্য অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন ও শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। মানুষের জীবন একটি চলমান প্রক্রিয়া। শিশুকাল থেকে এক সময় প্রাপ্ত বয়সে পরিণত হয়ে এ পৃথিবী ত্যাগ করে চলে যায় এটায় নিয়তি। এই শৈশবকাল থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে তার শরীরের বিকাশ ঘটতে থাকে যা তার আচরণের উপরও প্রভাব ফেলে থাকে।
একজন মানুষের দৈহিক সংগঠন ও বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের কর্মকান্ডের সুসমন্বিত প্রায়সই হচ্ছে বিকাশ। অন্যথায় এ বিকাশের পথ অর্থাৎ মানুষের সুষ্ঠ আচরণ প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে যে সকল বিষয় বাধা হয়ে দাড়ায় সেগুলোকে বিপত্তি হিসেবে ধরা হয়। এ সকল বিপত্তি মানুষের সুষ্ঠ বিকাশ ব্যাহত করে থাকে। তাই বিপত্তিগুলো ভালোভাবে জেনে সেগুলো মোকাবেলা করা অত্যন্ত জরুরি।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা
শিশুর শারীরিক আঘাত
দেহের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আঘাত বিশেষ করে মস্কিস্কের আঘাতের ফলে বিভিন্ন ধরনের বিচ্যত আচরণ লক্ষ্য করা যেতে পারে। শারিরীক আঘাতের ফলে ব্যক্তিত্বে সমস্যা দেখা যায়। ফলে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অসামঞ্জস্য আচরণ করে থাকে।
শিশুর শারিরিক অসুস্থতা
বিকাশের বিভিন্ন স্তর অনুযায়ি কতকগুলো রোগব্যাধি ’বিশেষ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- প্রাক-শৈশবকালে Respiratory ও Gastrointestinal – এর রোগব্যাধি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ৬/৮ বছরের শিশুদের পোলিও, হাম, হুপিংকাশি, জলবসন্ত, ডিপথেরিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন রোগব্যাধি ছাড়াও হজমের সমস্যা ও ঠান্ডা সমস্যা দেখা দেয়।
শিশুর অপুষ্টি
প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী নাদুস-নুদুস ছেলে-মেয়েদের পুষ্ট বা স্বাস্থ্যবান এবং ক্ষীণকায়দের অসাস্থ্যবান বলা হলেও ডাক্তারি গবেষণাতে এটা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, Chubby and skinny children are both suffering from malnutrition and neither is healthy. আর এ ধরনের অপুষ্টির অন্যতম কারণ দরিদ্রতা হলেও অসাস্থ্যকর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
ঘরোয়া পরিবেশ
শিশুর বর্ধন ও বিকাশের ক্ষেত্রে ঘরোয়া পরিবেশের বাধ্যবাধকতা অনেক সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন- সমবয়সীদের সাথে মিশতে না পারা, খেলার সুযোগ না পাওয়া, সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহন না করা বা পারিবারিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা, অতিরিক্ত ঘরকোণা স্বভাব শিশুর স্বভাবিক বিকাশের গতিকে ব্যাহত করে। এছাড়া মাতৃমৃত্যু, পিতা-মাতার বিচ্ছিন্নতাও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিবারের মধ্যে যখন দন্দ্ব দেখা দেয় বিশেষ করে পিতামাতার মধ্যে, তখন শিশুর আবেগিয় বিকাশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
আবেগীয় বঞ্চনা
সংকীর্ণ অর্থে আবেগীয় বঞ্চনা বলতে স্নেহ ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হওয়াকে বুঝালেও প্রকৃতপক্ষে স্নেহ, ভালোবাসা ছাড়াও, আনন্দ, উল্লাস, কৌতুহল প্রভৃতি বিভিন্ন সুখকর আবেগের যুক্তিসংঘত পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়াকে বুঝায়। বেশির ভাগ শিশুই দুর্ভাগ্যক্রমে এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠে যা তাদের মধ্যে ক্রোধ, ভয়,ঈর্ষা, হিংসা, প্রভৃতির জন্ম দেয়। উপরন্তু সুখকর আবেগের বঞ্চনা তাদেরকে ‘Emotionally stared’ করে তুলে ।
আবেগীয় বঞ্চনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কারণ লক্ষণীয়। যেমন- পিতা – মাতার অনুপস্থিতিতে বা তাদের কারোর মৃত্যুতে কোন প্রতিষ্ঠানভূক্ত হওয়া অথবা পিতা মাতার সামনেই তাদের কতৃর্ক অবহেলা, তিরস্কার, খারাপ ব্যবহার শিশুর মধ্যে এ ধরনের বঞ্চনার জন্ম দিতে পারে। এছাড়া শিশুর শৈশবকালীন বিভিন্ন বঞ্চনার ফলে মানসিক রোগের সঞ্চার ঘটে। যেমন- শিশুদের মৌখিকভাবে বিভিন্ন কারনে মনে কষ্ট দেয়ায় ফলে মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অথবা মায়ের স্নেহ মায়-মমতা থেকে বঞ্চিত হলে মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
স্নেহ-ভালোবাসার আধিক্যতা
স্নেহ, ভালোবাসার বঞ্চনা যেমন শিশুদের আবেগীয় বিকাশকে ব্যাহত করে তেমনি অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসাও বিপত্তি সৃষ্টি করে। যেসব পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি অতি উদগ্রীব বা অতি সোচ্চার থাকে তারা শিশুদেরকে অন্যদের প্রতি স্নেহ ভালোবাসা প্রদানের শিক্ষা দেয় না। বরং তারা তাদের শিশুদেরকে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে এবং অন্যের কাছ থেকে স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যাশা করতে উৎসাহ প্রদান করে।
এমতাবস্থায় শিশুরা অন্যের সাথে আবেগীয় সম্পর্ক সৃষ্টিতে র্ব্যথ হয়। এছাড়া অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসার আর একটি নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে, যেহেতু শিশুরা অল্প কয়েকজনের উপর নির্ভরশীল থাকে সেহেতু তাদের অনুপস্থিতিতে শিশুদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও নিরাপত্তাহীনতা জন্ম দেয় এবং তারা একাকী ও অসহায় হয়ে পড়ে।
অতিরিক্ত শাসন
অতিরিক্ত স্নেহ- ভালবাসা যেমন আবেগীয় বিকাশেক বাধাগ্রস্থ করে ঠিক তেমনি অতিরিক্ত শাসনও মানুষের আবেগীয় বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। যথা- শিশুর সহজাত স্বভাব হলো কোনো বিষয় সর্ম্পকে জানা, সে বার-বার তার বাবা-মার কাছে জানতে চায় কিন্তু তার পিতা-মাতা বা অন্য কেউ যদি তার কথা না শুনে তাকে চুপ থাকার জন্য শাসন করে তখন আবেগীয় বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।
অতিরিক্ত নির্ভশীলতা
মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে কিন্তু যদি আপনার সন্তানের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে না দিয়ে তার দায়িত্ব কর্তব্য পিতা – মাতা হিসেবে আপনি পালন করেন তবে সে আপনার প্রতি নিরর্ভশীল হয়ে পরবে এতে তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে।
সামাজিক বঞ্চনা
সমাজের জনগণের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের সুযোগ- সুবিধা হতে বঞ্চিত হওয়াকে সামাজিক বঞ্চনা বুঝায়। স্বাভাবিকভাবে শিশু যদি সমাজিক পরিবেশের সাথে মেশার সুযোগ না পায় তাহলে তার সামাজিক আচরণ শিক্ষার সুযোগও সীমিত হয়ে পরে। যার ফলে সামাজিক কাঠামো অর্থাৎ বাবা-মা, ভাই-বোন ও অন্যান্য সদস্যদের দ্বারাই সামাজিক বঞ্চনার সৃষ্টি হয়।
যেমন- পিতা-মাতার অযত্ন, অবহেলা, মনোযোগের অভাব, আচরণের কঠোরতা, মেলামেশার বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি শিশুর সামাজিকতায় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে । ফলে পরবর্তীতে স্কুল জীবনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং শিশুর মধ্যে একাকীত্ব ও অসাহায়বোধ জন্ম নেয়। দীর্ঘকালীন এ ধরনের সামাজিক বঞ্চনা শিশুর সামাজিক বিকাশে মারাত্নক প্রভাব ফেলে।
অতিরিক্ত নিয়মনিষ্টতা
পারিবারিক অথবা সামাজিক নিয়ম কানুন শিশুর বাক্তিত্ব বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিন্তু সেই নিয়ম কানুন যদি অত্যন্ত কঠোর হয় তবে, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেক বাবা-মা তার সন্তানদের নিজ থেকে কিছু করতে দেন না কিংবা অনেক নিয়ম শৃংঙ্খলে বেধে রাখেন ফলে শিশুর মানসিক বঞ্চনার শিকার হয়ে শিশু বিগড়ে যায়।
অসৎ সঙ্গ
কথায় আছে সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে স্বর্বনাশ। ঠিক তেমনি যখন কোন শিশু বা কিশোর সমাজের কোন অসৎ সংঙ্গের সাথে মিশতে থাকে এবং সমাজের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার খারাপ কাজ করতে থাকে তখন তার সামাজিক বিকাশে বিপত্তি ঘটে। একজন শিশু যদি উপরোক্ত বিপত্তিগুলো তার বয়:সন্ধি কাল পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারে তবে পরবর্তীতে সে একজন যোগ্য এবং সৎ নাগরিক হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে :-
বিকাশের প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণ
পারিবারিক পরিবেশ
শিশুর সামাজিক ও মনো:দৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রে ঘরোয়া পরিবেশ খুবই গুরূত্ব্পূর্ণ। পারিবারিক পরিবেশ হবে শিশুর অনুকুলে, শিশুর মানুসিক বিকাশে সকল কাজের ক্ষেত্রে হ্যাঁ বলুন। এটা কর না, ওদিকে যেও না, এটা খেও না অর্থাৎ না শব্দটা খুব কম ব্যবহার করতে হবে। সৃজনশীল কাজে অব্যস্থ করতে হবে। আপনার শিশুর হাতে দামি মোবাইল না দিয়ে বই কিনে দিন, বই পড়তে উৎসাহিত করুন, সন্তানের সাথে খেলাধুলা করুণ, গল্প করুণ, ঘুরতে নিয়ে যান এতে সামাজিক পরিবেশ সর্ম্পকে সম্যক ধারণা তৈরী হবে, মন ভাল থাকবে, অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে সর্ম্পক তৈরি হবে।
কিছুটা স্বাধীনতা
সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়মের বেড়াজালে না রেখে কিছু কাজ স্বাধীনভাবে করতে দিন। মাঝে মধ্যে বাজার থেকে কিছু কিনতে পাঠান এতে, তার অর্থনৈতিক বিষয়াদি সর্ম্পকে সম্যক ধারণা তৈরী হবে।
উৎসাহিত করা
আপনার সন্তানের বন্ধুবান্ধবদের সর্ম্পকে সঠিক ধারণা রাখুন, কার সাথে মিশে? কী করে? কোথায় যায়? ইত্যাদি বিষয় সর্ম্পকে সুস্পষ্ট খবর রাখুন। অসৎ সঙ্গ পরিহার করতে উৎসাহিত করুন।
প্রশংসা করা
ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস গড়ে তুলন। আপনার সন্তানের কাজ না করে দিয়ে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিন। তার কৃত কাজের প্রশংসা করুন।
প্রশ্নের উত্তর দেয়া
আপনার সন্তানকে অযথা বকা ঝকা না করে তাকে তার কৃত কাজ সর্ম্পকে পরিস্কার ধারণা দিন। আপনার সন্তানের যে কোনো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিন। তার যে কোন কৌতুহল মিটানোর চেষ্টা করুন তার কোনো প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাবেন না । আপনি তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিলে সে অন্য কোনো মাধ্যমে ভুল উত্তর জানতে পারে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ব্যক্তিত্ব বিকাশের পর্যায়ক্রম
সন্তানের সুস্পষ্ট বিকাশের জন্য মনোবিজ্ঞানি ’এরিকসন’ এর মানুষের সামাজিক, মানসিক, অথনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন দিকের সমন্বয় করে মনো-সামাজিক বিকাশ তত্ত্বের বিভিন্ন দিক লক্ষ্য করতে পারি। এ তত্ত্বে তিনি মানুষের জীবনব্যাপী ব্যক্তিত্ব বিকাশের পর্যায়ক্রমিক ধারা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিত্ব বিকাশের পর্যায়ক্রম সমূহকে ৮টি ভাবে বিভক্ত করেছেন।
মৌলিক বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাস
এ স্তর টি জন্ম থেকে অর্থাৎ ০ থেকে প্রায় ১৮ মাস পর্যন্ত ব্যাপৃত। এই সময় সাধারনত শিশুরা অসহায় ও পিতা-মাতার প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকে। তাই এই সময় পিতামাতার গহণযোগ্যতার বিবেচনায় শিশুদের মধ্যে জীবনের প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অনুভূতি জাগরিত হয়।
এ ক্ষেত্রে শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে পূরণ করা হয় অথাৎ সে যদি পিতা-মাতার যথাযথ আদর- যত্ন, স্নেহ-ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি অনুকুল থাকে তাহলে, তার পৃথিবী সর্ম্পকে ইতিবাচক ধারণা সুদৃঢ় হয় এবং বিশ্বাসবোধ জন্ম নেয়। অন্যদিকে, যদি তার মৌলিক চাহিদা পূরণ না হয় তবে তার পৃথিবী সর্ম্পকে অবিশ্বাস জন্ম নেয়। এরুপ ক্ষেত্রে শিশু পরবর্তী জীবনে সঠিক ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়।
স্বাধীনতা বনাম লজ্জা ও সন্দেহবোধ
সাধারণত ১৮ মাস থেকে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত এই স্তরের ব্যপ্তিকাল। এ পর্যায়ে শিশুদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতার্র্জনকাল এবং এক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা বাধা প্রদানকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দুই ধরনের মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে যা দুটি বিপরীতধর্মী অবস্থা সৃষ্টি করে। প্রথমত: এ পর্যায়ে শিশু যদি স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতার্জন করতে পারে এবং তা পিতা-মাতা বা অন্যকারো উৎসাহ পায় তবে, শিশুর নিজের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তথা স্বনিভর্রশীলতা এই পর্যায় থেকেই গড়ে উঠতে থাকে।
অন্যদিকে, শিশু যদি স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে মা- বাবা বা অন্য কারোর দ্বারা বাঁধা প্রাপ্ত হয় তাহলে তার মধ্যে লজ্জাবোধ জাগ্রত হয়। এছাড়া সব কাজে অতিশাসন, নিয়ন্ত্রণ বা কঠোরতা শিশুকে কোন কাজ করতে ভয়ের উদ্রেক ঘটাবে । এই অবস্থার ফলস্বরুপ শিশুর মধ্যে স্বাধীনতা- পরাধীনতার দ্বন্দ্ব জন্ম নিবে। যা তার ব্যক্তিত্বেও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ অন্তরায়স্বরুপ। কাজেই এক্ষেত্রে শিশুকে তার কাজের সর্ম্পূণভাবে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।
উদ্যোগ বনাম অপরাধবোধ
এই স্তরটি সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই স্তরে শিশু নিজ উদ্যোগে কিছু করার, জানার, এবং সংস্পর্শে আসার ইচ্ছা প্রবল হয় । এ সময় শিশুর মধ্যে নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং কল্পনাকে বাস্তবে কাজে লাগানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই স্তরে শিশুদের স্বাধীন কার্যক্রমের বিভিন্ন ভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপও অসম্ভব নয়।
তথাপি এই সময়ে শিশুর উৎসাহ উদ্দীপনার শক্তিকে যদি পিতা-মাতা বা অন্যান্যরা উৎসাহ দান করে, তাহলে পরবর্তীতে সে যে কোন কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষমর্তাজন করে এবং তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশ লাভ করে।
অন্যদিকে, যদি পিতামাতার কঠোর বাঁধা নিষেধ বা শাস্তির সম্মখীন হয় তাহলে তাদের মধ্যে অপরাধবোধ জন্ম নিবে। এর ফলে তারা স্বউদ্যোগে কিছু করতে দ্বিধাদ্বন্দে¦ও সম্মুখীন হবে। এই অবস্থায় তাদের মধ্যে অক্ষমতা ও অসহায়ত্ববোধ জাগ্রত করে। যা পরবর্তীতে সঠিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রতিবন্দ্বক হিসেবে কাজ করে।
অধ্যবসায় বনাম হীনমন্যতা
এই স্তর স্কুলগামী অর্থাৎ ০৬-১২ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত । এটাকে এরিকসন সুপ্তাবস্তার কাল বলেও অভিহিত করেছেন। এ পর্যায়ে শিশুরা কল্পনাকে পশ্চাতে রেখে বাস্তবতার দিকে ধাবিত হয় এবং একটি সুুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে চিহ্নিত করে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তা অর্জন এবং নিজেকে বিকশিত করার চেষ্টা করে। এ সময় শিশুরা পিতা-মাতা অর্থাৎ পারিবারিক পরিমন্ডলের বাইরের পরিবেশের সংর্স্পশে আসার আকাঙ্খা ব্যক্ত করে। এই অবস্থায় বাহ্যিক পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সঙ্গতিবিধান ও বন্ধুবান্দব, সহপাঠিদের সাথে আন্ত:ক্রিয়ার মাধ্যমে নিত্যনতুন আচরণ ও অভিজ্ঞতা আয়ত্ব করে।
এই অবস্থায় শিশুর মধ্যে দুটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রথমত : -এই স্তরে বাহ্যিক পরিবেশের সাথে যথাযথ সঙ্ঘতি বিধানের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এভাবে নতুন র্কায সম্পাদন ও অভিজ্ঞতা আয়ত্ব করার ফলে শিশুর মধ্যে পরিশ্রমী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং তার মধ্যে সন্তুষ্টিবোধ ও সাফল্য উপভোগ করার ইচ্ছা দৃঢ় হয়। এর ফলে তারা লেখা পড়া, খেলাধুলা ও অন্যান্য র্কাযে সফলতা প্রর্দশনে সক্ষম হয় ।
দ্বিতীয়ত : এই স্তরে শিশু যদি লক্ষ্যার্জনে বা পরিবেশের সাথে স্ঙ্গতিবিধানে ব্যর্থ হয় এবং অনুভব করে যে, সে তার সমবয়সীদের থেকে পিছিয়ে আছে, তাহলে তার মধ্যে হীনমন্যতা জন্ম নেয়। এ সময় শিশুরা নিজেদেরকে নিকৃষ্ট ও অকর্মণ্য ভাবতে শুরু করে। এই অবস্থা শিশুর মানসিক অবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তাই, এ পর্যায়ের শিশুর র্কায- সম্পাদনের সামর্থ্যকে যথাযথভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে।
আত্মপরিচয় বনাম ভূমিকার দ্বন্দ্ব
সাধারণত ১৩ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ কৈশোর ও বয়:সন্ধিকাল পর্যন্ত এই স্তরের বিস্তৃতি। এই পর্যায়ে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের প্রতি বেশী অনুগত থাকে এবং করণীয় বর্জনীয় বিষয়সমূহ চিহ্নিত করে এবং সে অনুযায়ী ভূমিকা পালনে উদ্যত হয়। এই সময়ে তাদের বিচক্ষণতা প্রখর এবং অহমবোধ সুদৃঢ় হয়। এ সময় তাদের সামাজিক বিভিন্ন বিষয়াবলী ও ভূমিকা তাদেরকে ভাবিয়ে তুলে । যার ফলে তারা প্রশ্নের মাধ্যমে আত্মপরিচয় খোঁজার চেষ্টা করে। এ সময় তাদের ধণাত্বক ও ঋণাত্বক দু’ধরনের মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে।
প্রথমতঃ এই স্তরে ছেলে-মেয়েরা নিজেদেরকে একজন আর্দশবান বা পরিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এ সময় সমাজে তাদের ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কে সুদৃঢ় চিন্তাভাবনা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে তাদের মধ্যে আত্ববিশ্বাস, উদ্যম ও স্বাধীন মানসিকতা জন্ম নেয় যা ধনাত্বক-পরিচয়বাহি। যা পরবর্তীতে সে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে।
দ্বিতীয়তঃ যে সব ছেলে-মেয়েরা সমাজে নিজের ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্ব বা সংশয় উপস্থিত হয় তারা ভবিষ্যৎ সর্ম্পকে কোন পরিকল্পনা গ্রহণে, এমনকি সমাজের কাছে যথাযথ পরিচিতি লাভে ব্যর্থ হয়। এ সময়ে তাদের মধ্যে ভূমিকার অস্পষ্টতা জন্ম নেয়। যার ফলে তাদের মধ্যে আত্মসংযম লোপ পায়- যা তাদেরকে মূল্যবোধ পরিপন্থী কাজে প্রবৃত্ত করে। এই নেতিবাচক পরিচিতি ও ভূমিকার স্পষ্টতা পরবর্তীতে ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
অতএব, এরিকসনের মতবাদের উপর ভিত্তি করে এ কথা নির্দিধায় বলতে পারি যে, সন্তান লালন- পালনে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্ভন করতে হবে । তাহলে, আপনার সন্তান সঠিক পথে পরিচালিত হবে এবং ইহকালিন ও পরকালিন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করবে।
তথ্যসূত্র
০১. মানবীয় জীবন: বৃদ্ধি ও বিকাশ, ড. মো: নুরুল ইসলাম
০২. মানবীয় মনোবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম, ড. মো: নুরুল ইসলাম
০৩ .ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট
লেখক : সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবার ডটনেট সম্পাদনা পরিষদের সদস্য