ভুল বোঝাবুঝির কারণে- খারাপ ও ভয়ানক দূরত্ব তৈরি হয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়, সম্পর্কহীন এমন কিছুর জন্যও দায়ী মনে করা হয়, অশান্তি বৃদ্ধি পায় এবং অবমূল্যায়ন করা হয়। ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে- ইঙ্গিতে কথা না বলে মন খুলে কথাবার্তার মাধ্যমে, সরাসরি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে।
একটা ভুল বোঝাবুঝি লাখো ভালোবাসার মুহূর্তকে ভুলিয়ে দেয়, দীর্ঘমেয়াদী অশান্তিও তৈরি করে। সাধারণত বেশিরভাগ সময়ই ভুল বোঝাবুঝি ও বোঝাবুঝির ভুল হয় অনিচ্ছাকৃত, তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও যে একেবারেই হয় না এমনটি নয়।
ভুল বোঝাবুঝি যেমন দু’জনের মধ্যে হয়, তেমনি দু’পক্ষের মধ্যেও হয়। অধিকাংশ ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে ৩য় কেউ বা ৩য় কোনো পক্ষ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এবং সুবিধা বা মজা নেয়। কারো কারো চোগলখুরি বা কূটনামি বা অপব্যাখ্যা এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। অনেকে জাস্ট টাইম পাস করার জন্য কূটনামি করেও সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি বদলে দিতে পারেন। তবে ভুল বোঝার কারণ খুঁজে বের করতে পারলে তা দূর করাও সহজ হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে-কর্মক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকারা পিছিয়ে থাকাদের কাছে গীবত চর্চার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি বাড়াতে সহজেই ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেন। পশ্চাতে পরনিন্দাকারীরা মিথ্যা শপথ করার ফলে অনেকেই বানোয়াট কল্প-কাহিনীও সরল মনে বিশ্বাস করে। কূটনামি চাল চালা ও অন্যের দোষ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা ভুমিকা রাখে পারিবারিক দ্বন্দ্বেও।
বিশেষ করে দুই জায়গায় থাকলে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাটা বেড়ে যায়, বেশি বেশি অভিমান-অনুরাগ জমা হতে থাকে। দূরে থাকলে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ায় ঠোঁটের হাসিতে ও চোখের চাহনিতে অনেক কিছুই বোঝানো যায় না। ফলে একটি ইতিবাচক বিষয়ও নেতিবাচক হতে পারে খুব দ্রুতই।
ভুল বোঝাবুঝিকে বাড়তে দিলে আরো বড় দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে উভয়পক্ষ যত্নশীল হলে মনোমালিন্য দূর করার প্রচেষ্টা চালানো যায় সহজেই। তবে এক্ষেত্রে ঝগড়া করার ইচ্ছা থাকলে তা বাদ দিতে হয়, ভুলটা অনুধাবন করলে স্বীকার করে নিতে হয়, নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ ভাবাও বন্ধ করতে হয়।
সাধারণত ভুল বোঝাবুঝিকে ঝগড়ায় রূপ দিয়ে সম্পর্কের বন্ধন নষ্ট করতে ইন্ধনের অভাব হয় না। ইগো সমস্যাটি এমন যে সম্পর্ক ঝরে যায়, ভালোবাসাহীনতার অভিনয় করে যায়! অহংকার ঝেড়ে ফেলে একবার ‘সরি’ বললেই ভুল বোঝাবুঝির সমস্যা সমাধান করা যায়।
অযথা ভুল বোঝাবুঝিকে দীর্ঘায়িত করলে কারোরই লাভ হয় না। দূরে থেকে ভালোবাসার পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলে কাছাকাছি যেতে হবে, সময় দিতে হবে, চোখের দিকে তাকাতে হবে, বিশেষ কোনো উপহার দিতে হবে। ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক প্রিয় মানুষকেও হারিয়ে ফেলতে হয়। তাই নিজেদের মনের চিন্তা-ভাবনা থেকে ঘৃণিত ভুল বুঝা সঠিক বুঝে রূপান্তর করতে হবে।
ভুল বোঝাবুঝি বড় উদ্বেগ তৈরি করে, অপছন্দের ঢালপালা বিস্তার করে, সঠিক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অন্তরায় তৈরি করে। ভুল বোঝাবুঝি থার্ড পার্টিকে নতুন নতুন সুযোগ নেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়, কাউকে অসহায় করে ও কেউ কেউ উপায়হীন হয়ে পড়ে।
কথা বলার মানেই হচ্ছে ভুল বুঝার ঝুঁকি থাকা। যে যা বলেন এবং সেই বলার মাধ্যমে যা বুঝাতে চান, যাকে বুঝাতে চান সে তা সেভাবে নাও বুঝতে পারে। একই শব্দ, একই বাক্য ভিন্ন অর্খ তেরি করতে পারে ভিন্ন মানসিকতা, ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ভিন্ন বোধবুদ্ধির কারণেও। ফলে কী বলেছে সেজন্য কেউ দায়ী হতে পারে, তবে কে কী বুঝেছে সেজন্য বক্তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না।
কিছু বললে ভুল বোঝার ঝুঁকি যতটা থাকে, আর না বললে ভুল বোঝার ঝুঁকি ততটা কম থাকে! তারপরও অবশ্য অনেকে আন্দাজ-অনুমান করে নানা ধারণা করেন এবং বিভ্রান্তি ছড়ান। কিছু মানুষ আছে যারা চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলের পিছনে দৌঁড়ায় অথচ কানে হাত দিয়ে দেখে না; তেমনি কিছু মানুষ আছে যারা একজনের কথা শুনে আরেকজন সম্পর্কে এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে থাকে যে যা জেনেছে তাই সত্য। অথচ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যা শোনছে তাই যাচাই ছাড়া বিশ্বাস করা।
কিছু ভুল বোঝাবুঝি তাদের জন্যও হয়- যারা নিজেদের ফেরশাতুল্য ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে মনে করেন, এবং অন্যকে সবসময়ই ভুল ভাবেন। সিনেমা নাটকে যেমন একজন নায়োকোচিত চরিত্র তৈরির জন্য ভিলেনের প্রয়োজন হয় তেমনি নিজেদের দোষ-অপরাধ সব ঢেকে পুষ্পতুল্য পবিত্র ইমেজ তৈরির স্বার্থে কাউকে নেতিবাচক হিসেবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপস্থাপন করতে হয়! নিজেদের কুৎসিৎ কদর্যতাতে ঢেকে অন্যের সহানুভূতি নিতে তারা কৌশল হিসেবে এই বক্র ও অস্বচ্ছ পদ্ধতি ব্যবহার করে।
যারা নিজেরা ভুলের মধ্যে থেকে অন্যকে ভুল বুঝতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদের ভুল বোঝাবুঝি সহজে দূর হয় না। অন্যকে ভুল বোঝায় অভ্যস্ত নিজেকে সঠিক বোঝায় অভ্যস্তও! ফলে ভুল বোঝাবুঝির বশবর্তী হয়ে যে যা কিছু করেন তার বড় খারাপ দিক থাকে। ভুল বোঝাবুঝি থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা ঝগড়ার মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত মানুষ রাগের মাথায় যা করে তার জন্য প্রশ্ন করে না যে এটার ফলাফল কি কি হতে পারে!
যে সম্পর্ক বা বন্ধুত্বকে ভুল বোঝাবুঝির কারণে নিঃশেষ হয়ে যেতে হয় তা প্রকৃত সম্পর্ক বা সার্থক বন্ধুত্ব নয়! শুধু নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সবকিছু বোঝার চেষ্টা করলে এবং অন্য কারও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার মানসিকতা না থাকলে মিটমাট করে ফেলা সহজ নয়। মতের অমিল হলেও সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে হলে খারাপ স্মৃতিগুলো মুছে সামনের দিকে এগোতে হয়, আগে থাকতে কিছু ধরে নেওয়ার প্রবণতা বাদ দিতে হয় ।
নিজের স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখেও অপর ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিটা বুঝলে শান্তিতে থাকা যায়। সম্পর্ক মজবুত রাখতে দু’জনের বা দু’পক্ষের সমান দায়িত্ব রয়েছে। পারস্পরিক দোষারোপ করার বদলে খোলাখুলি আলোচনা কঠিন পরিস্থতিতেও সম্পর্ককে সহজ করে। তবে মধ্যস্থতা করতে তৃতীয় ব্যক্তিকে ঢুকতে দিলে বা তৃতীয় পক্ষকে ডাকলেই তা জটিল অবস্থা ধারণ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
ভুল বোঝাবুঝি থেকে ভুল বিচার করে ফেললে একরকম বোঝালেও সেটা অন্যরকমভাবে বুঝার মতো ভুলের সাগর তৈরি হয়। যেহেতু প্রত্যেকের চিন্তা শক্তি আলাদা, ভাবনা ও বোধ আলাদা; ফলে প্রতিটা বিষয়ে সবার বিশ্লেষণ একরকম হবে না, সব ব্যাপারে মতের মিল হবে না। এই বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে না মানলেই মতের অমিল হওয়া ব্যক্তির কোনো কিছুই পছন্দ হয় না, মনে মনে তার প্রতি বাজে ধারণা জন্ম নেয়, ভুল বিচার করার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী কলহের দিকে এগিয়ে যায়।
ভুল বোঝাবুঝি মানসিক চাপ বাড়ায়। তাই ভিন্নতাকে-বৈচিত্রতাকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে কখনো সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির কারণে কারো যদি বাড়তি সুযোগ-সুবিধা তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন সে তা জিইয়ে রাখতে চায়! অভিমান ও অনুরাগ জমা করে সম্পর্কে প্রাধান্য না দিয়ে গোপন স্বার্থকে প্রাধান্য দিলে দোষাদোষীর মাধ্যমে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়। সম্পর্কে ফাটল ধরলে যারা খুশি হয়, তাদের খুশিতে শয়তানও খুশি হয়।
যারা অন্যকে তুচ্ছ ভাবে, অন্যের কথাকে মনোযোগ সহকারে গুরুত্ব দিয়ে শোনে না; তারা অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোনো বিষয়ে জোর দিয়ে কথা বলে। অথচ অনুমিত বিষয়টি অসত্যও যে হতে পারে; তা একবারের জন্যও ভাবে না। আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিবেককে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ও সমালোচনা করার চর্চা বাদ দিয়ে অন্যের ভালো গুণগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। চুপ থেকে আরো ঘোলাটে না করে ঠান্ডা মাথায় আলোচনার জন্য আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
ভুল-বোঝাবুঝি সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এটি খুব কঠিন অবস্থায় চলে গেলে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হয়। ভাঙা সম্পর্ককে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হলে কোনো কাজে বা কথায় খারাপ লেগে থাকলে নিজের মধ্যে চেপে না রেখে মনের কথা বলুন, নিজেদের মিলের জায়গাগুলো খুঁজে বের করুন এবং বিশ্বাস বজায় রাখুন, তৃতীয় কারো কথা না শুনে সত্যিটা বুঝুন, খুব দ্রুত ও ঘন ঘন মুড পরিবর্তন করবেন না।
বেশি বেশি অনুমান ও অর্থহীন ঝগড়া দ্বন্দ্বের দিকে পরিচালিত করে; তাই এসব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। নিজের ভুলের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমা চাইতে হবে এবং উল্টো দিকে থাকা মানুষকে অপমান করা বন্ধ করতে হবে, যার সঙ্গে গোলমাল হয়েছে তার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সম্পর্কে ফাটল ধরা ঠেকাতে হলে কোনো কিছু অগ্রিম ভাবা যাবে না। ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির অবসানে ভুল-বোঝাবুঝির পেছনে যার দায় তাকে ভূমিকা রাখতে হবে।
মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। ভুল হলে সেটাকে শুধরে নিয়ে সঠিক পথে সতর্ক হয়ে চলতে হবে। অন্যের ভালো দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে আর নিজের খারাপ দিকেও নজর দিতে হবে। ভুল বোঝাবুঝি সমাধান করতে হলে অহমিকা বর্জন ও উদারতাকে গ্রহণের বিকল্প পথ নেই। সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক, সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকুক আজীবন।
লেখক: আনিসুর রহমান এরশাদ, লেখার সময়: ৩ জুন ২০২২