কান্ট্রি ব্রান্ডিং দেশের সুষম উন্নয়নের পথকে প্রশস্ত করবে

Bangladesh

আনিসুর রহমান এরশাদ : সামাজিক সূচক, অর্থনীতি, মাথাপিছু আয়, জীবনযাত্রার মান, বেসরকারি খাত, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হলেও বিশ্ব যেভাবে এগুচ্ছে সে তুলনায় আমাদের অগ্রগতি আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্ভাবনা, সফলতা, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি বিষয়সহ সার্বিক অবস্থা বিশ্বকে জানানোর মাধ্যমে আমরা কান্ট্রি ব্রান্ডিং করতে পারি।

‘কান্ট্রি ব্রান্ডিং’ বর্তমান সময়ে দেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় একটি ফলপ্রসূ এবং অত্যাধুনিক ব্যবস্থা; যা দেশের সুষম উন্নয়নের পথকে প্রশস্ত করে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে, দেশের অর্থনীতিতে হবে প্রাণসঞ্চার। তাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির উচ্চমাত্রায় দাঁড় করাতে হলে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে জাতীয় পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দিয়ে কান্ট্রি ব্রান্ডিং করতে হবে।

ফ্রান্স মানেই মানুষ আইফেল টাওয়ারের নাম বলে, হল্যান্ড মানেই ফুলের দেশ বলে, জাপান মানেই ভূমিকম্পের সাথে লড়াই করে অপরাজেয় জাতি হিসেবে চেনে, চীন মানেই পরিশ্রমী জাতির নাম আসে। তেমনি আমাদেরও এমন কিছু করে দেখাতে হবে যাতে বাংলাদেশ মানেই সেই ব্রান্ডের নাম চলে আসে।

কান্ট্রি ব্রান্ডিং বা ‘দেশ পরিচিতি’ হচ্ছে, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সফলতা, বিশেষত্ব প্রভৃতি বিষয়সহ সার্বিক খবরাখবর বিশ্বকে জানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের নিজস্ব ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে পরিচিত করানোর জন্য কান্ট্রি ব্রান্ডিং এর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও এ পদ্ধতিতে তাদের দেশের আন্তর্জাতিক প্রচারের কাজ এগিয়ে নিয়েছে অনেকদূর। এটি একটি খুব ফলপ্রসূ এবং অত্যাধুনিক ব্যবস্থা যা নিজের দেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে অনেক সফলভাবে কাজ করে।

হাজার দেশের ভিড়ে বিশেষ একটি দেশকে বিশ্বসাসীর মনে আস্থার জায়গা করে নেওয়াকে প্রাথমিকভাবে কান্ট্রি ব্রান্ডিং বলা যায়। কান্ট্রি ব্রান্ডিং হচ্ছে দেশ ও জাতির সুনাম বৃদ্ধি করা, অন্য দেশের উপর নিজের দেশের গুরুত্ব, মর্যাদা, সম্মান তথা শ্রেষ্টত্ব নিশ্চিত করা। কান্ট্রি ব্রান্ডিং একটি ব্যাপক পরিসরের বিষয়। এর জন্য প্রচারণা দরকার, দরকার বিদেশিদের মনে আস্থা সৃষ্টি, দেশের আকর্ষণীয় দিগুলোকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই ব্রান্ডিং এর সাথে প্রয়োজন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার টুলসগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা। তবে এই সব কিছুর সাথে জড়িত থাকে কতগুলো সৃষ্টিশীল মানুষ, নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি, সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ।

সমন্বিত প্রচেষ্টাই দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সহায়ক হয় এবং বিদেশিরাও ঐ দেশ ও জাতির সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হয়, বাড়ে আস্থাশীলতা। সামগ্রিক কর্মকান্ড এমনভাবে পরিচালিত হতে হবে, যাতে দেশ ও জাতির ব্যাপারে অন্য দেশ ও জাতির মাঝে বিদ্যমান নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা পাল্টে যায় এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশকে বিশ্বে উচ্চকিত করে তোলতে এবং বাংলাদেশিদের মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধূলা, জ্ঞান-গবেষণা, বিনোদন, পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনশক্তি রপ্তানি, বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন- এসব নানান ক্ষেত্রেই হতে পারে।

জার্মানির একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, দেশটি এত বেশি উর্বর যে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে লাঙ্গল লাগে না, আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে কদুর (লাউয়ের) বীজ বপন করলে দুই দিন পর লতা, কয়েক দিন পরে পাতা এর পর কদু (লাউ) জন্মায়। অথচ দেশটির লোকেরা অশিক্ষিত ও অলস। তারা চিংড়ি মাছ দিয়ে মজা করে লাউ খায় আর গান ধরে- ‘স্বাদের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী।

একজন জাপানি বিশেষজ্ঞের মন্তব্য ছিল বাংলাদেশটাকে আমাদের হাতে দেয়া হলে আমরা বিশ্বকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দ্বিতীয় জাপান উপহার দিতাম।

এমতাবস্থায় ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ গড়তে ও ‘দিন বদলের’ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ‘কান্ট্রি ব্রান্ডিং’ হতে পারে একটি কার্যকর হাতিয়ার। ব্যবসা-বাণিজ্যে, সমাজ সচেতনতায় ও কল্যাণচিন্তা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নিতে সমন্বিত কর্মসূচি পরিচালিত করাটাই কাম্য। এই ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিত সমাজকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে, সমন্বিত প্রয়াস চালাতে হবে।

বাংলাদেশ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। কেউ বলেন, তলাবিহীন ঝুড়ি, কেউ বলে বেশিদিন সাসটেইন করে না আবার কেউ বলেন, বাংলাদেশ ইজ মিরাকল। রফতানি আয় বাড়ানো,  লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি, জিডিপি বৃদ্ধি, অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে একটি যথাযথ প্ল্যান দরকার। বাংলাদেশকে প্রযুক্তি চালিত মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে হলে সার্বিক উন্নয়নকল্পে দীর্ঘমেয়াদী ও বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগবান্ধব গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবে তখনি যখন স্থিতিশীলতা থাকবে, দুর্নীতিমুক্ত থাকবে। উৎপাদনশিল্পে ও বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সেবাখাত সমূহে  এবং অবকাঠামো বিনির্মাণে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ ও বাণিজ্যিক আস্থা  ধরে রাখতে হবে। আইটি আউটসোর্সিংয়ের গন্তব্যে পরিণত করতে হবে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল রপ্তানির গতি বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার মান আরো উন্নত করতে হবে। সামাজিক সূচকেও দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

আমাদের দেশের নাম ছড়িয়ে পড়ছে-ক্রিকেট উন্নতি ও গার্মেন্টস ব্যবসার  কারণে। পর্যটন কর্পোরেশন কক্সবাজারকে আর রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিশ্বে প্রচার করেছে,  নাম পেয়েছি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের কারণেও। আমাদের রয়েছে বিশাল জনশক্তি যাদেরকে আমরা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ সম্পদে পরিণত করতে পারি। আমাদের রয়েছে- কম খরচে সেবা পণ্য উৎপাদনের সুবিধা; সমূদ্র উপকূলীয় ও আরামদায়ক আবহাওয়ার এক চমৎকার অবস্থান; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আতিথিয়েতার বিশ্বব্যাপী সুনাম।

এদেশের সৃজনশীল উদ্যমী তরুণরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে দেশে বিদেশে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে সরকার নতুন ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশের পর্যটন এলাকাগুলোয় ট্যুরিজম অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ট্যুরিজম ইজেড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে (ইজেড) মানুষের কাজের সুযোগ হবে। অযুত সম্ভাবনার কারণেই অনেকের নজর এই দেশের দিকে।

দেশটি আয়তনে বিশ্বের ৩ হাজার ভাগের মাত্র ১ ভাগ হলেও এর লোকসংখ্যা ৪০ ভাগের ১ ভাগ। যা কি না বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ২০-৪০ গুন বড় এরকম অনেক দেশেই অনুপস্থিত। আর এই বিশাল ভোক্তার জনসংখ্যার কারণে আয়তনে দরিদ্র হলেও এই দেশটি একটি বিশাল বাজার। এই বাজার দখল বিশ্বমোড়লদের অতিরিক্ত নজরের একটি অন্যতম কারণ। অর্থনীতিকে উৎপাদনমুখীর পরিবর্তে ভোগমুখী করে তোলা হয়েছে। ঢাকাকে এখন বিশ্বের ‘সিটি অব শপিংমল’ বললে অত্যুক্তি হবে না।

আশার দিক হচ্ছে- ব্রান্ডিং বাংলাদেশ এর ক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগান এবং আইটি কেন্দ্রিক তৎপরতা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এককভাবে মেইড ইন বাংলাদেশ বা ডিজিটাল বাংলাদেশ অথবা হার্ট অব এশিয়া ব্রান্ড হতে পারে। বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য যেমন জুট বা পাট, হস্তশিল্প, প্রকাশনা, পর্যটন, সিমেন্ট, ইলেকট্রনিক্স এর মতো প্রায় ৩২টি সেক্টরকে নিয়ে ব্রান্ডিং করার সুযোগ আছে। ‘চাঁদপুর সিটি অব হিলশা’ নামে এ জেলাকে ব্রান্ডিং করা ছাড়াও অনেকে জেলাকেই নানা ভাবে ব্রান্ডিংয়ের সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের ২৫টি দেশে প্রায় দুই কোটি পিস লুঙ্গি রপ্তানি হচ্ছে।

ধ্বংসাত্মক জাপান বিশ বছরে যে শিল্পে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও চেষ্টা করছেন লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উন্নতির শিখরে যাওয়ার। আমাদের নকশীকাঁথাসহ এরকম অনেক কিছু আছে। আমরা যে কাঁথাকে পিঠের নিচে ঘামে ভেজাই সেটা একজন পশ্চিমাকে উপহার দিলে তিনি আয়নাতে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখেন। এটাও আমাদের সংস্কৃতির গৌরব। আমাদের লোকসংস্কৃতি আমাদের সম্পদ সেটাই আমাদের পরিচিতি বহন করবে। সংস্কৃতির জন্য পর্যটন বাড়ে, সংস্কৃতির কারণে পণ্য ব্রান্ডিং হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীকে সুইজারল্যান্ডের মতো করে সাজানোর সুযোগ রয়েছে।

আর্ন্তজাতিক বাজারে যাতে বদনাম না হয়। পোশাক শিল্পের ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট না হয়। বিশাল তৈরি পোশাকের অর্ডার যেন হাতছাড়া না হয়। বিদেশে জনশক্তির প্রেরণের হার যাতে কমে না যায়। ফ্রিলান্সিংয়ে যাতে পিছিয়ে না পড়ি। আমাদের বৈদেশিক মিশনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।  দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইটি, পর্যটন, ব্যবসা ইত্যাদি উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে ভালো ও এভেলবল কনটেন্ট তৈরি করতে হবে।

সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য-উপাত্ত থাকলেও সেসব তথ্য জনগণের জন্য খুব বেশি উন্মুক্ত নয়। বিশেষকরে দেশের ট্যুরিজম প্রমোট করার জন্যও ভালো ও প্রয়োজনীয় কনটেন্ট নেই। যেসব কনটেন্ট দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পর্যটক আকৃষ্ট করা যায়। বাংলাদেশ সম্পর্কে কাতারি আরবিরা যত দূর জানেন সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ খুব গরীব একটা দেশ; এখানে জঙ্গিরা বোমা-বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মানুষ পড়ালেখা জানে না, খেতে পায় না, বলার মতো কোনো রাস্তাঘাট নেই।

তারপরও বাংলাদেশের আকাশে এখন সম্ভাবনার সূর্য। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। সুপার ব্রান্ডিং বাংলাদেশ। জনসংখ্যা অভিশাপ না হয়ে আশির্বাদ হতে পারে, বোঝা না হয়েও সম্পদ হতে পারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেলে। সোনালী আঁশ খ্যাত বাংলাদেশের পাটকে বিশ্বের দরবারে ব্রান্ডিং হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে । সঠিক রাষ্ট্রীয় নীতি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার হতে পারে সমগ্র পৃথিবী।

মিরপুর এর শাড়ি পল্লীর উৎপাদিত বেনারসী শাড়িকে বলতে পারি মিরপুরি শাড়ি। কেননা শাড়ি আমাদের, কাজ আমাদের, ডিজাইন আমাদের। যাতে জামদানির মত নিজস্ব একটা ব্রান্ডের প্যাটেন্টও অন্যদের হাতে চলে না যায়। বাংলাদেশের ভিতরে থাকা ব্রান্ড ওয়ালটন, স্কয়ার, বেক্সিমকো ইত্যাদিকে ইন্টারন্যাশনালি রিকগনাইজড করার উদ্যোগ নিতে পারি। আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা নয়, উৎপাদকরাই হবে রাষ্ট্রের সম্পদ। শুধুমাত্র ট্যুরিজাম সেক্টরটাকেও যদি প্রোপারলি ইউটিলাইজ করা যায়, উন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একদম প্রথম সারির দিকে নিয়ে আসা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সম্ভব।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে- আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি আর প্রাকৃতিক দূর্যোগের তকমা ছাড়িয়েছি আমরা ঠিকই কিন্তু উদীয়মান বাঘ, গার্মেন্টস লিজেন্ড, ফিউচার আইটিল্যান্ড, হার্ট অব এশিয়া, ল্যান্ড অব ফ্রেন্ডশীপ এরকম পজেটিভ কোনো তকমাই লাগাতে পারেনি। যতদিন না এটা করতে পারছি ততদিন আমাদের অর্জনগুলো ফিকে হয়ে যাবে আর ব্রান্ড বাংলাদেশতো দূর, বহুদূর। রানা প্লাজা ধ্বংস ও তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকান্ড, স্পেকট্রাম গার্মেন্টস এর ধসে পড়ার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দৃশ্যপট আমাদের বারংবার জাগিয়ে তোলে, যেভাবে শত শত উদ্যোক্তা আর সাফল্যের ইতিহাস বিবর্ণ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গভীর সংকটে পতিত হয়েছিল।

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেখানে বাস্তবতার আলোকে অনেক বেশি উৎপাদনমুখী হওয়ার কথা ছিল সেখানে তা কেবলই ফটকা কারবারি ও প্রতারণার ফাঁদে বন্দী। দক্ষ এবং কাজ জানা শ্রমিকেরা অদক্ষ শ্রমিকদের চেয়ে ৫ গুন বেশি রোজগার করে জেনেও কেন্ আমরা লাখ টাকা খরচ করে শ্রমিক পাঠাই অথচ কয়েক হাজার টাকা খরচ করে কাজ শিখিয়ে শ্রমিক পাঠাই না। অথবা শ্রমিকদের দক্ষ হয়ে উঠার জন্য কোনো প্রচার প্রচারণা চালাই না।

একটি ব্যাপারে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে না বললেই নয় তা’ হচ্ছে পর্যটন। মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ভারত ও সিঙ্গাপুর এর অর্থনীতির নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটনকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশেও পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা অফুরন্ত। এ দেশের নদ-নদী, সবুজ-শ্যামল মাঠ, ফসলের ক্ষেত, ছায়াঢাকা গ্রাম, শান বাঁধানো পুকুর, গ্রামবাংলার মানুষের সরল জীবন বিশ্বের যে কোনো মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে। তাই যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে শুধু পর্যটন শিল্প থেকেই বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি পর্যটনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ কেন্দ্রবিন্দুতে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের পর্যটন স্পটের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। যথাযথ সংরক্ষণ, পরিচর্যা আর প্রচারের অভাবে সবকিছুই পর্যটকদের অজানা রয়ে গেছে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের কান্ট্রি ব্রান্ডিং নির্মাণের বিষয়ে আরও ভার্চুয়াল জগৎকে বেছে নিতে হবে এবং এর সর্বোচ্চ উপযোগিতা কিভাবে অর্জন করা যায় সে দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে। এখানে ইংরেজি জানা লোকের অভাব দূর করতে হবে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্রান্ড চালু করতে পারি ব্যাপকভাবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রচারণা বৃদ্ধি করতে পারি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। ‘হার্ট অব এশিয়া’ হিসেবে প্রচারণা চালাতে পারি। গার্মেন্টস শিল্পে ‘উই আর নাম্বার ওয়ান’ হওয়ায় সচেষ্ট হতে পারি। দেশে নতুন এক সম্ভাবনা ইলেকট্রনিক কমার্স। উদ্যোক্তা তৈরি করলে তারাই মানুষকে সেবা দেবে।

শুধু চাকরি নয় নতুন প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদেরকে দেশে বিনিয়োগে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের ব্যাপারে নেতিবাচক ইমেজ পরিবর্তন করতে হবে এবং সংগঠনগুলোকেও সহায়তা দিতে হবে। নিজেদের ‘লোকাল ব্র্যান্ড’ তৈরির দিকে আমাদের এখন নজর দেওয়া দরকার। শুধু বিদেশি পর্যটকদের নির্ভরতায় না থেকে ‘দেশকে চিনুন, দেশকে জানুন’; ‘ঘুরে দেখি বাংলাদেশ’ এরকম দেশাত্মক স্লোগানে দেশের মানুষকে দেশ দেখানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার। কান্ট্রি ব্রান্ডিংয়ের উপযুক্ত সময় এখনই।

নিবন্ধটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শেয়ারবিজ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top