শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ শাহ আবদুল হান্নান

শাহ আবদুল হান্নান

শাহ আবদুল হান্নান। অনেকেরই প্রিয় চাচা। লক্ষ তরুণ-তরুণীর মেন্টর।  আদর্শ, ন্যায়-নীতি ও সততার প্রতিক। শতাব্দীর এক শ্রেষ্ঠ দায়ী। বাংলাদেশের সম্পদ, মুসলিম বিশ্বের সম্পদ। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, কলামিস্ট ও সমাজসেবক।

তিনি আর্থিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততার অনন্য নজির রেখে গেছেন, যা বিরল। তার মতো মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়া যেকোনো সন্তানের জন্য বিরল সম্মান। নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরহংকারী এমন সরকারি কর্মকর্তা পাওয়া জাতির জন্য ভাগ্যের বিষয়। বহুমুখী মেধা, যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার বিরল এই মহীরুহ ব্যক্তিত্ব ছিলেন একজন মর্দে মুজাহিদের প্রতিচ্ছবি। অনেকের মহানায়ক, অনেকের সুপার হিরো।

যুগন্ধর প্রতিভার এই কিংবদন্তী মানুষ ছিলেন- অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ, সমাজ কল্যাণ ও সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরিন সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, ভ্যাট চালুর অন্যতম প্রবক্তা। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক। শুল্ক ও আবগারী বিভাগের কালেক্টর। তিনি ছিলেন সফল উদ্যোক্তা।

তিনি ছিলেন- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অন্যতম উদ্যোক্তা ও চেয়ারম্যান। দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান। ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও চেয়ারম্যান। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা। তিনি সমাজ সংস্কার ও শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইসলামিক থট বিআইআইটি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

মুখে-কর্মে-অন্তরে এক ও অভিন্ন এই মানুষটি বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতিকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তিনি অর্থনীতি ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে আশ্চর্যময় দিক নির্দেশক। বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরহংকারী ক্ষণজন্মা পুরুষ। এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাতের অন্যতম পথিকৃত। রাজনৈতিক জীবনে তেমন কোনো অবস্থান না থাকলেও দর্শনগত দিক থেকে তিনি ইসলামী রাজনীতি তে বিশ্বাসী ছিলেন। ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে কাজ করেছেন ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্যে। ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী সংস্কৃতি, ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ছিল তার বিশেষ আগ্রহ।

বহুগুণে গুণান্বিত মননশীল এই আলোচকের কথা বলার ধরণ খুবই আকর্ষণীয়। আলোচনার মাঝে জীবন থেকে নেয়া রসালো গল্প বলার ক্ষমতা ছিল। রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে এই ইসলামী স্কলারের গভীর বিশ্লেষণ শ্রোতাকে মুগ্ধ করতো। মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও তিনি খ্যাত ছিলেন। অভিনব জীবনবোধের অধিকারী মানুষটির প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাকে অমর করে রেখেছে। তার চিরায়ত সৃজন-কর্মগুলো মানবতাবাদী মানুষ মনে রাখবে।

সৃজনশীল মানুষটি ছিলেন প্রভাব বিস্তারকারী লেখক। অন্তরের তাগিদে লিখতেন। ইসলামী অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্ব চিন্তা, ফিকাহ, রাজনীতি, আইন, ইতিহাস, নারী অধিকার ও ইসলামসহ নানা বিষয়ে তার লেখা থেকে পাঠক আত্মপ্রত্যয়ী হতো, শিকড়ের কাছে টেনে নিতো, বহু মানুষের জীবনে প্রভাবক হয়ে উঠতো, বর্তমানের সাথে অতীতকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দিতো। তার লেখা পড়লেও তাকে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। তিনি ছিলেন- সমাজ গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী সফল সাধক। জীবনকে অনুভবের জন্য তাঁর এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। প্রতিটি বিষয়ে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিকতা দিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ধারালো রচনাশৈলী পাঠকের হৃদয় ছুয়েছে। এতে প্রচারের আতিশয্য নেই, বরং আছে নিখাদ অনুভবের আলপনা।

লেখক হিসেবেও এই সাদা মনের মানুষের অবদান অনেকাংশে রয়েছে। ইসলামিক জীবনপদ্ধতি, ব্যাংকিং, যাকাত ম্যানেজমেন্ট এসব বিষয়ে উনার কলামগুলো ছিল দারুণ। তার ক্ষুরধার লেখনি দিয়ে সম-সাময়িক বিষয় ও ইসলামী আদর্শ জাতির সামনে আমৃত্য তুলে ধরেছেন। লিখেছেন- ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা, ইসলামী অর্থনীতিঃ দর্শন ও কর্মকৌশল, নারী সমস্যা ও ইসলাম, নারী ও বাস্তবতা, সোস্যাল ল অব ইসলাম, দেশ সমাজ ও রাজনীতি, বিশ্ব চিন্তা, সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম, উসুল আল ফিকহ, ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি। লেখক হিসেবে দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন। যেখানে ঋদ্ধ হতে হয় ভিন্ন এক পাঠ-অভিজ্ঞতায়।

ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষের লিখা-কাজ অনেকেরই প্রেরণা হিসাবে রয়ে গেছে। সাইফুল্লাহ মানসুর লিখেছেন, সততার সাথে দেশ ও জনগণের সেবা করে গেছেন আমৃত্যু। তিনি সর্বক্ষণ কাজে যুক্ত থাকা মানুষ ছিলেন। সুন্দর ভাবনাগুলো শেয়ার করতে দেরী করতে না। আদ্যোপান্ত একজন আমলদার পাকা মুসলমান ছিলেন তিনি। অধিনস্তদের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন রহমদিল ও সচেতন। তিনি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়ও লিফটম্যানের পরিবারের কথা সুবিধা অসুবিধার কথা জানতে চাইতেন। বলতেন যেকোন সমস্যা হলেই আমার কাছে চলে আসবে।

২ জুন ২০২১ বুধবার দ্বিতীয় দফায় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে সকাল ১০টা ৩৭ মিনিটে ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন যুগ-শ্রেষ্ঠ একনিষ্ট দা’ঈ ও উস্তাদ। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়ে গত ৮ মে থেকে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় একাধিকবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন তিনি। একইসঙ্গে মস্তিষ্কে প্রদাহের কারণে স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার বয়স হয়েছিলো ৮২ বছর। তার বয়স হয়েছিলো ৮২ বছর। তার মত আদর্শিক ব্যক্তির শূণ্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

তিনি এক ছেলে, এক মেয়ে, তিন ভাইসহ বহু আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বুধবার বাদ জোহর ধানমন্ডি ঈদগাহ মসজিদ মাঠে তার প্রথম নামাজে জানাজা হয়। দ্বিতীয় জানাজা হয় সিপাহীবাগে তার বাসার সামনে বিকেল সাড়ে ৩টায়। বাদ আছর তৃতীয় জানাজা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে শাহজাহানপুরের কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়।

বহু গুণে গুণান্বিত শাহ্ আব্দুল হান্নান ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানার বিখ্যাত শাহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অনেক বড় পীর বংশের মানুষ তিনি। নিজ গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে সফলভাবে উল্লেখযোগ্য ফলাফলে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

শিক্ষকতার পেশা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের প্রাচীন ও বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান ফিন্যান্স সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের আভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।

ব্যক্তিজীবন ছিলো সাধারণ গরীব মানুষের মতো। খুবই সাদাসিধে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ব্যবহার ছিল অমায়িক। সরকারি কাজে বিদেশে যেতেও প্রবল অনীহা ছিল। বিদেশ সফরে গেলেও প্রায়ই হোটেলের মূল খাবার বাদ দিয়ে ফলমূল ও ডেজার্ট খেয়ে থাকতেন। নিজের খাবারের জন্য তিনি দেশ থেকে সঙ্গে কিছু বিস্কুট নিয়ে যেতেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালিনও বাসায় বিদেশে যাওয়ার কোনো ভালো ব্যাগ ছিল না। বাসায় থাকা টিনের বাক্স নিয়ে ব্রাসেলসে যাওয়ায় বিদেশফেরত দম্পতি তাদের স্যুটকেস, ট্রলি বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার দক্ষতা-সততা এবং গণমুখী চরিত্র তখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। তাকে সরকারও সম্মান ও সমীহ করত মূলত সততা ও নীতিনিষ্ঠার কারণে যা অন্য কোনো সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার ভাগ্যে জোটেনি। কোনো দুর্নীতিবাজ, ধান্ধাবাজ-দলবাজ তার সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত না।

যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তখনও তার রুম খোলা থাকত এবং লোকজন অবাধে যাতায়াত করতো। কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই সোজা ঢুকে যাওয়া যেত। তিনি দাঁড়িয়েও সাক্ষাতপ্রার্থীদের কথা শুনতেন এবং ঝড়ের গতিতে একের পর এক সিদ্ধান্ত দিতেন। তার বিনয় ও ভদ্রতায় আগন্তুকরা হতবাক হয়ে যেত।

রাজউকের দুজন চেয়ারম্যান ও পূর্তসচিব তাকে বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনি কেবল আবেদন করেন। বাকিটা আমরা দেখব।’ কিন্তু রাজউকের জমির জন্য আবেদন করতে তিনি কোনোমতেই রাজি হননি। তিনি বলেছেন, ‘ঢাকায় আমার এজমালি হলেও একটি পৈতৃক সম্পত্তি আছে। আমি মিথ্যা ঘোষণা স্বাক্ষর করতে পারব না। তা ছাড়া আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার ও কিস্তির টাকাই-বা আমি কোথা থেকে দেব?’ সৎ ও সজ্জন মানুষটির শেষ ঠাঁই ছিল পিতা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাইবোনদের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় উত্তর গোড়ানে গড়ে তোলা বাড়ি। তার মা বলেছিলেন, তার ছেলে একটা দরবেশ। দুটো শার্ট থাকলে একটা কাউকে দিয়ে দেয়।

বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী ছিলেন। কর্মজীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা, সততা ও ন্যায়-নীতির প্রতিক ছিলেন। বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে সৎ ও দক্ষ আমলা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ যাবৎ কালের সকল সচিবদের মধ্যে ব্যতিক্রম মানুষ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন । তার সততা ও ন্যায়পরায়নতা তাকে সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিনত করেছিল। অবসর জীবনে তরুণদের মাঝে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে পাঠচক্র পরিচালনাসহ নানাবিধ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। মানুষটির সাথে কিছু সময় কাটালেই যে কারো প্রিয় মানুষে পরিণত হতো মানুষটি । তিনি মানুষকে কাছে টানতেন, মানুষের কথা মন দিয়ে শুনতেন।

তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। খুব সহজে সবাইকে আপন করে নিতেন তিনি। যে কেউ পরিচয়ের পর থেকে প্রায়ই তাকে ঘিরে এক ধরনের আলোর বিকিরণ অনুভব করতেন। তার মমতাভরা চেহারা হৃদয় কোণে স্থায়ী ঠিকানা করে নিতো। প্রথম দেখাতেই আপন করে নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই উনি অভিভাবক সুলভ উপদেশ দিতেন, সহায়তা করতেন। তিনি বলতেন, ইসলামে তাওহীদের পরই জাস্টিস। কোন অজুহাতেই অবিচার আল্লাহ পছন্দ করেন না। আমরা যেন কোন দেশ সম্পর্কে এমন কিছু না বলি বা কোন দেশের এমন কিছু না চাই যা আমরা নিজের দেশের ক্ষেত্রে চাই না। সব ক্ষেত্রেই জাস্টিস করতে হবে।

মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মায়ের প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকার ঔষধ লাগতো। গত দুই মাস আগে তিনি মারা যান। মা মারা যাওয়ার কারণে আমার তো এখন প্রতিমাসে ১৫-২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত থাকার কথা। কিন্তু সে টাকা কই? আমি টাকার কোন হিসাব পাই না।’ কথার সারাংশ হলো- ‘মানুষ যখন চলে যায়, তার রিজিকের অংশও সাথে করে নিয়ে যায়।’ অর্থাৎ আত্নীয়-স্বজন,পিতা-মাতার রিজিকের অংশ আপনার আয়ের মধ্যেই দেওয়া থাকে। এ রকম না যে, আপনি যদি তাদের জন্য খরচ না করেন, আপনার টাকার অংশ সেভ হবে।

মানুষটির বাসায় পাঠচক্রের সদস্য হিসেবে অনেকেই বহুবার যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ড্রয়িং রুমে ছাত্রেরা বসতো। ড্রইং রুমে ছিল কম দামী পুরানো সোফা। অনেক সময় সোফায় না ধরায় মেঝেতেও বসতো ছাত্ররা। তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় পড়াতেন। তার এই ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলামপন্থীদেরকে গোড়ামী মুক্ত করতে সাহায্য করছে। যখনই তার কাছে কেউ যেতো, তখনই তার আলোর ভান্ডার থেকে আলোর টুকরো নিয়ে ফিরতো। তার আদর্শিক কর্মের মাধ্যমে সর্বমহলে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। অসংখ্য চিন্তাগত ছেলে-মেয়ে আছে যারা তার কাছে গেলে পিতার স্নেহ পেত। তিনি ছিলেন শতশত মেধাবী তরুণের নিরলস ক্যারিয়ার এডভাইজার। তিনি দরদ ভরা মন নিয়ে তরুণদের সাহস যোগাতেন এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতেন।

উত্তর গোড়ানে ছিল তিন তলা নীল রঙ্গের বাড়ি। দামী কোনো আসবাবপত্র ছিল না। সাধারণ মানের জিনিসপত্র দিয়ে গোছানো ঘর। ঘরের এককোণে টেবিলে রাখা কম্পিউটার। ছোট্ট ড্রয়িং রুমে কম দামের সোফা আর বেডের ওপর বসেই তিনি সাবেক সচিবদের নিয়েও স্টাডি সার্কেল পরিচালনা করতেন। হাতে সাধারণ মানের মুঠোফোন থাকতো। পরনে থাকতো শার্ট আর লুঙ্গি। সাদামাটা ভাব। নেই কোনো অহংকার কিংবা অন্যকে ছোট করার মানসিকতা। আছে বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা। উনাকে প্রশ্ন করলে কখনো বিরক্ত হতেন না, হোক সেটা মেইলে বা সরাসরি ফোনে।

উনি চাইতেন- তরুণরা যাতে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র-সবকিছুতে একটা নৈতিক, সত্য ও স্বচ্ছ্ব ধারণা নিয়ে এগিয়ে যায় এবং সেটার প্রচার ও প্রসার হয়। শিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়তে তিনি সবাইকে বই উপহার দিতেন। সময়ানুবর্তীতা ছিল চাচার অসাধারণ গুণ। কাজকে তিনি ফেলে রাখতেন না। যখনকার কাজ তখনই করে ফেলার তাগিদ ছিলো। নিজের কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও শুনতেন। কুরআন ও হাদিস থেকে দেয়া দারস তন্ময় হয়ে শুনতেন। তিনি তরুণদের স্নেহ করতেন, তরুণদের ভেতরে স্বপ্নের বীজ বুনে দিতেন। বারুদ জ্বালিয়ে দিতেন। ছোটোদের কলিজাটাকে কীভাবে বিরাট বড়ো করে দিতে হয়, তিনি খুব ভালো করে তা জানতেন।

ছিলেন অসাধারণ এক সাধক। সাধারণ খাবার খেতেন। উম্মাহর জন্য স্বার্থহীনভাবে বিনাবেতনে পরিশ্রম করতেন। সবসময় লোভ পরিহার করতেন। বৈধ স্বার্থও উপেক্ষা করতেন। সমালোচনার মুখেও অভীষ্ট লক্ষ্যে অটুট থেকে কাজ করে যেতেন। বিশাল বড়ো মানুষ হয়েও ছোটদের বড়ো করে তুলে ধরতেন। বাংলাদেশের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষটিকে শুধু সৎ মানুষ বললে কম হবে, তিনি ছিলেন মহৎ চিন্তার মানুষ । সব শ্রেনীর মানুষকেই তিনি স্নেহ করতেন, ভালোবাসা দিয়ে হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতেন ।

বাসার কাজের মেয়েকে ১০ হাজার টাকা বেতন দিতেন। কাজের মেয়ের বেতনের ব্যাপারে উনার কথা ছিল এরকম- ‘একটা মেয়ে আমার বাসায় অনেকটা সময় কাজ করে। আমার কাজ করে তাকে তার পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য আবার অন্য বাসায় যেতে হবে কেন? তারা থাকে বস্তিতে, অতোটা মানসম্মত জায়গাও না। সেখানেও কি ভালোভাবে থাকার মতো বেতন আমরা দিবো না? এটা না দিলে তো তার প্রতি অমানবিকতা হয়ে যাবে। আমার বাসায় কাজ করে তাকে আবার অন্য বাসায় দৌড়াতে হবে কেন?’

প্রতিটি মানবিক কাজে তিনি থাকতেন সামনের কাতারে। লেখাপড়া ও গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন নিয়মিত। অনেকের ইমেইল এড্রেস নিতেন এবং নিজের লেখাগুলো পাঠাতেন। সময়কে কতো সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারেন তার উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। জীবন ঘনিষ্ট বিষয়গুলোর উপরই বেশি গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের সীমারেখার মাঝে থেকেও নারীরা কিভাবে সমাজে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে পারেন সেবিষয়ে লিখেছেন, সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলতেন, নারীরা ঘরের বাইরে প্রয়োজনে ভুমিকা রাখবে কাজ করবে সেজন্যই আল্লাহ্ পর্দার বিধান দিয়েছেন। তিনি তাঁর চিন্তা শুধু শেয়ার করতেন কারো উপর চাপাতে চেষ্টা করতেন না। সর্বত্রই তিনি ভদ্রতা সৌন্দর্য বজায় রাখতেন। আদ্যোপান্ত একজন শরীফ মানুষ ছিলেন। উচুমাপের এক অভিভাবক ছিলেন।যেদেশে সততার খুব অভাব; সেই দেশে দুর্নীতি, অন্যায়, অনাচার ও বৈষম্যমুক্ত শান্তিপূর্ণ একটি সমাজ গড়তে হলে তার মতো ভালো মানুষের কোনো বিকল্প নেই।

তথ্যসূত্র

সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের লেখা উত্তর গোড়ান নিবাসী সচিবের কথা, প্রথম আলো, ০৩ জুন ২০২১

শাহ আব্দুল হান্নান : একজন মর্দে মুজাহিদের প্রতিচ্ছবি, গোলাম মাওলা রনি, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ০৩ জুন ২০২১

ফেসবুকে অনেকের স্মৃতিচারণ

উইকিপিডিয়া বাংলা

বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সন

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

 

লেখক: আনিসুর রহমান এরশাদ, গবেষক ও সাংবাদিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top