আলোর কাণ্ডারী ড. মীর মো. আকরামুজ্জামান

ড. মীর মো. আকরামুজ্জামান

ড. মীর মো: আকরামুজ্জামান বিশিষ্ট ও আদর্শ শিক্ষাবিদ, নিবেদিতপ্রাণ দেশ-সচেতন মানুষ, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা সংস্কারের অকুতভয় সৈনিক। একজন ভালো মানুষ এবং কাজের ক্ষেত্রে সৎ, দক্ষ, কর্মঠ, প্রকৃত জ্ঞানী, কাজ পাগল, নিরহংকার ও আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন বিনয়ী মানুষ, স্বাস্থ্যসচেতন, মিতাচারী, সদাহাস্যজ্জ্বল, প্রচার বিমুখ, নির্লোভ, নিরলস পরিশ্রমী, শিক্ষাপাগল, অকৃত্রিম ছাত্রবন্ধু ও সবসময় শিক্ষার্থীবান্ধব।

মানুষ গড়ার দক্ষ এই কারিগর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সেবামূলক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি সমাজসেবায় নিরলসভাবে কাজ করেছেন, নিজের মেধা-শ্রম ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সৎ ও চরিত্রবান নাগরিক হিসাবে গড়তে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি শিক্ষার্থী-সহকর্মীদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি ক্লাসরুমেই শুধু শিক্ষক ছিলেন না; ছিলেন অনেকের সামগ্রিক জীবনের শিক্ষক।

১৯৫০ সালের ২৫ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দী উপজেলার কুরশী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা মীর মো: আসাদুজ্জামান। কর্মজীবন শুরু করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। ১৯৭৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ‘আর্মি এডুকেশন কোরে’ অফিসার পদে কমিশন লাভ করেন। তিনি ইবিআরসি, সদর দপ্তর আর্মি সিগন্যাল, সেনাসদর (শিক্ষা পরিদপ্তর), ৪৪ পদাতিক বিগ্রেড, সিএসসিএসসি ও বিএমএ- তে দায়িত্ব পালন করেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে অবসর গ্রহন করেন, তখন তিনি ছিলেন মেজর।

মানুষ গড়ার দক্ষ কারিগর কীর্তিমান এই মানুষটি সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অগ্রযাত্রা ও সুনাম প্রসারে তার অবদান ছিল। তিনি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গবেষণাকর্মে যুক্ত ছিলেন। বিভাগের সম্মুখে অবস্থিত মনোরম ফুল বাগানের পেছনেও রয়েছে তার ভূমিকা। তিনি ছিলেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের সদস্য, সাভার মডেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির সদস্য, গুলশান ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের চেয়ারম্যান।

তিনি ছিলেন মানারাতের স্থায়ী ক্যাম্পাসের প্রাণপুরুষ; তার অস্তিত্ব সেখানকার প্রত্যেকটি গাছ-পাথর-ইট-বালুকণা-ফুলের মাঝে। তিনি মানারাত স্কুল এ্যান্ড কলেজ, বাদশাহ ফয়সাল ইন্সটিটিউট এর ট্রাস্টি মেম্বারসহ অনেক স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির সাথে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনে বরেণ্য এই শিক্ষাবিদের অসামান্য অবদান রয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই একাডেমিক বিভিন্ন কার্যক্রমে সাপোর্ট দিতেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে, সিলেবাস তৈরি, শিক্ষক নির্বাচন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বুক লিস্ট তৈরি ইত্যাদি।

তিনি ছিলেন নির্ভীক, নির্মোহ, নি:স্বার্থ ও জনপ্রিয় ব্যক্তি। এমন মানুষ এই সময়ে এ দেশে বিরল। তার লক্ষ্যভেদী দৃঢ়চিত্ত অনেককেই বিমোহিত করতো। তরুণদের দেয়া তার নিদের্শনা ও পরামর্শ ছিল অসাধারণ। তাই তাকে কোনো উপমা বা বিশেষণে পরিচয় করিয়ে দেয়াই যথার্থ হবে না, নিজের পরিচয় তিনি নিজেই। তিনি কর্মজীবনে ৪০ বছর কোনো ছুটি নেননি। জাবি থেকে অবসরের পর বলতেন- ‘এখন আমি বিশ্রাম করছি’। কিন্তু বাস্তবতা ছিল- এই সময়েও তিনি ফুলটাইমারদের চেয়ে বেশি কাজ করতেন।

তিনি কাজ ভালোবাসতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানোন্নয়নমূলক প্রোগ্রামে জীবনের শেষদিনটিও কাটিয়েছেন। এভাবে কাজপাগল থেকে অন্যকে কর্মঠ হতে শিখিয়ে গেছেন তিনি। হাসপাতালে যখন মেয়ে আসে তখন সেন্স ছিল না, যখন ছেলে আসে তখন পালস নেই, যখন স্ত্রী কাছে আসে তখন তিনি লাশ। তবে কাছে ছিল সহকর্মীরা, যাদের মাঝে কাজ করতে করতেই তিনি মারা গেছেন।

মৃত্যুর দিন সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের পরিচালককে নিবেদিতপ্রাণ এই জ্ঞানসাধক বলেন- মাইক নিয়ে রেডি থাকেন, ঠিক ৯টায় প্রোগ্রাম শুরু করবেন। ঐদিন তিনি কোনো তাত্ত্বিক বক্তৃতা দেননি, সহজ-সরলভাবে নিজের জীবনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি পরামর্শ দিতেন, অনেকেই পরামর্শ নিতেন, কথার মাধ্যমে ভেতরের শক্তিকে নাড়ায়ে দিতেন। কখনো কেউ দোষ বললে হাসিমুখে গ্রহন করতেন, পজেটিভ বলতেন ও শুনতেন।

তিনি ছিলেন আট-দশ জন মানুষের থেকে আলাদা। কাজে-কর্মে ও চিন্তা-চেতনায় ব্যতিক্রম। ছিলেন একজন প্ল্যানার, মোটিভেটর, কর্মপ্রিয়, দূরদর্শী ও সাহসী মানুষ। জীবনের শেষ বক্তব্যেও তিনি বলেছেন- জীবন মানে কাজ, কাজ আর কাজ। আপনি কাজ ভালোবাসলে লোক আপনাকে স্যালুট করবে আর কাজে ফাঁকি দিলে অন্যকে স্যালুট করতে করতেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে। তিনি নিজে কাজ করতে ভালোবাসতেন, অন্যকেও কাজ করতে উৎসাহিত করতেন। তিনি কতভাবে যে, কত কাজ করেছেন, কাজ করার চেষ্টা করেছেন তার ইয়াত্তা নেই।

মীর আকরামুজ্জামান বিভিন্ন বক্তৃতায় ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের কথা বলতেন। নিজেও আবদুল কালামের মতো বক্তৃতা দিতে দিতেই মারা গেলেন, যা উভয়ের মধ্যকার মিল। তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন শিক্ষার্থীরা ফুল হয়ে ফুটবে, ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবে, নীতি-নৈতিকতা ছড়াবে অন্তরে-প্রান্তরে, সুন্দর সমাজের জন্য আদর্শ মানুষ হবে। তিনি ছিলেন শহীদ আব্দুল মালেকের ক্লোজ ফ্রেন্ড। ১৯৬৯ সালে ২২ বছরের তরুণের রক্তাক্ত কফিন ছুঁয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করার শপথ করেছিলেন তিনি।

তিনি এমন মানবদরদী ছিলেন যে, সদ্য বিবাহিত এক যুবককে বাসার ড্রয়িংরুমের খাট নিজ হাতে খুলে ভ্যান ডেকে পাঠিয়েছিলেন। স্যারের প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কর্মরত আরেকজনকে বিয়ের পরে ফ্যান কেনার জন্য শীতকালেও ১২০০ টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- আজকেই ফ্যান কিনে নাও, যেকোনো সময় লাগতে পারে। একজনকে বাসার ডাইনিং টেবিলও দিয়েছিলেন। তিনি পরিচিতদের সাথে দেখা হলে সুযোগ পেলেই ছেলে কোথায় পড়ে, মেয়ে কেমন আছে- এসব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে আন্তরিকতার সাথে খোঁজখবর নিতেন।

যথাসময়ে মিটিংয়ে পৌঁছানোর জন্য তিনি পাবলিক বাসের ছাদে পর্যন্ত উঠেছেন; তবুও যথাসময়ে হাজির হয়েছেন। তিনি জীবনে সফল হওয়ার জন্য সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। এমনকি দৈনিক জুতার ফিতা লাগাতে গিয়ে মাসে-বছরে-জীবনে কত সময় ব্যায় হয় তা দেখিয়ে দিতেন। কিভাবে বাথরুমে বসেও সময়কে অবহেলা না করে পড়া যায়, জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে দুটো ইংরেজি শব্দ মুখস্ত করা যায়- তিনি তা বলতেন। মীর আকরামুজ্জামানের ৩টা ৪০ মানে ৩টা ৪০; ৩টা ৩৯ নয় কিংবা ৩টা ৪১ নয়।

অন্যদেরকেও অনুপ্রাণিত করতো তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সিদ্ধান্তে অটল থাকার দৃঢ়তা ও সাহস। দরদী এই মানুষটির কাছে সব রকমের বেদনার কথা বলা যেত এবং তিনি মন দিয়ে শুনতেন। এতবেশি পরিশ্রমী, ধার্মিক এবং নিয়মানুবর্তী মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। তিনি অন্যের কাছ থেকে কখনো সহযোগিতা চাইতেন না। গভীর রাত হলেও আয়োজক কর্তৃপক্ষের কাছে গাড়ি না চেয়ে তিনি পাবলিক বাসে করে যাতায়াত করতেন। তার বাসা ছিল হোটেল খানার মতো, সাধারণ অনেক মানুষও খেতো। ফলে ভ্যানে করে বাজার হতো।

তিনি বলতেন, প্রতিষ্ঠান করলে সমাজ ভালো মানুষ পাবে। অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনে তার ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের ক্ষণজন্মা পুরুষ, অনেক স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা। তিনি নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য কাউকে উপযুক্ত মনে করলে তাকে নিজ থেকে প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে আসতেন। তিনি এনজিওতে কর্মরত একজনকে ৬ ভাগের ১ ভাগ বেতন দিয়ে কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করতে রাজি করাতে পেরেছেন। তিনি এমন যৌক্তিক ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় কথা বলতেন যে কেউ স্যারের কথা ফেলতে পারতেন না। তরুণ গ্রাজুয়েটদের তিনি সংগঠক ও উদ্যোক্তা হবার চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম করে গড়ে তুলতে পারতেন। তিনি অনেক মানুষের জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছেন।

লোভ কখনো তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি। হাজার হাজার যুব লিডার ও ভালো মানুষ তিনি তৈরি করে গেছেন সারা দেশ জুড়ে। তিনি শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কার কার টাকা লাগবে তা জেনে পরের দিন তালিকা ধরে সবাইকে চাহিদানুযায়ী টাকা দিয়েছিলেন। এক শিক্ষার্থী স্যারের কাছে টাকা ধার চেয়েছিল। হরতালে বিভাগের গেট তালাবদ্ধ থাকায় দেয়াল টপকে ঢুকে ২য় তলায় রুম থেকে চেকবই এনেছিলেন। টাকা ব্যাংক থেকে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। ঐদিন ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টাকা তুলতে না পেরে পরদিন বাসায় গিয়ে শিক্ষার্থীর হাতে টাকা দিয়ে এসেছিলেন। আরেকদিন স্নাতক ভর্তির শেষ তারিখেও এক মেয়ে হরতালের কারণে বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে পারছিলেন না। তিনি মেয়েটির লেখা চিঠি নিয়ে ভ্যান-রিক্সায় চড়ে টাঙ্গাইলে তার বাড়ি গিয়ে কাগজপত্র এনেছিলেন এবং মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল।

স্যার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে খুবই পছন্দ করতেন। শিশুরা ছিলেন স্যারের খুবই প্রিয়। তিনি বিভিন্ন স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে শুধু উপস্থিতই থাকেননি, পুরো রিহার্সেলও মনোযোগ দিয়ে দেখতেন, পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতেন। ১৯৯০ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বামপন্থী শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের দাপট ছিল, তখনো প্রথম ক্লাসেই স্যার এসে বলেছিলেন, আমি ৫টায় ঘুম থেকে উঠেছি, মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়েছি, ২০ মিনিট কুরআন তেলাওয়াত করেছি। সেই সময়েও তিনি এমনভাবে বলতে ভয় পেতেন না।

যারা একাডেমিক লাইনে কিছু করতে চেষ্টা করেছেন তাদের আন্তরিক শুভাকাঙ্খী ছিলেন তিনি। দল-মতের উর্ধ্বে থেকে জন্য কাজ করেছেন। অপরিচিত হলেও সহযোগিতা করেছেন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী রিক্সা থেকে নেমে রিক্সা ভাড়া দিতে পারছিল না। অনেকেই পাশ দিয়ে গেলেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু ঠিকই একজন কাছে এসে কোনো কথা না বলে পকেট থেকে সব টাকা বের করে ছাত্রীর হাতে দিয়ে দ্রুততার সাথে চলে গেলেন। পরে তিনি জানতে পারেন মানুষটি মীর আকরামুজ্জামান।

ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী, তৎকালীন এসপি, বর্তমানে ডিআইজি। একদিন নিজেকে আওয়ামীলীগ করেন বলে পরিচয় দিলেও তিনি পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হতে কার্পণ্যতা করেননি। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ককে রাজনৈতিক পরিচয়ের উর্ধ্বে মনে করতেন। তিন বছরেই ঐ শিক্ষার্থী পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরে একদিন তত্ত্বাবধায়কের পা ধরে সালাম করতে এসেছিলেন। স্যার বললেন-পা ধরা জরুরি না। তিনি বললেন- আমার জীবনে আমি পা ছুয়ে শুধুমাত্র মা-বাবাকে সালাম করেছি, আপনাকেও করবোই; না করে এ বাড়ি ছেড়ে আমি যাব না।

মীর আকরামুজ্জামানকে যারা জানেন তারা মিস্টার এভারেজ ম্যান আর তার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে জানার কথা। এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকের এদেশে বড়ই প্রয়োজন। তিনি অনেকেরই সম্পদ, অনেকেরই অনুপ্রেরণা, অনেকেরই অহংকার, অনেকেরই এগিয়ে চলার গতি। তিনি একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেধা, শ্রম ও পকেটের পয়সা খরচ করতে পছন্দ করতেন। এমন হয়েছে যে, তার কোনো একজন ছাত্র টাকার অভাবে পড়ালাখায় মনোযোগ দিতে পারছে না; স্যার জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া বেতনের পুরো টাকাই সে ছাত্রকে দিয়ে দিয়েছেন।

গণিতের শিক্ষার্থীদের মেকানিক্যাল বিষয়ে একটি কোর্স পড়তে হতো। কিন্তু কোর্সটি এক শিক্ষার্থী কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। স্যারকে জানালে তিনি রাত সাড়ে এগারোটার পরে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যেতে বলেন। শিক্ষার্থী বিভাগে গিয়ে দেখলেন স্যার পিএইচডি শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। সাড়ে এগারটায় নামাজ পড়ে তাকে ২-আড়াই ঘন্টা ঐ কোর্স বুঝালেন। পরে সেই শিক্ষার্থী ঐ কোর্সে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে স্থানীয় এক কলেজ শিক্ষককে বলেছিলেন- বয়স হয়ে গেছে, বেশিদিন থাকবো না। তোমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বও নিতে হবে। স্যারের পোশাক-মোবাইল ছিল খুবই কম দামি কিন্তু মানুষটি ছিল অনেক বড়। তিনি এতটাই বড় মাপের ও উদার মনের মানুষ ছিলেন যে সাবেক শিক্ষার্থীর বাসায় গিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তার কাছে কেউ আসলে মুখ দেখেই ক্ষুধার্ত থাকলে বুঝে বলতেন- ওতো খায়নি, খেতে দাও।

বিশ্রাম ছাড়া টানা ৫৪ ঘন্টা কাজ করেছেন তিনি। মৃত্যুর দিনও বাসা থেকে প্রেসারের ২টি ওষুধ খেয়ে এসেছেন এই বলে যে- আজ বেশি কথা বলতে হবে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন- সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় শুরুর দিকে একদিন খেলার মাঠে দর্শক হিসেবে খেলা শুরুর ২ মিনিট পরে গিয়েছিলেন। ২মিনিট দেরির কারণে খেলা শেষে পুরো মাঠে টানা দৌঁড়াতে হয়েছিল ৯০ মিনিট। তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেন, সময়ের কাজ সময়ে করতেন, নিরবে কাজ করতে পছন্দ করতেন, নিজেকে ফোকাস করতেন না, নেতিবাচকতার চর্চা করতেন না।

তিনি প্রতিষ্ঠান গড়তে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাত সাড়ে দশটায় কলেজের জন্য টাকা ধার নিতে হাজির হয়েছিলেন পরিচিত এক ব্যাংকারের বাসায়। বলেছিলেন- আপনি আজ ১ লাখ টাকা দিলে কলেজ হবে আর না দিলে কলেজ হবে না। বাড়ি করার সময় তিনি সেই ব্যাংকারকে বলেছিলেন- বাড়ি না করে প্রতিষ্ঠান করলে বেশি সওয়াব হতো। এভাবেই তিনি কষ্ট ও শ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠান করেছেন এবং অন্যকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

তিনি কাজ ছাড়া কিছু বুঝতেন না। তিনি মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গার্ডেনিংয়ে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষক, গবেষক, প্রশিক্ষক ও ব্যবস্থাপক। তিনি একজন ব্যক্তি ছিলেন না, নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান; যে প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয়েছিল জাতির মিশনে। তিনি অফিসে রুমের দরজা কখনো বন্ধ করতেন না। কারণ দরজা খোলা রাখলে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষকসহ যে কেউ আসতে পারে। তিনি জানতেন- কীভাবে মানুষকে অ্যাপ্রিসিয়েট করতে হয়। বলতেন- যে জায়গায় থাকবে সে জায়গাটাকে ওন করবে। সব সময় শুধু কাজ আর কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এসব নিয়ে কথা বললে বলতেন- এটা অন্য হিসাব।

মীর আকরামুজ্জামানের দূরদৃষ্টি এমন ছিল যে- বোর্ড মিটিংয়ে তার প্রস্তাবই গৃহীত হতো। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হবার প্রস্তাবে রাজি হননি। স্যারের সাদামাটা জীবন-যাপন ছিলো পোষাকে-খাবারে কিন্তু বাকি জীবনটা ছিলো বর্ণাঢ্য। তিনি যখন যেখানে ছিলেন সেখানে ছিলেন সেরা। কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। সমাজকে সুন্দরভাবে সাজাতে-বাসযোগ্য করতে সুন্দর চিন্তা ও মনের মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন সবসময়। শিক্ষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রসেনানী। জীবনের সব অর্থ, শিক্ষা অকাতরে বিলিয়ে গেছেন তিনি। নিজের বাসায় রেখে, পকেটের টাকা খরচ করেও অনেক ছাত্রকে এমফিল-পিএইচডি করিয়েছেন। যে দেশে গবেষণায় হাজারো বাধা, সেই দেশেই তার তত্ত্বাবধানে ৩০ জন ছাত্র পিএইচডি, ১৫ জন এমফিল এবং ৪৫ জন এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

সৎ মানুষরা যোগ্য-দক্ষও বটে সেটা প্রমাণ করেছেন সকল কর্মক্ষেত্রে। মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামের বিজয় অনিবার্য সেটা ছিলো উনার ধ্যান-জ্ঞান। তরুণদেরকে সময় উপযোগী যোগ্যতম মানুষ হিসেবে গড়ার কাজে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা, একসাথে অনেক কাজ করার যোগ্যতা অর্জনের কথা বলতেন। তিনি কথায় নয় কাজের বুদ্ধিজীবি ছিলেন। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তার যাবতীয় ভাবনা-কাজ ছিল মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য।

তিনি সারা জীবন মানুষকে যেভাবে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন তা বিরল। পরিবার, স্বজন, নিজের চিকিৎসা কোনো কিছুই নয়, সবার আগে গুরুত্ব দিতেন কাজকে। স্যারের বিয়ের আগের রাত। তরুণ মেজর হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন; মাত্র দু’দিনের ছুটি নিয়ে। ছোট ভাই-বোনেরা বায়না ধরলো কাল বিয়ে; মুখে একটু হলুদ দেই। কর্মব্যস্ত, আয়রনম্যান বললেন- অনেক কাজ; সময় নেই। ঘুমালে লাগিয়ে দিও। তিনি কারো স্মরণে বিমর্ষ হয়ে কাঁদতেও দিতেন না বরং সেই ব্যক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিবেদিত হতে বলতেন।

কাজ পাগল মানুষটি কাজ করতে করতেই হারিয়ে গেলেন। তিনি যেকোনো কাজে-উদ্যোগে লোকজনকে যুক্ত করতে চেষ্টা করতেন। এত কাজ করতেন, সব সময় কাজের মধ্যেই থাকতেন; তারপরও বলতেন- আমার অনেক কাজ। তিনি বলতেন- যে এলাকায় প্রতিষ্ঠান সে এলাকার লোকজন যদি প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান মনে করে তবেই কেবল প্রতিষ্ঠান বেঁচে থাকবে। স্যার নির্মোহ নির্লোভ জীবন যাপন করতেন। ঘরে কোনো টেলিভিশন ছিল না, ছিল না কোনো রেফ্রিজারেটর! ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও ছিল খুবই সাদাসিধে।

তিনি আত্মসমালোচনা করতেন, স্বচ্ছতা বজায় রাখতেন এবং জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করতেন। মানারাতে পূর্ব নির্ধারিত একটি ক্লাস ট্রেনিংয়ের সময় নিতে পারেননি। শিক্ষার্থীদের ক্লাসটি হবে না আগে জানাতে না পারায় একজন শিক্ষক বলেছিলেন- এটি ঠিক হলো কিনা? মীর আকরামুজ্জামান বলেছিলেন, না, এটি আমার ভুল হয়েছে। তিনি নিজের সামান্য ভুলও স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। কাজ, কাজ আর কাজ- বলে আশেপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের ভুল সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, নিজেকে শুধরাতে চেয়েছেন।

২০১৭ সালের ২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেলে গুলশানে একটি সেমিনারে বক্তব্য শেষ করেন। কিছুক্ষণ পর নিবেদিতপ্রাণ এই জ্ঞান তাপস অসুস্থবোধ করেন। গুলশান শিকদার হাসপাতালে নেয়া হয়। হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে রাত ১০টায় ৬৮ বছর বয়সে মারা যান। তিনি ওযু করে নেন। বলেন ‘আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে চলে যাচ্ছি। আমাকে পবিত্র অবস্থায় যেতে হবে।’ মৃত্যুর আগে প্রায় বেহুশ অবস্থা। দীর্ঘ সময় প্রস্রাবের বেগ ছিল, ডাক্তার বললেন বিছানাতেই করতে। অস্ফুট অথচ বজ্র-নির্ঘোষ কন্ঠে বললেন- আমি আল্লাহর কাছে যাচ্ছি; নাপাক অবস্থায় যেতে চাই না।

৩ নভেম্বর শুক্রবার বাদ জুমা গুলশানে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজ মাঠে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করে অধ্যাপক ড: আ: সামাদ। জানাযা শেষে তাকে বনানীর সেনা কবরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে স্ত্রী- মিসেস বেগম রোকেয়া ও ছেলে- মীর মো: আমিরুজ্জামান এবং মেয়ে সৈয়দা আকরামুন্নাহারকে রেখে যান।

তিনি সবসময়ের চাওয়া অনুযায়ী কর্মব্যস্ত থাকা অবস্থায়ই মারা গিয়েছেন। নিবেদিত প্রাণ এই শিক্ষানুরাগীর মৃত্যু অনেক ভক্তকেই কাঁদিয়েছে। আমিও অসম্ভব ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। প্রার্থনা করি, নবীনদের মধ্য থেকেও যেন এমন মীর আকরামুজ্জামান বেড়িয়ে আসে, যারা আগামী প্রজন্মকে সামনে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা যেন স্যারের অসম্পূর্ণ কাজগুলো এগিয়ে নিতে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে যেতে পারি। আল্লাহ স্যারের সকল নেক আমল কবুল করে তাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top