মাদককে নিয়ন্ত্রণ করা হোক

pain killer

অনেকেরই মনে আছে- ঐশী নামের মেয়েটি ইয়াবাসেবী ও মাদকাসক্ত হয়ে জীবনের খুব আপনজন জন্মদাতা মাতা-পিতাকে খুন করেছিল। মাতা-পিতার অবহেলা, পারিবারিকভাবে অ-বন্ধুসুলভ আচরণে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ, অবাধ চলাফেরার সুযোগ, খারাপ বন্ধু-বান্ধবের সাথে অবাধভাবে চলাফেরার কারণে ঐশী নিজের সুন্দর জীবন ধ্বংস করেছে। নিজের সাময়িক রঙিন মুহূর্তকে গুরুত্ব দিয়েছে। এভাবে নিষ্ঠুর নির্মম আচরণে একটি পরিবার চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না যদি প্রতিটি পরিবারের সচেতনতা, ভালোবাসা, দৃঢ় অঙ্গীকার ও সক্রিয় ভূমিকা মাদকাসক্তি নামক বিভীষিকাকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করে।

মাদকাসক্তির লক্ষণ হচ্ছে- চিন্তা ও আচরণের পরিবর্তন, চিন্তা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠা, কোনো কিছুতে বেশিক্ষণ মনোসংযোগ করতে না পারা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অবাধ্য হয়ে ওঠা। ঘুমের সমস্যা দেখা যায়, সারারাত জেগে থাকে আর পরদিন দুপুর ২টা-৩টা পর্যন্ত ঘুমায়। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম দেখা যায়। খিদে কমে যায়, বমিভাব দেখা দেয়। বাসায় ঠিকমত খায় না, গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে, কোনো কোনো দিন বাসায়ই ফিরে না। কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলে। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নানা উছিলায় বাবা-মার কাছে টাকা চায়, টাকা না পেলে রাগারাগি করে। শরীর ভেঙে পড়ে, দুর্বল হয়ে যায়। হাত-পা কাঁপতে পারে। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়, পড়ালেখার মান কমে যায়, চাকরি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। বাথরুমে বেশি সময় কাটায়। নতুন নতুন বন্ধু-বান্ধবী তৈরি হয়, পুরনোদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। ঘন ঘন মোবাইলের সিম বদলায়। ঘরের ভেতর মাদক গ্রহণের বিভিন্ন উপকরণ পাওয়া যায়। বাসার জিনিসপত্র/ টাকা-পয়সা/মোবাইল ফোন চুরি হতে থাকে। অনেক সময় বিনা কারণে খুব উৎফুল্ল বা খুব বিষণ্নতা দেখা দেয়। অসংলগ্ন কথা বলা বেড়ে যায়। স্ত্রী-স্বামীর সাথে সবসময় ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে, স্বাভাবিক যৌনজীবন ব্যাহত হয়। সবসময় উৎকণ্ঠা বা অহেতুক ভীতির মধ্যে থাকে। নিজেকে গুটিয়ে রাখে, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো বর্জন করে। শখের পরিবর্তন ঘটে। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যকে অহেতুক সন্দেহ করা শুরু করে। উপরের সবগুলো লক্ষণ একসাথে যেমন সব মাদকাসক্তের মধ্যে থাকে না, তেমনি উপরের লক্ষণগুলো মাদকাসক্তি ছাড়াও ভিন্ন কারণে হতে পারে।

মাদকাসক্তির চিকিৎসার বেশক’টি ধাপ রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়, মাদকাসক্তির ধরন নিণয় করা হয়। শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর তার ‘উইথড্রয়াল’ সিনড্রোম এবং মাদক প্রত্যাহারজনিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। শরীর থেকে মাদকের ক্ষতিকর রাসায়নিক অংশগুলো বের করে দেয়া হয়, এ ধাপটিকে বলা হয় ‘ডিটক্সিফিকেশন’। এসময় তার পুষ্টি নিশ্চিত করতে হয় ও প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদান করা হয়। মাদকমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন স্বীকৃত ওষুধ নির্দিষ্ট নিয়মে মনোচিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করা লাগতে পারে। পরবর্তী ধাপে তাকে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মাদকমুক্ত থাকার প্রেরণা দেয়া হয়। আবার যাতে মাদক গ্রহণ না করে সে বিষয়ে উপযুক্ত পরামর্শ দেয়া হয়, ফের আসক্ত হওয়ার জন্য যেসব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ রয়েছে সেগুলো থেকে দূরে থাকার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করা হয়, নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও উৎসাহিত করা হয় চিকিত্সাধীন আসক্তজনকে। আসক্ত হওয়ার আগের যোগ্যতা ও গুণাবলী ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। মাদকাসক্তি চিকিৎসার ধাপগুলো বেশ দীর্ঘমেয়াদি। তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করাতে হয়। অপরিপূর্ণ চিকিৎসার কারণে আবার আসক্তি (রিল্যান্স) হতে পারে। ফ্যামিলি কাউন্সেলিংও চিকিৎসার একটি জরুরি ধাপ।

মাদকের বহুবিধ সমস্যা চিন্তা করে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা জাগাতে হবে। প্রতিটি পরিবারপ্রধানকে সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূতিকাগার হতে হবে পরিবার। সৃজনশীলতা, কল্যাণ, শান্তি ও সৌন্দর্যের জন্য মাদককে নিয়ন্ত্রণ করাই হোক আমাদের মূলমন্ত্র! মাদকের প্রসার ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা হোক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top