আত্মিক উন্নতিতে গণমানুষের কল্যাণ

development

আত্মিক উন্নতিকে কম গুরুত্ব দিলে- মানুষ অন্য প্রাণীর তুল্য হয়ে যায়। মনোজাগতিক ইতিবাচক পরিবর্তন কঠিন হয়। শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা থাকে না। আত্মিক উন্নতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত- সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, সদ্গুণাবলি, সুচিন্তা ও সৎকর্ম।

আত্মিক অবনতি কেন হয়?

নগ্নতা, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতায় জড়ালে।শয়তানের আনুগত্য করলে।বিপথগামী হলে। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় বোঝার জ্ঞান না থাকলে। নিজের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি অন্যের অধিকার রক্ষায়ও নিবেদিত না হলে। আত্মা অপরিশুদ্ধ থাকলে। উন্নত মূল্যবোধ না থাকলে। মোহমুক্ত না হলে।

আত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করতে করণীয়

কোরআন তিলাওয়াত করা; শিক্ষা দেয়া এবং শিক্ষা নেয়া। আত্মিক উন্নতির জন্য কলবকে ঠিক করা। হারাম ও সন্দেহজনক কার্যাবলি থেকে বাঁচা। স্বীয় বিবেককে যথার্থরূপে সুষ্ঠু ও সঠিক করা।

এছাড়া এছলাহে কলব বা আধ্যাত্মিক শুদ্ধি লাভ করা। স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষ্ম আত্মার ও বিবেকের উন্নতি করা। আল্লাহকে স্মরণ করা, আল্লাহর জিকির করা। ফরজ, ওয়াজিব ছাড়াও নফল ইবাদত বাড়ানো। আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া।

আত্মিক উন্নতি কেন অধিক গুরুত্বপূর্ণ?

আত্মিক উন্নতি না হলে মানুষের নেক আমলও নিষ্ফল হয়ে যায়। নেক আমল নিষ্ফল হয়- নেক আমল করার একনিষ্ঠ নিয়ত না থাকলে। আল্লাহ পথে ও মতে না চললে। ভুলের কারণে নেক আমল নষ্ট হয়ে গেলে।পাপকাজ জারি রেখে আল্লাহকে ভয় করার দাবি করলে। নেক কাজ ছাড়াও সাওয়াবের বা উত্তম প্রতিদানের আশা করলে।

অপরাধের কারণে লজ্জিত না হলে বা অন্তরে লজ্জা অনুভব না করলে। গোনাহের কাজ ছেড়ে না দিলে বা অহংকারের কারণে ক্ষমা না চাইলে। নিজেকে সংশোধন করার একান্ত ইচ্ছা ও চেষ্টা না থাকলে। বাহ্যিক লোক দেখানো নেককাজ করলে বা শুধু মুখে মুখে ভালো কাজের কথা বললে।

ভালো কাজের মেহনত ব্যতিত শুধু দোয়ার ওপর নির্ভর করলে। নিজে আমল না করে অন্যকে উপদেশ দিলে। মন থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে ও আন্তরিকতার সাথে ভালোবেসে কাজ না করলে। মনে রাখতে হবে ইখলাসবিহীন যে কোনো আমলই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ ও একেবারেই মূল্যহীন।

নেক আমল বদ আমলে পরিণত হয়

কোনো কাজে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য না দিলে। নবী-রাসূল ও সাহাবীদের পদ্ধতি না মেনে নিজের খেয়ালখুশিমত ভালো কাজ করলে। কৌশল করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্য ভুললে। দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে বে-দ্বীনের কাজ করলে।

গোনাহকে দ্বীন প্রচারের বা নেক কাজরে মাধ্যম বানালে। আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করলে। নেক আমল করে দুনিয়ায় খ্যাতি চাইলে বা আল্লাহর সন্তুষ্টির পাশাপাশি নিজের সুনামও চাইলে। হিরছ বা লোভ থাকলে। তমা বা উচ্চাভিলাষ থাকলে। রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা থাকলে।

কিবর বা অহংকার থাকলে। কিজব বা মিথ্যা থাকলে। গিবত বা পরনিন্দা থাকলে। হাছাদ বা হিংসা থাকলে। উজব বা অহমিকা থাকলে। কিনা বা পরশ্রীকাতরতা থাকলে। বুখল বা কৃপণতার মন্দ স্বভাব থাকলে।

আত্মিক অবনতি রোধের উপায়

আত্মিক অবনতি রোধের  ক্ষেত্রে কিছু করণীয় রয়েছে। নিজের আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি আশপাশের মানুষের মনকে জাগানোর মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করতে হলে মানুষের ইহকালীন সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ জানা ও জানার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। ক্ষমতা পেলে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব- এমন চিন্তা বাদ দিতে হবে। দুনিয়ার সমস্যার সমাধান দিয়েই মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে।

বিষয়ভিত্তিক গবেষণামূলক কমিটির সাথে আলোচনা- পর্যালোচনা-সুপারিশমালার আলোকে সমস্যা জেনে তা সমাধানের কৌশল ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। যেমন আমরা ক্ষমতায় গেলে এভাবে দুর্নীতি দূর করব, এভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব ইত্যাদি।

সবকিছু এমন হতে হবে, যাতে মানুষের মনের কথা প্রতিফলিত হয়। যেসবের মধ্যে থাকবে জনগণের দুর্দশার কথা, জনগণের সমস্যা সমাধানের কথা, ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের কথা। শুধু স্লোগান দিয়ে, ইসলাম ইসলাম করলে হবে না; সব মানুষের মনের কথা বলতে হবে।

সবার সমস্যা সমাধানের কথা বলতে হবে। জনগণ যে নেতা বা দলের মাধ্যমে শান্তি-সমৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখে, ওই নেতা ও দলকে সমর্থন দিয়েই যাবে। কর্মসূচির মধ্যে ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন থাকবে। ধর্মের কোনো কথা না থাকলে বা না বললেও যখন তারা খুশি হবে তখন নেতার অনুসরণ করবে।

ইসলামি দল বলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো কথা দাবি থাকবে না এমন নয়। ক্ষমতায় গিয়েই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে কিংবা ক্ষমতায় গেলেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। তাই জনগণের কল্যাণের জন্যে যা কিছু করার যোগ্যতা ও সুযোগ আছে, তা আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।

নাজিমুদ্দিন আরবাকান বলতেন, ‘দেশের ও জনগণের পরিবর্তন আনতে হলে ক্ষমতায় যাওয়ার বিকল্প নেই। ক্ষমতায় অবশ্যই একমাত্র জনগণের মন জয় করে, তাদের সমর্থন নিয়েই যেতে হবে। অন্য কোনো পন্থায় নয়।’ ফলে জনগণের মন জয়টা আগে করতে হবে।

গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা চাইলে দলের সঙ্গে যেকোনো লোক কাজ করতে পারবে, যে কেউ যোগ দিতে পারবে- এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে; কারণ সবার ভোটই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই দলকে কীভাবে বেশি করে জনসম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।

ব্যক্তিজীবনে সরল জীবন যাপন করতে হবে। সব স্তরের লোকজনের সাথে খুব সহজে মিশে যেতে হবে।অতুলনীয় ব্যবহার দিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে হবে। যা বলবেন তা সময়মতো বাস্তবায়ন করবেন।

তরুণ-যুবকদের প্রাধান্য দিতে হবে; কারণ কোনো সংগঠনকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন তারুণ্যের শক্তি, প্রবীণের বুদ্ধি (Young’s blood, old’s head)। রাজনীতিতে ও সমাজের কাজে পরিবর্তন আনা যৌবনকালে যত সহজ, তা বার্ধক্যে অনেকটা কঠিন।

জনগণের নেতা হতে চাইলে চরিত্র ও যোগ্যতা দিয়ে দল ও জনগণের মন জয় করতে হবে। যার কথা জনগণ শোনে সেই জনগণের নেতা হতে পারে। শুধু দলের অনুসারীদের কাছে প্রিয় হলেই জননেতা হওয়া যায় না।

কোনো নেতা যদি জনপ্রিয় না হন তাহলে তার দল ও আদর্শও জনপ্রিয় হবে না। রাজনৈতিকভাবে সফল হতে না পারলে নেতার উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়া অথবা দলের অনুসারীদের উচিত নেতৃত্ব পরিবর্তন করা।

প্রত্যেক নেতা ও কর্মীর সমাজের প্রতিটি মানুষের সাথে মেলামেশা করার এবং বিয়েশাদি, জানাজা, মিলাদ, সুন্নতে খতনা ও যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সময় থাকতে হবে। সাধারণ মানুষের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।

প্রতিবেশির সন্তান জন্মের পর তাদের বাড়ি গিয়ে মোবারকবাদ জানাতে হবে এবং দলের নেতার পক্ষ থেকে সালাম ও উপহার দিতে হবে। স্থানীয় নেতাদের সমাজের সব লোকের সাথে পরিচিত হতে হবে। সুন্দর কথা ও জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে হবে।

জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের জন্য আরও উত্তম পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনীতি করতে হবে। পেশাজীবীদের ছোট ছোট দল নিয়ে গণসংযোগ করতে হবে। কীভাবে কোন সমস্যার সমাধান করবেন, সে বিষয়ে লেখাপড়া-চিন্তা-গবেষণা করতে হবে।

নারীদের উৎসাহের সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। সংগঠনকে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। কশাই, মুচি থেকে শুরু করে ক্লাবে গিয়েও দাওয়াতি কাজ করতে হবে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে মিশে সংগঠন করা শিখতে হবে। প্রচারণায় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।

আদর্শের জন্য নিবেদিত করতে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে- সবার মধ্যেই ন্যূনতম সচ্ছলতা পরিলক্ষিত হবে। সবাই সময়কে কাজে লাগানোর মতো ব্যস্ত থাকবে। কেউ বেকার থাকবে না। প্রয়োজনে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে স্বাবলম্বী করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজের সব কিছু রেখে অন্যকে যথাসাধ্য সাহায্য করবে। মসজিদগুলো সমাজের তথা এলাকার মানুষের সামাজিক কাজেও আসবে।

এসবের জন্য চিন্তার পরিবর্তন করতে হবে। যে পথে গন্তব্যে পৌঁছার কোনো সম্ভাবনা নেই, ইসলামের মূল আকিদা ও মৌলিক শর্তাবলি পরিবর্তন না করে সেই পথ পরিবর্তন হতে পারে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি সংস্কার করতে হবে।

যদি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো ফলপ্রসূ করতে সময়ের দাবি অনুযায়ী উপস্থাপন করা না যায়, জনগণের নিঃস্বার্থ সেবক রুপে গড়ে তোলার কলাকৌশল অনুসন্ধান করা না হয়, জনমত সৃষ্টিতে ইসলামের আলোকে আধুনিক যোগাযোগ পদ্ধতির প্রয়োগ না হয় এবং সার্বজনীন দাওয়াতী চরিত্র গঠন ও দাঈর সক্ষমতার উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়ন করা না যায়- তাহলে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা ও ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নেক লোকদের যোগ্য বানাতে ও যোগ্য লোকদের নেক বানাতে যা করণীয় তাই করতে হবে। কথা ও কাজের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্যতা আনয়ন করতে জীবন যাপনের শিল্পকলা যেমন হওওয়া উচিত তেমনই হতে হবে। জীবনকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করে ইসলামের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। রুহের শক্তিকে বৃদ্ধি করে দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে ইলম ও আমল বাড়াতে হবে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top