আগামীর শিক্ষা হবে নতুনধারার

Learning Training Teaching

আনিসুর রহমান এরশাদ : শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় পাঠ তৈরি, শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এমতাবস্থায় আগামীর শিক্ষাব্যবস্থায় নিরাপদ পাঠদান নিশ্চিতকরণ, করোনা ঝুঁকিমুক্ত পদ্ধতি ও ভবিষ্যতে শিক্ষাখাতে বিকল্প পথ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। ভবিষ্যতে কোনো মহামারিতেও যেন নিরাপদ ক্লাসরুম নিশ্চিত করা যায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠামুক্ত পরিবেশে পঠন-পাঠন চলে তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। ক্লাসরুমের বিকল্প পদ্ধতি নিয়েও পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। পুরনো শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বন হবে না। অনলাইন শিক্ষা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের বিকল্প শিক্ষার আরেকটি নতুন ধারা।

এক নজরে দেখে নিন

শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন

করোনার প্রভাবে উন্নতবিশ্বে ইতোমধ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা কার্যক্রমে ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বেড়েছে। উন্নত বিশ্বে সামাজিক মাধ্যম জুম অ্যাপ ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। বাংলাদেশে সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। ছেলেমেয়েদের ফাঁকা জায়গায় দূরে দূরে বসিয়ে ‘লকডাউন স্কুল’ চলছে। হোয়াইট বোর্ড, মার্কার ও পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে অভ্যস্ত ফ্যাকাল্টির মানসিকতাকেও এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে।

মুখস্থবিদ্যা কমবে

আগামীতে পরীক্ষা মুখস্থবিদ্যার উপর ভিত্তি করে হবে না। ভবিষ্যতে পরীক্ষার প্রশ্নসমূহ বিশ্লেষণাত্মক হবে এবং ছাত্রদের আরও সৃষ্টিমূলক হতে হবে। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে ও উদ্ভাবনী হতে হবে। সংকটের ভেতরেও সুযোগ খুঁজে বের করতে হবে। কোচিং-গাইড নির্ভরতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্ত হবে। মননশীলতার বিকাশ হবে অনায়াস, স্বাচ্ছন্দ্য ও টেকসই। মুখস্থবিদ্যার বদলে নতুন কিছু তৈরিকে, অথবা নতুন চিন্তাধারাকে উৎসাহিত করা হবে। যার যে বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে, তাকে সে বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ হবে

ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অনেক কাজ যা এখন শিক্ষকেরা করেন তা স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠবে। এই পরিবর্তনের জন্য শিক্ষকদের নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় সর্বদা নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন ও সম্পাদন চক্র চলমান থাকে। প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যায়। এডুটেকভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারাই চিরাচরিত শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন হবে।

খোলা মাঠে শিক্ষাদান

বাচ্চারা যাতে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে তার সমাধান খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থা। হালকা ওজনের টেবিল ও চেয়ার বাগানে নিয়ে টিচাররা মাঠে বসে উন্মুক্ত জায়গায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে পারেন। খোলা চত্বরে, উঁচু ভবনের ছাদে এবং এমনকি পরিত্যক্ত নৌকায় পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে। সিঙ্গাপুরে বহু বছর ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া শেখানোর চল রয়েছে। দেশটি শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে তোলার জন্য খোলা জায়গায় পাঠদানে সাফল্য পেয়েছে।

উন্মুক্ত পরিবেশে, প্রকৃতির সাহচর্যে, আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদানে প্রকৃতির সাথেই নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, শেখার আগ্রহ বাড়ে, শারীরিক তৎপরতা বাড়ে এবং মানসিকভাবেও তারা সমৃদ্ধ হয়। শিক্ষক পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নিজের অভিজ্ঞতা ও মনন শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। এধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য পার্ক ও জনসাধারণের জন্য খোলা জায়গাও কীভাবে বাড়ানো যায় সেটাও ভাবা উচিত।

শিক্ষামূলক কনটেন্ট

এখন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে জুম বা ওয়েবএক্স বা স্কাইপ বা গুগল হ্যাংআউটস বা মাইক্রোসফট টিম বা গোটুমিটিং ব্যবহার করে। এই ভিডিয়ো কনফারেন্সিং সফটওয়্যারগুলির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দেখতে পান শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে। লেকচারকে অনলাইন ক্যামেরার সাহায্যে রেকর্ড করায় ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি হয়।গুগল ক্লাসরুম, গুগল হ্যাংসাউট মিট, স্কাইপে, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এর মাধ্যমে সহজেই শ্রেণী কার্যক্রম চালানো যায়।

সহজ সংরক্ষণ

হাতে লেখা কাগজের লেকচারশীট বা নোটের জায়গায় এসেছে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বা পিডিএফ বা ওয়েবসাইট লিংক বা ইউটিউব লিঙ্ক। অনলাইন মাধ্যমগুলোর সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে এসবের সহজ সংরক্ষণ। তাই শিক্ষাদানের পরেও শিক্ষার্থীরা নিজেদের সময়ানুসারে অনলাইনে পড়তে বা ডাউনলোড করে নিয়ে নিতে পারছে।

গুগল স্প্রেডশিট-ক্লাসরুম

উপস্থিতি নথিভুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গুগল স্প্রেডশিট এবং গুগল ক্লাসরুম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও উপস্থিতির নথি রাখা হচ্ছে। এখানেও কোনও কারচুপির জায়গা নেই। যা হচ্ছে তা সাদাকালো নথির সাহায্যেই হচ্ছে। এই নথি দরকার মতো প্রশাসনিক প্রয়োজনেও ব্যবহার করা সম্ভব।

অংশগ্রহণমূলক

অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় পাঠ উপকরণ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং ক্লাসের সময় শুধুমাত্র প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে সন্দেহ দূরীকরণ হচ্ছে, সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। এতে এতদিনের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সংগঠিত হচ্ছে। পাঠদান করলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। ক্লাসের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একপেশে লেকচারের দিন শেষ। শিক্ষাকে দক্ষতায় পরিবর্তন করাও শিক্ষকের অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়ছে।

মিশ্র শিক্ষা

করোনা-পরবর্তীতে ৪০ শতাংশ পাঠ অফলাইনে গতানুগতিক পন্থায় দেওয়া হবে। বাকি ৬০ শতাংশ ইন্টারনেট-ভিত্তিক শিক্ষা হবে। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে বুদ্ধিগত বিকাশে অনলাইন শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেবে। অনলাইন শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে। প্রযুক্তিনির্ভর অন্যান্য ব্যবস্থার মতোই হয়তো অনলাইন শিক্ষাটাও এক সময় ‘অতি স্বাভাবিক’ একটি কার্যক্রম হয়ে উঠছে। এর মানে অফলাইন-অনলাইন পদ্ধতির মিশ্রস্রোত শিক্ষাকাঠামোয় প্রাণ ফিরিয়ে দেবে।

ক্যাম্পাসহীন শিক্ষাব্যবস্থা

দূরশিক্ষণ শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব আনছে। ক্যাম্পাস-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ক্যাম্পাসহীন শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ছাত্ররা ঘরে বসেই পড়াশোনা করবেন নানান অভিনব পন্থা ব্যবহার করে। তাই ভবিষ্যতে কাজ এবং পড়াশোনা, দুটোই চালিয়ে যাওয়ার অপরিমিত সুযোগ থাকবে। মুখস্থবিদ্যাকে প্রতিস্থাপন করবে সত্যিকারের বিদ্যা।

দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা

ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষা থাকবে না। দক্ষতা দান না করলে সেই শিক্ষার মূল্য থাকবে না। কাগুজে ডিগ্রির দিন শেষ হতে চলেছে। করোনা মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার দাম। কর্মক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত হওয়া তথা চাকরির বাজারের উপযোগী দক্ষতা, অন্তর্দৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন গুরুত্ব পাবে। অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রচুর অনলাইন ক্লাস আছে।

অনলাইন কোর্স সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেকের সুনাম আছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি করে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা যেতে পারে। নিজের জন্য যত বিনিয়োগ করবেন, অভিজ্ঞতা তত বাড়বে এবং তত বেশি কর্মক্ষেত্রের যোগ্য হয়ে উঠবেন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, যারা দক্ষ প্রবাসী শ্রমিকের চাহিদা মেটাবে। জটিল চিন্তা ও সমস্যা সমাধান, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সহযোগিতামূলক ও দলগত দক্ষতা, নৈতিকতা ও সহমর্মিতা, সক্রিয়তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা বাড়বে।

মূল্যভিত্তিক শিক্ষা

মূল্যভিত্তিক শিক্ষাই হবে করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর পাথেয়। এই মহাদুর্যোগ মানুষকে নতুন করে মনুষ্যত্ব শেখাচ্ছে। বাজারকেন্দ্রিক সভ্যতা থেকে মানুষ আবার সহমর্মিতা-চালিত সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই পরিবর্তনের পিছনে শিক্ষা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার

করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষক এবং ছাত্র ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং লিঙ্কেডিন স্লাইডশেয়ারের সাহায্যে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। স্থান এবং কাল ভবিষ্যতে শিক্ষার ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যাবে। কোনো একটা ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষ যখন অভ্যস্ত হয়ে যায়, সেখান থেকে সে সহজে বেরিয়ে আসতে চায় না। এটাই হয়তো মানবমনের ‘স্থিতিজড়তা’। এটা ধীরে ধীরে কেটে যাবে।

মানবাধিকারে ইন্টারনেট

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্জাল একটি মৌলিক মানবাধিকারে পরিবর্তিত হবে। খাদ্য, পরিধান এবং বাসস্থানের মতো তথ্য আমাদের প্রাথমিক প্রয়োজনে পরিবর্তিত হব। একই ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও অন্তর্জাল অপরিহার্য হয়ে উঠবে।

ওয়েবিনার বাড়বে

অনলাইন আলোচনাসভা বা ওয়েবিনার জ্ঞান অর্জন এবং জ্ঞান বিতরণের একটি প্রাথমিক পন্থা হয়ে উঠবে। আমরা বিশ্বজুড়ে সব নামী বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক ওয়েবিনার সংগঠিত করছে। করোনা-পরবর্তী জগতে ওয়েবিনারের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।

তথ্যভিত্তিক শিক্ষা কমবে

করোনা-পরবর্তী জগতে শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা বিকাশে সাহায্য করবে। তথ্যভিত্তিক শিক্ষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই পাল্টে যাওয়া বা বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়ায়ই সামনে চলতে হবে।

অনলাইনে পাঠ কার্যক্রম

অনলাইন পাঠ কার্যক্রমের অন্যতম উপাদান। গুরুত্ব পাবে বিভিন্ন মাধ্যমে অডিও, ভিডিও রেকর্ডিং, স্লাইড, পিডিএফ, ওয়ার্ড ডক্যুমেন্ট, স্ক্যান, ইমেজ ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সকল শিক্ষার্থীর কাছে সরবরাহ করা, নিয়মিত বাড়ির কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া, মৌখিক প্রশ্নোত্তর, কুইজ, আলোচনা বা ভাইভা নেয়ায় মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা এবং পরীক্ষা নেয়ার অনলাইন পদ্ধতি। ইতোমধ্যেই পড়াশোনা নতুন মাত্রা পেয়েছে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনের পর্দায়।

অনলাইন ক্লাসরুম

বিল গেটস এবং ম্যালিন্ডা গেটসের উদ্যোগে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং ম্যাসাচুসেস্ট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহযোগিতায় অনলাইন ক্লাসরুম ‘ইডিএক্স (বফঢ)’ চালু রয়েছে। অলাভজনক এ প্ল্যাটফর্মের স্লোগান হচ্ছে ‘ভবিষ্যতের জন্য অনলাইন এডুকেশন: সবার জন্য, যেকোনো জায়গা থেকে, যেকোনো সময়’। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অনলাইন ক্লাসরুম রয়েছে। অনলাইন ক্লাসরুমের পাইওনিয়ার ‘খান একাডেমি’ এগিয়ে চলছে বীরদর্পে। অনলাইনে পড়াশোনার এ ধরনের উদ্যোগ দিন দিন বাড়বে। ক্লাসরুমকে চিন্তা করেই ডিজিটাল ক্লাসরুমের কনসেপ্ট তৈরি হয়েছে।

অনলাইন ক্লাস ব্যবস্থাপনা

ফেসবুক বা জুম ব্যবহার করে অনলাইন পাঠদান হয়। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইউটিউব চ্যানেলকে ব্যবহার করা যায়। ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও কনটেন্টগুলো দিলে শিক্ষার্থীরা সহজে পায়। অনেকেই সেগুলো দেখে ও সে অনুযায়ী পড়াশোনা করে। প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিনকার ক্লাসগুলো আপলোড করা যায়। আগে থেকেই সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের নাম ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। শিক্ষকরা কথা বলতে পারেন। তথ্য নিতে পারেন। অভিভাবকদের মাধ্যমে পড়াশোনার নির্দেশনাও দিতে পারেন।

রেকর্ডকৃত ক্লাস

রেকর্ডকৃত ক্লাসের জনপ্রিয়তা জোরদার হতে শুরু করেছে।খান একাডেমির মতো শিক্ষামূলক ভিডিও ক্লাসগুলো ছাত্ররা ধীরে ধীরে ব্যবহার করা শুরু করেছে। ‘টেন মিনিট স্কুল’, ‘রেপ্টো’, ‘শিক্ষক বাতায়ন’, ‘ই-শিক্ষণ’, ‘স্টাডি-প্রেস’ ইত্যাদির মতো আরও বেশ কয়েকটি অনলাইন ক্লাসরুম প্ল্যাটফর্ম কার্যক্রম শুরু করেছে। শিক্ষার্থীরা নিজের সময়-সুযোগমতো নিজের অবস্থানে থেকেই এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে।

রেডিওতে পাঠদান

বেতারকে পার্টনার করে এফএম ও কমিউনিটি রেডিওগুলোকে যুক্ত করে শিক্ষকদের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এই বেতার কার্যক্রম। টিভি ও ইন্টারনেটের চেয়েও রেডিও কাভারেজ বেশি থাকায় এবং সেটিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিগত শিক্ষাদান কার্যক্রমের আওতায় আনা যাবে বলে মনে করছেন তারা।

বিনাখরচেই পড়াশোনা

ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে, কম্পিউটারের মাধ্যমে নিত্যনতুন বিষয় শেখার সুযোগ বাড়বে। প্রতিটি শিশুর হাতে অক্ষর জ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন গেমস, ছবি, কার্টুনসহ বিভিন্ন ই-বুকসহ ল্যাপটপ তুলে দেয়ার চেষ্টা বাড়বে। দরিদ্র শিশুরাও বিনা খরচায় ঘরে বসে শিক্ষক ছাড়াও যাতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেজন্য অনেকে এগিয়ে আসবে। শিক্ষার জন্য স্কুলেই যেতে হবে না, শিক্ষা হবে অবাধ, বিনা খরচে, সবার জন্য উন্মুক্ত। অনলাইন ক্লাসরুম হবে ফ্রি। বিনা খরচে প্রতিটি মানুষ নিজের ইচ্ছামত পড়াশোনা করবে কম্পিউটারের সামনে বসেই। যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে নিজের পছন্দমত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকবে।

সফটওয়্যারের ব্যবহার

প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেওয়ার জন্য ব্যবহার উপযোগী সফটওয়্যার হবে। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করার সমস্যা দূর হবে। অনলাইনে নানা ধরনের কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রোজেক্ট পেপার তৈরি এবং ডিফেন্স, মৌখিক পরীক্ষা, ওপেন বুক পদ্ধতিসহ লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে শিক্ষাকার্যক্রম চলবে।

অটোমেশন পদ্ধতি

স্কুল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন পদ্ধতি হতে পারে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। উন্নত বিশ্বে দূরশিক্ষণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে প্রধানত জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শাদ’ নামে একটি লার্নিং অ্যাপ চালু করেছে। এ অ্যাপে সব স্কুলশিক্ষার্থীকে রেজিস্টার করার জন্য বলা হয়েছে, যাতে তারা অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।

স্বাস্থ্যবিধির জোরালো চর্চা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো কোভিড শিষ্টাচারগুলো প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে উঠবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানোর প্রশ্নটি জোরালো হবে। আবার মুখর হয়ে উঠবে শিক্ষাঙ্গনগুলো নতুন পোশাকে, নতুন সাজে, নতুন ছকে।

এডুটেকের প্রয়োগ

এডুকেশন টেকনোলজি বা এডুটেক এখন শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে। প্রাইমারি শিক্ষা, সম্পূরক শিক্ষা, পরীক্ষার প্রস্তুতি, রিস্কিলিং, অনলাইন সার্টিফিকেশন, ভাষা-শিক্ষা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে এডুটেক্ এখন বহুল ব্যবহৃত। পৃথিবী-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটগুলো এখন অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রি প্রদান করছে।

সামনের বছরগুলোয় এডুটেক আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এখন অনলাইনে শিক্ষাকে আরও ব্যক্তিবিশেষে স্বতন্ত্র করা যাচ্ছে। অর্থাৎ যে শিক্ষার্থীর যেমন প্রয়োজন বা যতটা প্রয়োজন, ঠিক ততটা তাকে শিক্ষাদান করা হবে। করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঝুঁকছে অনলাইন শিক্ষাসহ নানা সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে।

এডুটেনমেন্ট বৃদ্ধি

এডুটেনমেন্ট বা গেমিফিকেশনের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসও এখন দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা খেলার ছলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখতে পারে। অনলাইন লাইভ ক্লাসের প্রসার শুরু হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো হবে। ‘গুগল ক্লাসরুম’ বা অন্যান্য অনেক কোলাবোরেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষক একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইন্টারেকটিভ ক্লাস নিতে পারেন। এই ক্লাসগুলোকে রেকর্ড করে শিক্ষার্থীরা পরে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এমবাইব

রিলায়েন্স জিও-র উদ্ভাবন নতুন ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এমবাইব (ঊসনরনব)। এই বিশ্বমানের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মেই রয়েছে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের সুবিধা। এমবিবে-র সাহায্যে অনলাইনে শিক্ষকরা ক্লাস নিতে পারবেন। ক্লাসের মধ্যেই প্রশ্ন করতে পারেন শিক্ষার্থীরা। আলাদা উইন্ডোতে প্রশ্ন লিখে পাঠানো যাবে। একসঙ্গে অনেক পড়ুয়া ক্লাস করতে পারবেন।

অনলাইনেই বই পাবেন পড়ুয়ারা। তাদের প্রয়োজন মতো স্টাডি মেটিরিয়াল তৈরি করবে জিও। শিক্ষক ও পড়ুয়াদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকছে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সাহায্যে প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেবে। দূর শিক্ষণের বিপ্লব এ প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসহীন শিক্ষাব্যবস্থার দিকে। যুগোপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গড়ে উঠবে বিশ্ব নাগরিকদের জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ।

কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ

কারিকুলাম শিক্ষার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। আগামী কারিকুলাম গতানুগতিক হবে না। বর্তমান সময় ও আগামীর কথা মাথায় রেখেই কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ হবে। কমিউনিটি বেইজড বা ক্রাউড সোর্স কারিকুলামের মাধ্যমে শিক্ষা যতটুকু কমিউনিটির প্রয়োজন, ততটুকু কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলামের পাশাপাশি বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রমও কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হবে।

এডুকেশনাল রিসোর্স

প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের সাথে দেয়া ওয়ার্কবুকে বাসায় বসে বাড়ির কাজগুলো নিজেরাই সম্পূর্ণ করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পড়া মূল্যায়ন পদ্ধতিতে হোয়াটসআপ, ইমো, ভাইভার, ফেসবুক, ইউটিউব এবং জুম ব্যবহার হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ইন্টারনেট, কম্পিউটার, রেডিও, টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের ব্যবহার আরও সহজলভ্য করা হবে। শিক্ষা প্রদানের জন্য ফিচার ফোন এবং বাইটস সাইজ এডুকেশন চালুও হতে পারে।

মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা

শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেকোনো জরুরি সময়ে যেকোনো সমস্যা সবার সহযোগিতা নিয়ে কিভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব এবং মানসিক শক্তি আরও সুদৃঢ় করার উপায়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একে অপরের পাশে এসে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার উপায়গুলোও সামনে আসবে। সিলেবাসে আবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ বাড়বে। শিক্ষার পদ্ধতিগুলো হবে- সমস্যা ভিত্তিক, প্রজেক্ট ভিত্তিক, ধারণা বা অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখন।

প্যারেন্টিং এডুকেশন

আগামীতে হয়তো বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রমের সময়সীমা কমে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা বাসায়ই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করবে। নতুনভাবে তৈরি হবে ‘হোম স্কুলিং আইডিয়া’। হোম স্কুলিংয়ের জন্য প্যারেন্টিং এডুকেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিভাবক একজন ভালো শিক্ষক কিভাবে হয়ে উঠতে পারেন তার উপর গুরুত্ব বাড়বে। শিক্ষার্থীর পড়া তৈরিতে সহযোগিতা, বাসায় বসে মূল্যায়ন ও ফিডব্যাক দেওয়ার জন্য প্যারেন্টিং এডুকেশনের প্রয়োজন হবে। তাই প্যারেন্টিং এডুকেশনের উপর গুরুত্ব খুব তাড়াতাড়ি বাড়বে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top