প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে শিশুতোষ চরিত্রের হওয়া দরকার

Md Mizanur Rahman Zami
প্রকৃতিগতভাবে মানুষ খুবই অস্থির ও চঞ্চল প্রকৃতির। কিন্তু সাফল্য আসে ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ে। সম্ভবত, বাংলাদেশের মানুষ বেশি অস্থির এবং ধৈর্য্যহীন।এদের মাঝে রাতারাতি (শর্টকাট ওয়েতে) বড়লোক হবার তীব্র আকাঙ্খা সমাজে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি’র স্ফূরণ দেখা দিয়েছে। অনেকের ভিতরে শর্টকাটে বিখ্যাত হবার বাসনা দেখা যায়, ফলে সৃজনশীলতার চেয়ে দলবাজী, কিংবা চাটুকারিতার আধিক্য লক্ষণীয় হারে বাড়ছে । তবে এগুলো ক্ষণিকের জন্য প্রতাপশালী হলেও দীর্ঘস্থায়ী হবার কোনো সম্ভাবনা নাই। বিপদে হতাশ না হয়ে ধৈর্য্য ধরলে সহসাই নতুন পথ পাওয়া যায়।
আমি দুনিয়ার যত মানুষের সাথে মিশেছি, তাদের বোঝার চেষ্টা করেছি, তাদের কাজ ও সাফল্যকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করেছি। তাদের ধৈর্য্য, সহনশীলতা, দীর্ঘ সময় অধ্যবসায় তাদেরকে বড় মানুষে পরিণত করেছে। এদিক থেকে ব্রিটিশরা জাতি হিসেবে খুবই হিসেবী মনে হয়েছে আমার কাছে। ছোট একটা দেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ বলতেও তেমন উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নাই। আইনের শাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, নাগরিকদের কর্তব্যপরায়ণতা আর উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে এখনো দুনিয়াতে নেতৃত্বের আসনে রেখেছে।
ব্রিটিশদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য আমাকে আকৃষ্ট করে- সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরা খুবই হিসেবী, তড়িত, এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত রিভিউ করে পুনরায় নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহনে এরা খুবই সিদ্ধহস্ত। অন্ততপক্ষে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা ফলো করা হয়। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সভ্যতাগুলোকে অবলোকন করেছি। একেকটা সভ্যতা গড়ে উঠতে শত শত বছর লেগেছে। কয়েক প্রজন্মের নিরলস সাধনায় তারা নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছে। এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মৌলিক নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
জীবনে কত কর্মঘন্টা সময় আমি অন্যদের (ছাত্র/ছাত্রী, ছোট/বড় ভাই, সহপাঠী, কিংবা অপরিচিত মানুষ যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার সাথে যুক্ত) ক্যারিয়ার কিংবা বাইরে উচ্চতর পড়াশোনা’র জন্য পরামর্শ দিতে গিয়ে ব্যয় করেছি তার হিসাব নাই। এমনও হয়েছে খুবই স্নেহকরি বিধায় বিদেশ থেকে একাধিক দিন, বহুবার ফোন করে ঘন্টার পর ঘন্টা মোটিভেশন দিয়েছি। হিসাব করে দেখলাম এগুলো সব বৃথা হয়ে গেছে। সময়গুলো নষ্ট হয়েছে।আমার কথার মর্মার্থ কেউই বুঝতে পারে নাই। কেউ না! যদি বুঝতে পারতো ওরা রাতে ঘুমাইতে পারতো না! সাধনায় ডুবে যেতো।
আমি অক্সফোর্ডে পড়তে আসছি। এর আগে ইউসিএল এ পড়েছি। ওদের ধারণা, এসকল প্রতিষ্ঠানে চাইলেই পড়া যায়। সেলফি তুলে, ঘুড্ডি উড়ায়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ফালতু প্যাচাল অথবা নিদেনপক্ষে আড্ডাবাজি করে সময় নষ্ট করেও এখানে পড়তে আসা যায়- এরকম ধারণা নিয়েও অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে। ওরা জানেনা, কত কঠোর সাধনায় এগুলো আমাকে পেতে হয়েছে!!
অক্সফোর্ডে যারা এসেছে প্রায় সকলেরই গল্পগুলো প্রায় একইরকম।এমনকি ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপীয়ান যারা এখানে পড়ে তাদের অনেকের সাথেও আমি গল্প করে জেনেছি অক্সফোর্ডে পড়া তাদের কাছেও স্বপ্ন, এবং কিভাবে সেই স্বপ্ন তাদের নিকট ধরা দিয়েছে। দুনিয়ার অন্য যেকোন ভালো প্রতিষ্ঠানে যারা পড়তে যায় তারাই জানে কতটা অধ্যবসায় এগুলোর জন্য তাদেরকে করতে হয়েছে! আফসোস!!
বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত দুটি সেক্টর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অথচ এ দুটিই সবচেয়ে প্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিলো। বাংলাদেশী হিসেবে এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্যজনক। এবারের স্কুলের যে কারিকুলাম সেখানে বছর শেষে কোনো পরীক্ষা নাই। মানে, সারা বছরেই কোনো লিখিত পরীক্ষা হবে না। শ্রেণী /বিষয় শিক্ষক সারা বছর জুড়ে অভ্যন্তরীন এ্যাসেসমেন্ট করবেন। এটা ব্রিটিশ সিস্টেম। খুবই ভালো তবে যদি বাস্তবায়ন করা যায়।
বাংলাদেশের যে শিক্ষা ইনফ্রাস্টাকচার তাতে করে কি এই ধরনের একটা কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা সম্ভব? বিষয়টা হলো যে, মটর কারের ইঞ্জিন আর গরুর গাড়ীর বডি দিয়ে আপনি যদি একটা গাড়ী তৈরি করেন তবে সেটা যেমন কিম্ভুতকিমাকার অকার্যকর একটা যানবাহন হবে, বাংলাদেশের বর্তমান পরীক্ষা ছাড়া ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুসরণ তেমনই।
এটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নাই যে, সরাসরি ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুসরণ করার মতো শিক্ষা ব্যবস্থাপনা (শিক্ষক, সরঞ্জাম, দক্ষতা, মোটিভেশন, সক্ষমতা) বাংলাদেশের নাই। এটা দুয়েক বছরের বিষয় না, তৈরি হতে দীর্ঘ কয়েক যুগ সময় প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের যেটা দরকার ছিলো, আমাদের সামর্থ অনুযায়ী ধীরে ধীরে পরিবর্তনগুলোকে এডোপ্ট করা। এক্ষেত্রে উত্তম হতে পারতো ভারতের শিক্ষা পদ্ধতিকে বিবেচনায় নেয়া।
আমি নিশ্চিত যে অতীতে স্কুল এডুকেশন নিয়ে নানা প্রকল্পের মতো এটিও ব্যর্থ হতে বাধ্য। কয়েক বছরের ভিতরেই এই সিষ্টেম চেঞ্জ করতে সরকার নিজে থেকেই বাধ্য হবে। মাঝখান থেকে লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোরের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে মূল্যবান সময় ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ। এটা আমাদের জন্য অতীব লজ্জাজনক যে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও একটা কার্যকর টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা ডেভেলপ করতে পারি নাই।
আমি দেখছি- ইংল্যান্ডে বাচ্চারা স্কুলে যাবার জন্য ব্যাকুল থাকে। কোনোভাবেই তারা স্কুল কামাই দিতে চায় না। কিন্তু কেন? আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এখানকার স্কুলের শিক্ষকগণ বাচ্চাদের সাথে এমনভাবে মিশে যায় যেন তারাও বাচ্চা এবং প্রচুর ফান করে করে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সবকিছুই (সিলেবাস অনুযায়ী) শিখিয়ে দেয়। মানে বাচ্চারা বুঝতেই পারে না যে তারা পড়ছে, তারা ভাবছে যে ফান করছে কিন্তু পড়াটাও হয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে অবশ্যই রাশভারী না হওয়া, শিশুতোষ চরিত্রের হওয়া দরকার।
আমার মেয়েকে এখানে এসেই ভর্তি করাতে গেলাম স্কুলে। ক্লাস হলো প্রি-স্কুল। তো সেখানে প্রায় প্রতিদিনই আমরা দেখতাম ‘টিচার’ (এরা নাম ধরে ডাকে) নানা ধরনের ফানি পোশাক, ক্যাপ, কিংবা রং মেখে সং সেজে আছে এবং বাচ্চাদেরকে কি আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে রিসিপশন দিয়ে ক্লাসে গ্রহণ করছে। এই যে ফান করছে, সেটা ধীরে ধীরে কিছুটা কমে আসলো যখন সে ক্রমান্বয়ে বড় ক্লাসে উঠতে থাকলো। পড়াশোনার চাপ মোটামুটি শুরু হয়ে গেলো যখন সে ক্লাস ওয়ানে উঠলো।
লেখক : মো. মিজানুর রহমান জামি, ডক্টরাল স্কলার (পিএইচডি), আর্কিওলজিক্যাল সাইন্স, ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য  এবং সহযোগী অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top