রহস্য আর বিস্ময়ে ভরা ধনুষকদি

ধানুষকদি

মোস্তাফিজুর রহমান : ভারত এক বিস্তুত ভূখণ্ডের নাম ধনুষকদি। যেখানে এমন সব ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যা মানুষকে আজও রোমাঞ্চিত করে তোলে। ভারত-শ্রীলঙ্কা সীমান্তে অবস্থিত পাম্বান দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত এই শহরকে ডাকা হয় ‘পরিত্যক্ত শহর’, ‘নিষিদ্ধ শহর’ কিংবা ‘ভূতুরে শহর’ হিসেবে।

নেতিবাচক এই খেতাবসমূহ একটি ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কেন্দ্র করে আরোপিত হলেও দ্বীপটির সাথে হিন্দু ধর্মের এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে সীতাকে উদ্ধারের জন্য এখান থেকেই সেতু নির্মাণ করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র, যা রাম সেতু নামে পরিচিত। এছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে এই অঞ্চলকে বলা হয় পার্থিব প্যারাডাইস বা স্বর্গোদ্যান। প্রচলিত আরও একটি মত আছে। সেটি হলো হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেহশত থেকে শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড়ে পতিত হয়ে এখানে তিনি নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত ‘অ্যাডামস ব্রিজ’।

এসব কারণে ভারতের যে সকল সীমান্ত উপকূলীয় অঞ্চল পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে তার মধ্যে এই ধনুষকদি অন্যতম। এটি তামিলনাড়ুর পাম্বান দ্বীপে অর্থাৎ ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যকার পক প্রণালীতে অবস্থিত। পক প্রণালী বঙ্গোপসাগর ও মান্নার উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে। এই উপকূলীয় জায়গাটি সারিবদ্ধভাবে থাকা অনেকগুলো ডুবোপাহাড়, দ্বীপ ও অগভীর সমুদ্রপথের সমষ্টি। ডুবোপাহাড় থাকায় এই জায়গাটি সমুদ্রপথ হিসেবে বিশেষভাবে বিপজ্জনক। অন্যদিকে অনেক হিন্দু বিশেষজ্ঞ এই সারিবদ্ধ দ্বীপকেই রাম সেতুর অবশিষ্টাংশ বলে দাবি করে থাকেন।

রমনাথস্বামী মন্দিরের জন্য বিখ্যাত রামেশ্বরম শহর থেকে ধনুষকদি ২০ কিলোমিটার পূর্বে এবং শ্রীলংকার সীমান্তবর্তী শহর তালাইমনার থেকে ৩৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

বিংশ শতকের শুরুর দিকের কথা, ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, ধনুষকদি তখন একটি উন্নত ও প্রভাবশালী শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ধনুষকদিতে পুলিশ স্টেশন, খ্রিষ্টান চার্চ, রেলওয়ে স্টেশন, স্কুলসহ প্রায় ৬০০ বসতবাড়ি গড়ে উঠেছিল। এটি তৎকালীন সিলন বা বর্তমান শ্রীলংকার সাথে ভারতের যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অঞ্চলদ্বয়ের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যে সকল নদীপথ বা সমুদ্রপথ ছিল তার সবগুলোতে একাধিক ফেরি সার্ভিস চালু ছিল। এসব ফেরি সার্ভিস পর্যটক ও বাণিজ্যিকভাবে মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে এসব ঘটনা দ্রুত ইতিহাস হয়ে যেতে থাকে।

প্রায় ৫০ বছর আগে এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ঐতিহাসিক শহরটি মানচিত্র থেকে কার্যত উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের প্রধান ভরসা তাদের ‘ভয়ানক’ সমুদ্রই। সমুদ্রই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস, আবার সেই সমুদ্রই তাদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর অন্যতম উপলক্ষ। ধনুষকদিতে বসবাসরত জেলেদের জীবনে এ যেন এক নির্মম সত্য। ধনুষকদির একপাশে বঙ্গোপসাগর এবং অপরপাশে ভারত মহাসাগর অবস্থিত। স্থানীয় জেলেরা বঙ্গোপসাগরকে ডাকেন ‘পেন কাদাল’ বা ‘নারী সাগর’ হিসেবে। কেননা বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের তুলনায় অনেক শান্ত। এ কারণে বছরের অধিকাংশ সময় জেলেরা বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরেন। বিশেষত গ্রীষ্মে তারা তাদের নারী সাগরের উপরই বেশি নির্ভর করেন। কিন্তু নারী সাগরের পানি যখন উত্তাল হয়ে ওঠে, তখন তারা মাছ ধরার জন্য ভারত মহাসাগরে চলে যান।

যদিও এই জেলেরা সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু সাগর যখন উত্তাল হয়ে ওঠে, তখন তারা আশাহীন হয়ে পড়েন। জীবনের সকল সম্ভাবনার দুয়ার প্রচণ্ড দমকা হাওয়ায় বন্ধ হয়ে আসে। তাদের জীবনে সবচেয়ে ভয়ানক দমকা হাওয়া এসেছিল ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। এ সময় এক দানবীয় ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল ধনুষকদির বুকে। এতে ১,৮০০ এর অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এরপর আরও অনেক ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে ধনুষকদির বুকে। এমনকি কয়েক দফায় পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল শহরটি। তবুও আশাহীন পথে জীবনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার জেলেরা।

ঘূর্ণিঝড় ধনুষকদির দক্ষিণাংশকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে। সেখানকার ঘর-বাড়ি, রাস্তা, উপাসনালয়, রেল লাইন- সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং শহরটি প্রায় ৫ মিটার পানির নিচে তলিয়ে যায়। যারা ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল তারা আগেভাগেই রামেশ্বর শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর ভারত সরকার ধনুষকদিকে ‘মানুষ বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত’ ঘোষণা করে। ফলে ধনুষকদি এক নিষিদ্ধ শহরে পরিণত হয়। কিন্তু অসহায় জেলে পরিবারের জন্য শত বিপদের মাঝেও এই শহর ছেড়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ অন্য কোথাও তাদের জীবিকা নির্বাহের কোনো অবলম্বন ছিল না। এ কারণে সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সেখানেই তারা আবার ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে। যারা কিছুদিনের জন্য অন্য শহরে চলে গিয়েছিল, তারাও আবার ফিরে এসে সেখানে বসবাস শুরু করে। কিন্তু আগের সেই ধনুষকদি আর তাদের জন্য ফিরে আসেনি। সেখানে এখন পর্যন্ত নেই কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ, নেই কোনো বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, নেই কোনো চিকিৎসা সেবা; অর্থাৎ কোনো নাগরিক সুযোগ সুবিধাই আজ সেখানে বিদ্যমান নেই।

তবুও জীবনের বাস্তবতায় এখন সেখানে প্রায় ৪০০ মানুষ বসবাস করে। তাদের মধ্যে অনেকে সেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। তারা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই তারা রান্নাবান্না করার মতো প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ও মাছ ধরার দ্রব্যাদি ছাড়া কিছুই সাথে রাখেন না। তাদের ঘরগুলো এমনভাবে নির্মিত যেন সহজেই তা স্থানান্তরিত করা যায়। খাবার পানি সংগ্রহের জন্য তারা ছোট ছোট গর্ত তৈরি করেন, সেখানে সমুদ্রের পানি প্রাকৃতিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত হয়ে জমা হয়। কিন্তু সেই গর্ত এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় না, সমুদ্রের স্রোত এসে তা সমান করে দিয়ে যায়।

ধনুষকদির জেলেরা মাছ ধরার জন্য এখনো অনেক ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি অবলম্বন করেন। পূর্ব-পুরুষের হাত ধরে তারা এই পদ্ধতি আয়ত্ব করেছেন। এর মধ্যে একটি পদ্ধতির নাম ‘ওলা ভেলা’। এই পদ্ধতিতে তারা জালের ভেতরের পার্শ্বে তাল পাতা বেঁধে দেন। মাছ অপরদিক থেকে এসে তালপাতা ভেদ করে জালের ভেতরে প্রবেশ করে, কিন্তু সেখান থেকে আর বের হতে পারে না। কেননা বের হওয়ার সময় উক্ত তালপাতা জালের সাথে লেপ্টে যাওয়ায় মাছেরা সেখানে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।

আরেকটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি হলো- রাতে যখন জোয়ারের পানিতে সমুদ্রের পাড় তলিয়ে যায়, তখন তারা গলা-পানিতে জাল পেতে রাখেন, সকালে ভাটা হলে ওই পানির ভেতরের দিকে থাকা মাছ আর যেতে পারে না, তারা জালে আটকা পড়ে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাকে গড়া নেয়া বলে। এরপর জেলেরা সেখান থেকে মাছ সংগ্রহ করেন। এছাড়া গভীর সমুদ্রে তারা প্রথাগতভাবে মাছের অনুসন্ধান তো করেনই।

ধনুষকদির প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মৎস্য ব্যাবসার সাথে যুক্ত। নারীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরুষরা যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে চলে যায়, নারীরা তখন আগের ট্রিপে ধরে আনা মাছ বাছাই ও বিন্যাস করতে ব্যাস্ত থাকেন। তারপর তা নিকটবর্তী রামেশ্বরম বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যান। কিছু কিছু দুঃসাহসী নারী পুরুষদের সাথে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতেও চলে যান।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি জাতিরাষ্ট্রের বাস্তবতাও ধনুষকদির জেলেদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তাদের মাছ ধরার স্থানের অদূরে শ্রীলংকান নৌবাহিনীর কড়া নজরদারি চলতে থাকে। অধিক মাছ পাওয়ার লোভে কিংবা অসতর্কতাবশত যদি তাদের নৌকা শ্রীলংকান সীমান্তে প্রবেশ করে বসে, তাহলে নেমে আসতে পারে যেকোনো দুর্ঘটনা। রাতের বেলা অন্ধকারের কারণে জেলেদের জন্য এই নীতিমালা রক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

ধনুষকদি বসবাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে। নিষিদ্ধ হওয়াতে সেখানে নেই কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। নতুন প্রজন্মও সেই অমোঘ নীতি থেকে সুরক্ষা পায়নি। তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যও নেই কোনো বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা। তবে ২০০৬ সালে তামিল নাড়ুর প্রাদেশিক সরকার সেখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে এখন প্রায় ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছে ভারত সরকার। ধীরে ধীরে সেখানে পর্যটকদের ভিড়ও বাড়ছে।

বাংলাদেশ থেকে ধনুষকদি যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায়। এর পর ট্রেন কিংবা বিমানে তামিলনাড়ুর অন্যতম বড় শহর চেন্নাইয়ে। চেন্নাইয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক রোগী চিকিৎসা করতে যায়। চেন্নাই থেকে যেতে হবে পাশের শহর রামেশ্বরমে। চেন্নাইয়ের এগমোর স্টেশন থেকে বিকেল ৫টা ও রাত ৯টা ৪০ মিনিটে রামেশ্বরম এক্সপ্রেসে চড়ে রামেশ্বরম পৌঁছতে পারবেন পরের দিন সকালে। বাসেও যেতে পারেন চেন্নাই থেকে রামেশ্বরম। সেখানে থেকে জিপ ভাড়া করে চলে যান ধনুষকদি।

ভাবছেন ধনুষকদিতে থাকার কি কোনো ব্যবস্থা আছে? সত্যিই তাই। ধনুষকদিতে রাতযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। রামেশ্বরমেই থাকতে হবে। রামেশ্বরমে তামিলনাড়ু পর্যটনের হোটেল তামিলনাড়ু অবস্থানগত দিক থেকে সব চেয়ে ভালো। এ ছাড়া এখানে অসংখ্য বেসরকারি হোটেল, ধর্মশালা আছে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা- ঢাকা স্কুল অব জার্নালিজম ও চীফ এক্সিকিউটিভ- ঢাকা ট্যুরিস্ট

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top