রবিউল করিম মৃদুল এই সময়ের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ও কথাসাহিত্যিক। ২০১৪ সালে ‘হলুদ খাম ও বাদামী ঘাসফড়িং’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০টি। এগুলোর মধ্যে তিনটি গল্পগ্রন্থ, একটি কবিতার বই ও ছয়টি উপন্যাস। উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা নাটকসহ লেখালেখির সব মাধ্যমেই সরব তিনি। জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অজস্র গল্পগুলোকে নিজের ঢঙে তুলে আনতে তিনি সিদ্ধহস্ত। লিখেছেন নিষিদ্ধ গোলাব, এখানে আকাশ নীল, ফুলন, তোমার পায়ের নখে এত চাঁদ কেন, হত্যার শিল্পকলা, জলপাই রঙের কোট, রকস্টার, ঘানি ও শুভ্র কুসুম কৃষ্ণ কুসুম। বহুমুখী প্রতিভাবান এই মেধাবী তরুণের মুখোমুখি হয়েছিল মাসিক এডুকেয়ারের নির্বাহী সম্পাদক আনিসুর রহমান এরশাদ|
আনিসুর রহমান এরশাদ: মাসিক এডুকেয়ারের পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলুন।
রবিউল করিম মৃদুল: জন্ম নাটোরের বড়াইগ্রামে। ১৯৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। বর্তমানে কর্মরত আছি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। নিয়মিত পেশার পাশাপাশি বই ও শিল্প-সাহিত্যের জনপ্রিয় ওয়েবপোর্টাল লিট নিউজের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিও আমি দারুণ আগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালে যুক্ত হই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিমন্ডলে মঞ্চাভিনয়, নাট্য রচনা ও নাট্য নির্দেশনায় প্রশংসিতও হয়েছে।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার হাতেখড়ি হয় মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জলসিঁড়ির সাথে সুদীর্ঘ দিন কাজ করেছি। দুই মেয়াদে পালন করেছি সভাপতির দায়িত্ব। অভিনয় করেছি বহু নাটকে। নাট্য রচনা ও নাট্য নির্দেশনায় কাজ করেছি। আমার রচিত ও নির্দেশিত বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটসহ বিভিন্ন মঞ্চে। আমার রচিত মঞ্চনাটক ‘জননী জন্মভূমিশ্চ’ ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে জাবির মঞ্চে। বর্তমানে পেশাগত ব্যস্ততায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে কিছুটা দূরত্ব বাড়লেও মন থেকে কখনোই দূরে সরে যাইনি। সব সময়ই নিজেকে একজন সাংস্কৃতিক তথা থিয়েটার কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসি।
আনিসুর: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মৃদুল: আমার শৈশব কৈশোর এমনকি যৌবনের পারম্ভিক সময়টাও গ্রামে কেটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে কখনো ঢাকায় আসা হয়নি। গ্রামীণ জীবনের পুরোটাই উপভোগ করেছি আমি। দূরন্ত শৈশব বলতে যা বোঝায়, তখন না বুঝলেও এখন বুঝি আমাদের আসলে তেমন শৈশব ছিল। পুকুর-নদীতে ঝাঁপাঝাপি করা, দলবেঁধে খালেবিলে মাছ ধরতে যাওয়া, বড় বাগানে খড়ি কুড়োনো, বড়শি দিয়ে মাছ ধরার আদার বানাতে গাছের আগা মাথা খুঁজে পিঁপড়ের ডিম নামানো এগুলো ছিল আমাদের নিয়মিত কাজ।
ধান কেটে নেওয়া খালি জমিতে দলবেঁধে বিকেলে গোল্লাছুট, বউছি খেলতাম ছোটবেলায়। তখন মার্বেল খেলারও খুব প্রচলন ছিল। মাটির চাঁড়া দিয়ে ভেন্না খেলাম। আমাদের বড়রা সন্ধ্যার পর কাঁঠাল বাগানে বড়বড় হারিকেন জ্বেলে দারিয়াবান্ধার আয়োজন করতো। ছোটরা এ খেলায় ছিল দর্শক। আমরা খেলার সুযোগ পেতাম বিকেলে। সন্ধ্যাবেলায় হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতে হতো। উঠোনে খেজুরপাতার বড় পাটি পেতে হারিকেন জ্বেলে পড়তে বসতাম আমরা। আটটা ন’টা পর্যন্ত পড়ে তারপর রাতের খাওয়া।
আমরা যখন পড়তাম, পাশেই টুল পেতে পাখা হাতে বসে থাকতেন দাদা। একটু পরপর বলতেন, মনযোগ দিয়ে পড়াটা শেষ করতে পারলেই খাওয়া-দাওয়ার পর গতকালকের অসম্পূর্ণ গল্পটা শোনাবেন। এতে পড়ার গতি বেড়ে যেতো আমাদের। দাদা এমনভাবে গল্প বলতেন এবং এমন জায়গায় এনে শেষ করতেন যে, পরের পর্ব না শুনলে আর ঘুমই আসতে চাইতো না। কিন্তু দেখা যেতো, প্রতিদিনই তিনি খুব আকর্ষণীয় একটি জায়গায় এসে বলেন, বাকিটুকু আবার আগামীকাল। এইভাবে গল্প শুনতে শুনতে, হৈহুল্লড় করে ছুটতে ছুটতে কখন যে এক ফাঁকে বড় হয়েগেছি আমরা, টেরই পাইনি।
আনিসুর: আপনাদের প্রজন্ম ও বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কেমন পার্থক্য লক্ষ্য করছেন?
মৃদুল: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ব্যবধান আসলে থাকবেই। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। একেক প্রজন্ম একেকভাবে বেড়ে ওঠে। আমরা বড় হয়েছি পুরোই গ্রামীণ পরিবেশে। মোবাইল টেলিফোন টেকনোলজি তখন আমাদের নাগালে ছিল না। বিনোদন বলতে সপ্তাহে একদিন ওই শুক্রবার পাড়ার কোনো এক বাড়িতে দলবেঁধে টিভি দেখা ছাড়া বাকি সময়টা আমাদের কাটতো খেলাধুলা করে, গল্প করে, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে।
এই বেড়ে ওঠার তো একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এই জায়গাতেই বর্তমান প্রজন্মের সাথে আমাদের কিছু তফাৎ দেখা যায়। আমরা যে পরিবেশটা পেয়েছি, ওরা তেমন পায়নি। গ্রামে গ্রামেও এখন পৌঁছে গেছে টেকনোলজি। খেলাধুলার প্রবণতা কমে গেছে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে। শহরের মতো গ্রামেও মানুষ অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক, পরিবারকেন্দ্রিক জীবনাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এর একটা স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে তরুণ প্রজন্মের ওপর।
তবে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা বিভিন্ন দিকে এগিয়েছেও। সব পরিবর্তনকেই খারাপ বলার সুযোগ নেই। আমরা আমাদের সময়ে বাস করতাম, ওরা তাদের সময়ে বাস করে। সবার কাছে সবার সময়টাই সেরা। তবে পাখির চোখে দেখলে কিছু পরিবর্তন নতুন প্রজন্মকে র্দীঘমেয়াদী ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হতে পারে কিছুকিছু ক্ষেত্রে।
আনিসুর: সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া উচিত?
মৃদুল: শিশুর সুস্থ ও সুন্দর বিকাশ নিশ্চিত করা সন্তান লালন পালনের অন্যতম প্রধান কাজ। এই কাজটি মোটেও সহজ নয়। শুধু পুষ্টির অভাব পূরণ করলেই শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে না। আবার পুষ্টিবিনেও চলে না। শিশুর বিকাশ ও বেড়ে ওঠার জন্য স্বীকৃত সব কাজই যত্নের সাথে পালন করতে হবে পরিবারকে। শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশও নিশ্চিত করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদেরকে বইপড়া, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার বুনিয়াদও শৈশবেই গড়ে দিতে হবে।
আনিসুর: সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কি রকম ভুমিকা রয়েছে?
মৃদুল: শিশুর বিকাশে পরিবার হলো সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান। সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা মূলত পরিবারের। শিশু পরিবারে যা দেখবে, যা শুনবে, তাই সে শিখবে। এজন্য শিশুর সামনে এমন কোনো কাজ পরিবারের সদস্যদের করা উচিত নয়, যা তারা শিশুর কাছ থেকে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করেন না।
একটি শিশুকে ভবিষ্যতে ঠিক যেমনটা দেখতে চান, যদি চান শিশু আদর্শবান হোক, শিশুর নৈতিকতা থাকুক, তাহলে পরিবারের মধ্যে বাবা মাকেও সেই চর্চাটা চালু রাখতে হবে। শুধু পয়সা খরচ করে সন্তান মানুষ করা যায় না। পরিবারের অপরাপর সদস্যদের মধ্যে মূল্যবোধের চর্চা থাকতে হবে, যা শিশুর নরম কাদামাটির মতো মনকে সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
আনিসুর: আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব পরিবার ব্যবস্থার উপর কি ধরণের হুমকি?
মৃদুল: তথ্য প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা আমাদের পারিবারিক কাঠামো শিথিল করে দিচ্ছে হয়তো সকলের অলক্ষেই। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের সব সদস্য মিলে বৈঠকী পরিবেশে নানারকম গল্পগুজব, পারিবারিক হাসিঠাট্টায় মেতে থাকতো। সন্ধ্যায় উঠোনে পাটি পেতে বসত গল্পের আসর। এখন এসব সময় প্রযুক্তি গ্রাস করে নিয়েছে। বাচ্চাকে খাওয়াতে হলে মায়েরা মোবাইলে বা টিভিতে কার্টুন সিনেমা দেখাচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় শিশু এমনভাবে কার্টুন নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, যে কার্টুন দেখানো ছাড়া তাকে আর খাওয়ানোই যাচ্ছে না।
আপাতত এটা সাধারণ ব্যাপার মনে হলেও শিশুর বিকাশের পথে এ ধরনের কাজগুলো বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। বাবা মা নিজেরাও মোবাইল নিয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছেন, যাতে সন্তান বঞ্চিত হচ্ছে বাবা মার সান্নিধ্য থেকে। আসলে কিছু সুবিধার পাশাপাশি বহুবিধ সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। কিন্তু একে এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। তবে পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা চাইলে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে পারেন।
আনিসুর: আপনি কি মনে করেন বর্তমান পারিবারিক ব্যবস্থায় অবক্ষয় চলছে? কিভাবে উত্তরণ সম্ভব?
মৃদুল: পারিবারিক কাঠামোতে এক ধরনের অবক্ষয় যে চলছে চারপাশের বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার দিকে তাকালে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পারস্পারিক সম্পর্কগুলো শক্তি হারাচ্ছে ক্রমশ। সম্পর্কগুলোর মধুরতা কমে আসছে যেনো। এককেন্দ্রিক পরিবারের আধিক্য এর পেছনে একটি বড় কারণ বলে মনে হয়। একা থাকতে থাকতে, একা চলতে চলতে অপরের প্রতি যে দায়িত্বশীলতা বা টান থাকার কথা, সেখানে কিছু ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এই ঘাটতি থেকে পরিবারগুলো আরো বেশি আলগা হয়ে যাচ্ছে।
এর থেকে উত্তরণের জন্য সহজ কোনো প্রেসক্রিপশন বা ওষুধ নেই। পরিবারের সিনিয়র সদস্যদেরকে এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কারো একার পক্ষে চারপাশের সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। কিন্তু কেউ চাইলে নিজের পরিবারকে অন্তত একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারেন ধীরে ধীরে। সামাজিক সংগঠনগুলোর সাথে পরিবারের যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পারলে পরিবারের জুনিয়র সদস্যরাও এতে আকৃষ্ট হবে।
আনিসুর: একটি সুখী পরিবার তৈরিতে কোন বিষয়গুলো জরুরি আপনার নিজের পরিবারের আলোকে বলুন।
মৃদুল: সুখী পরিবার গঠনের জন্য ‘কলহ’ শব্দটাকে পরিবার থেকে দূরে রাখতে হবে। বাবা মায়ের মধ্যে কলহ থাকলে সেই পরিবারের শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। শিশু তার স্বাভাবিক বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিষয়টা এমন নয় যে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মতভেদ বা মতদ্বৈততা থাকবে না। থাকলেও সেটা সমাধানের জন্য কলহে জড়িয়ে না পড়ে যৌক্তিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে।
বাবা মাসহ পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের সব সময় এই কথা মাথায় রাখতে হবে যে, তাদের চলন-বলন, কাজকর্মের ওপর নির্ভর করছে আগামীর প্রজন্ম। ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, সহযোগীতা, সহমর্মিতা, মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলো পরিবারের দৈনন্দিন চর্চায় থাকতে হবে।
আনিসুর: মাসিক এডুকেয়ারের পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলুন….
মৃদুল: মাসিক এডুকেয়ারকে ধন্যবাদ আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। শিক্ষা, ক্যারিয়ার ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি কেন্দ্রিক তাদের এ যাত্রা অব্যাহত থাকুক। এর সাথে জড়িত সকলের জন্য ভালোবাসা।