ছোটবেলার রোজা ও ঈদের স্মৃতি

eid mubarak

ছোটবেলায় পুরো রমজান মাস জুড়েই দেখতাম উৎসবমুখর পরিবেশ। রমজানের রোজাকে, তারাবির নামাজকে বড়রা থেকে শুরু করে ছোটরাও উপভোগ করতো। তখন রমজানে কুরআন খতম করা ও নফল ইবাদত-বন্দেগী আর ঈদে কোলাকুলি, সেলামি আদান-প্রদান, বেড়াতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে এমনভাবে সময় কাটাতো যে- তখনকার স্মৃতিই এখনকার ঈদে অনেকের বড় সম্বল।

গ্রামে শৈশবের প্রাণখোলা ঈদ অনেক বেশি তাড়িত করে আমাকে। শৈশবের ঈদ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে এখনো।  শৈশবের ঈদের স্মৃতি গ্রামকে ঘিরেই। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামেই পড়েছি; সে সময়ের গ্রামীণ ঈদগুলো ছিল কী যে মায়া আর আনন্দঘেরা! তখন অতি অল্পতেই অসাধারণ আনন্দ হতো। মনটা ছিল প্রশস্ত নদীর মতো। মনে এত বেশি জায়গা ছিল যে ছোট একেকটা ঘটনায় প্রাণখোলা খুশি লাগতো।

ছোটবেলায় পুরো রমজান মাস জুড়েই দেখতাম উৎসবমুখর পরিবেশ। রমজানের রোজাকে, তারাবির নামাজকে বড়রা থেকে শুরু করে ছোটরাও উপভোগ করতো। তখন রমজানে কুরআন খতম করা ও নফল ইবাদত-বন্দেগী আর ঈদে কোলাকুলি, সেলামি আদান-প্রদান, বেড়াতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে এমনভাবে সময় কাটাতো যে- তখনকার স্মৃতিই এখনকার ঈদে অনেকের বড় সম্বল।

একদিনে কয়েক রোজা

ঠিক কবে থেকে রোজা রাখা শুরু করি, দিনক্ষণ মনে নেই। খুব ছোট থেকেই রোজা রাখার চর্চা শুরু হয়।  অনেক অল্প বয়সে মা রোজা রাখতে দিতেন না।  জোর করে থাকতে চাইতাম। একেবারে  ছোটবেলায় একইদিনে কয়েকটা রোজাও রেখেছি; সাহরি খেয়ে দুপুর পর্যন্ত একটা, দুপুর থেকে ইফতার পর্যন্ত আরেকটা। কোনোদিন মা সাহরিতে না উঠালে খুবই মন খারাপ নিয়ে দিন শুরু করতাম!

মন খারাপ বেড়ে যেত যখন দেখতাম বন্ধুরা রোজা রেখেছে, কেবল আমিই রাখিনি। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আবার মন ভালো হয়ে যেত। ইফতার-তারাবির আনন্দ ভুলিয়ে দিত রোজা না রাখার কষ্টটুকু। একটু বড় হবার পর প্রথম রোজা ও শেষ রোজা রাখতে দিতেন মা। আমি খুশি থাকতাম এই ভেবে যে- প্রথম ও শেষটা রাখার মাধ্যমে মাঝের সবগুলোকেই আটকে রেখেছি! এভাবেই রোজার সঙ্গে প্রেম গড়ে ওঠে।

ইফতারের আর অল্প সময় বাকি এমন অনেক সময় খুব ক্লান্তি ও পিপাসায় দুর্বল হয়ে রোজাটা ভেঙে ফেলতে চাইলেও মা রোজা ভাঙতে দিতেন না। অর্থাৎ সকালে মা রাখতে দিতেন না, আর বিকালে ভাঙতে দিতেন না। প্রথম রোজা রাখার সে কী আনন্দ হতো। অনেক ভালো লাগতো। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলতো- কে কার চেয়ে বেশি রোজা রাখতে পারে। কত মধুর-বর্ণিল ছিল ছেলেবেলার দিনগুলো!

তারাবির নামাজ

রমজানে মসজিদে খতম তারাবিহ হতো। প্রতিবছর চাঁদ দেখার ঘোষণা হওয়ার পর মসজিদে থেকে ঘোষণা করা হতো- রমজানুল মোবারক আর তারাবির নামাজের সময়।  মসজিদে তারাবির নামাজে শরিক হওয়া ছিল খুবই আনন্দের। উৎসবমুখর পরিবশে বিরাজ করতো ।  মতিয়ার ভাই ও ইবরাহীম  কাকাসহ তারাবির নামাজ পড়তে যেতাম।

হাফেজ মাও. আনিসুর রহমান মাদানীর কথা খুব মনে পড়ে! যিনি তারাবীহ পড়াতেন ও নামাজের আগে-পরে ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয়াদি নিয়ে হৃদয়স্পর্শী বয়ান দিতেন। হাফেজ মো. ইবরাহীম, হাফেজ মো. আল মামুন, হাফেজ মো. ইসমাইল হোসেন, হাফেজ সামিনুর রহমানসহ আরো অনেকেও খতমে তারাবি পড়াতেন।

জামাতে নামাজ

মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ পড়াকে তাগিদ দেয়া হতো। মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হলে বাড়িতেই জামাতে নামাজ পড়া  হতো! নামাজ শেষে জিকির-আজকার, তাওবা-ইসতেগফার, দোয়া-দরূদ পড়া হতো।

শিক্ষামূলক আসর  ও আড্ডা

কুরআন শিক্ষার আসর বসতো, মসজিদ ও মক্তব্যে নৈতিক ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণ হতো। বড় কাকার দরাজ গলায় পুথিঁ পড়া, ছোট ফুফুর মুখে মাও. ক্বারী মো. শামছুজ্জামান কাকার লেখা কবিতা শুনা খুব আনন্দের ছিল।

ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয়াদি নিয়ে হৃদয়স্পর্শী বয়ান এবং এসব আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে!  রমজানে মসজিদে খতম তারাবিহর আগে-পরে মাদানী হুজুরের (হাফেজ মাওঃ আনিসুর রহমান আল মাদানী) হৃদয়স্পর্শী বয়ান থেকে ধর্ম-নৈতিকতার (মাসআলা-মাসায়েল) জ্ঞানার্জন হতো।

আহম্মদ হুজুরের (ক্বরী আহমাদ আলী) বাসায় ও জুম্মাপাড়া মক্তবে মুন্সি হাফিজ উদ্দিনের কাছে কোরআনের সহীহ তেলাওয়াত শিখতে যেতাম ছোটবোনসহ। ঢাকা থেকে সাঈদ কাকা (হাফেজ মাও. সাঈদুর রহমান) গ্রামে আসলে সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনাতেন-শুনতেন এবং ইসলামী গান শুনাতেন।

ইফতার  অনুষ্ঠান

অনেক পরিবারই সামাজিকভাবে ইফতার অনুষ্ঠান আয়োজন করতো। বাড়িতে বাড়িতে ইফতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ফলে অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ছিল আনন্দের; ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত হতো। এছাড়া মসজিদেও ইফতার অনুষ্ঠান হতো।

তবে তখন এখনকার মতো ইফতারের টেবিল জুড়ে থাকতো না পরিবারের সবার পছন্দের খাবারগুলো। যদিও একসঙ্গে বসে ইফতারকে উপভোগ করতো পরিবারের সবাই। তখনকার ভাঙা বা কাঁচা ঘরে বসে সাধারণ লেবু-গুড়ের শরবত, গুঁড় দিয়ে তৈরি বেলের শরবত ,  ইসবগুলের ভুসি বা তোকমার শরবত, ছোলা বুটের সঙ্গে মুড়ি দু-একটা খেজুরের ইফতারেই খুবই মজা পেতাম। পেঁপে ও পেয়ারার মতো দেশি ফল থাকতো।  ইফতার করতে গিয়ে দু একটা মুড়ি পড়লেও মুরগি  ঢুকে তা খাওয়া শুরু করতো।

তবে একবারে ছোটবেলায়- ইফতারে যে তেলে ভাজা এত মুখরোচক খাবার খায় লোকে, তা জানা ছিল না ।  মা কে যা খেতে দেখতাম ভেবেছিলাম এই সবই হয়তো খেতে হয়।  তেল, কাঁচা মরিচ আর সর্ষের তেল সমেত হাতে বানানো মুরি মাখানিও খেতে  ভালোই লাগতো। সেসময় ইফতারের আগে সবাই যার যার কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে চেষ্টা করত। ইফতারের একটু আগে আগে রেডিও চালিয়ে সুরা, হামদ বা নাত শুনতে শুনতে ইফতারের জন্য  সবাই অপেক্ষা করতো।

দশদিনের ইতিকাফ

মসজিদে ইতেকাফ হতো। রমজানের শেষ দশকে কয়েকজন ইতিকাফে বসতো।

শামসুজ্জামান কাকা, হাজী মরহুম ফয়েজ উদ্দিন মেম্বার, ক্বারী আহমাদ আলী হুজুর, মসজিদের মোয়াজ্জিন ও মক্তবের প্রশিক্ষক মুন্সি হাফিজ উদ্দিন কাকা ইতিকাফে বসতেন। উনাদের জানাশুনা-অভিজ্ঞতা থেকে জেনেও আমরা সমৃদ্ধ হতাম।

কাক ডাকা ভোরে মৃত্যুহীন প্রাণ মরহুম হাজী আজিজুল ইসলাম খলিফা ভাই এর সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম; কোনো কোনো রমজানে উনিও ইতিকাফে বসতেন। আসলে আমার বেড়ে ওঠা অনেকের অবদানে ভরপুর।

ঈদকার্ড ও চিঠি

ছোটবেলায় হাতে লিখে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ঈদকার্ড বানাতাম! কখনো ছবি এঁকে ঈদ কার্ড বানিয়ে অপরকে উপহার দিতাম। কখনও বন্ধুদেরও ডাকে পাঠাতাম। তখন ঈদ কার্ড ছিলো একটা বিশেষ বিনোদন।

দোকান থেকে নানা রঙের বাহারি ঈদ কার্ড কিনেও লিখে পাঠাতাম।   ঈদ কার্ড পাওয়া খুবই আনন্দের ছিল! ঈদের আগে প্রবাসী বাবার পাঠানো চিঠি পেলে তা নিয়েই অনেক আনন্দে দিনটা কেটে যেত আমার।

নতুন করে সাজানো

ছোটবেলায় রোজার ঈদেই বেশি আনন্দ ছিল।  ঈদ যত ঘনিয়ে আসত ছোটদের আনন্দ আর উত্তেজনার সীমা থাকত না। ঈদ উপলক্ষে ঘরকে নতুন করে সাজানো হতো। ঘরে নতুনের ছোঁয়া লাগাতে বিভিন্ন ছবি লাগানো হতো। বাসাবাড়ির চাকচিক্য করার দিকে খুব মনোযোগ ছিল।

নতুন জামা-জুতা

সাধারণত ছোটবেলায় ঈদের মৌসুমে নতুন জামাকাপড় নিয়ে বেশ একটা আমেজে থাকতাম, আগ্রহ থাকতো সবচেয়ে বেশি। কয়েকদিন আগেই নতুন জামা-জুতার  বায়না ধরতাম; কেনার পর থেকে মনের আনন্দে ঘরে ফেরতাম।  ঈদ আনন্দ নতুন জামা-জুতা ঘরে আসার পর থেকেই শুরু হয়ে যেত!

বাবা বিদেশে থাকায়- গনি ভাই কখনো সখিপুর-মির্জাপুর থেকে আর বড় ফুফা বাসাইল থেকে কিনে দিতেন; মৌলভী কাকা টাঙ্গাইল থেকে এমব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবি বানিয়ে আনতেন। প্যান্ট-শার্ট কিংবা পায়জামা-পাঞ্জাবিই হোক আর জুতাই হোক, নতুন কেনাকাটা ছিল দারুণ উত্তেজনার, আনন্দের জোয়ারে ভাসতাম তখন।

আসলে তখন অধিকাংশ পরিবারে বছরে যখন-তখন কাপড় কেনা হতো না। দুই ঈদেই কাপড় কেনা হতো। আর তাই ঈদের নতুন কাপড়ের কদর ছিলো অনেক বেশি। এমনও হতো এক ঈদে শার্ট কিনে দিলে পরের ঈদে প্যান্ট কিনে দেয়া হতো।  অনেকে টেইলার্সে বানানোর পর বাসায় নিয়ে এসে লুকিয়ে রাখতো, কেউ যেনো দেখে না ফেলে। ঈদের দিন সকাল বেলা পড়ার পর সবাই দেখতো- এটা খুব আনন্দের ছিলো।

ফুপুদের আনতে যাওয়া

ঈদের আগে টাঙ্গাইলে ছোটফুফু ও বাসাইলে বড়ফুফুদের বাড়িতে উনাদের আনতে যেতাম। অনেক সময় ইবরাহিম কাকাও আমার সফর সঙ্গী হতেন। আমার ছোট ফুফু’র বাড়ি আদি টাঙ্গাইলের ছাপড়া মসজিদের কাছে। সে অনেক দূরের পথ!

ছোটবেলায় অনেক সময় পায়ে হেঁটে, আবার অনেক সময় বাইসাইকেল নিয়ে বাসাইলে বড় ফুফুর বাড়িতে যেতাম।  মাটির রাস্তায় কত গ্রাম কত গঞ্জ কত বাজার ছাড়িয়ে যেতে হতো! মনে হতো– বড় ফুফুর বাড়ি এতদূর! বড় ফুফুর চোখে ছিল এক আশ্চর্য দৃষ্টি। বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালেই ফুফু কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসতেন। ফুফু আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বড় ফুফাও  খুব আদর করতেন।

এরপর বাসাইল থেকে টেম্পুতে করে টাঙ্গাইলে যেতাম। যাত্রীদের চাপাচাপি করে বসতে হতো। গরমের মধ্যে গাদাগাদি করে ঘেমে নেয়ে দুঃসহ পথ পাড়ি দিতাম।  পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সায় ফুফুর বাসায় পৌঁছতাম।  ফুফু পিটপিট করে দেখতেন আমাদের। তারপর জড়িয়ে ধরতেন– মুখে, বুকে, হাতে ধরে ধরে পরখ করতেন যেনবা অনেকদিন পর তিনি অতি আপনজনের স্পর্শ পেয়েছেন। আমি এখনো সময়ে, অসময়ে কান পাতলে ফুফুর মুখে মৌলভী কাকার লেখা কবিতার আবৃত্তি শুনতে  পাই।

ঈদের চাঁদ দেখা

ছোটবেলায় ঈদের চাঁদ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম। ঈদের আগের রাতে চাঁদ দেখতে বেরোতাম। সুমনদের ও সেলিম নানাদের বাড়ির উত্তর পাশের খোলা জায়গায় ছোটদের সাথে বড়রাও যোগ দিতেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। উঠানে দাঁড়িয়েও গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে  তাকিয়ে থাকতাম চাঁদের অপেক্ষায়। ভাবতাম,  চাঁদটা আমিই যেনো আগে দেখতে পাই। দেখতে পেলেই জোরে চিৎকার!

ঈদের একফালি বাঁকা চাঁদ উঠা একসাথে দেখা যে কতটা আনন্দের হতে পারে তা তখনকার স্মৃতি ভুলে গেলে আর অনুভবই করতে পারতাম না। সন্ধ্যায় শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখার মধ্যে দিয়ে শুরু হতো ঈদের আনন্দ। রীতিমতো আনন্দ মিছিল হতো। খুশির মিছিলে শ্লোগান দিতাম। চাঁদের তালাশ করে সফল হলে তাকবির পড়তাম।

ছোটবেলায় চাঁদ দেখার মাঝে যে কী আনন্দ ছিল, এখনকার ছেলেমেয়েদের বোঝানো যাবে না।  ঈদের চাঁদ দেখার পর সুর করে গাইতাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর গীতি- ‘ও মোর, রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ‍‍’। ঈদের চাঁদ দেখে খুশি হওয়া সুন্নতও।

মেহেদি লাগানো

চাঁদ রাতে ছোট-বড় মেয়েদের সবারই মেহেদি লাগানোর ধুম পড়তো। সবাই একসঙ্গে বাড়িতে বসে হাতে মেহেদি লাগাতো। ঈদের নতুন পোশাক আর দুই হাতে বিভিন্ন নকশার মেহেদি যেন ঈদ আনন্দের সূত্রে গাঁথা ছিল।

আমার নখগুলোকেই শুধু মেহেদির রঙে রাঙানো হতো! রাতে মেহেদি লাগানো হতো। সকালে মেহেদির ঘ্রাণে ঘুম ভাঙত। মনে হতো এটা যেন ঈদের ঘ্রাণ!

চাঁদ রাত

চাঁদ রাতেই  যেন অনেক কিছু পাল্টে যায়। সবকিছুতেই থাকে যেন ঈদ আনন্দ।  ঈদকে ঘীরে থাকা নানা স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করে। কত পরিকল্পনা! কত আয়োজন! কেউ সেলুনে গিয়ে চুল কাটতো! কেউ কেউ চায়ের দোকানে আড্ডাও দিতো। ছোটরাও নানা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তো। ঈদের খুশিতে সবকিছু উলোট-পালোট হয়ে যেত।

ছোটবেলায় ঈদের আগের রাতেই ঈদ মনে হতো। সে যে কী আনন্দ যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেক ঈদের আগের রাতে শত চেষ্টা করেও উত্তেজনায় দু’চোখের পাতা  এক হতে চাইতো না। গভীর রাতেও মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যেত। ঘুমের ক্নান্তি শরীরে স্পর্শ করতো না। বিছানায় এদিক সেদিক গড়াগড়ি করতে করতে হঠাৎ সকাল হয়ে যেত।

নতুন সাবানে গোসল

তখনকার ঈদ শীতের সময় হতো। নামাজ পড়ে ভোরবেলায়ই কনকনে শীতের মধ্যেও সুগন্ধি সাবান মেখে গোসল করতাম।  ঈদের গোসলের সাবান নতুন হতে হতো, কে আগে গোসল করবে তা নিয়েও ভাই-বোনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো!

হালাল খুশবো সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করে শরীর থেকে সুঘ্রাণ ছড়ানোয় আগ্রহ থাকতো। নতুন সাবান দিয়ে ঈদের সকালে গোসল করার এই রেওয়াজ এখনো আছে! ঈদের দিন গোসল করা মুস্তাহাবও;  নবী সা. ঈদের দিন নামাযে যাওয়ার আগে গোসল করতেন।

ইদগাহে আসা-যাওয়া

নতুন জামা-কাপড় পড়ে টুপি মাথায় দিয়ে আতর মেখে সেমাই খেয়েই দলবেঁধে ঈদের নামাজ পড়তে ইদগাহে যেতাম। ছোট্ট কাঁচের শিশির থেকে আতর একটি ছোট্ট তুলোয় মাখিয়ে পাঞ্জানীর কলারে মাখিয়ে নিতাম।

চোখে-মুখে থাকতো আনন্দের ঝলক। ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে তাকবির বলতাম। যাওয়াত সময় এক রাস্তা দিয়ে যেতাম আর নামাজ পড়ে ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করে ফিরতাম। সাধারণত পায়ে হেঁটেই আসা-যাওয়া করতাম; এটা সুন্নাতও।

সৌহার্দ্যের কোলাকুলি

ঈদের নামাজ পড়ার পর ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হতো, জড়িয়ে ধরা হতো, বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করা হতো, হাতে হাত মিলিয়ে  করমর্দন  করা হতো।  এতে ঈদের আনন্দ আরও বহুগুণে বেড়ে যেতো।  সবাই একে অপরকে অভিনন্দন জানাতেন, সবাইকে নিজ বুকে টেনে নিতেন। এর মাধ্যমে পরষ্পর মুহাব্বত ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতো, ঈদ আনন্দ পূর্ণতা পেতো, হৃদয়ের বন্ধন সুদৃঢ় হতো।

সৌহার্দ্যের চিত্রের দেখা মিলতো ঈদগাহ ময়দানে। কে কতজনের সাথে কোলাকুলি করতে পেরেছে তা নিয়ে ছোটদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হতো। আসলে সামাজিক সম্প্রতিতেও কোলাকুলি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আর ধর্মীয়ভাবেও ঈদের দিনে কোলাকুলির গুরুত্ব রয়েছে। তখন বড়রা ছোটদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে কার্পণ্য করতেন না।

কোলাকুলি করার সময় মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যাওয়ায় মনও ভালো হতে শুরু করে। ফলে যার সঙ্গে কোলাকুলি করছেন, তার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে, সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। নর্থ ক্যারোলাইনা মেডিক্যাল স্কুলের মনোবিজ্ঞানী ক্যারেন গ্রুজেন বলেন, ‘কোলাকুলি করলে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোল মান হ্রাস করে এবং বাড়িয়ে দেয় ‘ভালো লাগা’ হরমোন ডোপামিন ও সেরোটনিন।’

আনন্দে ভিন্ন মাত্রা

খুবই দুরন্ত ছিলাম বলে ছেলেবেলায় আমাকে চোখে চোখে রাখতো আমার দুই ফুফু। তবে ঈদের সময় একটু স্বাধীনতা বেশি পাওয়া খুবই প্রাণভরে উপভোগ করতাম। বড়দের কাছ থেকে নতুন টাকা বা ঈদের সেলামি পাওয়া আনন্দে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতো। ছোটবেলায় ঈদের সময় লম্বা ছুটিও কম আনন্দের ছিল না।

ঈদে বেড়ানো

দেখা হলে পরিচিতজনদের বাসায় নিয়ে আসা, দলবেঁধে অন্যদের বাসায় বেড়ানোর অনুভূতি ছিল অন্যরকম আনন্দের।  ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নত; আর এই সুন্নাত পালনও হতো। ঈদে সবার বেড়ানো বা ছোটাছুটি বেড়ে যেত। অনেকসময় বন্ধুরা মিলে ঘুরতে বের হতাম।

কোনো কোনো ঈদের দিন বিকেলে কিংবা পরদিন সকালে বালিয়াটায় নানীর বাড়ি বেড়াতে যেতাম; মাঝে মাঝে মেঝো মামার কাঁধেও সওয়ার হতাম। এতটা পথ কতটা কষ্ট করে উনারা হাসিমুখে নিয়ে যেতেন, ভাবলেও হৃদয় থেকে দোয়া চলে আসে। সেখানে বাকি ভাইয়ের সাথে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম, ছোট মামার সাথে শাপলা তোলতাম।

দাদীর সাথে বেড়ানো

ঈদ আসে ঈদ যায়। তবে তখনকার ঈদগুলো ছিল একটু বেশিই ব্যতিক্রম। এখনতো দাদীকে ছাড়াই ঈদ উদযাপন করি। দাদীকে মনে পড়লে ভীষণ শূণ্যতা অনুভব করি, মাথায় হাত বুলানো আদর ছিল আমার ভালোলাগার এক অফুরন্ত উৎস।

দাদীর মুখে ‘দাদা ভাই’ ডাক শুনার ইচ্ছে আর পূরণ হবার নয়। দাদির জানাযায় শরিক হতে না পারা আমাকে আজও আবেগাপ্লুত করে। ঈদে দাদির সাথে আত্মিয়–স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো খুব উপভোগ করতাম। বেড়ানোর আনন্দটাই ছিল স্বর্গীয়।

বক্তৃতা করা

হানারচালা গ্রামের মধুর ঈদের দিনগুলো খুবই মিস করি।  ঈদে এখনো হাতীবান্ধায় গ্রামে যেতে খুব ইচ্ছে করে।  সাধারণত তক্তারচালায় ঈদের নামাজ আদায় করলেও দড়ানীপাড়া জামে মসজিদকে মিস করি! মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান আনসারী তখন ঈদের নামাজে ইমামতী করতেন ও খুৎবা প্রদান করতেন!

ছোটবেলার এমন কিছু স্মৃতি খুব মনে পড়ে।  ঈদগাহে মুসল্লিদের সামনে বয়ান করলাম বা মসজিদে খুৎবা  দিলাম; পরে  স্বজনর বাবা ঘরে এসে মাকে বললো, এরশাদ আজকে অনেক সুন্দর কথা বলেছে। মা তখন অনেক খুশি হতেন।

ঈদে রান্না ও খাবার

একেবারে ছোটবেলায়- ঈদের দিন সকালে মা রান্নাঘরে ক্ষীর রান্না করতেন। সেই ক্ষীর আর এখনকার এই ক্ষীর এক নয়।  সেমাই রান্না করতেন। খিচুরি ও মুরগি রান্না করতেন। তবে  সেমাই খেয়ে নামাজে যাওয়া যেন একটা সামাজিক রেওয়াজ ছিল।

কোনো কোনো বাড়িতে রান্নার হাড়িতে ঢাকনা দিয়ে ঘরের কোনে ঝুলানো দড়ি বা নারকেলের ছোবড়ায় তৈরি শিকায় তুলে রাখা হতো- বিড়ালের হাত হতে খাবারকে রক্ষা করার জন্য।

ঈদ আনন্দ সবার

অভুক্ত ও অসহায় মানুষেরকে ইফতার সামগ্রী ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হতো।  অনেকেই জাকাতের অর্থ পৌঁছে দিতেন। ফিতরা আদায় করা হতো। জুম্মার নামাজ শেষে দান-খয়রাত করা হতো। এভাবে ঈদ আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলতো।

শেষ কথা

ছেলেবেলার ঈদ ছিল পরিপূর্ণ বিনোদনে ভরা। যা এখন শুধু স্মৃতি, তবুও মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে। আমি ছোটবেলার ঈদের আনন্দটুকু বেশি মিস করি এখনও, হয়তো ভবিষ্যতেও করবো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top