হীনমন্যতা হচ্ছে মানসিক দুর্বলতা ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি। অথচ কিছু কিছু ঘরানার মানুষের মধ্যে হীনমন্যতা খুবই ব্যাপক। এরা পাত্তা না পেলে হীনমন্যতায় ভুগে, স্বীকৃতি না পেলে হীনমন্যতায় ভুগে, প্রশংসা না পেলে হীনমন্যতায় ভুগে। কিছু মানুষ সামান্য কিছু করলেই তা নিয়ে চিরকাল গৌরব করতে চায়। একটু বাহবা পেতে এরা অনুগত হয়ে যায়! সফল বা বিজয়ী হবার পরও হীনমন্যতা থাকায় তাদের সকল অর্জন ম্লান হয়ে যায়!
কর্মবিমুখতায় বাড়ে হীনমন্যতা
শিক্ষা হীনমন্যতা বাড়ালে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ। কর্মবিমুখতায় বাড়ে হীনমন্যতা; যা জীবন্ত মানুষকেও জীবিত লাশে পরিণত করে। মিথ্যাবাদিতা হীনমন্যতা বাড়ায়। কেউ কেউ অন্যের হীনমন্যতা অনুসন্ধান করতে করতে নিজের হীনমন্যতার প্রমাণ দেয়।
হীনমন্যতা যেন অপরাধীর নয়!
স্বামী যদি পরকিয়া করে হীনমন্যতাবোধে না ভুগে, স্ত্রীকে কেন ডিভোর্স নিয়ে হীনমন্যতাবোধে ভুগতে হয়! মাদকাসক্ত সন্তানও বাবা স্বনামধন্য আমলা হওয়ায় বুক ফুলিয়ে চলে, অথচ সেই সন্তানকে নিয়ে বাবা হীনমন্যতায় ভুগেন! হীনমন্যতা যেন অপরাধীর নয়!
যার হীনমন্যতা নেই সে সুখী
যার হীনমন্যতা নেই- সে পেশাজীবী না হয়ে গৃহিনী হয়েও সুখে থাকতে পারে। হীনমন্যতা থেকে অন্ধত্বও আসে। অনেকে নামাজ পড়ে গোপনে অথচ শিরক করে প্রকাশ্যে! যার হীনমন্যতা থাকে সে শিকড়কে অস্বীকার করে, অতীতকে ভুলে যায়, ইতিহাসকে মুছে ফেলে।
কেউ কেউ নিজের পান্ডিত্য জাহিরে অনেক কথা বলে! অথচ কেউ তার বোঝাপড়ার শোচনীয় অবস্থা ধরায়ে দিলে, জানাশোনা বাড়াতে পড়াশোনা বাড়াতে বললে ক্ষেপে যান! অথচ লেখাপড়া ছাড়া সার্টিফিকেট, শুদ্ধ বলা ও লেখার অক্ষমতা, আর্থিক অসামর্থ্যে যেমন গৌরবের কিছু নেই।
তেমনি আচরণ জ্ঞান থাকলে, যোগাযোগ দক্ষতা থাকলে, প্রশ্ন তোলার সক্ষমতা থাকলে, নিজের অবস্থানের পক্ষে শক্ত-কঠিন যৌক্তিক ব্যাখ্যা সঠিকভাবে উপস্থাপনের যোগ্যতা থাকলে তাকে অবহেলা করারও কিছু নেই।
বিশ্বাসের দুর্বলতা থেকে হীনমন্যতা
চিন্তার অসাঢ়তা ও বিশ্বাসের দুর্বলতা থেকে হীনমন্যতা আসে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা বাড়লে, মনে তুচ্ছতা বাসা বাঁধলে- নিজের ব্যাপারে মর্যাদার অনুভূতি আসবে কোত্থেকে। হীনমন্যতা না থাকলে চাকরিই হোক আর উদ্যোক্তাই হোক যেকোনো পদে থেকেই কাজ-দায়িত্ব খুব ভালোভাবে আঞ্জাম দেয়া যায়।
বিবেকেরই অনাস্থা থেকে হীনমন্যতা
কারো যদি নিজের অবস্থার ব্যাপারেই মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে, নিজের অবস্থান সম্পর্কে সংশয়-সন্দেহ থাকে, নিজের চিন্তা-কর্মের ব্যাপারে দুর্বলতা থাকে, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য-ভূমিকার ব্যাপারে নিজের বিবেকেরই অনাস্থা থাকে এবং আত্মপরিচয় সংকটে ভুগে থাকে- তাহলে সে হীনমন্যতা মুক্ত থাকতে কখনোই পারবে না।
হীনমন্যতা খারাপ সময়ের দিকে নিয়ে যায়
কতটা হীনমন্য হলে বন্ধু হয়ে বন্ধু পরিচয় লুকিয়ে-এড়িয়ে মূলত বন্ধুত্বকে অস্বীকার করে! দাসত্বের জীবনকে আলিঙ্গন করার বেপরোয়া প্রতিযোগিতা-আত্মমগ্ন হওয়াকে ত্বরান্বিত করে, কমিটমেন্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, মানুষের জন্য কাজ করাকে গৌণ মনে করে। এভাবে হীনমন্যতা মানুষকে অনেক খারাপ সময়ের দিকে নিয়ে যায়।
মানুষের জন্য কাজ করায় হীনমন্যতা
কী অদ্ভূত! কারো কারো মানুষের জন্য কাজ করায় হীনমন্যতা! দরিদ্র-আত্মীয় স্বজনকে যথাযথ সম্মান-মর্যাদা দেয়ায় হীনমন্যতা! প্রকৃত কোনো মানবসেবক-সমাজসেবক-দেশপ্রেমী-জ্ঞানসাধককেও ক্যারিয়ারিস্ট ভাবনা থেকে পাত্তা না দেয়ায় তৃপ্ত হতেও দেখা যায়! এই ধরনের ক্যারিয়ারিজম সুবিধাভোগে কাতর, নিকৃষ্ট মুখোশ পরেও উৎকৃষ্ট ভেবে আত্মমগ্ন থাকায় উস্তাদ!
হীনমন্যতা থেকে পরিচয় গোপন ও লুকোচুরি
হীনমন্যতার শেষ নেই! বয়স নিয়ে হীনমন্যতা না থাকলে কী কেউ বয়স কমিয়ে বলে! চেহারা নিয়ে হীনমন্যতা না থাকলে কী কেউ এতো পার্লারে যায়, চেহারা উজ্জল বা ফর্সা করার ক্রীম মাখে, সাজগোজ করে বেড়ানোয় বাড়াবাড়ি করে!
হীনমন্যতা না থাকলে কী কেউ যে কলেজে অনার্স-মাস্টার্স করেছে তার পরিচয় গোপন করে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স করেও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবেই পরিচয় দেয়!
হীনমন্যতা জন্ম দেয় হিংসার
মানসিকতার অবস্থা নিচু হলে তা থেকে ভারসাম্যহীনতাও দেখা দেয়! হীনমন্যতা যখন হিংসার জন্ম দেয়, তখন তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। ধর্ম নিয়েও অনেকে হীনমন্যতাবোধে ভুগে, ধার্মিক হয়ে গোপনে ধর্ম চর্চা করেও প্রকাশ্যে সেক্যুলার হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ হীনমন্যতা সফল মানুষ হবার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।
নাম স্বীকৃতি ও প্রশংসা নিয়ে হীনমন্যতা
অনেকে মুসলমান হবার পরও ইসলামিক নাম নিয়ে বা আরবি নাম নিয়ে একধরনের হীনমন্যতা আছে। জাতি হিসেবে হীনমন্যতা হচ্ছে- সম মেধাবী দুই নাগরিকের মধ্যেও বিদেশিকে বেশি যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রবণতা! ভিন দেশের প্রশংসা করা আর নিজ দেশকে অত্যন্ত বাজে বলার প্রবণতা খুবই খারাপ।
হীনমন্যতা দূর হয় বিনয়ী হলে
হীনমন্যতা বোধ বাড়ে- অন্যের ইনকাম বসে বসে খাইলে, যাকে টেনে তোলা যায় তাকে পেছনে ঠেলে দিলে৷ হীনমন্যতা দূর হয় বিনয়ী হলে, পরিবারের শক্তিশালী বৃত্তে সুস্থভাবে আটকে থাকলে, দশজনের মতো না হয়ে নিজের মতো হলে।
জীবনীশক্তির ক্ষয় করে হীনমন্যতাবোধ
হীনমন্যতাবোধ মানুষের আত্মবিশ্বাস শেষ করে, জীবনীশক্তির ক্ষয় করে। কাউকে তাচ্ছিল্য করা, নিজের চাইতে হীন ভেবে অপমান করা, অন্যের নামকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উচ্চারণ করা, নিজ গোত্র-বংশকে অপর গোত্রের-বংশের চাইতে শ্রেষ্ঠ মনে করা, নিজের দলকে সঠিক মনে করে অপর সকল দলকে বিভ্রান্ত মনে করা, নিজে লম্বা হওয়ায় আকার-আকৃতিতে খাটোকে দুর্বল মনে করা, নিজে ফর্সা-সুদর্শন হওয়ায় কালোকে অসুন্দর-কুৎসিত মনে করা, অন্যকে নিকৃষ্ট ভাবা- হীনমন্যতাবোধ থেকে আসে!
আত্মবিস্মৃতির পরিণতি হীনমন্যতাবোধ
হীনন্যতাবোধ বিশ্বাসই করতে দেয় না সৎকর্মপরায়ণতার কারণে বা কর্মগুণেই মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। সম্পদের অহমিকায় মাটিতে যেসব দাম্ভিকদের পা পড়ে না আর ক্ষমতার তাপে অহঙ্কারে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে তারা মূলত হীনন্যতায় ভুগে! কোনো মুসলমান হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন না; হীনমন্যতায় ভুগার অনুমতি ইসলামে নেই। যারা আত্মপরিচয় ভুলে যায়, তাদের আত্মবিস্মৃতির পরিণতি হীনমন্যতাবোধ।
নিজেই করে নিজের অবমূল্যায়ন
হীনন্যতাবোধ থাকলে নিজেকে নিজে তুচ্ছ ভেবে নিজের ওপর নিজেই অবিচার করে। নিজেকে মূল্যহীন মনে করে নিজেই নিজের অবমূল্যায়ন করে। সময়-সমাজ তাকে তুচ্ছ-মূল্যহীন মনে করছে সন্দেহে পড়ে, নিজের কাছে নিজের মূল্য হারিয়ে ফেলে। আপন হৃদয়ে যার স্থান নেই, এ জগতে তার স্থান নেই, মর্যাদা নেই।
হীনমন্যতায় ভুগে কাটে জীবন
কালো ত্বক, বেশী ওজন বা স্থুলতা, স্তনের আকৃতি, বেঁটে হওয়া, চুল কম থাকা, বরের সাথে বয়সের ব্যবধান খুব বেশি হওয়া- এসব নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা মেয়েদের জীবন কেটে যায় হীনমন্যতায় ভুগে ভুগেই। লম্বা দেখাতে হাই হিল জুতা পরেন। ছেলেদেরও কেউ কেউ টাক নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগেন, কেউ কেউ বড় সাইজের ভুরি নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগেন।
গুরুত্বহীনতা থেকে হীনমন্যতা
কেউ ছোটবেলা থেকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ঠিকমতো গুরুত্ব না দিলেও প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন। ক্রোধও হীনমন্যতার জন্ম দেয়, এতে মানসিক শান্তি নষ্ট হয়। অনেকের ব্যবসা নিয়ে হীনমন্যতা রয়েছে।
পছন্দের জায়গায় পোস্টিং না পেলে বা অপছন্দের জায়গায় বদলি হলে কেউ কেউ হীনমন্যতায় ভুগেন। হীনমন্যতায় ভুগেন অনেকে সম্পর্ক নিয়ে, অনেকে যে প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন সেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে, যেই পদে কাজ করছেন সেই পদ নিয়ে, যে পরিমাণ আয় করছেন সেই পরিমাণ নিয়ে!
হীনমন্যতা থেকে অবমূল্যায়ন
দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভুগে আত্মহত্যা করা বা যার কাছ থেকে তীব্র অবহেলা পেয়েছে তাকে খুন করার মতো ঘটনাও ঘটে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় পর থেকে বা প্রত্যাশিত প্রতিষ্ঠানে বা পছন্দনীয় সাবজেক্টে ভর্তি না হতে পারার কারণেও হীনমন্যতায় ভুগে নিজের মেধাকে নিজেই অবমূল্যায়ন করতে থাকে। কর্মজীবীরা কর্মক্ষেত্রেও অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে বা কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন না পেলে হীনমন্যতায় ভুগেন।
হীনমন্যতা এগিয়ে যাওয়ার বাধা
হীনমন্যতায় না ভুগে নিজের প্রতি পূর্ণ আত্মবিশ্বাস থাকলে সে মান+হুঁশ=মানুষ। হীনমন্যতায় থাকা মানুষগুলোর উন্নতি বা এগিয়ে যাওয়ার বাধা নিজেও। অনেকে অতিরিক্ত রোগা হওয়ায় হীনমন্যতায় ভুগেন। অনেকে দাঁতে বাদামি দাগ হওয়ায় হীনমন্যতায় ভুগেন। অনেকে চুলে পাক ধরায় হীনমন্যতায় ভুগেন। অনেকে সাবলীলভাবে কথা বলতে না পারার কারণে হীনমন্যতায় ভুগেন।