প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শুধুমাত্র পড়াশুনার গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে প্রথম বর্ষেই গাজীপুরে কোনাবাড়ীর দেওলিয়াপাড়া গ্রামে ‘ইকরা মডেল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন সাহসী ও উদ্যমী তরুণ শরিফুল ইসলাম (সুমন)। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল, গরিব পরিবারের সন্তানদেরও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে কিছু একটা করতেই হবে।
বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েই আগামীর পথে এগিয়ে চলছেন বীরদর্পে। স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সেভ দ্য ফ্যামিলি-বাংলাদেশ নামে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তরুণ এই উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে লোভনীয় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিভাগে অধ্যয়নরত। এই তরুণ উদ্যোক্তার মুখোমুখি হয়েছিল পরিবার ডটনেটের প্রতিবেদক শাওন মুকুল।
শাওন মুকুলঃ আপনার স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্পটা জানতে চাই।
শরিফুল ইসলাম সুমনঃ আমি কর্মপাগল মানুষ, কর্মব্যস্ত থাকতেই পছন্দ করি। আমার স্বপ্নই মানুষের মুখে হাসি ফুটানো। পরের জন্য ভালো কিছু করার মাঝে আমি আনন্দ পাই। আমি নিজে অনেক সম্ভাবনার অপমৃত্য দেখেছি, মেধাবী শিক্ষার্থীরও পড়াশুনা বন্ধ করে গৃহিণী কিংবা শ্রমিক হয়ে যেতে দেখেছি। বিশেষ করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে অকালেই ঝড়ে পড়া আমাকে ব্যাথিত করত। কিছু করার দায়িত্ব অনুভব করতাম। ঢাবিতে ভর্তি হবার পর সেই কিছু করার সাহসটা বেড়ে গেল।
২০১৪ সালে ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ‘ইকরা মডেল একাডেমি’ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে ২৫০জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত এবং ২০জন শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মরত। বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই চরম দরিদ্র পরিবারের সন্তান; যারা গরিব হলেও নূন্যতম বেতনে ভালোমানের শিক্ষা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অধিকাংশের পরিবারেই উপার্জনকারী অভিভাবকের কর্মস্থল বিভিন্ন কল-কারখানা। যার ফলে ছোটরা বড়দের থেকে আলাদা থেকেই দিনযাপন করে। এতে করে সন্তানের বিপথে যাওয়া, খারাপ সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, তাদের মেধার সুষ্ঠু পরিচর্যা ও বিকাশ কঠিন হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন মানসিক রোগেও তারা আক্রান্ত হয়। এসব সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সুযোগ পেলে ভবিষ্যতেও কাজ করে যেতে চাই।
মুকুলঃ সেভ দ্য ফ্যামিলি- বাংলাদেশ সম্পর্কে বলবেন কী?
সুমনঃ বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, নিজ হাতে গড়া বিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাই আমাকে সেভ দ্য ফ্যামিলি-বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আগ্রহী করে তুলেছে। এর প্রধান লক্ষ্যই হলো দেশের প্রত্যেকটি জায়গায় প্রত্যেক মানুষের কাছে পরিবারের গুরুত্ব ও কার কী করণীয় তা তুলে ধরা, সচেতনতা বৃদ্ধি করা। যদি প্রতিটি ঘরে ঘরে এমন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে যারা অন্যের অধিকারের ব্যাপারে দায়িত্ববান এবং পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার ব্যাপারে যত্নশীল; তবে সুখী পরিবারই সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
মুকুলঃ সন্তানের সঠিক পরিচর্যায় অভিভাবকদের কী করণীয় রয়েছে?
সুমনঃ জীবিকার প্রয়োজনে কিংবা উন্নত ক্যারিয়ারের অভিপ্রায়ে অনেকেই পারিবারিক সান্নিধ্যের বাইরে বড় হচ্ছে। স্নেহ-প্রীতি-প্রেম-ভালোবাসাময় পরিবারের আন্তরিকতার পরশ না পেয়ে একাকিত্ব নিয়ে সময় কাটছে অনেকের। শৈশব-কৈশরে কাজের লোকের আদর-যত্ন যে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যের বিকল্প হতে পারে না এটাও অনেকে বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। ভিডিও গেমস খেলা, কম্পিউটার-ইন্টারনেট-সেলফোনের বিনোদন কখনো দাদি-নানির কাছ থেকে শুনা গল্প কিংবা মামা-কাকাদের শুনানো ছড়ার বিকল্প হতে পারে না। আমি অভিভাবকদের বলবো- সন্তানের চাহিদা পূরণেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয়, সন্তানকে সময় দিতে হবে; যাতে সে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠে।
মুকুলঃ পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কী?
সুমনঃ বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে সবাইকে সফল ও সার্থক জীবনের জন্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা জীবনব্যাপী চলে কখনো অন্যের সাথে কখনো নিজের সাথে। জীবন সংগ্রামে বিজয়ী হবার স্বপ্ন পূরণে আমাদের ভালোবাসার নীড় পরিবার ছেড়ে বাড়ি থেকে হলে-মেসে, গ্রাম থেকে শহরে কিংবা দেশ থেকে বিদেশে ছুটে বেড়াতে হয়। এই কর্মব্যস্ততা কখনো নিজের জন্য, কখনো বাবা-মায়ের জন্য,কখনো স্ত্রী সন্তানের জন্য। এই ব্যস্ততা থাকবেই। তারপরও বলবো- সাধ্যানুযায়ী পরিবারকে সময় দিন এবং পরিবারের যত্ন নিন।
মুকুলঃ ব্যস্ততার মাঝেও সময়দানের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সুমনঃ আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে পাঠক ও সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ।