আনিসুর রহমান এরশাদ
ডিজিটাল বিপ্লবের জোয়ারে এখন দেশের মোট টেলিফোনের শতকরা ৯৯ শতাংশই সেলফোন ব্যবহারকারী। দিন দিন স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ার ফলে বেড়েছে সেলফোনে ইন্টারনেটের চাহিদা। সবগুলো অপারেটরই গ্রাহকদের জন্য নিয়ে এসেছে আকর্ষণীয় প্যাকেজ। চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ পেতে রয়েছে হেলথ লাইন সেবা। অনেক ব্যাংক সেলফোন অপারেটরদের সহযোগিতায় অর্থ লেনদেন সুবিধাও দিচ্ছে। সেলফোন থেকে আসছে সরকারের রাজস্ব আয়, বাড়ছে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ। এসব অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও সেলফোনের প্রভাব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও পড়ছে। প্রভাবটা কখনও ইতিবাচক আবার কখনও নেতিবাচক।
সেলফোন প্রযুক্তি সেবা দেশের মানুষের জীবনে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, পাল্টে দিয়েছে জীবনযাত্রা। সর্বস্তরের মানুষের পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে এটি। গ্রামীণ জনপদ আর শহরের মানুষকে একে অপরের অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। দেশের মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ধারক হিসেবেও কাজ করছে। এই খাতে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশেরই সমকক্ষ। ১৯৯৭ সালে মাত্র ৩টি জেলা, ২০০০ সালে ৩০টি জেলা, ২০০২ সালে ৫০টি জেলা, ২০০৪ সালে ৬১টি জেলা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসে। এখনতো জেলা দূরে থাক এমন কোনো থানা উপজেলাই পাওয়া যাবে না যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক পেঁছেনি। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসে গেছে। অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাব কষা আর ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে এই লেখা নয়। সেলফোন ব্যবহারের বহুবিধ ঝুঁকি ও সমস্যা লাঘবের উপায় সম্পর্কে আলোকপাতকেই গুরুত্ব দেয়া হবে।
গবেষণায় দেখা যায় যে, সেলফোন ব্যবহারকারীরা দৈনিক গড়ে ১২ মিনিট ফোনালাপ, গেমস খেলায় ১৪ মিনিট, গান শোনায় ১৬ মিনিট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৭ মিনিট এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিং এ ২৫ মিনিট ব্যয় করে। সেলফোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সময় দেখার জন্যে। সেলফোন ব্যবহারকারির সতর্কতা ও সচেতনতাই বাঁচাতে পারে ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। সেলফোনে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনে মোবাইলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেমন জঙ্গি অর্থায়নে লেনদেনেরও অভিযোগ উঠেছে। তেমনি মোবাইল যে আধুনিক জীবনকে সহজ ও উপভোগ্য করেছে। এমতাবস্থায় মোবাইল যাতে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহারিত না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। স্পূফিং, সীম ক্লোনিং ও এসএমএস এডিটিং যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। আবার এই শিল্প বেঁচে থাকবে কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হবে, তাদের ভবিষ্যত জীবন তথা ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এটাও হতে দেয়া যাবে না। ফলে এই সেক্টরের সমস্যা, সমস্যা সমাধানের সর্বাধুনিক কৌশল প্রয়োগ এবং সম্ভাবনার বিকাশে সময়োপযুগী উদ্যোগের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শুধু মেবাইল অপারেটররা নয়, ব্যবহারকারী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদেরও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।
সেলফোন অপারেটরদের কিছু কিছু অফারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পড়াশুনা। প্রায় প্রতিটি সেলফোন অপারেটর নানা সময় নানারকম লোভনীয় অফার ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে গ্রাহকদের। এক্ষেত্রে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা তাদের অন্যতম টার্গেট গ্রুপ। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানীদের সশ্রয়ী কলরেট, ইন্টারনেট প্যাকেজের কারণে ছাত্রছাত্রীরা দিনে রাতে মেতে থাকে ফোন ব্যবহারে। এসব অফার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তা ব্যাপকভাবে প্রচার হয় পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও বিলবোর্ডে। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এসব অফারে ঘুম হারাম করে ফেসবুকে চ্যাটিং কিংবা বন্ধুর সাথে গল্পে মেতে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের পড়াশোনা। সেলফোনের অত্যাধিক ব্যবহার বাড়াচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। নানা চটকদার বিজ্ঞাপন ও ছবি, রিংটোন ও গান তাদের আকৃষ্ট করছে। অনেক সময় ফ্রি এসএমএস ও রাত ১২টার পর থেকে সকাল পর্যন্ত ফ্রি কথা বলারও সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যেমন- একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ক্যাপশনে লেখা ‘ভালোবাসার টানে পাশে আনে’। রাতের বেলা প্রায় অবাধে কথা বলা ও গান-বাজনা শোনার সুযোগ উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। পড়ছে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাসহ লেখাপড়ায় মনোসংযোগের অভাবজনিত সমস্যায়। প্রায় রুটিনবিহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালেও মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায় তাদের। ছেলেমেয়েদের এসব সমস্যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এক্ষেত্রে সেলফোনের অবাধ ব্যবহারসহ বিজাতীয় অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ দায়ী। এভাবে দেশীয় সংস্কৃতি, পারিবারিক ও ধর্মীয় সংস্কার সর্বোপরি মূল্যবোধ ও মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।
সেলফোন অপারেটরদের বিনা পয়সায় ফেসবুক ব্যবহারের সুযোগ কিংবা এক কলে যতক্ষণ খুশি কথা বলার অফারে নির্ঘুম রাত কাটছে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের। রাত ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একদম ফ্রি ফেসবুক ব্রাউজিং শুরু হলে ইউজারকে রাত জাগতে হবে। সবাই অফার ব্যবহারের জন্য রাত জাগে, সকালের সূর্য দেখতে পারে না। রাতজাগা অফার -প্রথম মিনিটের পর থেকে ফ্রি, মধ্যরাত থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফ্রি ইত্যাদি। অনেক সেলফোন অপারেটর গ্রাহকদেরকে দিনের চেয়ে রাতে কম খরচে কথা বলার অফার দিয়ে থাকে। পরীক্ষার পূর্বে এসব অফারে মজে ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুম বাদ দেয়ায় তাদের অনেক ক্ষতি হয়। ফ্রি ফেসবুক ব্যবহারের ফলে যে আসক্তি জন্মায় তা অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করে। অভিভাবক মহল এনিয়ে দারুণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এমন অফারের বদলে কমমূল্যে ইন্টারনেট সেবা সব সময় চালু করাটাই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন তারা। অনেক টিনএজরা শুধু রাতে নয়, খাবার টেবিল, টিভি দেখার সময়-এমনকি ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার সময়ও ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকে। তারা ক্লাসে ঘুমায়। কারণ রাত জেগে ফেসবুকে চ্যাট করে। তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কে? ফেসবুকের রাতজাগা ফ্রি অফার ধ্বংস করছে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের। ক’দিন আগে আমার কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী বলতেছিল, সারা রাত ইন্টারনেট ব্যবহার করে সারাদিন মানুষ কি ঘুমাবে? কত রাত জাগাবে অপারেটররা? সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যে ফ্রি অফার ছাত্র-ছাত্রীদের বিপথে নিচ্ছে। অপারেটররা তাদের সঠিক পথে থাকতে দিচ্ছে না। ছাত্র সমাজকে ধ্বংস করার উপায় বের করেছে। প্রতিদিন ও প্রতি ঘণ্টার ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি কথা বলা গ্রাহককে খুঁজে বের করে আকর্ষণীয় সেলফোন সেট ও স্যামসাং গ্যালক্সি ট্যাব থ্রি পুরস্কৃত করা কিসের আলামত? শিক্ষক-অভিভাবক সবাই উদ্বিগ্ন।
সেলফোনের অত্যাধিক ব্যবহারে সময় ও মেধার অপচয় বাড়ছে। ১০ টাকার কথা বললে ২ টাকার কথা ফেরতের ক্যাশব্যাক অফার, বডি ট্র্যাকার এর মাধ্যমে বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের অবস্থান জানা, আনলিমিটেড এসএমএস অফার, এক্সাইটিং রিঅ্যাক্টিভেশন অফার, নাইট টাইম অফার, ইনকামিং বোনাস অফার, ইউসেজ বোনাস, রিচার্জ বোনাস, ইন্সট্যান্ট ক্যাশ ব্যাক ও বান্ডল অফাওে সময় ও মেধার অপচয় বাড়ছে। শুধু তাই নয় মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভর যোগাযোগে বাড়ছে আবেগ, কমছে বাস্তবজ্ঞান। কথাবার্তা উৎসব, আনলিমিটেড অফারে আনলিমিটেড ভয়েস, এসএমএস ও ইন্টারনেটের বোনাস উপভোগ করার অফারে কম বয়সী শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ সময়ই পছন্দের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে কানেক্টেড থাকছে। ফলে তারা অতিমাত্রায় স্বপ্ন সুখের কাল্পনিক জগৎ তৈরি করছে মনের মধ্যে। ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধে সেলফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। সেলফোনে ডেকে নিয়ে হত্যা, গুম ইত্যাদি ঘটনা বিরল নয়। সেলফোনে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে অহরহ মিথ্যা কথা বের হচ্ছে। সেলফোনে পর্ণোগ্রাফির ব্যবহার মহামারীর আকার ধারণ করেছে। অযাচিত প্রেম, ইভটিজিং, প্রেমিকের হাত ধরে পলায়ন ইত্যাদি বিষয় ত্বরান্বিত করার জন্যও সেলফোন অনেকাংশে দায়ী। বেশিরভাগ স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সেলফোন, ট্যাব ও ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দেখা যায়। সেলফোনের সঠিক ব্যবহার থেকে অপব্যবহার বেশী পরিলক্ষিত হয়।
স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের টয়লেটে গোপন ক্যামেরা ও প্রেমের মায়াজালে ফেলে বিভিন্ন আপত্তিকর ছবি এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। মতের পার্থক্য দেখা দিলে, তা প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, ইউটিউবে। এতে অনেক মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া পর্ণোগ্রাফি স্কুল কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চোখে বেশ লাগে! পড়ার টেবিলে বসে খাতা কলম রেখে দিয়ে এসব দেখে। এতে অনেকেরই পড়া শোনার সময় নষ্ট হয়। নৈতিক অবক্ষয় হয়। কাঁচা বয়সীদের মনের মধ্যে ময়লা জমতে শুরু করে। কম বয়সীরা অপকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়। বাংলাদেশ অধিকার ফোরাম আয়োজিত একটি সেমিনারে বলা হয়, ‘শিশুরা এখন বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়ছে পর্ণোগ্রাফির সঙ্গে। বেশিরভাগই শিশুই পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অবাধ ইন্টারনেটের ব্যবহারের কারণে শিশুরা পর্ণোগ্রাফি তৈরি ও বিনিময়ে করছে বন্ধুদের সঙ্গে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘চাইল্ড পর্ণোগ্রাফি, অ্যান এক্সপ্লরেটরি স্টাডি অ্যাট ঢাকা’ শিরোনামে একটি গবেষণায় দেখা যায়, গবেষণা কাজে অংশ নেয়া ৭৭ ভাগ শিশুই পর্ণোগ্রাফি দেখে।’ শিশু বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়ষ্কদের। এখন ছেলে-মেয়েরা ১৪ বছরে স্কুল পাস দেয়। ১৬ তে পাস করে কলেজ। ১৮ তে তারা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলাদেশে স্পুফিং সফওয়্যারটিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় অপহরণ, জিম্মি করে টাকা আদায়ে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি করা হচ্ছে। ‘স্পুফিং-ঝঢ়ড়ড়ভরহম’ হচ্ছে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মোবাইল নম্বর হুবহু নকল করে অন্য কাউকে ফোন করা। কৌশলে ঈধষষবৎ ওউ ঝঢ়ড়ড়ভবৎ সহ বিভিন্ন সফটওয়ারের মাধ্যমে কলার নিজের নাম্বার হাইড করে তার স্থলে কলারের ইচ্ছে মতো নাম্বার প্রদর্শন করে রিসিভারের মোবাইলে। এছাড়া ‘সীম কার্ড ক্লোনিং’ এর মাধ্যমে সিমের পুরো তথ্যই চুরি করা হচ্ছে। একটি সিম কার্ডের মাইক্রো কন্ট্রোলারের থাকা তথ্য অনুরূপ বা নকল করা হচ্ছে। ফলে সিম কার্ডে থাকা সকল তথ্য নকল সিম কার্ডে চলে যাচ্ছে, এমনকি সিম কার্ড ক্লোনিং এর ফলে সঠিক সিম কার্ডের রেকর্ড যেমন: কল লিস্ট, ডায়াল কল লিস্ট, মেসেজ লিস্ট, পিন কোড, আইসিসিআইডি নম্বর এবং সিম কার্ডের ব্যালেন্স স্থানান্তর হচ্ছে। সিম কার্ড ক্লোনিং এর ২টি পদ্ধতির মধ্যে একটি হলো, হার্ডওয়্যার বা ডিভাইস ভিত্তিক সিম কার্ড ক্লোনিং এবং অপরটি হলো আইপি টেলিকমিউনিকেশন ভিত্তিক সিম কার্ড ক্লোনিং। সিম ক্লোনিং হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে পারেন। জালিয়াতরা মূল ব্যবহারকারীর সিম, মেমোরি কার্ড বা ডেটা কার্ডে সংরক্ষিত তথ্যগুলো হাতিয়ে নেয়। সিমের নম্বর ব্যবহার করে তারা অন্য যে কোনো নম্বরে ফোন করতে পারে। যে কোনো ব্যক্তিকে হুমকি বা সন্ত্রাসমূলক ফোনের কাজে নম্বরটি ব্যবহার করতে পারে। সিম ক্লোনিং এর কারনে ক্রাইম না করেও চাদাবাজি, প্রতারনা, ডাকাতি এমনকি খুনের মামলায়ও ফেসে যেতে পারেন। আর্থিক বিপর্যয়, সামাজিক সম্মানহানি বা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে পারেন।
আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এসএমএস এডিটিং, যা মোবাইল প্রতারকদের নতুন কৌশল হতে পারে। স্পুফিং ও সিম ক্লোনিং হচ্ছে বাংলাদেশে মোবাইলে প্রতারণায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর প্রথম ধাপ মাত্র। এসবে ব্যবহৃত সফটওয়্যারগুলোর আরো আপডেট ভার্সন আছে। এমনও শক্তিশালী প্রযুক্তি আছে যার মাধ্যমে একজনের পাঠানো এসএমএস আরেকজন এডিট করে পাঠাতে পারে, কথা শুনতে পারে এবং রেকর্ডও করা যায়। এসএমএস এডিটিং এর মাধ্যমেও হতে পারে প্রতারণা। এসএমএস পরিবর্তন করেও পাঠানো যায়। প্রতারকরা এসবের অপব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। এভাবে হাতে হাতে মোবাইল বাড়াচ্ছে অপরাধ প্রবণতা। পড়ালেখার সময় প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত কাজকর্ম ধর্ম-কর্ম ছেড়ে এবং ঘুম হারাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেলফোনে সময় দিচ্ছে। বিশেষ করে রাত ১২টার পর বিভিন্ন সেলফোন কোম্পানি বিশেষ সুবিধা প্রদান করায় প্রেম-পরকীয়া, প্রেম বিনিময় চলছে। সেলফোনের মাধ্যমে একজন মেয়েও ঘরের বাইরে বের করে আনছে। ওই সেলফোন রিংটোন ও মেমোরিতে আজে-বাজে গান, অশ্লীল ছবি ঢুকিয়ে রাস্তায় পথেঘাটে, বাজারে, বসতবাড়িতে, অলিগলিতে, দোকানে, বিভিন্ন আড্ডার আসরে অশ্লীল গান বাজিয়ে উঠতি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেলফোনে অশ্লীল ভিডিও, অডিও ছবি ও গান ছড়ানো হচ্ছে। ছবি ও সিডি, গান লোড ব্যবসায়ীরা এসব কার্যক্রম চালাচ্ছে। ড. স্কট ফ্রাঙ্ক বলেছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এবং মেসেজ পাঠানোর ক্ষেত্রে যে মানসিকতা দেখা গেছে তা অনেকটাই জুয়াসহ অন্যান্য আসক্তির শামিল।
শুধু তাই নয়, সেলফোন ও টাওয়ারে শারীরিক সমস্যা বাড়ছে। দু’কানে মাইক্রোফোন লাগিয়ে উচ্চশব্দে গান শুনায় এবং মোবাইল ফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলার কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস করছে, কানের মধ্যে ব্যথা হচ্ছে, কানের অন্তঃপর্দা ও অন্তকর্ণের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ফোনালাপ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, মস্তিষ্কে এর প্রভাব পড়ে, মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়, বাড়ায় নিদ্রাহীনতা। ব্যবসা ও প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে,স্মার্টফোন, ট্যাবের মতো ইলেকট্রনিক যন্ত্র রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিয়মিত ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুললে ঘুম ও স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। রাতে সেলফোন বা ট্যাব ব্যবহার করে বার্তা পাঠানো, ফেসবুক চ্যাটিং কিংবা অনলাইনে ব্রাউজ করা অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ স্মার্টফোন স্ক্রিন থেকে নির্গত কৃত্রিম নীল আলো ঘুমের চক্র নষ্ট করে দেয় এবং স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির এক ভিডিও বার্তায় নিদ্রাহীনতার জন্য রাতের বেলা স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারকে দায়ী করেছে। এতে এক পর্যায়ে ঘুমের মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয় এবং ‘সিøপ ডিজঅর্ডার’ এর ঝুঁকি তৈরি হয়। রাতের বেলা অতিরিক্ত সময় সেলফোন ব্যবহারে চোখের সমস্যা হতে পারে। রেটিনার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। শরীরে মেলাটোনিনের ঘাটতি দেখা দেয়। শরীরে সহজেই রোগ বাসা বাধতে পারে। যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, সেলফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টি দেখা দিতে পারে। চোখের খুব কাছে রেখে অতিরিক্ত সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্ষীণদৃষ্টি সৃষ্টির জন্য যা ভূমিকা রাখতে সক্ষম। গবেষকেরা একে ‘এপিজেনেটিকস’-সংক্রান্ত বিষয় বলেন।
কেউ ভাবতে পারেন বড়রা সেলফোন ব্যবহার করলেতো আর ছোটদের সমস্যা নেই। এটি একটি ভুল ধারণা। ন্যাচার সাময়িকীর ওয়েবসাইট সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতিবিদ্যা, স্ত্রীরোগ ও প্রজনন বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হিউ টেইলর ও তার সহযোগীদের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভবতীদের সেলফোন নিজের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা উচিত। তা না হলে গর্ভস্থ শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, মানসিক বিকলাঙ্গ হয়েও জন্ম নিতে পারে শিশু। অসুস্থ সন্তান সুস্থ শিক্ষার্থী হতে পারেবে না। তাই সতর্ক থাকতে হবে গর্ভবর্তী মায়েদেরও। সেলফোনের তরঙ্গের প্রভাবে মস্তিষ্কের পিফ্রন্টাল করটেক্স অংশের নিউরনের গঠন প্রভাবিত হয়। মস্তিষ্কের এ অংশের সমস্যার কারণে শিশুদের মধ্যে ‘অ্যাটেশন ডিফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)’ দেখা দিতে পারে। ফলে শিশুদের আচরণগত সমস্যার কারণও হতে পারে মোবাইল তরঙ্গ।” অনেকে ভাবতে পারেন, অধিকাংশ সময় সেলফোন ব্যবহার না করলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এটা ভুল ধারণা। ফোন যখন স্ট্যান্ড-বাই মোডে থাকে তখনও আয়োনাইজিং এবং নন-আয়োনাইজিং বেতার তরঙ্গ ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কে প্রবাহিত হতে থাকে। ছোট খাটো শব্দে ফোন ভাইব্রেট করছে মনে করে কয়েক মিনিট পরপরই ফোন খুলে দেখা মানেই ‘রিংজাইটি’-তে ভুগা। সেলফোনে আসক্ত ব্যক্তিদের ব্রেইন ক্যান্সারও হতে পারে। তাই সুস্থ, সবল ও দীর্ঘ জীবন যাপনের স্বার্থে মোবাইল ফোনের পরিমিত ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেকেই সেলফোন টাওয়ারের রেডিয়েশনের ক্ষতি নিয়ে ভাবেন না। অথচ এ নিয়ে বিশ্বে এ পর্যন্ত ৯২৬টি গবেষণা হয়েছে। তন্মধ্যে ৬০১টি গবেষণায় পশু, পাখি, পোকামাকড়, অণুজীব এবং মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। সেলফোন টাওয়ারের এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০০ মেগাহার্টজ মাইক্রোওয়েভ ছড়ায়। এসব টাওয়ার থেকে নিগত ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (ইএমআর) ঘটিত ইলেক্ট্রো স্মোগ খুবই ভয়ানক। যা শিক্ষার্থীদেরও ক্ষতি করছে। যেমন- ব্রেন ক্যান্সার, কানের শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস, বুকের কাছে সেল ফোন রাখলে হৃদপিন্ড, যকৃত ও ফুসফুসের ক্ষতি হওয়া ইত্যাদি। সেলফোনের সেটের সাথে টাওয়ারের যোগাযোগ হয়ে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের মাধ্যমে। যা মানবদেহের ভিতরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে ইয়ারফোন যারা ব্যবহার করে তাদের ক্ষতি হয় আরও বেশি। প্যান্টের পকেটে সেলফোন রাখলে ছেলেদের প্রজনন ক্ষমতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে এক গবেষণায় দাবি করেছেন যুক্তরাজ্যের এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল থেকে নির্গত রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন গুণগতমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শুক্রাণুর ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে। অতিরিক্ত সময় ধরে মেসেজ বা বার্তা টাইপ করা হলে আঙুলের জয়েন্টগুলোতে ব্যথা হতে পারে এবং অবস্থা বেশি খারাপ হলে আর্থরাইটিসের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীরের জয়েন্ট বা সন্ধির সমস্যা থেকে সুস্থ থাকতে হলে অতিরিক্ত সময় ধরে সেলফোনে বার্তা লিখা যাবে না।
মার্কিন গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, টয়লেট সিটের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে সেলফোনে। সেলফোন নিয়মিত পরিষ্কার না করায় এটি জীবাণুর অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। সেলফোনে ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্যবহারকারীর জন্য খুব বেশি ক্ষতিকারক না হলেও এটি থেকে সংক্রমণ বা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাইতো ইতোমধ্যেই সেলফোনকে ক্যান্সারের ঝুঁকির তৈরি করতে পারে এমন পণ্যের তালিকায় রেখেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেলফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকবেরি ও অ্যাপলও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে সেলফোন শরীর থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছে। স্নায়ুতন্ত্রের উপর সেলফোনের ক্ষতি নিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমীক্ষা ‘ইণ্টারফোন স্টাডি’ ও ‘হার্ডেল রিসার্চ গ্রুপ’। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দিনে দেড় ঘণ্টা বা তার বেশি সময় সেলফোনে কথা বললে ব্রেনের উপর তার খারাপ প্রভাব পড়ে। দশ বছর ধরে সেলফোন ব্যবহার করলে মস্তিষ্ক কোষের অস্বাভাবিক রকমের বৃদ্ধি হতে পারে। যা থেকে পরবর্তীকালে গ্লাইওমা ও ব্রেন ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশনের প্রভাবে মস্তিষ্কের ব্লাড-ব্র্রেন বেরিয়ার লিক করে। ফলে রক্তের বিষাক্ত পদার্থ এই পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি হয়। ৩০ মিনিটের বেশি সেলফোনে কথা বললে মস্তিষ্কের কাজের ক্ষমতা কমে যায়, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়।
সেলফোন থেকে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা মানুষের হার্টের স্বাভাবিক কর্মকান্ডকে ব্যহত করে। এর ফলে রক্তের লোহিত রক্তকণিকাতে থাকা হিমোগ্লোবিন আলাদা হয়ে যেতে থাকে। এছাড়া হিমোগ্লোবিন রক্তের লোহিত কণিকার মাঝে তৈরি না হয়ে দেহের অন্যত্র তৈরি হতে থাকে। যেটি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। যে কারণে বুক পকেটে ফোন রাখা একদমই অনুচিত। এছাড়া যারা হার্টে পেসমেকার বসিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও সেলফোন ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তাছাড়া সেলফোন আসক্তিতে মানসিক সমস্যা বাড়ছে। হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেলফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যায় পড়ছেন ব্যবহারকারীরা। মুঠোফোন হারানোর ভয় নিয়ে মন সব সময় সতর্ক থাকায় মনের মধ্যে জন্ম নেয় ভয়জনিত অসুখ ‘নোমোফোবিয়া’ তথা নো ‘মোবাইল-ফোন ফোবিয়া’। অনেক শিক্ষার্থীরা এ রোগের শিকার। মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত সময় বার্তা পাঠানো ও চ্যাটিং করার ফলে হয় ‘সিøপ টেক্সটিং’ সমস্যা। এ সমস্যা হলে রাতে ঘুমের মধ্যে কাকে কী বার্তা পাঠানো হয় তা আর পরে মনে থাকে না। বার্তা পাঠানোর বিষয়টি মাথায় থাকে বলে ঘুমের মধ্যেও হাতের কাছে থাকা মুঠোফোন থেকে অনাকাঙ্খিত নম্বরে বার্তা চলে যায়।
অত্যধিক মোবাইলের ব্যবহারে ঘুমের সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, আত্মহত্যার প্রবণতা, বিষণ্নতা, হতাশা বাড়তে পারে। রাতে ঘুমানোর সময় নিজের মোবাইল ফোনটা বালিশের নিচে কিংবা পাশে রেখে দিলে তা মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে মানুষের ঘুমের পরিমাণ ও ঘুমের গভীরতা কমে যায়। স্নায়ু অবচেতন অবস্থাতেও উত্তেজিত থাকে। ঘুমের মধ্যেও ফোনকল কিংবা মেসেজের অপেক্ষা করতে থাকে। আর এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে মানুষ খুব বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখতে পারে না। ঘুম না হওয়ায় মেজাজ খিটখিটে হয়, বদরাগী হয়ে যায়। সুইডেনের ইউনিভার্সিটি অব গুটেনবার্গ এর গবেষক সারা থমি বলেন, যারা অতিরিক্ত কম্পিউটার ও সেলফোন ব্যবহার করেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যারা মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত কথা বলেন এবং কম্পিউটার ব্যবহার করেন তাদের অনিদ্রাসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় এবং তারা বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভোগেন। অনেকেই আবার এ বিষণ্নতার কারণে আত্মহননসহ নানা ধ্বংসাত্মক কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। যারা রাত জেগে একটানা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ব্যবহার করেন বা মোবাইল ফোনে কথা বলেন তাদের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সেলফোন ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে ভুগেন। তাদের মানসিক প্রশান্তি কমে যায়। সব সময় আশা করতে থাকে এই বুঝি ফোনটি বেজে উঠবে কিংবা কেউ হয়তো মেসেজ দিবে। সচেতনভাবে না হলেও অবচেতন মন তাদের সব মনোযোগ এই ক্ষুদ্র ফোনটির কাছে কেন্দ্রীভূত করে। এধরণের চিন্তার কারণে এক ধরণের মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস’র এক খবরে জানা যায়, আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) এর গবেষকেরা দাবি করেছেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার অভ্যাসের সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্ক থাকতে পারে। নিজের চেহারা প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। অতিরিক্ত নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেওয়ার মানসিক সমস্যার নাম ‘সেলফিটিস’। ব্যাধিটির তিনটি স্তর হতে পারে। প্রথম স্তরটি ‘বর্ডার লাইন সেলফিটিস’। মানসিক সমস্যার এই পর্যায়ে দিনে তিনবার নিজের ছবি তুলে কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের সাইটে তা পোস্ট না করা। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘অ্যাকিউট সেলফিটিস’। এই পর্যায়ে দিনে অন্তত তিনটি নিজের সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তিনটি সেলফিই পোস্ট করা হয়। শেষ স্তরটি হচ্ছে ‘ক্রনিক সেলফিটিস’। এ পর্যায়ে নিজের সেলফি তোলা রোধ করা যায় না। দিনে অন্তত ৬বার সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের সাইটে পোস্ট করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বারবার নিজের ছবি তোলার প্রবণতা থাকে ক্রনিক সেলফিটিস পর্যায়ে। অতিরিক্ত সেলফি তোলার সঙ্গে নার্সিসিজম ও আসক্তিরও সম্পর্ক থাকতে পারে। বডি ডিসফরমিক ডিজঅর্ডারে ভুক্তভোগী দুই তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রেই সেলফির সম্পর্ক রয়েছে।
স্বাস্থ্যগত ও মানসিক ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যবহারে সতর্কতা গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হবে। এর বাইরেও অবশ্যই সেলফোনের সেট যাতে ভালমানের হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাটারিতে যাতে চার্জ ঠিকমতো থাকে এব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। অপ্রয়োজনে বা বেহুদা কাজে যাতে সন্তানরা সেলফোন ব্যবহার না করে সেজন্যে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। আর দরকার না হলে সেলফোন ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। আর সেলফোন ব্যবহারের ক্ষতির মাত্রা যাতে কমে যায় সেজন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়োপযুগী পদক্ষেপ নিতে হবে। সেলফোন কোম্পানীগুলোকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে ব্যবহারকারীদের মাঝে সচেতন বৃদ্ধি এবং ক্ষয়ক্ষতি যাতে কম হয় সেধরনের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। আর এমন সার্ভিস দিতে হবে যাতে বৃহত্তর পরিসরে নেতিবাচক কোন প্রভাব না পড়ে। মোবাইল খাতকে আরো এগিয়ে নিতে আলাদা আলাদা স্থানে ‘মোবাইল পার্ক’ স্থাপন করতে পারে সরকার। সরকার চাইলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই হ্যান্ডসেট উৎপাদন করে এই সেক্টরকে ১০০ ভাগ উৎপাদনমুখী করতে পারে। দেশে বৈধ ও অবৈধ সব ধরনের হ্যান্ডসেট আমদানিতে প্রতিবছর ৭ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে দেশের টাকা দেশেই থাকবে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হতে পারে, কর্মসংস্থানের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধাটাকে সারাদেশে আরো বেশি সম্প্রসারণ ও নিরাপদ করা যেতে পারে, অনিয়ন্ত্রিত সিম রিপ্লেসমেন্ট বন্ধ করা যেতে পারে। দেশে অবৈধ হ্যান্ডসেট আমদানির প্রবণতা কমাতে আমদানি শুল্ক কমানো যেতে পারে। কলচার্জ নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এমটব এর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও শক্তিশালী করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, সরকারি কোষাগার সমৃদ্ধ হবার পাশাপাশি মোবাইল খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৫ লক্ষের অধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, তাদের জীবন ও জীবিকার পরিবর্তন এসেছে। প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারের মধ্যে ৬০ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে সেলফোন অপারেটররা। দেশে মোবাইল সিমের সংখ্যা ১৩ কোটি ছাড়িয়েছে। আর ইন্টারনেট পরিষেবা নিচ্ছেন ৬ কোটি গ্রাহক। ফলে সেলফোন খাতের এই অবদানকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে সেলফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মকে কল্পনা বিলাসী, মাত্রাতিরিক্ত আবেগী ও বিবেক বর্জিত করে গড়ে না তোলে সেক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজন ছাড়াই প্রিয় সন্তানের হাতে দামি স্মার্টফোন দিয়ে তার স্বাস্থ্যগত-মানসিক-চারিত্রিক ক্ষতির সুযোগকে অবারিত করার ক্ষেত্রে যেমন অভিভাবকেদের সতর্ক হতে হবে। তেমনি সেলফোন অপারেটরদেরও শুধু অধিক মুনাফা অর্জনের লোভী মানসিকতা পরিহার করে অফার দেয়ার ক্ষেত্রে উঠতি বয়সীদের ক্যারিয়ার ও সুন্দর আগামীর নিশ্চয়তার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি সকল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও যথাযথ ভূমিকাই এই খাতের সম্ভাবনার বিকাশ ও সমস্যার বিনাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। মোবাইল কোম্পানিদের কর্পোরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি, নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও প্রতিভার বিকাশে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এবং সচেতন মহলের সমন্বিত প্রয়াসে কাঙ্ক্ষিত সচেতনতা বাড়বে এমনটাই প্রত্যাশা করি।
এমন গুরুত্বপূর্ণ লেখা পাওয়া সত্যি অনেক কষ্টকর। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। আরও উপকারী লেখা আমাদের উপহার দেবেন এটাই কামনা।