ভালো নেতা শুধু কাজের অর্ডার আর কিছু নির্দেশনা দেন না। কাজ করার আগ্রহ যোগান, দিক নির্দেশনা দেন এবং কাজটা যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ হচ্ছে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করেন। নেতৃত্ব মানে হচ্ছে আপনার কর্মী অথবা অন্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যদেরকে কাজের জন্য প্রভাবিত করা ও সঠিক নির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা, যাতে তারা কাজকে বোঝা না ভেবে আনন্দ সহকারে করে। নেতৃত্ব চর্চাই পারে একজনকে সকলের সামনে অন্যতমভাবে তুলে ধরতে। ভালো নেতাকে অনেক সময়েই এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা সকলের পছন্দ নাও হতে পারে। তাই বলে সিদ্ধান্তটি যতই কঠোর হোক না কেন অন্যের কথা ভেবে কখন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না, জটিল বিষয়েও সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে হবে।
একটি দলের মধ্যে কেউ না কেউ নেতৃত্বের হাল ধরেন, অন্যরা তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেন এবং তিনিই দল পরিচালনা করেন। নেতৃত্ব সব সময় প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি হয় না। অনুকূল পরিবেশ ও সমাজ থেকে প্রেরণা পেলে নেতৃত্বের সুপ্ত গুণাবলি প্রকাশ পায়। আমাদের সমাজ এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে নানা রকম ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়ায় সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশ অনেক বেশি প্রয়োজন। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক তৈরি হলে তারা ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও এগিয়ে আসবেন, ইভটিজিং-চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-দুর্নীতি-মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্ম প্রতিরোধে কাজ করবেন। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলতে পারেন না।
নেতৃত্ব বিকশিত হয় সংগঠনের মাধ্যমে। অনেকে জন্মগতভাবে আবার অনেকে সামাজিকভাবে নেতৃত্ব শিখে নেন। নেতারা জানেন কীভাবে আর দশজনকে অনুপ্রাণিত করবেন, অন্যদের প্রভাবিত করবেন, উৎসাহ দেওয়ার মন-মানসিকতা রাখবেন এবং সমাজের পরিবর্তন ও উন্নয়নে কাজ করবেন। যেমন যৌতুকের মতো সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে তরুণদের মোটিভেট করার জন্য কাজ করতে পারেন।নেতাকে বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে, ঘটনার প্রতি কৌতূহল ও যোগাযোগ দক্ষতা থাকতে হবে। নেতাকে চিন্তা করতে হবে, ঝুঁকি নিতে হবে, অনুসারীদের কাছ থেকে শিখতে হবে; যা তিনি সমাজের প্রয়োজনে প্রয়োগ করবেন।
নেতার আত্মসচেতনতা ও কথা বলার সময় সচেতন থাকা জরুরি। যোগ্য নেতা না জেনে কথা বলেন না, কথার সাথে কাজের মিল থাকে। জন্মগতভাবে পাওয়া নেতৃত্বের গুণাবলি ও যোগ্যতা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, এ গুণাবলি বিকশিত করে উৎকর্ষ সাধন করা এবং তা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রশিক্ষণ ও পড়ালেখার প্রয়োজন হয়। নেতৃত্ব মানে প্রভুত্ব নয়। নেতাকে জ্ঞানী হতে হবে, লক্ষ্য নির্ধারণে থাকতে হবে দৃঢ়তা ও আবেগ। জ্ঞানচর্চার জায়গাটি উন্মুক্ত রাখলে এবং পরমতসহিষ্ণুতা উপস্থিত থাকলে নেতৃত্ব সহজে বিকশিত হয়। নেতার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে।
তৃণমূল থেকে মেধাবী তরুণ ও যুবসমাজকে নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে, নবীন ও প্রবীণের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে, বাছাইকৃত প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বয়স্ক মানুষদের প্রশিক্ষণ দিলে সহজে জ্ঞান বিতরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলেও তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। বয়স্কদের তুলনায় কম বয়সীদের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণের ফলাফল ভালো হয়। ম্যানেজারগণ স্বল্প মেয়াদী ফলাফলের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে আর নেতারা দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলের উপর গুরুত্ব দেয়।
সমাজের বিভিন্ন অপকর্ম, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং, পারিবারিক সহিংসতা ও যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে তরুণসমাজকে সচেতন করতে হবে। আত্মকর্মসংস্থানের জন্যও কাজ করতে হবে। নবীন-প্রবীণের সমন্বয় ও সচেতনতা সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। নিজের ভেতর তাগিদ থাকতে হবে। নেতৃত্বের বিকাশে শিক্ষকেরা সুবিধাবাদী না হয়ে মর্যাদা ও শ্রদ্ধা বজায় রেখে সৎ ও নীতিবান থেকে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করতে পারেন। নেতৃত্বের বিকাশের জন্য তরুণদের সুশিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। অনেক বেশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা যত বাড়বে মননশীলতা তত বাড়বে। মননশীল তরুণ ভালো কাজ করবেন, তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে, পুরস্কার দিতে হবে, ভালো কাজে উৎসাহিত করতে হবে। সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝেন। কালোটাকার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন।
নেতৃত্ব বিকাশের অনুকূলময় দেখতে হবে। এক দেশে একাধিক শিক্ষাব্যবস্থা থাকা, তরুণদের সুপ্ত প্রতিভা ও চিন্তা বিকাশে নজর দিতে হবে। সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশ করতে হবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাড়াতে হবে, নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারী-পুরুষের বৈষম্য রাখা যাবে না। দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি যুবসমাজই অত্যন্ত কর্মক্ষম, সৃজনশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল। তাদের ‘ড্রাইভিং ফোর্সে’ নিয়ে আসলে দেশটি শুধু মধ্যম আয়ের দেশ হবে না, একই সঙ্গে জীবনমানের দিক থেকেও মধ্যম স্তরে পৌঁছে যাবে। দারিদ্র্য সম্পূর্ণ দূর করে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যম আয়ের দেশকে জীবনমানের দিক দিয়েও কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে যুবকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করে না দেখে দেশ ও জাতির উন্নয়ন কর্মসূচির সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে। ভালো কাজ, আইন ও বিধি মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।
প্রতিশ্রুতিশীল ও শিক্ষিত মানুষগুলো রাজনীতিতে এলে সমাজের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে, ভালো আইন কিংবা নীতিমালাকে মানুষের কাছে পৌঁছাবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও তৃণমূলের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন করলে নেতৃত্ব বিকাশের আরেকটি জায়গা সৃষ্টি হবে। নেতৃত্বের বিকাশটা সামাজিক বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে তা বংশগতভাবেও হতে পারে। তবে পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থান তৈরি করতে পারলে নেতৃত্বের বিকাশ হবে। দেশের যুবসমাজকে নেতৃত্ব বিকাশের পরিবেশ না দিলে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, অনেক ক্ষেত্রে স্থবিরতা আসবে।
নেতার নিজেকে আগে পরিবর্তন করতে হবে, পরিবারকে পরিবর্তন করতে হবে, আশপাশের সমাজ পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। সামাজিক নেতার মধ্যে অবশ্যই সততা থাকতে হবে, টিমওয়ার্ক থাকতে হবে। এককভাবে নেতৃত্বের কথা চিন্তা না করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কাজ করা, নেটওয়ার্ক তৈরি করা ও সমস্যা মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নকাজের স্বচ্ছতা আসবে, অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ হবে। এভাবে যুবসমাজের শক্তি ও প্রবীণদের মেধা কাজে লাগাতে পারলে, সুনেতৃত্বের অভাব দূর করতে পারলে, পরিবারে-সমাজে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব সৃষ্টি হলে অনেক বিশৃঙ্খল ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।