আনিসুর রহমান এরশাদ
অযুত সম্ভাবনা ও মেধাবী নাগরিক থাকার পরও দুঃখজনকভাবে সমসাময়িক বাংলাদেশে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্থিরতা, দুর্নীতি, অসততা এবং অসহিষ্ণুতা প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে। মানুষের সামগ্রিক দায়িত্বজ্ঞান, কর্তব্যনিষ্ঠা, সত্যপরায়ণতা আজ সমাজদেহ থেকে প্রায় বিতাড়িত। একটু শান্তির প্রত্যাশায়, একটু ভালো থাকার আশায় সাধারণ নাগরিকরা সৎ, দুর্নীতিমুক্ত ও দেশপ্রেমী নেতৃত্বের প্রত্যাশা করছে।
দেশের মানুষ চায় –তাঁরা খেয়ে-পরে মানুষের মতো বাঁচবে, নিশ্চিন্তে ঘুমুবে, ন্যায়বিচার ও ন্যায্য অধিকার পাবে, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রকৃত বন্ধু হবে। আর সচেতন নাগরিকরা তাদের মেধা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শক্তি সমাজের কোন শ্রেণির পক্ষে ব্যবহার না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহার করবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকেই সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাবে। কারণ একজন সুনাগরিকই দেশের বড় সম্পদ।
সামাজিক অনুমোদনের অভাব ও জনমানুষের অসম্মতি দেশ নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা কেড়ে নেয়। আইনের বৈধতাই সব নয়; লেখকের লেখনীর বৈধতা আসে প্রত্যেক পাঠকের কাছ থেকে, অভিনেতার অভিনয়ের বৈধতা আসে দর্শকের কাছ থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন অন্যত্র চলে না যাচ্ছেন, ততক্ষণ তিনি চলমান-বিদ্যমান অবস্থাকে বৈধতা দিচ্ছেন বা মেনে নিচ্ছেন। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নৈতিক অবস্থান বেশি দুর্বল হয় তখনি, যখন এর ভেতরের-সংশ্লিষ্টরা কোনো অন্যায়-ত্রুটিকে সামনে এনে প্রতিবাদ করে। জনগণের অধিকার সংরক্ষণ এবং কল্যাণ নিশ্চিতকরণে সম্ভব হবে তখন, যখন রাষ্ট্র শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিশোষণ লালন -পালন-ধারণ করবে না, শুধু ‘এলিট সোসাইটি’র স্বার্থরক্ষা করবে না। বস্তুগত স্বার্থের ধারক হিসেবে ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত উদ্যোগ পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করলেও তৃণমুল মানুষের প্রকৃত মঙ্গল হবে না।
মনে রাখতে হবে- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুসংহত না থাকলে, দুস্থ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজের সুযোগ না থাকলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব থাকে না এবং সম্প্রীতির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে না। নগরে অভিবাসন হওয়া শিশু ও গরিব শিশুদের সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ দরকার। নারী অধিকার, শিশু অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে শুধু আলোচনা নয়, পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে; কারণ সহিংসতা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বস্তিতে থাকুক অথবা প্রাসাদে থাকুক, ক্ষমতাসীন থাকুক কিংবা বিরোধী দলে থাকুক; অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বাইরে তাদের সামাজিক অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে।
দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যও কাজ করতে হবে। দেশে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে যারা জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ। দেশের শতকরা ৩৫ ভাগ মানুষ নিরক্ষর। দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু স্কুলে যায় না। এছাড়া প্রতিবন্ধী শিশুরা মাত্র ৪ ভাগ শিক্ষার্জনের সুযোগ পাচ্ছে। তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ সাধারণ মানের পয়োসুবিধা থেকে বঞ্চিত, শিশুরা পুষ্টিহীনতায় এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, আমাদের বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে। জঙ্গি তৎপরতা ও দুর্নীতি বাড়ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও দেশী সংস্কৃতির বিকাশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারাচ্ছে জাতির হাজার বছরের পুরানো ঐতিহ্য। দেশে লক্ষাধিক কুটির শিল্প রয়েছে, আধুনিক নগরায়নের দরণ ওসব ধবংসের পথে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম উপাদানগুলো না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে। এসব বঞ্চনা আর ক্ষোভ থেকে সামাজিক আন্দোলনের জমি তৈরি হতে পারে ।
এটাই সত্য যে- নিজের সংগঠনের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকলে, নিয়মনীতি ভঙ্গের ঘটনা ঘটলে, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠলে, শোষণমূলক-বৈষম্যমূলক-বঞ্চনামূলক কাজ করলে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে; জোর গলায় অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ- প্রতিরোধ করা যায় না। আর নারী রমণীয় কমণীয় হয়ে কড়া মেকাপের প্রলেপ মেখে ফ্রন্টদেস্কে বসে থাকলে, কাস্টমার কেয়ার, রিসিপ্সনিস্ট, কন্সালট্যান্সি করলে; তাতেই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গড়তে হলে দেশের মানুষের মাঝে ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে। কবি নজরুলের ভাষায়, ‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়েছে হিন্দু, মুসলিম-খ্রিশ্চান।’ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে একযোগ দেশের স্বার্থে, মাটি-মানুষের কল্যাণে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। শুধু ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকলে হবে না।
১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় কার্ল মার্ক্স ‘একজন তরুণ পেশা নির্বাচন করবে কীভাবে’ শীর্ষক একটি রচনায় লিখেছিলেন- ‘পেশা নির্বাচনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত তা হলো, কী করে মানুষের কল্যাণ করা যায় এবং তার নিজেরও বিকাশ ঘটে পরিপূর্ণতার দিকে। শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে, সে হয়তো ব্যক্তিগত খ্যাতি অর্জন করতে পারে, একজন পণ্ডিত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে, হতে পারে একজন চমত্কার কবি। কিন্তু কখনোই সে একজন মহত্ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সাধারণের কল্যাণের জন্য যাঁর প্রাণ নিবেদিত, তিনিই মহাত্মা।’ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতেও পরের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণদের স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা খুব বেশি প্রয়োজন।
কাজ-পরিশ্রম-সাধনায় লজ্জা ভুলে যেতে হবে। কবি কামিনী রায় বলেছিলেন, ‘করিতে পারি না কাজ / সদা ভয় সদা লাজ / সংশয়ে সংকল্প সদা টলে / পাছে লোকে কিছু বলে।’ নেতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন মানুষগুলোর কথায় কান না দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর মানসিকতা থাকতে হবে। সুনাগরিকই সুশাসন আশা করতে পারে। মহৎ কাজ করতে দরকার সুচিন্তা ও নেতিবাচক মানসিকতা পরিহার। সৎ ও সচেতন নাগরিকের সংখ্যা যত বাড়বে দেশ ততই এগিয়ে যাবে, উন্নত-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।