পারিবারিক বন্ধনের প্রভাব দারুণ কর্মব্যস্ততায় কিংবা নিবিড় অবসর মুহূর্তে প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করে। FAMILY শব্দে ৬টি বর্ণ আছে। Forgiveness (ক্ষমাশীলতা), Acknowledgement (স্বীকার), (প্রণোদনা), Inspiration (প্রেরণা), Love (ভালোবাসা) within Yourself. যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এই ছয়টি গুণ থাকে সে পরিবার হয় আদর্শ পরিবার।
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সম্পর্ক যদি চমৎকার আন্তরিক হয় তাহলে পরিবারই হবে সুন্দর জীবনের অনুপ্রেরণা, হয় সুখ ও শান্তিময় মানবীয় আবাস এবং নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র। পারস্পরিক দয়া-করুণা-সহানুভূতি, দায়িত্বশীলতা, আন্তরিক সহযোগিতা, অন্তরের স্বতঃস্ফুর্ত দরদ ও প্রণয়-প্রীতি, অপরিসীম স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধনে পরিবার হয় সুখ-শান্তি ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতির অনাবিল উৎস।
পরিবার প্রথার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এমনকি পারিবারিক পবিত্র বন্ধনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা সার্থক ও অর্থবহ জীবনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পারিবারিক বন্ধন ছিল আমাদের গর্ব। অথচ কালের পরিক্রমায় এই বন্ধন আজ হুমকির সম্মুখীন। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে পরিবারের আদর্শ-মূল্যবোধ; ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে পরিবারিক-বন্ধন। যান্ত্রিক জীবনে অস্থিরতা ও হতাশা বাড়ায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং খুন-খারাবির মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। অথচ পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখা আমাদের শুধু আজকের নয়, সব সময়ের প্রয়োজন; যা আমাদের মাঝে স্থিতিশীলতার বোধ এবং আধ্যাত্মিক প্রশান্তি এনে দেয়। তাই মায়া-মমতা, অনুশাসন আর নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক ব্যস্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে পুরনো সেই পারিবারিক বন্ধন। কেননা পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ়করণেই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত।
অথচ প্রযুক্তিনির্ভর এ সমাজ ব্যবস্থায় দিনদিন বাড়ছে নবীন ও প্রবীণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক দূরত্ব, মানুষে মানুষে ভালোবাসা কমছে এবং মানব মনের কোমল দিক সম্পর্কে যে আস্থা ছিল তা ভেঙ্গে যাচ্ছে। নড়বড়ে পরিবার, বিয়ে বহির্ভূত শিশুদের জন্ম, বয়স্ক পিতামাতার সেবাযত্মহীন জীবনযাপন এখন নির্মম বাস্তবতা। মানুষে মানুষে সন্দেহ, হিংসা, ঘৃণা, লোভ, ক্রোধ আর অবিশ্বাস বেড়ে চলছে। প্রতারণা ও ছলচাতুরি করে অন্যকে ঠকিয়ে হলেও নিজে এগিয়ে যাওয়া বা বিজয়ী হওয়ার মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। সন্তান নেয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিটি পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ও জীবনচর্চা ভিন্ন ধরনের হচ্ছে। যদিও পরিবারগুলি এখনও সমাজের মজবুত কোষ ও বাচ্চাদের বড় করার একমাত্র মজবুত আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে চলছে। তারপরও এখনই পরিবার সম্পর্কিত সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে না পারলে দ্রুতই পারিবারিক বন্ধন ঢিলেঢালা হয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।
পরিবারের মাঝেই একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশ ঘটানো সম্ভব এবং এটাই একমাত্র উপায় যেখানে শিক্ষার সুষ্ঠু ধারাকে অব্যাহত রেখে একটি শিশুকে একজন পরিপূর্ণ নাগরিকে রূপদান করা যায়। সুস্থধারার বিনোদন এবং রুচিবোধকে প্রভাবিত করে পরিবার সম্পর্কিত এমন গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনচিত্র প্রভৃতির চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমরা যদি পারিবারিক বন্ধন হারিয়ে ফেলি তাহলে আমাদের মানবিক বোধেরা নিজেদের বিকলাঙ্গ ঘোষণা করে চলে যাবে মহাকালের অতল গহ্বরে। যেখান থেকে আর কোনো দিন ফেরার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হওয়াই হবে সময়ের অপরিহার্য দাবি।
পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হলে ও দেশি সংস্কৃতির চর্চা বাড়ালে আগামী প্রজন্মকে জঙ্গিবাদের কালো থাবা থেকে বাঁচানো যাবে। সন্তানকে দেশপ্রেম ও মানবতার শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হবে। সাধারণত মা-বাবার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকলে সন্তান বিপথগামী হয় না। তাই ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বড়রা যাই করে, শিশুরা তা অনুকরণ করে। মা-বাবার মধ্যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ক্ষমাশীলতা, সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা না থাকলে শিশুদের মধ্যে তা গড়ে ওঠে না। এজন্য সন্তানকে সময় দিতে হবে, উদারতা শিখাতে হবে। সকল ধর্মের, সকল শ্রেণির মানুষকে সম্মান করতে জানতে শিখাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনে সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরিবারের ভালোবাসা, যত্ন ও পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্ব অপরাধপ্রবণতা রোধে কাজে আসবে। পিতা-মাতাকে সন্তানের মন খারাপ বা হতাশার কারণগুলো বুঝতে শেখা দরকার।
সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটার ফলে পারিবারিক বলয়ে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গণমাধ্যমে ‘২ শিশুকে হত্যার পর আত্মঘাতী মা’ ও ‘মায়ের ওপর অভিমানে ঢাবি ছাত্রীর আত্মহনন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে পিতা-মাতা সন্তানের হাতে, সন্তান পিতা-মাতার হাতে, স্বামী স্ত্রী কর্তৃক, স্ত্রী স্বামীর দ্বারা খুন হচ্ছে পৈশাচিকভাবে। পারিবারিক হত্যাকান্ডের পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, মানসিক বিষণ্নতা, আর্থিক দৈন্য, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পারিবারিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পারিবারিক বন্ধন পারে কিশোর অপরাধ কমাতে। তাই পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করা এবং সঠিক যত্ন-পরিচর্যাই হোক আমাদের সুখ-শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। আসুন পরিবারকে সময় দেই এবং যথাযথ পরিচর্যা করি।