গবেষণা করার জন্য অর্থের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন গবেষণার মানসিকতা। গবেষণাকে সংস্কৃতির সমৃদ্ধ অংশ হিসেবে বিবেচনা করলেই কেবল এই মানসিকতা গড়ে তোলা সম্ভব। সৃষ্টিশীল ও উদ্ভাবনমুখী পরিবেশ গবেষণার মনোভাব বা উদ্ভাবন মনস্কতা গড়ে তোলতে সহায়ক। গবেষণাকে জীবনের এমন অবিচ্ছেদ অংশে পরিণত করতে হবে, যা সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। গবেষণার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা যেখানে যত কঠিন, উদ্ভাবনে এগোনোও সেখানে তত কঠিন।
সামাজিক গবেষণা
সামাজিক গবেষণা মূলত সমাজকে নিয়ে, সামাজিক সমস্যা নিয়ে ও সামাজিক সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করা। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়- মানুষের আচরণগত পরিবর্তন, পলিসি পরিবর্তনের প্রভাব, উন্নয়ন পদক্ষেপের ফলাফল, বিশেষ কোনো জনপদের জীবন, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জীবিকা, সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থার সুফল, কোনো পদ্ধতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, পিছিয়ে পড়াদের চাহিদা, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, কোন প্রতিবন্ধকতার সমাধান বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রগতি মূল্যায়ন ইত্যাদি।
সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব
সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হয়- টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনে, সমাজ-ব্যক্তিজীবন-জীবিকার সমস্যাগুলোর সমাধানে, সমৃদ্ধির জন্য, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের জন্য, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, গুণগত শিক্ষার জন্য এবং আগামীর অনিশ্চয়তা থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য। স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিল্পসহ টেকসই সমৃদ্ধি অর্জন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাকে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা বাড়াতে হবে।
সামাজিক গবেষণার পরিসর
সামাজিক গবেষণা হতে পারে- কী করলে আরো অগ্রগতি সম্ভব, সবাইকে কীভাবে আরো বেশি সম্পৃক্ত করা যায়, সম্ভাবনাকে আরো বেশি কীভাবে কাজে লাগানো যায়, মানসিক দূরত্ব কীভাবে কমানো যায়, প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে আরো বেশি কার্যকর করা যায়, সংগঠনকে আরো বেশি কীভাবে গণমুখী করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে। বিদেশিরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করলেও তা বাংলাদেশকেন্দ্রিক না হওয়ায় আমাদের নিজস্ব গবেষণা খুব দরকার।
সামাজিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা
আমাদের দেশে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যে কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিদেশে একই কারণ হবে না। দেশ ভেদে, সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে সমস্যার গতি-প্রকৃতি ও ধরন আলাদা। ফলে এদেশের বিভিন্ন সমস্যা বিদেশের গবেষণার আলোকে সমাধান করা যাবে না। এদেশে বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধি, হতাশা বৃদ্ধি, একাকিত্ব বৃদ্ধি বা আত্মহত্যা বৃদ্ধিকে অন্যদের সাথে মিলালে হবে না। আমাদের সামাজিক বা উন্নয়ন সমস্যার গবেষণা আমাদেরই করতে হবে।
মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো সামাজিক গবেষণা দরকার। দক্ষ সমাজ গবেষক দরকার- দেশকে পরিবর্তন করতে, সমাজকে পরিবর্তন করতে, সংগঠনকে পরিবর্তন করতে, প্রতিষ্ঠানকে পরিবর্তন করতে। সমাজ গবেষণাকে উপেক্ষা করলে, সামাজিক গবেষণার সমস্যা সমাধান না করলে, সীমাবদ্ধতাগুলো দূর না করলে- ভালো গবেষণা হবে না।
সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান
সামাজিক গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। সমাজ গবেষকদের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলতে হবে। সমাজ গবেষক তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা নিতে হবে। সমাজ গবেষণার জন্য নিয়মিত বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সমাজ গবেষণার অগ্রাধিকার সেক্টর ঠিক করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে হবে। না হলে সমাজ গবেষণা যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে পারত, সেটি সম্ভব হবে না।
গবেষণায় সাফল্য ও ব্যর্থতা
গবেষণায় সাফল্য না পাওয়ার পেছনের কারণ- গবেষক লক্ষ্য স্থির করতে না পারা, গবেষণার বিষয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন না করা, রাতারাতি অর্জন চেয়ে অধৈর্য হয়ে সাধনা বন্ধ করা, আন্তর্জাতিক বা বিশ্বমানে পৌঁছানোর লক্ষ্য না রাখা। বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার সম্ভাবনা অনেক, বিষয়বস্তু ভালোভাবে জানাদের চাহিদাও আছে, বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারের ব্যবহার জানলে সুবিধাও বেশি। এখানে যে গবেষণাই করা হবে তা যদি যথার্থ হয় তবে সবার নজরে আসবে।
যত বেশি গবেষক থাকবে, গবেষকদের ওপর আস্থাও তত বেশি বাড়বে। গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে; কারণ গবেষণায় রাতারাতি ফলাফল আসে না। গবেষণায় নিয়মনিষ্ঠ হতে হয়, ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকতে হয় এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। গবেষণায় কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নেই আর গবেষণার কোনো বিকল্পও নেই। তবে দুঃখজনকভাবে সত্য যে, বাংলাদেশে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা এখনো সরকারের পূর্ণ অগ্রাধিকার পায়নি। যার ফলে একটি উন্নত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ আমরা দেখতেও পারিনি।
বিশেষায়িত জ্ঞান বা দক্ষতার ব্যবহার
যেকোনো প্রতিষ্ঠানে বা সংগঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষ। অথচ মানুষকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করতে কম উদ্যোক্তাই নজর দেন। জনশক্তিকে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনে করে সঠিকভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও পারদর্শিতার পরিচয় দেন কম সংগঠকই।
একেকজনের মেধা, দক্ষতা, আগ্রহ ও বিশেষ পারদর্শিতার ভিন্নতা বিবেচনা করে সঠিকভাবে তাদের পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী ও চৌকস নেতৃত্বের। মানব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার মানে সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের যোগ্যতার যথাযথ-সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
মানুষের কর্মক্ষমতা বা ভেতরের শক্তির বহিপ্রকাশ ঘটাতে হলে তার দক্ষতা প্রয়োগে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো সর্বোত্তমভাবে দিতে হয়। যেমন একজন আইটি বিশেষজ্ঞ কর্মক্ষেত্রে যদি কাজের উপযোগী কম্পিউটারই না পান কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত একজন যোদ্ধাও যদি লড়াইয়ের জন্য অস্ত্র না পান- তাহলে তিনি তার বিশেষায়িত জ্ঞান বা দক্ষতার ব্যবহার করবেন কিভাবে!
উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান
একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়ার পরে দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি আন্তরিকতা সত্ত্বেও চাহিদার আলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা-সহায়তা-উপকরণাদি না পেলে তিনি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে পারেন। গবেষক গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন, শেখার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেন, সমস্যা বোঝে তা সমাধান করেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে অজ্ঞতা দূর করেন, জ্ঞানের আধুনিকায়ন ঘটান, উদ্ভাবন করেন। তবে গবেষক যদি গবেষণার জন্য ফান্ডই না পান, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি-সরঞ্জামাদি না পান- তাহলে গবেষণা কাজ এগোবে কিভাবে?
গবেষণার প্রাণশক্তি গবেষক
সাধারণত গবেষকরা কঠিন বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ফলে তাদের মস্তিস্ক বেশি পরিমাণে শক্তি ও শরীর থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। গবেষকদের অবচেতন মন কখনো ঘুমায় না; অবচেতন মনেও তারা স্বপ্ন দেখে গভীরভাবে করা চিন্তা-ভাবনার বিষয় নিয়ে। গবেষকদের মস্তিষ্কের নিউরন চলাচলের গতি-স্পীড সাধারণদের চেয়ে গবেষকদের বেশি। গবেষকরা যেহেতু নতুন নতুন তথ্য ঘাটাঘাটি করেন তাই তাদের মস্তিষ্কের নিউরনও বৃদ্ধি পায়।
গবেষণার প্রাণশক্তি গবেষক। কারণ তার সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ওপর গবেষণার সফলতা নির্ভর করে। সমস্যায় প্রশ্নগুলো উত্থাপন করতে হয়। সমাধান অনুসন্ধান করতে হয়। প্রশ্নের বিষয়বস্তু, কাঠামো ও ধরণ ঠিক করতে হয়। প্রশ্নের শব্দবিন্যাস, অনুক্রম ও আঙ্গিক সাজাতে হয়। সাক্ষাৎকার নিতে হয়। উত্তরদাতা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর জন্য নির্দেশাবলী দিতে হয়।
গবেষকের বৈশিষ্ট্য ও কাজ
গবেষকের থাকতে হয়- অনুসন্ধানী মনোভাব, পক্ষপাতিত্ব থেকে দূরে থাকার সামর্থ্য, পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের দক্ষতা ও খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা থাকতে হয়। গবেষণা পরিকল্পনা তৈরি করা, পরিকল্পনামাফিক কাজ করা, গবেষণা সম্পর্কিত নৈতিকতা বজায় রাখা ও যোগাযোগের দক্ষতা থাকা খুব জরুরি। গবেষকের সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতা ও মানসিক চাপ সামলানোর দক্ষতা থাকতে হয়।
গবেষককে নিয়মিত নতুন বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে যত বেশি সম্ভব জানার চেষ্টা করতে হয়। বাড়াতে হয় জ্ঞান ও চিন্তার পরিধি। অন্য গবেষকদের কাজ নিয়েও ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। নতুন কিছু শেখার আগ্রহ ও সে আগ্রহকে ঠিকভাবে পরিচালনা করার দক্ষতা দরকার হয়।
গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন
গবেষণার অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালানোর দক্ষতাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য- পরিমাণ নির্ধারণ করা, অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি চিহ্নিত করা, সম্ভাব্য অর্থ প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা এবং অর্থায়নের সাথে জড়িত শর্তের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া দরকার।
সামর্থ্যে এগিয়ে থাকতে গবেষণা
বর্তমান বিশ্ব অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক ও দ্রুত ধাবমান। আধুনিক-যুগোপযুগী থাকার ও রাখার উপযোগী পদ্ধতি এই সময়ে সামর্থ্যে এগিয়ে থাকতেই জরুরি। লক্ষ্য অর্জনকে সহজসাধ্য করতে, দুর্বলতা দূরীকরণে যথাযথভাবে অর্থ-মেধা-শ্রম-সময় ব্যয় নিশ্চিত করতে এবং প্রশিক্ষণ ও পদ্ধতিগত উন্নয়নে চিন্তা-গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ কর্মসূচি, কার্যকারি মান, চাহিদার উপযোগিতা ও উন্নীত লক্ষ্য অর্জনে গবেষণায় গুরুত্ব আরোপ দরকার।
পরিবর্তন পরিবর্ধন সংস্কারে গবেষণা
ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংস্কারের প্রয়োজনে, পরিবর্তিত সমাজ ও মানুষের মনন বিশ্লেষণ করে সঠিক পদ্ধতি ও কলা-কৌশল নির্ধারণে এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা প্রণয়নে সুনির্দিষ্ট গবেষণালব্দ তথ্য ও উপাত্ত দরকার। সময়ের দাবি অনুযায়ী ফলপ্রসূ উপস্থাপনার গাইডলাইন বা রূপরেখার প্রভাব সাধারণত ইতিবাচকই হয়।
সমস্যার সমাধানে গবেষণা
বাস্তবিক নানাবিধ সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তার সমাধানে করণীয় ঠিক করা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তবে দক্ষ মানব সম্পদ গঠন করে জনসম্পদকে কাজে লাগায়ে সর্বোচ্চ সুফল আনতে এবং শক্তিতে পরিণত করতে পারলে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা দারুণ ফল দেবে। সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ ও পদক্ষেপ খতিয়ে দেখতে এবং কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য চিন্তার চাষ করতে পারলে, তা সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে ও দক্ষ মানব সম্পদ গঠনে কাজ করবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাজ কী?
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাজ- ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া, মডেল দেয়া। গবেষণা অবশ্যই নিয়মানুযায়ী হতে হয়, কম্প্রিহেনসিভ হতে হয়, সুনির্দিষ্ট হতে হয়, ক্ষুদ্র এরিয়া ঠিক করে গভীরে যেতে হয়। মৌলিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে গবেষণার শাখা-প্রশাখার সন্ধান মিলে। এমন গবেষণা করা দরকার যা পরবর্তীতে রসদ হিসেবে ব্যবহারের উপযোগিতা থাকবে, কার্যকর করার উপায় থাকবে, অর্থপূর্ণ করার নির্দেশনা থাকবে।
জ্ঞানের ব্যাপারে বিদেশমুখী প্রবণতা
আমরা জ্ঞানের ব্যাপারে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করছি এবং নিজেদের সমর্পণ করছি। নিজেদের গবেষকদের দাম দিচ্ছি না। অথচ জ্ঞানের বিষয়ে নিজেদের গবেষকদের প্রমোট করার মাধ্যমে এই বিদেশমুখী প্রবণতার নতজানু মানসিকতা পরিবর্তন করা আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের স্বার্থেই অপরিহার্য। নিম্নমানের গবেষণা ঠেকানো যাচ্ছে না। মাতৃভাষায় পিএইচডি করা এবং ভালো গবেষণাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করা বাড়ছে না। এমন বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে যা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটানো যাচ্ছে না। বৈশ্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আত্মবিশ্বাস ও সামর্থ্য বৃদ্ধি না পাওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতাকেই তীব্র করে ।
জীবনে নতুনমাত্রা যোগ করতে গবেষণা
গবেষণা ও প্রকাশনাকে গুরুত্ব দিয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ ও মনোযোগী করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। গবেষণা কাজ পরিচালনা করা, গবেষণা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা, মানসম্মত আর্টিকেল প্রকাশ করা, মানসম্মত গবেষণার জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার অভাব, প্রকাশনা-গবেষণা মেলা অপ্রতুল। এদেশে প্রতিভাবান ও মেধাবীদের শিক্ষা ও গবেষণায় কাজে লাগানো হয় না। অথচ মর্যাদাশীল জাতি গঠনের জন্য সৃজনশীল প্রজন্ম বিনির্মাণে অভিজ্ঞ প্রবীণ ও সদা আন্দোলিত তারুণ্যের এক মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। গবেষণার উদ্দেশ্যতো মানুষের জীবনে গবেষণা যাতে কোনো নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
অগ্রযাত্রা ও সম্ভাবনা বিকাশে গবেষণা
অগ্রযাত্রায় গবেষণা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। গবেষণা কার্যক্রমে বিদ্যমান অনগ্রসরতা উত্তোরণের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। নিজেদের সৃজনশীলতা লালনের মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসের অভাব তীব্র। স্বাভাবিক চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির লালন না করায় এবং সম্ভাবনা বিকাশ সীমাবদ্ধ থাকায় কাঙ্খিত ফল লাভ সম্ভব হচ্ছে না। গবেষণাও যে সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হতে পারে বা মননে গবেষণা কর্মকে গ্রথিত করা যেতে পারে- এই চিন্তাই যেন অনুপস্থিত।
গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন
মেধা ও চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে জ্ঞান সৃজন করা, গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন নিজেদের সমস্যার সমাধান করে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়ক। জ্ঞান সৃষ্টিতে যেমন গবেষণার কোনো বিকল্প নেই তেমনি এই জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে পৌছে দিতে জ্ঞানভিত্তিক সংগঠন ও জ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন উদ্যোগেরও কোনো বিকল্প নেই। গবেষণার গুরুত্ব বোঝে গবেষণায় ব্যাপক মনোযোগ দিবে এমন বুদ্ধিমান নীতি নির্ধারকের সংখ্যা অধিকাংশ সেক্টরেই কম।
সামাজিক গবেষণার চ্যালেঞ্জ
সামাজিক গবেষণার মনোযোগী প্রকৃত গবেষকের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। যেসব বিষয়ে গবেষণায় বিপুল অর্থ ব্যায় প্রয়োজন, এমন গবেষণার বাজেটও হয় খুব কম। সঠিক পর্যবেক্ষণের ও ফান্ডিংয়ের অভাবে অনেক গবেষণাই মুখ থুবড়ে পড়ে। রিসার্চে প্রণোদনা চালু করে তা অব্যাহত না রেখে বন্ধ করে দিলে, পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকলে, ফান্ডিং-জনিত সমস্যা তীব্র হলে- যিনি বা যারা গবেষণা করবেন, তিনি বা তাদের রিজিকের জন্য অন্যত্র কাজ করতে হয়।
গবেষণা খাতে যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া উচিত সে পরিমাণ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। গবেষণা কাজে প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক লাভ কম। প্রত্যক্ষ লাভ না থাকায় গবেষণা কাজের সহায়তায় সাধারণত অনেক মানুষই এগিয়ে আসে না। বাস্তবতা হচ্ছে- মানবতার কল্যাণে আসে এমন সকল বিষয়ে গবেষণা করায় প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সাপোর্ট বা অনুদান পাওয়া যায় না। ফলে ক্ষুধার তাড়নায় গবেষণা কাজ বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণা বিষয়ক কিছু ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে ফি দিতে হয়। বাংলাদেশে গবেষণা করে যথেষ্ট মূল্যায়ন না হওয়ার সমস্যা রয়েছে। গবেষণা করার পরে মোটা অংকের সম্মানী না পেয়ে অনেক গবেষকই গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
বিদেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ও ভালো জার্নালের পাবলিকেশন থাকার পরও এদেশে কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারভিউ কল না পাওয়ার ঘটনা অনেক। যারা পরে দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে ঠিকই যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন; তাদের গবেষণার সুবিধা সেই দেশ পায়, বাংলাদেশ পায় না। গবেষণার ক্ষেত্রে অন্ধ রাজনীতি যুক্ত হওয়া যে ঠিক নয়; সেটা যাদের বোঝা দরকার তাদেরই অনেকে বোঝেন না। তাছাড়া গবেষণায় ভালো কিছু হুট করে হয় না, ভালো হতে সময় দিতে হয়, মানসম্মত হতে সময় লাগে। পৃষ্ঠপোষকতা লাগে। না হলে কাজের ধারাবাহিকতা রাখা যায় না। এই বাস্তবতাটা অনেকেই বিবেচনা করেন না।
গবেষণার চেয়ে ডিগ্রিতে আগ্রহ
পড়াশুনা, গবেষণা কাজ, চিন্তা-ভাবনার বিষয়গুলো লিখা, সময়োপযুগী লেখালেখির অভ্যাস তৈরী করা দরকার। অথচ বাংলাদেশে গবেষণার চেয়ে ডিগ্রিতে আগ্রহ বেশি। অপ্রয়োজনীয়ভাবে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার অদ্ভূত প্রবণতা বাংলাদেশ ছাড়া বোধহয় অন্য কোথাও নেই। গবেষক, বিজ্ঞানী ও একাডেমিকরাতো ডিগ্রিটি প্রয়োজনেই নেয়, নেয়া জরুরিও! কিন্তু কাজে সহায়তা করে না এমন অনেকেরও এই ডিগ্রিপ্রীতি রয়েছে! এজন্য কেউ কেউ থিসিস চুরি করে, বিশ্লেষণ ধার করে, চিন্তাকে শানিত না করেই ডিগ্রিটি নেন! যারা জ্ঞানচর্চার বৈশ্বিক মানদণ্ড মানেন না; তাদের কারণেই- তলানিতে ঠেকেছে পিএইচডি গবেষণার মান, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে ডিগ্রি প্রদানের পদ্ধতি!
বাস্তবক্ষেত্রে কাজে লাগছে না গবেষণা
এদেশের অনেক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কোনো সমাধান করেছে না, সম্পূর্ণ নতুন কোনো বিশ্লেষণ দিচ্ছে না; তা কোনো কাজে লাগছে না বা সমাজ-দেশ-জাতি উপকৃত হচ্ছে না। সময়োপযুগী নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার হচ্ছে না, চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনীয় নতুন কিছুর উদ্ভাবন হচ্ছে না। গবেষকরা ইন্ডাস্ট্রিসহ অনেক খাতেরই সমস্যার সমাধান একাডেমিক এরিয়া থেকে দিতে পারছেন না!
অতি নিম্নমানের আবর্জনা উৎপাদন করে কঠিন ডিগ্রি সহজে নিয়ে ডিগ্রিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে! দেশকে কিছু দিতে হলে পিএইচডির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়ে দেশে ফিরে বাংলা ভাষাতেও লেখা দরকার; কারণ দেশের বেশিরভাগ পাঠক ইংরেজিতে প্রবন্ধ পড়ে না! ডিগ্রি দিয়ে কনট্রিবিউট করতে পারেন না বা বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেন না!
পাবলিকেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ গবেষণা
এদেশে যতটুকু গবেষণা হয় তার সিংহভাগই হয়ে থাকে বিজ্ঞান খাতে। বিজ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবসায়, মানবিক এবং সমাজবিজ্ঞানে গবেষণার সুযোগ খুবই কম। বাজার গবেষণাও প্রয়োজনের চেয়ে কম। এখনো আছে নানান প্রথা, কুসংস্কার আর ট্যাবুর চর্চা; যেসব প্রমাণ করে যে সমাজ ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা কতটা জরুরি। এসব বিষয়ে যত বেশি গবেষণা হবে তা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক পরিবেশের উপর তত বেশি অবদান রাখবে। দেশের গবেষণাগুলো পাবলিকেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়; গবেষণাগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য করতে হবে।
গবেষণা পরিবেশের অভাব
বাংলাদেশে ব্যবসায়, মানবিক এবং সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে গবেষণার পথে অন্তরায় হলো উপযুক্ত গবেষণা পরিবেশের অভাব। অনেকেই জানে না কীভাবে গবেষণা করতে হয় বা কোন পর্যায় থেকে এটি শুরু করতে হয়। গবেষণার প্রতি এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বেখেয়ালী ও উদাসিন!
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদেশে গবেষণা বলতে বুঝায় পাবলিকেশন, গার্মেন্টস এর টি শার্ট প্রডাকশন এর মতন। কে কত পাবলিশ করতে পারে। গার্মেন্টস এর টি শার্ট তো তাও কিছু কাজে আসে, বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনার মতন অকাজের তো কিছু না। কাট, কপি, পেস্ট করে মানহীন থিসিস লিখে ডক্টরেট ডিগ্রি পাচ্ছেন! দেশে গবেষণাকর্মের সংখ্যা খারাপ না হলেও অধিকাংশই হয় পদোন্নতির জন্য অন্যথায় ফরমায়েশি।
গবেষণার সীমানা
গবেষণার কোনো সীমানা নেই। সকলক্ষেত্রে গবেষণা সম্ভব। গবেষণা- বাংলায় হলে সমৃদ্ধ হবে সাহিত্য, ইতিহাসে হলে সমৃদ্ধ হবে দেশের ইতিহাস, বাণিজ্যে হলে সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি, বিজ্ঞানে হলে উন্মোচিত হবে নতুন নতুন দিক আর কৃষিতে হলে কৃষি জমি কমলেও খাদ্যের অভাব হবে না। গবেষকের কাজ হয় জনহিতকর কাজ ও জ্ঞানের কাজ যা মানুষের উপকারে আসে। আর জনকল্যাণমূলক ও জ্ঞানমূলক কাজ সদাকা জারিয়ার মর্যাদা পায়।
গবেষণামুখী হবার জন্য অর্থ
গবেষণার জন্য বা গবেষণামুখী হবার জন্য অর্থ লাগে, পর্যাপ্ত ফান্ড লাগে; যা এককভাবে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। লিমিটেশন আছে, লিমিটেশন থাকবে; এরমধ্যেও গবেষককে কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার মতো পরিবেশ দিতে হয়। কারণ গবেষককে বন্ধের দিনেও গবেষণার কাজে লেগে থাকতে হয়। কল্যাণমূলক কাজের পথনির্দেশক হিসেবে পথনির্দেশনা দিতে হয়। অনেকে রাত অবধি কাজ করতে হয়। এগিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা লাগে!
আলোকিত মানুষ ও আলোয় উদ্ভাসিত সমাজ
চিন্তা-গবেষণায় আগ্রহীরা ও গবেষকরা আলোকিত মানুষ। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত সমাজ এবং আলোকিত মানুষ তৈরির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে গবেষকের দরকার আছে, গবেষণার প্রয়োজন আছে। এজন্য চাই জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন, জ্ঞানভিত্তিক সংগঠন, জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
গবেষণা একটি উত্তম কাজ
গবেষণা কাজ একটি উত্তম কাজ। প্রত্যেক ভালো কাজে সহায়তা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। গবেষণা কাজে সহায়তা দান ও সহায়কের মর্যাদা অপরিসীম। গবেষণা কাজে সহায়তা করা এমন একটি ভালো কাজ, কেউ যদি সম্পাদন করে আল্লাহ তাকে ১০গুণ প্রতিদান প্রদান করবেন।
অনেক মেধাবী মুখ আছে; যাদের গবেষণার মন রয়েছে, গঠনমূলক চিন্তা রয়েছে, বিশ্লেষণধর্মী ক্ষমতা রয়েছে, সুদূরপ্রসারী ভাবনা রয়েছে। যারা চিন্তায় অগ্রগামী, কর্মে সৃজনশীল, আচরণে বুদ্ধিদীপ্ত, যুক্তিতে ক্ষুরধার, সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা পরিশ্রমী সাধক, গতানুগতিকতার বাইরে কাজেও আগ্রহী!
এদের সঠিক পথ নির্দেশ করলে, পরামর্শ দিলে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করলে, সহযোগিতা করলে উচ্চতর গবেষণায় ভালো করতে পারেন। যাদের গবেষণা নতুনত্ব আনবে, আধুনিক ব্যাখ্যা হাজির করবে, নতুন নতুন অনুসন্ধানী তথ্য ও তত্ত্ব স্পষ্ট করবে। স্বনামধন্য গবেষকদের সাথে নবীন গবেষকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা দরকার।
উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভে গবেষণা
সমাজ জীবন জটিল হচ্ছে, সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে দেশে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, গবেষণা ও গবেষকের যথাযথ মূল্যায়নও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞান গবেষণা, কৃষি গবেষণা, শিল্প গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
এমতাবস্থায় গবেষণায় ব্যাপক মনোযোগ না দিলে উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ টেকসই হবে না। কোনো দেশ অধিক গুরুত্ব দেয় ফলিত গবেষণায়, কোনো দেশ মৌলিক গবেষণায়, কোনো দেশ যে কোনো প্রকার গবেষণায়। গবেষণায় অনেক রাষ্ট্রই বিপুল অর্থ ব্যায় করে এবং ব্যয়ের পরিমাণ দিনদিন বাড়ায়।
গবেষণার উদ্দেশ্য
সাধারণত এসব গবেষণার উদ্দেশ্য থাকে মূলত দৈনন্দিন জীবনের আরাম-আয়েশগুলো বৃদ্ধি করা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা, সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করা, জীবনের অর্থ খুঁজে বের করা। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয়ের উন্নয়ন করা।
এছাড়া নিত্য নতুন উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধানের পথ বের করা। জটিল কাজকে সহজ করা। নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে নতুন নতুন সমস্যা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সমাজকে কীভাবে সংগঠিত করতে হবে, কীভাবে সর্বাধিক কার্যোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, কীভাবে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করতে হবে- এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা ও সুপারিশ করা।
কিছু চিন্তাশীল মানুষের কলমে ধার, অন্তর্দৃষ্টি, প্রসারিত বক্ষ, স্বচ্ছ হৃদয় আছে। যারা মগজ চালিত দেহ থাকার কারণে পুরাতন ছেড়ে নতুনকে গ্রহণ করেন। যাদের ধার করা চিন্তা নেই, অনুকরণ প্রিয় মন নেই, নতজানু মানসিকতা নেই! যাদের সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের সুতীব্র বাসনাও নেই! বিলাসী যিন্দেগী যাপনের অদম্য স্পৃহাও নেই। দৈনন্দিন জীবনের আরাম-আয়েশ বৃদ্ধির চেয়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করায় মনোযোগ বেশি!
এসব কর্মপ্রিয়রা ‘গ্যাপ’ খুঁজে বের করেন, প্রয়োজনীয় দক্ষতাও অর্জন করেন, কাজেও নেমে পড়েন; কিন্তু একসময় হাল ছেড়ে দেন- উপযুক্ত প্লাটফর্ম না পাবার কারণে। মানুষের জন্য ব্যাপক ভিত্তিক কাজ করার স্বপ্নরা মরে যায়, স্বপ্নগুলো আর ডানা মেলে না সম্ভাবনার অসীম আকাশে। দেশের উন্নতির জন্য ও মানুষের উন্নয়নে মেধা কাজে লাগে না।
গবেষণার পরোক্ষ লাভ বেশি
গবেষণার পরোক্ষ লাভ অনেক বেশি। কারো সহায়তার মাধ্যমে যদি কোনো গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয় আর সেই গবেষণাকর্ম দ্বারা কোনো গোষ্ঠী বা জাতি জীবনের কোনো একটি দিকের সঠিক পথনির্দেশনা পান তবে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ ভালো কাজের জন্য গবেষকের পাশাপাশি সহায়তাকারী মর্যাদা পাবেন। তার আমলনামায় এত বিপুল পরিমাণ সাওয়াব লিখিত হবে যা সে ভাবতেও পারবে না। তাই অন্য সকল ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে গবেষণা কাজকে সহায়তা করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কী করে? কী করা উচিত?
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেবল তত্ত্বগত উন্নয়নে নয় বরং সামগ্রিকভাবে সামাজিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন গড়তে কাজ করতে পারে। জ্ঞান-অর্জন, জ্ঞান-উৎপাদন, জ্ঞান সংরক্ষণ, জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞানের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে গবেষণা করা ও গবেষণায় পৃষ্টপোষকতা করতে পারে। জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব তৈরীর মাধ্যমে একটি আলোকিত ও সোহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলবে যেখানে সকলেই কাধে কাধ মিলিয়ে মানব সভ্যতা বিকাশে ভূমিকা পালন করবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মানবকল্যাণ করে, সচেতনতা বৃদ্ধি করে, স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে ও সৃজনশীলতার বিকাশ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানে থাকে নলেজ প্যাট্রনরা, নলেজ স্কলাররা, নলেজ এ্যাডভাইজাররা, নলেজ ওর্য়াকার (সিনিয়র নলেজ ওর্য়াকার, জুনিয়ার নলেজ ওয়ার্কার), নলেজ লার্নাররা ও নলেজ ফ্রেশাররা। সংশ্লিষ্টরা হয় উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞানপিপাসু, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল লেখালেখিতে আগ্রহী ও পাবলিক স্পিকিংয়ে দক্ষ। কিছু কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে গবেষণা চুক্তি করেও কাজ করে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণাও হয়, গবেষক তৈরিও হয়। জ্ঞান গবেষকরা গবেষণা করে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রবীণের সাথে নবীনের যোগাযোগ ঘটিয়ে গবেষণায় আগ্রহী ভবিষ্যতের গবেষক তৈরিতে বহুবিধ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
সবাইকে হতে হয় নিজে শিখতে ও অন্যদের শেখানোর মানসিকতা সম্পন্ন। নিজে নিজেই চিন্তা করতে সক্ষম। সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি যাকে ভাবায়। জ্ঞান চর্চায় উৎসাহীরা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। সময় দিতে ইচ্ছুক হতে হয়। গবেষককে হতে হয় যোগ্য, মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন সুবিবেচক, লেখক, বক্তা কিংবা চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণ লাভের লক্ষ্য ঠিক করে। আবেগনির্ভর পথ পরিহার করে। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে নব পথ-পদ্ধতি ও কৌশল বের করতে চেষ্টা করে। অনাগত ভবিষ্যতকে দেখে পরিকল্পনা নেয়। অন্বেষণ, অনুসন্ধান ও অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার মাধ্যমে সত্যকে খুঁজে বেড়ায়।
সস্তা জনপ্রিয়তা ও চমকপ্রদ কিছু করে তাক লাগিয়ে দিয়ে তড়িৎ ফলাফলে প্রত্যাশী হন না। জাগতিক স্বীকৃতি ও সাময়িক প্রাপ্তির মোহ-লোভ বিসর্জন দেন। উন্নয়ন, ইতিবাচকতা, সম্ভাবনার বিকাশ, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, মানবতা এবং উম্মাহ, স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা নেন।
আলোকিত মানুষ ও আলোকিত সমাজ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান জ্ঞানচর্চার পরিবেশ ও অধ্যয়নের মানসিকতা তৈরির যুগোপযুগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। লাইব্রেরি করবে, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি করবে, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ও পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তোলাকে উৎসাহিত করবে। এমন কোনো বিল্ডিং থাকবে না, যেখানে লাইব্রেরীর জন্য কমন একটা প্লেস থাকবে না। লাইব্রেরি গ্যারেজের চেয়ে কিংবা বারান্দার ফুলের টব বা ছাদ বাগানের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান জ্ঞান বিতরণে আধুনিক উপায় ও উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করবে। এমন কিছু নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রকাশনা তৈরি করবে; যা সার্বজনীন আবেদন সমৃদ্ধ হবে। এমফিল ও পিএইচডি করতে উদ্বুদ্ধ করবে; সহায়তা করবে। গবেষণা কর্মে সহায়তা বা গবেষণা কর্মকে পাবলিক স্পেসে পরিচিত করাবে। জ্ঞান সংরক্ষণে নানান ধরণের শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলবে। অপেক্ষাকৃত বেশি যারা জানে তাদের কাছ থেকে শেখানোর এবং সেগুলোকে অন্য প্রজন্মের কাছেও পৌঁছানোর আয়োজন করবে।
আলোকিত মানুষ ও আলোকিত সমাজ গঠনে সামাজিক আন্দোলন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চেষ্টা এমন হতে পারে যে, প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দিতে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে যাবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মা-বাবাদের প্রশিক্ষণ, সংগঠক-উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও লেখক-গবেষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি হতে পারে। জ্ঞানের জগতে যারা কাজ করছেন সেসব নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, লেখক, শিক্ষা উদ্যোক্তা, গবেষকদের সম্মাননা-পুরস্কার চালু করা যেতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকৌশল
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকৌশল হবে এমন যে- এটি দেশ ও মানবতা নিয়ে যে বা যারাই কাজ করছে সবাইকে সহযোগী বন্ধু ভাববে। কাউকেই শত্রু বা প্রতিপক্ষ মনে করবে না। রাজনৈতিক মতর্পাথক্য কিংবা যেকোনো সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে কাজ করবে। প্রচেষ্টার সাথে একাকার হয়ে যেতে কারো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডগত বা পেশাগত ভিন্নতা প্রতিবন্ধক মনে করবে না।
যেকোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে হতে হবে অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।প্রতিষ্ঠানটির কাজের উপায় ও পদ্ধতি এমন হবে যে- নিজেরা জানবে। যতটুকু জানেন তা অপরকে জানাবে। যারা চিন্তা গবেষণায় অগ্রসর কিন্তু কর্মে পিছিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করে কর্মমুখী করে তোলবে। যারা চিন্তা গবেষণা ও র্কমে অগ্রসর তাদের সাথে সর্ম্পক তৈরি করবে।
যারা চিন্তা গবেষণায় পশ্চাদপদ কিন্তু র্কমে অগ্রসর তাদের চিন্তার বিকাশে ভূমিকা রাখবে। যারা চিন্তা গবেষণা ও র্কমে পশ্চাদপদ তাদের অবস্থার পরির্বতনে বা উন্নয়নের চেষ্টা করবে। প্রতিষ্ঠানটি নতুন কিছু সৃষ্টিকেই শুধু উদ্বুদ্ধ করবে না, তা সভ্যতার কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য মানুষের দ্বারে পৌঁছে দেয়াকেও সমান গুরুত্ব দেবে।
গবেষকদের করণীয়
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বিশ্বজনীন স্ট্যার্ন্ডাড বুদ্ধিজীবিদের লেখা পড়বে। বিদেশি স্কলারদের বই পড়বে। বিশ্বের দেশে দেশে সমধর্মী প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলোর নিয়ম নীতিমালা জানবে। আধুনিক যৌথ উদ্যোগ, সংস্কার ও তত্ত্বগুলোকে বিচার-বিবেচনা-বিশ্লেষণ করবে।
নিজের প্রত্যাশা অন্যের ওপর না চাপিয়ে সমাজের ভবিষ্যত আকাঙ্ক্ষার সাথে প্রাসঙ্গিক স্বপ্ন দেখা-দেখানো এবং সেজন্য প্রস্তুত করবে। মানুষের বিবেককে জাগাবে, অচেতন মনে চেতনা জাগাবে। যা-সুন্দর, ভালো, কল্যাণকর তার প্রতি আকর্ষণবোধ তৈরি করবে, পূণ্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কর্মরতরা
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলকে গবেষণায় নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। যিনি দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি প্ল্যান বাস্তবায়ন করবেন। ফান্ড তৈরিতে সহায়তা ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবেন। বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবেন। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুযায়ী কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন। গবেষক, পৃষ্টপোষক ও ম্যানেজমেন্টের সাথে যোগাযোগ, সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান করে কাজ করবেন।
সমন্বয়করা রিসার্চ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্ল্যান করবেন, সেই প্ল্যান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে শুরু করে রিসোর্স সংগ্রহ করবেন, রিসার্চ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ডিং যোগাড় করা সহ প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের কাজে সহযোগিতা করবেন। রিসার্চ টিমের কো-ওয়ার্কারদের থেকে সেরা ফলাফলটি বের করে নিয়ে আসতে ভূমিকা রাখবেন।
জুনিয়ার অফিসারদের আইটি স্কিল ভালো থাকতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তিতে পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে হবে। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, বিশ্লেষণে সহযোগিতা করতে হবে। অফিসিয়াল কাজকর্ম, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, ডকুমেন্ট আদান-প্রদান, ডকুমেন্টেশনে তিনি কাজ করবেন। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পিয়নও থাকবে।
কমপক্ষে একটি অফিস কাম লাইব্রেরী থাকবে। বুকসেলফ ও প্রয়োজনীয় বই থাকবে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফটোকপি, স্ক্যানার, প্রজেক্টর, ক্যামেরা ও লাইটংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। গ্রুপ ডিসকাশন ও গ্রুপ স্টাডি করার মতো ব্যবস্থা থাকবে। একটি গবেষণা টীম থাকবে। যেখানে বেতনভুক্ত গবেষণা সহযোগীরা থাকবে আবার অনারারি গবেষকরাও সম্পৃক্ত থাকবে। অভিজ্ঞরা গবেষণা টীমকে গাইডলাইন ও পরামর্শ দেবে।
গবেষণার ক্ষেত্র
গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে মানব সম্পদের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেসব গবেষণা শিক্ষাখাত, দক্ষতা উন্নয়ন, সংগঠন, ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগবে। গবেষণার ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়নকে ফোকাস করলে সার্বজনীন গ্রণযোগ্যতা পাবে। তবে এই সুনির্দিষ্ট এরিয়া নিয়ে কাজ করলেও অন্য কোনো বিষয় প্রয়োজনীয় মনে হলে বা সামনে আসলে সেটি নিয়েও কাজ করা যেতে পারে।
একাডেমিক গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার পাশাপাশি যেকোনো বিষয়ে যেকোনো সময় চাহিদার আলোকে যেকোনো ধরনের গবেষণা করতে পারে সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গবেষণা উপস্থাপন হবে- অনলাইন ও প্রিন্ট ম্যাগাজিনে প্রতিবেদন-কলাম হিসেবে। একক বক্তৃতা বা গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন হবে। বই/সংকলন প্রকাশ করা হবে। সেমিনার প্রবন্ধ ও নিবন্ধ উপস্থাপন হবে। ভিডিও ও ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরি হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হবে।
গবেষণার পদ্ধতি
গবেষণার পদ্ধতি হিসেবে শুধু কোনো একটি পদ্ধতি বেছে নিবে এমন নয়। প্রত্যেকটি গবেষণায় তার ধরন বুঝে উপযুক্ত পদ্ধতি বাছাই করে কাজ হবে। সামাজিক গবেষণায় নিবিড় বা বিস্তারিত সাক্ষাতকার, ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন, অংশগ্রহণ ও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ, মাঠ গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা ইত্যাদি। কেইস স্ট্যাডিকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশ্নমালা তৈরী করে মতামত সংগ্রহ করতে হবে।
সংক্ষিপ্ত মতামত নিতে হবে। জরিপ পরিচালনা হবে। আগের প্রাসঙ্গিক গবেষণা ও সাহিত্য পর্যালোচনা হবে। অনুবাদ, অনুলিখন, শ্রুতলিখন ও উদ্ধৃতি ব্যবহার হবে। সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ হবে। গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন হবে। গবেষণার যথার্থতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য যথাযথ নিয়মনীতি ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফলাফল আনয়ন হবে। তথ্য সংগ্রহে প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী সোর্স ব্যাবহার হবে। মাধ্যমিক উৎসকেও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হবে।
যে যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সে বিষয়ে তার দেয়া অভিজ্ঞতা-মতামত-পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়া হবে। সংকট কী কী এবং সেই সংকট নিরসনের উপায় চিহ্নিত করা হবে। প্রচলিত পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের কার্যকর পন্থা অনুসন্ধান করা হবে। বহুবিধ পরিবর্তন থেকে শিক্ষা ও করণীয় সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা বিশ্লেষণ করা হবে।
গবেষণার ক্ষেত্রে মূলনীতি
গবেষণার ক্ষেত্রে মূলনীতি হবে- রিপিটেশন হবে না। বাস্তব উপযোগিতা থাকবে। প্রয়োগযোগ্য হবে। ইস্যুভিত্তিক/বিষয়ভিত্তিক হবে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্যভিত্তিক ও পদ্ধতি নির্ভর হবে। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, উদারতা, ইতিবাচকতা ও জাতির উন্নতিকে বিবেচনা করা হবে। নতুনত্ব, সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী হবে।
সমস্যার সমাধান ও সম্ভাবনার বিকাশের কলাকৌশল অনুসন্ধান করা হবে। অতীতকে পর্যালোচনা ও বর্তমানকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য গাইডলাইন দেয়া হবে। দীর্ঘমেয়াদী আবেদন সমৃদ্ধ হবে। গবেষণা যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া, একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঠিক করে তার ভিত্তিতে গবেষণা কাজগুলো চলবে।
স্বেচ্ছাসেবী গবেষণা প্রতিষ্ঠান
ঐশী জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান, দেশের শাশ্বত ঐতিহ্য ও সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ-সমন্বয় ঘটে যে আলোর উদ্ভব হয় তাতে সমাজ আলোকিত করতে স্বেচ্ছাসেবী গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। গবেষণা করার পাশাপাশি গবেষণা কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। গবেষণাপত্র সংকলন, ই-জার্নাল, ই-বুলেটিন, ই-ম্যগাজিন প্রকাশনা করতে পারে।
গবেষণা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে। সমস্যা উল্লেখ করে তা সমাধানে প্রস্তাবনা নিয়ে ফান্ডিং করতে পারে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, বই প্রকাশ ও বই প্রকাশে সহযোগিতা করতে পারে। গোল টেবিল আলোচনা/সংলাপ/সেমিনার/অনুষ্ঠান আয়োজন এবং এসব কেন্দ্রিক প্রকাশনা করতে পারে। গবেষণায় আগ্রহী করে তোলতে ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গবেষণায় ক্যারিয়ার উৎসব আয়োজন করতে পারে। বিভিন্ন প্রকাশনা মেলায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রকাশনা উপস্থাপন করতে পারে। গবেষক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে।
বিষয়ভিত্তিক গবেষণা
দুনিয়ার সমস্যার সমাধান দিয়েই মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। মানুষের মনের কথা প্রতিফলিত হতে হবে। বিষয়ভিত্তিক গবেষণার আলোকে সমস্যা জেনে তা সমাধানের কৌশল সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ জানা ও জানার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। সমস্যার সমাধানের চিন্তা করতে হবে এবং সমালোচনা না করে প্রতিটি সেক্টরে উত্তম বিকল্প দিতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানবতার কল্যাণ, সৃষ্টির কল্যাণ, উম্মাহর কল্যাণ, স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও সদকায়ে জারিয়াহ লক্ষ্য হবে। জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে, শিক্ষার প্রসার ঘটাতে, অজ্ঞতা দূর করতে- বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বিকশিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গবেষকরা শ্রদ্ধার পাত্র, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সহায়ক শক্তি। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ক্রমাগত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষার যতদিন পরিসমাপ্তি না ঘটবে ততদিন প্রয়োজন থাকবে জ্ঞান-গবেষণার।