সহযোগিতামূলক মনোভাব ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয়। একে অন্যের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব জাগ্রত হওয়া সুনাম-সম্মান ও পরিচিতি বৃদ্ধিতে সহায়ক, বিভিন্ন টীমে মিলেমিশে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করায় সহায়ক। পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শনে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছে, আস্থা অর্জনও সহজ হয়।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যাপক ঝুঁকিতে থেকেও দুরন্ত সাহস দেখানোর মতো অনুভূতি কম জনেরই রয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে উষ্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক বা যোগাযোগ অনেকসময় বৃহত্তর পরিসরের কর্মকাণ্ডেও কাজে লাগে। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৃহত্তর পরিসরে সাহায্য করার সুযোগ সীমিত। যেহেতু ব্যক্তিগত সক্ষমতা জ্ঞান-দক্ষতা-সামর্থ্য ও কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার শক্তি দ্বারা প্রভাবিত, সেহেতু ব্যক্তিগত পর্যায়ে উৎসাহ বা কাজও গুরুত্বের দাবিদার। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গবেষণা-উদ্যোগ-অনুশীলন যাই হোক, আক্রান্ত হলে বা দুর্বলতা দেখা দিলে ঘুরে দাঁড়ানো বা কঠিন ধাপ থেকে ফিরে আসাটা সবসময় সহজ-স্বাভাবিক হয় না।
পারিবারিক পর্যায়েও সহযোগিতার সম্পর্ক অতীব জরুরি। কারণ পারিবারিক পর্যায়ে যত্নশীল ও সচেতন হলে পারিবারিক নির্যাতন-যৌনহেনস্থা- যৌননিপীড়ন-যৌন হয়রানি-যৌন নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, পারিবারিক কলহ, পারিবারিক বিরোধ, পারিবারিক বিপর্যয়, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক হিংসা- এসবের মাত্রা কমিয়ে আনা যায় এবং পারিবারিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক আচরণ শুধু পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে না, সামাজিক পর্যায়েও প্রভাব ফেলে। তাই পারিবারিক পর্যায়ে শুদ্ধাচারের চর্চা বা অনুশীলন করা দরকার। পারিবারিক পর্যায় নিরাপদ করতে যার যা করণীয়, তিনি তা না করলে সুখ-শান্তি-প্রশান্তি কমে যায়! তাই পারিবারিক জীবনে পারিবারিক পরিষেবাগুলোর মাধ্যমে পারিবারিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে টিকে থাকে।
পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি হলে এবং পারিবারিক জীবনে যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা বাড়লে- পরিবারের সম্পর্কের গন্ডীর মধ্যেই অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলা যায়! এক্ষেত্রে যেসব দক্ষতা অর্জন করা দরকার- আত্মসচেতনতা, সহমর্মিতা, আন্তব্যক্তিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, বিশ্লেষণমূলক চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা-সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, চাপ মোকাবেলার দক্ষতা ও আবেগ সামলানোর দক্ষতা ইত্যাদি। পারিবারিক পর্যায়ে যদি জ্ঞানবৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া যায়, দুর্নীতিকে ঘৃণা করার মনোভাব তৈরি হয়, পারিবারিক বিষয়ে ধৈর্য ধরার মানসিকতা বাড়ে তাহলে পারিবারিক ঐক্য-দায়িত্ব-সম্মতি-বন্ধনই পারিবারিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করবে; ফলে পারিবারিক উদ্বেগ কমে যাবে।
সাংগঠনিক পর্যায়ে সহযোগিতার সম্পর্ক হয় সর্বস্তরে মানবিক আচরণ চর্চা ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। মাঠ পর্যায়ের কোনো বিষয় কখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে গেলে তা কেন্দ্রীয় পর্যায়েই চূড়ান্ত সমাধান করতে হয়। সাংগঠনিক পর্যায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়- নাগরিকদের কল্যাণে, কর্মীদের মঙ্গলে, সাংগঠনিক সমস্যা সমাধান চেষ্টায়, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ধরে রাখায় ও বিশেষজ্ঞতা অর্জনে। একে অপরের হাত ধরে থাকার বা একতার মাধ্যমে যে সাংগঠনিক শক্তি অর্জিত হয় তা পারস্পরিক সহযোগিতায় ব্যয় করলে উল্লেখযোগ্য সুফল লাভ হয়।
সাংগঠনিক তৎপরতা যদি সঠিক ও সময়োপযুগী হয় তাহলে যেকোনো ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা যায়, সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে পারলে সর্বোচ্চ ত্যাগও নিশ্চিত করা যায়। একজনের কাজে আরেকজনের আন্তরিক সহযোগিতা লক্ষ্যপানে দৃঢ়পদে এগিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় গতিদান করে। সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্তরা যাতে মানসিক উৎফুল্লতা-প্রফুল্লতা নিয়ে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে উপকারভোগী বাড়ায়ে আর্থ-সমাজিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। তবে দলীয় বা সাংগঠনিক নীতি-উদ্দেশ্য পরিপন্থী আচরণকারী অপরাধী বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়াটাই সংগঠনের জন্য মঙ্গলজনক।
সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করা যেমন দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক অঙ্গীকারের রূপরেখা প্রণয়ন করা এবং সংগঠনভুক্তদের বহুত্ববাদী-সমন্বয়ধর্মী চিন্তাধারা নির্ভর একটি ভারসাম্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাও তেমনি পারদর্শিতা। সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংগঠনকে সহযোগিতার জন্য স্বেচ্ছাসেবী দল থাকতে পারে, মানুষের সেবা বাড়াতে বা অভাবগ্রস্তদের সহযোগিতা করতে পরামর্শভিত্তিক পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক চর্চা আত্মতৃপ্তি বাড়ায়, গঠনমূলক সমালোচনা পরিশুদ্ধি আনে। নিবিড় সম্পর্ক রক্ষায় সাধ্যমত চেষ্টা সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
সমাজের নানাবিধ সমস্যা এবং যথাসাধ্য সমাধানের মহতী উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়েই সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে যেমন বিভিন্ন উদ্যোগের প্রয়োজন হয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তেমনি বিভিন্ন উদ্যোগের দরকার পড়ে।
সহযোগিতা বিভিন্ন ধরণের হয়, যেমন- অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্যিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ সহযোগিতা, ঋণ সহযোগিতা, রাজনৈতিক সহযোগিতা, দক্ষতা উন্নয়নে সহযোগিতা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, কূটনৈতিক সহযোগিতা, সামরিক সহযোগিতা, মানবিক সহযোগিতা, উন্নয়ন সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, উদ্ভাবনে সহযোগিতা, গবেষণা সহযোগিতা, সরকারি সহযোগিতা, বেসরকারি সহযোগিতা, স্বেচ্ছাসেবী সহযোগিতা ইত্যাদি।
এছাড়াও সহযোগিতার কত রকমফের! পারস্পরিক সহযোগিতা, ত্রাণ সহযোগিতা, আপদকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্থদের সহযোগিতা, সার্বিক সহযোগিতা, প্রকাশ্য সহযোগিতা, গোপন সহযোগিতা, বৈশ্বিক সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, কৌশলগত সহযোগিতা, কারিগরি সহযোগিতা, ব্যবস্থাপনা সহযোগিতা ইত্যাদি।
যেকোনো ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় সহযোগিতা সুষ্ঠ ও সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদনে সহায়ক। উন্নত সহযোগিতার দক্ষতা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাবার অর্থই নিজে সামনে এগিয়ে যাবার মাধ্যমে অন্যদেরকেও সামনে এগিয়ে নেয়া। কোনও কাজ শেষ করতে বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে গিয়ে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হতেই পারে। কেউ সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা নেন, আবার কেউ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা নেন। যারা সহযোগিতা করেন তারা কেউ আধিপত্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, কেউ প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে, কেউ মানবিক কারণে দয়াপরাবশ হয়ে।
যে যেটা করতে পারে না, অথচ তার সেটা করা দরকার, তখন অন্যের দ্বারস্থ হওয়াই যায়! তবে যিনি সহযোগিতা নেবেন তার যদি সেই ক্ষমতাটুকু থাকে যে- কতটুকু নেবেন আর কতটুকু নেবেন না বা কী গ্রহণ করবেন আর কী গ্রহণ করবেন না বা কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নেবেন আর কোন ক্ষেত্রে নেবেন না, এটা নিজেই ঠিক করতে পারেন; তাহলে ভালো! কারণ নিজের কোনটি ভালো, কোন সহযোগিতা নেয়া ভালো, কোন সহযোগিতা নেয়া খারাপ- সেই বোধবুদ্ধি না থাকলে সে সহজেই ফাঁদে পড়তে পারে, প্রতারিত হতে পারে, সহযোগিতা প্রদানকারীর উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহারিত হতে পারেন।
সহযোগিতা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কই মর্যাদাজনক-সম্মানজনক সম্পর্ক। শুধু কারো কাছ থেকে নিলে কিংবা শুধু কাউকে দিলে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমি বলছি না যে সবসময় অর্থমূল্যে বিনিময়যোগ্য হতে হবে, তবে একজন শুধু পেয়েই যাবেন আর আরেকজন শুধু হারিয়েই যাবেন বা একজন শুধু লাভ করবেন আর আরেকজনের শুধু ক্ষতি হবে- এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনে না।
কার্যকরী সহযোগিতা লক্ষ্য অর্জনকে সহজ করে এবং দ্রুততার সাথে ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়। দুর্দান্ত সহযোগিতার দক্ষতা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস গড়ে তোলায়ও সহায়ক। সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আন্তরিক সহযোগিতা করলে সহযোগিতা সফল করা সহজ হয়। আর সহযোগিতার টেকসই সংস্কৃতি কখনো কৃত্রিমতা-প্রদর্শন-প্রচারণার উদ্দেশ্যে পরিচালিত তৎপরতার মাধ্যমে তৈরি হতে পারে না।
যিনি সহযোগিতা করেন তিনি যদি মন থেকে ভালোবেসে করেন, আর ভেতরের পবিত্রবোধ থেকে তৈরি অনুভূতি এক্ষেত্রে তাকে সক্রিয় রাখে- তবে তা দারুণ নৈতিক প্রভাব ফেলে। সহযোগিতার মনোভাব দলকে সুসংহত করে, টীম স্পিরিট বৃদ্ধি করে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণকে সহজ করে। ভেবে-চিন্তে বুঝে-শোনে সচেতনভাবে সহযোগিতা করলে তা যতটা আশানারুপ ফলাফল আনতে পারে, আবেগে-ভয়ে-লজ্জায় সহযোগিতা করলে তা সেই রূপ দীর্ঘমেয়াদী ফল ধরে রাখতে পারে না।