আনিসুর রহমান এরশাদ
শান্তিময় সমাজ গঠনে চাই আশাবাদী নতুন প্রজন্ম। যারা সুবচনে সুসম্পর্ক গড়বে, যথাযথ ব্যক্তি-আচরণের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়বে, হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করবে, ধৈর্য ধারণ করবে, অন্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবে, পরমত সহিষ্ণু হবে,সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে যথাযথ মর্যাদা দিবে, নিষ্ঠা-সততা-শালীনতা-সহমর্মিতা-আন্তরিকতা চর্চা করবে, মেধা ও শ্রম দিয়ে অর্জিত ডিগ্রিকে সঠিকভাবে কাজে লাগায়ে জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করবে, শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবে। সামাজিক বন্ধন, শান্তি-শৃংখলা এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির অপরিসীম গুরুত্বকে স্বীকার করবে।
বড় হবার জন্য প্রয়োজন আত্মশক্তির। বাচ্চা বয়সে হাতিকেও সামান্য রশির সাহায্যে যদি খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়, তবে চেষ্টা করে শিকল খুলতে বিফল হয়ে বন্দিত্বে থাকার এই অভ্যাস তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। সে শক্তি প্রয়োগ করে না, নিজের শক্তি সামর্থ্যের ব্যাপারেও জানে না। মানুষের ক্ষেত্রেও নানান সংকট- সমস্যা-প্রতিবন্ধকতার কারণে সম্ভাবনার অপমৃত্যু হয়। বড় কাজ করার যোগ্য ব্যক্তিও ছোট কাজ করেই প্রশান্তিতে থাকে। আত্মশক্তির ঘাটতি ও হীনমন্যতা শুধু ব্যক্তির সমস্যা নয়, দেশ ও জাতির উন্নয়নের বড় প্রতিবন্ধকতা। মানবসমাজে এক অপরের সঙ্গে সু সম্পর্ক বজায় রেখে শান্তিতে বসবাস করার যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন তন্মধ্যে প্রেম, সততা, ন্যায়পরায়নতা হচ্ছে অন্যতম মহৎ গুণ। আজীবন এসব মানবিক ও নৈতিক গুণ অর্জনের চেষ্টা, অনুশীলন মানুষকে মর্যাদা ও গৌরবের শ্রেষ্ঠতম স্থানে পৌঁছে দিতে পারে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধে মানুষের বিবেক জাগ্রত হওয়াটা খুব জরুরি। অচেতন মনে চেতনা জাগাতে, হৃদয়কে আলোকিত করতে, যাকিছু সুন্দর–ভালো-কল্যাণকর তার প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে, পঙ্কিলতাকে বর্জনের মানসিকতা তৈরি করতে হলে যথাযথ জ্ঞান আবশ্যক। যদিও অনেকক্ষেত্রে জ্ঞানীর চেয়ে জ্ঞানপাপীদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। তারপরও বলা যায় তোতা পাখির মত মুখস্ত করে গভীর জ্ঞান উপলব্ধি হয় না। পরীক্ষায় পাস করা ও সার্টিফিকেট অর্জন করার মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী হওয়ার নিশ্চয়তা মিলে না। কুসংস্কার ও গোঁড়ামী মিলে তৈরি হয় ধর্মান্ধতা, অহংকার ও আমিত্ব মিলে তৈরি হয় ঔদ্ধত্য। নানা অন্ধবিশ্বাস আর অস্পষ্টতার সমন্বয়ে সংকট বাড়ে আর জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রয়োজনীয় মনে হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীন মনে করায় ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়; যা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয় ও বিভ্রান্তি ডেকে আনে। মহামানবদের জীবনী অনুসরণের মাধ্যমে সৎ, সুন্দর ও মহিমান্বিত জীবন গঠন ও শান্তিময় সমাজ গঠন সম্ভব।
চাই প্রকৃতির মত উদারতা; আলোকে উদ্ভাসিত হৃদয়। নানা কৃত্রিম জটিলতার মধ্যে দিয়ে গরলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সমাধানের পথ নয়। সঠিক পথে যিনি নিজেই চলতে ব্যর্থ তিনি অপরকে সঠিক সুন্দর পথ দেখাতে পারেন না। অন্যের জীবনকে সুন্দর ও সঠিক করতে পরামর্শদাতার মধ্যেই যদি ভেজাল থাকে, তবে সেখানে সুফল আশা করা বোকামি। আপনার জ্ঞান ও দায়িত্বের কোনো প্রভাব যদি চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতায় প্রতিফলন না ঘটে তবে সফল হলেও আপনার জীবনে সার্থকতা আসবে না। জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হৃদয়ে ব্যক্তিস্বার্থ, সংকীর্ণতা, হীনমন্যতার ছোঁয়া বেমানান। উদার মুক্ত আকাশের মত বিশাল হৃদয়ই পারে দু:খ-কষ্টের মাঝেও ধৈর্য্যের সাথে কাজ করতে, স্বপ্নভঙ্গ হলেও হতাশ না হয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে, ব্যর্থতা আসলেও হাসিমুখে সার্থক জীবনের সন্ধান করতে।
আত্মসম্মানবোধই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব রূপে উপস্থাপনে কার্যকর। আত্মমর্যাদা সংকটে ভোগে বিশালতাকে উপলব্ধি করা যায় না। আচরণেই প্রকাশ পায় ব্যক্তির সত্যিকার রুচিবোধ, মন-মানসিকতা, ব্যক্তিত্ব। ব্যবহারিক ক্ষেত্রই ব্যক্তিকে সঠিকভাবে বুঝার ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর। কে কত বড় মহৎ, বড় মাপের মানুষ তা ফুটে উঠে তার ব্যবহারে, আচার-আচরণে। যার জ্ঞানের কোনো আলো নেই, সামাজিক কোনো মর্যাদা নেই, ব্যক্তিত্বের ইমেজ নেই- সে অনেক কিছুই করতে পারে যা যৌক্তিকতার মানদণ্ডে বিচার করা যায় না। অনেকেই শিক্ষা-দিক্ষায়, পদ-পদবিতে, অর্থ-ক্ষমতায় বড় হয় কিন্তু সেই অনুপাতে হৃদয়কে বড় করতে পারে না। মনটা ছোট থেকে যাওয়ায় আচরণে নেতিবাচকতা প্রকাশ পায়। যেমন: টাকাওয়ালা তবে হৃদয়হীন কৃপণ, বিদ্যান কিন্তু দুর্জন, ক্ষমতাবান কিন্তু প্রতারক ইত্যাদি। সংকীর্ণ মন নিয়ে ভালো কিছু করা যায় না, সামগ্রিক আচরণে বিশালতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে।
সবাই মানুষ। কিন্তু সবাই সমান নয়। জ্ঞান, সম্পদ, ক্ষমতা নানা পার্থক্য সৃষ্টি করে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তিত্বই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্ব মহিমায় চিরভাস্বর, কেউ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাউকেই তুচ্ছ মনে না করে উপযুক্ত সম্মান করতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে। বড় হবার জন্যে নিজেকেই উদ্যোগ নিতে হয়, প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাতে হয়, সাধনা করতে হয়। সবাই সমান সফলতা অর্জন করতে পারে না। এটাকে শুধু কপালের লিখন, ভাগ্য বলে চালায়ে দেবার প্রচেষ্টা অযৌক্তিক। ফুলে সুরভী আছে, সৌন্দর্য আছে, হৃদয় মন কেড়ে নেয়ার আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে। তবে এ ফুলের পেছনে মালির ভূমিকা কি কম গুরুত্বপূর্ণ? মোটেই নয়। তবে ফুলের সাথে তো আর মালির তুলনা চলে না। যারা কৃতিত্বপূর্ণ জীবনের সন্ধান লাভ করেন তাদের সফলতার পেছনে অনেকের অবদান থাকতে পারে। তবে নিজেকে গড়ার জন্য সবচেয়ে নিজের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পৃথিবীর সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালায়েও কেউ ছোট থাকতে চাইলে তাকে বড় বানাতে পারবে না। তবে কেউ যদি বড় হবার চেষ্টা করে তার সাথে অন্যদের সহযোগিতা একত্র হওয়ায় বিরাট কল্যাণ হাসিল সহজ হতে পারে।
সুদূরপ্রসারী চিন্তা করুন; গড়ুন অর্থবহ জীবন। সাফল্যের পেছনে ছুটে নিজেকে নিঃশেষ করবেন না। সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক দুর্বলতা থাকলে জ্ঞানার্জন করা যায় না, মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় না, মনোযোগের সাথে কাজ করা যায় না, ফলে জীবনের মূল্যবান সময়ের কিছু অংশ অনর্থবহ হয়ে পড়ে। জাগতিক সামান্য প্রাপ্তির পিছনে অসতর্কভাবে ছুটতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কর্মক্ষমতা হারানো কিংবা কর্মব্যস্ততার দোহাই দিয়ে খাবার ও ঘুমে অনিয়ম করে রোগী হয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নেয়া কিংবা চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হলে সেটা কীভাবে বিবেচনা করা হবে ? পাঁচ টাকা বাঁচাতে গিয়ে পঞ্চাশ টাকা খরচ হলে সেখানে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় না। পরের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করা, নিজের চেয়ে অপরের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া মহৎকর্ম এতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। তাই বলে নিজেকে অযত্ন-অবহেলা করে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনা যাবে না।
সফলতার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে পরিকল্পনা নিন। মনে রাখবেন স্বপ্ন দেখা আর বাস্তবতায় অনেক তফাৎ। মন অনেক কিছুই চায় তবে পায় খুব কমই। কল্পনায় শুধু বড় না হয়ে কাজকর্মে বড় হতে হবে। সীমাহীন আশা-আকাঙ্ক্ষা, সব তো পূরণ হয় না। তাই শুধু স্বপ্ন ও কল্পনার জগতের সুখী বাসিন্দা হওয়া বাস্তবজগতের দুঃখকে ভুলে থাকার প্রচেষ্টা মাত্র। দুঃখের সাথে গলাগলি ধরেও অনেকে সুখের সাথে সম্পর্ক গড়তে পেরেছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে ধ্যান করে বর্তমান সময়কে নিষ্কর্মভাবে কাটায়ে দিলে তা মূর্খতার পরিচয়ই বহন করে। যিনি শুধু কল্পনাবিলাসী বাস্তবিক জীবনে তিনি চলার অযোগ্য। ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে ধ্যানী সাজলে পেটের ক্ষুধা মিটবে না। প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখাও যত সহজ, স্কুলের কেরানী হওয়াও বাস্তবে অত সহজ নয়। তাই সময়ের মূল্য সত্যিকারভাবে দিয়েই সার্থকতা পেতে হয়। সফলতা কখনোই অলসদের জীবনে আসে না। তাই দরকার পরিশ্রমী নবীন প্রজন্ম যারা সমস্যার ভীড়েও সম্ভাবনা খুঁজতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের জন্য সাময়িক নগণ্য প্রাপ্তির লোভ ছাড়তে পারে, পাহাড়সম বিপদেও লক্ষ্যে অটল-অবিচল থাকতে পারে।