অনেক পরিবারেই বৈষম্য চর্চা করা হয়। জেন্ডারের ভিন্নতা, মানসিক বা শারীরিক শ্রমের ধরণে ভিন্নতা, গায়ের বর্ণ ভেদে ভিন্নতার কারণে বৈষম্য করা হয়। অনেক বাবা-মা পড়াশুনার খরচের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের মাঝে বৈষম্য করেন, কয়েকজন উত্তরাধিকারি থাকলেও কাউকে জমি লিখে দিয়ে বৈষম্য করেন, সম্পদ বণ্টনে কাউকে ভালোটা দেন, কাউকে খারাপটা দেন।
অথচ জীবিত থাকাকালীন সব সন্তানদের মাঝে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা মা-বাবার ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বাবা মায়ের সন্তান অনেকগুলো থাকতে পারে কিন্তু সন্তানের জন্য বাবা মা একজনই। তাই পারিবারিক সম্পর্ক সুন্দর রাখতে অর্থবিত্ত, ছোট বড় হিসাব বাদ দিতে হবে।
অসম আচরণের প্রভাব
অসম আচরণে সন্তানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। বাবা-মা সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য করলে একে অন্যের প্রতি দুঃখ, ভালোবাসার স্থলে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব পায়। ফলে পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিবাদ (siblings rivalry) ও অনৈক্য। কম-বেশি করে বাবা-মা আসলে দৃশ্যত কারো উপকার করলেও প্রকৃতপক্ষে সবারই ক্ষতি করেন, সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেন নিজেদেরই।
ভাই-বোনদের বন্ধন নষ্ট
সন্তানদের মধ্যে একজন বেশি প্রিয় হওয়া অনেক বাবা মায়ের কাছে স্বাভাবিক বিষয়। কোনো একজন সন্তান মায়ের কাছে অথবা বাবার কাছে প্রিয় হতেই পারে কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই সংবেদনশীলতার সাথে সামলানো দরকার। কারণ ‘প্রিয় সন্তান’ এবং ‘গুরুত্ব কম পাওয়া সন্তান’ উভয়ের ওপরই ভীষণ রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যদি কোনো বাবা মা কোনো একটি সন্তান যে প্রিয় সেটি সন্তানদের সাথে নিজের আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেলে তাহলে তা ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এতে একাধিক ভাই বোনদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। ভাই বোনদের মধ্যে বিভেদ তাদের পরবর্তী জীবনেও অব্যাহত থাকে।
বেশি ভালোবাসা প্রকাশের ঝুঁকি
পরিবারে বাবা মায়ের কাছের থেকে বৈষম্যমূলক আচরণ অনেকেই পান। ইয়েলেনা গিদেনকো পিএইচডি বলেন, যে সন্তানটির কাছে মনে হয় তাকে কম ভালোবাসা হয় বা তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে; তার মধ্যে বিধ্বংসী হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। তার কাছে সারাক্ষণই মনে হতে পারে যে তাকে কম ভালোবাসা হচ্ছে, পরিবারে ভাই বোনদের মধ্যে সে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে। এক সময়ে তাদের মধ্যে হতাশা, ক্রোধ এবং হিংসামূলক আচরণ (siblings jealousy) প্রবল হয়ে ওঠে।
একই সাথে যে সন্তানদের প্রতি বাবা মা বেশি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাদের ক্ষেত্রেও কিছু খারাপ চরিত্র প্রকট হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে অহংকার বোধ কাজ করতে থাকে। কোনো সময় বাবা মা তাদের বদলে অন্যদের বেশি স্নেহ, ভালোবাসা বেশি দিলে তারা রাগান্বিত হয়। তাদের মধ্যে সব সময় উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা এবং নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে থাকে। বাবা মায়ের কাছে কোনো একটি সন্তান একটু বেশি প্রিয় হলে এবং সে যা চায় তা-ই যদি পেয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে সে যদি কিছু চেয়ে না পায় তবে সে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠতে পারে।
একপেশে আচরণ প্রকাশে ক্ষতি
সন্তানদের মধ্যে জটিল ধরনের সমস্যা এড়িয়ে যেতে বাবা-মাকে অনেক বেশি সাবধানি হতে হবে। কোনো সন্তানের প্রতি যেন এই ধরনের একপেশে আচরণ প্রকাশ না পায় সেটি খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে সন্তানদের চাহিদা অনুযায়ী যৌক্তিকভাবে সেগুলো সমানভাবে সবার চাহিদা পূরণ করতে হবে।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী ড. সুসান নিউম্যানের পরামর্শ, প্রত্যেক সন্তানই স্নেহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা চায়। বাবা মায়ের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসে। সুতরাং সব বাবা মায়েরই উচিত সব সন্তানকে সমানভাবে স্নেহ ভালোবাসা দেওয়া।
পক্ষপাতমূলক আচরণ ইনসাফের পরিপন্থী
সন্তানদের কোনো কিছু দেওয়ার ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। তাদের মাঝে বৈষম্য করা হারাম। পারিবারিক জীবনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম।
স্নেহের আতিশয্যে কোনো সন্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ ইনসাফের পরিপন্থি। নিজের সন্তানদের সমতা রক্ষা করা মা-বাবার ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এটি ইসলামের অনন্য বিধানও।
সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা
হজরত আমের (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নুমান ইবনে বশীরকে (রা.) মিম্বরের ওপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহকে (সা.) সাক্ষী রাখা ব্যতীত আমি এতে সম্মত নই। তখন তিনি রাসূল (সা.)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমি আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম দিয়েছ? তিনি বললেন, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। নুমান (রা.) বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে এসে সেই দানটি ফিরিয়ে নিলেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘…অতএব এ ব্যাপারে আমাকে সাক্ষী রেখ না। কারণ আমি জুলুমের সাক্ষী হতে পারি না।’
বণ্টনে সমতা রক্ষা জরুরি
মা-বাবা যদি তাদের জীবদ্দশায় সন্তানদের মাঝে টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় অথবা খাদ্যবস্তু বণ্টন করেন তবে সে ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সমতা রক্ষা করা জরুরি। মেয়েকে সে পরিমাণ দেবে, যে পরিমাণে ছেলেকে দিয়েছে। ছোট সন্তানকে সেই পরিমাণ দেবে যে পরিমাণ বড় সন্তানকে দিয়েছে। মা-বাবা যখন প্রয়োজনের বাইরে অথবা খুশি হয়ে সন্তানদের কিছু দেবে সে ক্ষেত্রেও এ সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। যেমন, ঈদের সময় ঈদের বকশিশ অথবা সফর থেকে ফিরে এসে সন্তানদের হাদিয়া দেওয়া ইত্যাদি।
প্রয়োজনে ব্যয়ের বিষয়টি ভিন্ন
প্রয়োজনের বিষয়টি ভিন্ন। মা-বাবা যদি প্রয়োজনে কোনো সন্তানের জন্য কিছু ব্যয় করেন যেমন, অসুস্থতার জন্য খরচ করছেন, কারও শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করছেন, ছেলে অথবা মেয়ে কেউ সফরে যাচ্ছে, কারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খরচ কম, কারও বেশি, কারও সফর ছোট, কারও সফর বড়, কারও সফরে বেশি টাকার প্রয়োজন আবার কার কম, এভাবে প্রয়োজনের সময় সন্তানদের জন্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে কম-বেশি করার মধ্যে কোনো গুনাহ নেই। বরং যার যতটুকু প্রয়োজন তাকে ততটুকু দিতে পারবে।
ভালোবাসা প্রকাশেও সমতা রক্ষা আবশ্যক
ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। কখনও মা-বাবা কথায় ও কাজে এমন ভাব প্রকাশ করবে না, যাতে সন্তানরা বুঝতে পারে, মা-বাবা অমুককে বেশি ভালোবাসেন, অমুককে কম ভালোবাসেন। এমনটা করবে না। যদি মা-বাবা এমনটা করেন তাহলে তা হবে অন্যায় এবং কেয়ামতের দিন এর জন্য পাকড়াও করা হবে।
জনৈক আনসারী সাহাবিকে রাসুল (সা.) ডাকলেন। ইতোমধ্যে ওই সাহাবির এক পুত্রসন্তান তার কাছে এলো। তিনি তাকে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং কোলে বসালেন। কিছুক্ষণ পর তার এক কন্যাসন্তানও সেখানে উপস্থিত হলো। তিনি তার হাত ধরে নিজের কাছে বসালেন। এটি দেখে রাসুল (সা.) বললেন, উভয় সন্তানের প্রতি তোমার আচরণ অভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। তোমরা নিজেদের সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। এমনকি চুমু দেওয়ার ক্ষেত্রেও।
বৈষম্যের প্রতিক্রিয়া নিয়ে শিক্ষণীয় ঘটনা
ইউসুফের (আ.) ভাইয়েরা ইউসুফকে (আ.) হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন, কারণ তাদের ধারণা ছিল, ইয়াকুব (আ.) ইউসুফকে (আ.) বেশি ভালোবাসেন। অথচ ইয়াকুব (আ.) তার সন্তানদের মাঝে কোনরূপ বৈষম্য করেননি বা তাদের প্রতি জুলুম করেননি কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউসুফের (আ.) ভাইদের ধারণা ছিল, তাদের বাবা ইউসুফকে (আ.) বেশি ভালোবাসেন।
এতে তাদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার সৃষ্টি হয় এবং পরিণতিতে তারা ইউসুফকে (আ.) হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। একজন নবীর সন্তানরাও তাদের দৃষ্টিতে যেটা বৈষম্য মনে হয়েছে, সেটাকে মেনে নিতে পারেনি। এজন্যই তারা আপন ভাইকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুতরাং কোনো বাবা যখন সন্তানদের মাঝে বৈষম্য করেন, তখন বৈষম্যের শিকার সন্তানদের মাঝে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা উপরোক্ত ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়।
কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া নিষিদ্ধ
মানুষ সহজাতভাবেই বৈষম্যকে মেনে নিতে পারে না। কোনো মানুষ যখন বৈষম্যের শিকার হয়, তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হয় আর এটা তার মনোজগতে চরম নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান আর তখন থাকে না। ফলে প্রাধান্য পাওয়া ভাই, এমনকি বাবার প্রতিও তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন।
হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সন্তানদের একজনকে অপরজনের উপর অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে তাদের মাঝে শত্রুতা ও হিংসা বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। এমনকি এর ফলে সন্তান এবং বাবার মাঝেও হিংসা-বিদ্বেষে ও শত্রুতার সৃষ্টি হয়। আর এ জন্যই এটি নিষিদ্ধ।
মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে খরচ
মৌলিক চাহিদা যেমন ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়ে প্রত্যেককেই তাদের প্রয়োজন অনুসারে খরচ করতে হবে। এক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার যথাযোগ্য হক্ব দিয়েছেন। অতএব ওয়ারিশদের জন্য কোনো অসীয়ত নেই।’
শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ কোনরূপ শর্ত ছাড়াই সন্তানদের একে অন্যের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়াকে নিষিদ্ধ বলেছেন। এবং তাদের মাঝে সমতা ও ইনসাফ করা ওয়াজিব বলেছেন। তবে সেটি নারী ও পুরুষের অধিকার স্বত্ত্ব অনুসারে। কিন্তু যদি তারা প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং কাউকে কিছু দেওয়ার ব্যাপারে সবাই সম্মত হয়, তাহলে সেটি জায়েজ হবে।
বৈষম্যের শিকার না করা
যখন কেউ তার কোনো ছেলেকে ১০০ টাকা দিবে তাহলে তার অন্য ছেলেদেরকেও ১০০ টাকা এবং মেয়েদেরকে ৫০ টাকা দেওয়া তার জন্য ওয়াজিব। বাবা যেমন কামনা করেন যে, তার সন্তানরা তার সাথে সবাই ভালো আচরণ করুক, অনুরূপভাবে সন্তানরাও চায় যে, তাদের বাবাও তাদের সবার সাথেই সমতা বজায় রাখবেন, তাদেরকে বৈষম্যের শিকার করবেন না।
কোনো সন্তানের প্রতি যেন একপেশে আচরণ করা না হয়, যাতে অন্য সন্তান ভাবতে পারে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সন্তানদের মধ্যে তুলনা করা ও উচিত নয়। “ও এ রকম আর তুই এরকম কেন?” এ ধরনের আচরণের কারনে সন্তান হীনমন্যতায় ভুগতে পারে বা জিদের কারনে ভয়ংকর কিছু করে বসতে পারে।
সম্পত্তিতে অগ্রাধিকারে বাড়ে বঞ্চনা
বেশির ভাগ মানুষের কিছু না কিছু সম্পদ থাকে। অনেকে মৃত্যুর সময় কোনো কোনো সন্তানকে সম্পত্তিতে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। এতে অন্যরা বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অসিয়তে জুলুমে জাহান্নাম
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কোনো কোনো ব্যক্তি ৭০ বছর ধরে (গোটা জীবন) নেক আমল করে। কিন্তু অসিয়ত করার সময় জুলুম করে। তখন একটি খারাপ কাজের মাধ্যমে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ফলে সে জাহান্নামে যায়। আর কোনো কোনো ব্যক্তি ৭০ বছর ধরে (গোটা জীবন) খারাপ কাজ করে। কিন্তু অসিয়ত করার সময় সে ইনসাফ করে। তখন একটি ভালো কাজের মাধ্যমে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ফলে সে জান্নাতে যায়।’
মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে সবাই কমবেশি অসিয়ত করে। এ অসিয়তের মাধ্যমে যদি কোনো উত্তরাধিকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চিন্তা থাকে, তাহলে এমন অসিয়ত ইসলামে নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘…এটা (উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন) অসিয়ত আদায় ও ঋণ পরিশোধের পর (কার্যকর হবে), যদি অসিয়ত কারো জন্য ক্ষতিকর না হয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অশেষ সহনশীল।’
বৈষম্যমূলক আচরণ দূরে সরায়
প্রতিটা সন্তানই নাড়ি ছেড়া ধন, কিন্তু সমতা রক্ষায় অনেক বাবা মা’ই অপারগ। ভালোবাসায় ঘাটতি নেই কিন্তু প্রাধান্যের জায়গায় কেউ একজন এগিয়ে থাকে। সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ সেই সন্তানকে যতোটা না প্রভাবিত করে তার চাইতে বেশি প্রভাবিত করে সেই সন্তানের হাত ধরে আগত পরিবারের নতুন সদস্যটিকে। সন্তান তার নিজ জন্ম, লালন-পালন নিয়ে বাবা মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকলেও নতুন সদস্যটির কৃতজ্ঞতা বেশিদিন থাকে না, বরং অপমান হিসেবে কষ্ট পেয়ে দূরে সরে যায়।
বৈষম্যে ধাক্কা লাগে আত্মসম্মানে
এক মেয়ের জামাইয়ের সামনে অন্য মেয়ের জামাইকে বেশি খেয়ালে রাখলে কম খেয়াল রাখা জামাইটা শ্বশুরবাড়ি যেতে চায় না। এক ছেলের বউকে সবসময় গুরুত্ব দিলে অন্য ছেলের বউকে শ্বশুরবাড়ির প্রতি নাখোশ হয়।
কেউ যদি অতি উদার হয়ে সব মেনে নিতে চায়ও সেক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পাওয়াদের নানা রকম টিপ্পনিতে সেই মেনে নেয়াটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তখন অজান্তেই প্রশ্ন জাগে, ‘আমি কি ফেল না?’ অথবা ‘আমি কি বেশি হইছি?’। আত্মসম্মানে বিরাট ধাক্কা লাগে।
নিন্দিত থেকে নন্দিত
অনেক বাবা মা ইচ্ছে করেই বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, আবার অনেকে না বুঝেই করেন। যারা ইচ্ছে করে করেন তারা বরাবরই নিন্দিত হয়ে থাকেন অপর সন্তানের জামাই বা বউয়ের কাছে, আর যারা না বুঝে করেন তাদের সাথে বিষয়গুলো আলোচনা করলে তারা সন্তানের প্রতি সমতা এনে নন্দিত হয়ে উঠেন। বিয়ের পর ভাইবোনের মাঝে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ।
জীবদ্দশায় সন্তানদের মাঝে সম্পদ বণ্টন
কোনো ব্যক্তি যদি তার জীবদ্দশায় নিজ সন্তানদের মাঝে সম্পদ বণ্টন করে তাহলে তার জন্য সব ছেলে-মেয়ের মাঝে সমানহারে সম্পদ বণ্টন করা মুস্তাহাব। মেয়েকেও ছেলের সমান সম্পদ দিবে। জুমহুর উলামায়ে কেরাম বলেছেন, সম্পদ বণ্টনে ছেলে-মেয়ের মাঝে বৈষম্য না করার বিষয়টি শরয়ী দলীলের আলোকে অধিক শক্তিশালী এবং অগ্রগণ্য এবং এর ওপরই ফতোয়া।
হেবা ও মিরাছের পার্থক্য
হেবা এবং মিরাছের মাঝে বিস্তর পার্থক্য আছে। কেউ তার জীবদ্দশায় সন্তুষ্টচিত্তে কাউকে কোনো সম্পদ দান করে দেয়া হেবা। আর কারও ইন্তেকালের পর অবধারিতভাবে তার থেকে ওয়ারিসের প্রাপ্ত সম্পদ মিরাছ। হেবার ক্ষেত্রে ব্যক্তির কিছুটা স্বাধীনতা থাকলেও মিরাছ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না। কমবেশি করতে পারে না।
কোনো ব্যক্তি হেবাসূত্রে সম্পদ তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দান করার সময় স্বাধীনভাবে কমবেশি করে দিতে পারেন; কিন্তু সন্তানের বেলায় শরীয়ত পরিপূর্ণভাবে এই স্বাধীনতা দেয়নি। সান্তানদের হেবাসূত্রে সম্পদ দান করলে বৈষম্য করা অনুচিৎ। কারণ সন্তানের মাঝে বৈষম্যের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাদের পরস্পরে ঝগড়া লাগার সম্ভাবনা আছে। পিতার প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অভক্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে কিংবা হেবার মধ্য দিয়ে কোনো সন্তানকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ খোঁজা হতে পারে। অভিভাবকের জন্য এমন কাজ করা মোটেই ন্যায়সঙ্গত নয়।
কেউ তার কোনো এক সন্তানকে মৌখিকভাবে হেবা করে মারা গেল। তার জীবদ্দশায় ওই সন্তান কাগজে-কলমে হেবাকৃত সম্পদ গ্রহণ করেনি বা নিজের মালিকানায় নেয়নি, তাহলে এই হেবা কার্যকর হবে না। শরয়ী নিয়মানুযায়ী সব ওয়ারিসদের মাঝে তা বণ্টন করতে হবে।
তথ্যসূত্র ও তথ্যনির্দেশ
ডেইলি মিরর
ফাতাওয়া আলমগীরী ৪/৩০১
আলবাহরুর রায়েক ৭/৪৯০
তাকমেলায়ে ফাতহুল মুলহিম ২/৭৫
কিতাবুন নাওয়াযেল ১২/১৮৫, ১৮৭
মাসাইলুল জমহুর ২/৫৯৮
আদ্দুররুল মুখতার ৮/৪৯০
ফাতাওয়া আলমগীরী ৪/৩৭৪
আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী : ১২১৮৬
মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক : ৯/১০২
কিতাবুন নাওয়াযেল ১২/২১১
হেদায়া ৩/২৮৫
ফাতাওয়া আল জামে’আহ লিল মার’আতিল মুসলিমা ৩/১১১৫-১১১৬
আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৫৬৬
আবু দাউদ, হাদিস : ২৮৬৭
তিরমিজি, হাদিস : ২১১৭
সুরা নিসা, আয়াত : ১২
মুসলিম : হাদিস ৪২৬৯
মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক : হাদিস ১৬৫০১
আল মুগনী ৫/৬৬৪
বুখারি : হাদিস ২৪৪৭