প্রতিটি রোজাদারের জন্য বিশেষ ফজিলতের মাস পবিত্র মাহে রমজান প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংযম, শুদ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়। সবচেয়ে ধনী থেকে অতি ফকির পর্যন্ত সকলের আত্মাই উপলব্ধি করে যে, সে নিজে মালিক নয় বরং অন্যের মালিকানাধীন, স্বাধীন নয় বরং অন্যের বান্দা। পানি পানের মতো অতি সহজ ও সাধারণ কাজও অনুমতি ছাড়া করতে পারে না। এভাবে রোজা আত্মাকে আলোকিত করে, স্বর্গীয় প্রেরণার উন্মেষ ঘটায়, অহংকার দূরীভূত করে।
রোজায় দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়
রোজা এমন কল্যাণকর ব্যবস্থা, যা আত্ম সংযমের নীতি অবলম্বনে সহায়ক, খুবই বিজ্ঞানসম্মত, মানবতার জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ। রোজার মাধ্যমে মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়, আত্মিক পরিশোধন লাভ হয়, স্রষ্টা প্রদত্ত অসংখ্য নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন হয়।
সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়
ধনীরা রমজানের সময় অভুক্ত থাকার মাধ্যমে দরিদ্রদের দারিদ্রাবস্থা ও ক্ষুধার তাড়না পরিপূর্ণরুপে অনুভব করতে পারে। এ কারণে তাদের মাঝে দরিদ্রদের প্রতি করুণার উদ্রেক হয়। বিপদগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়।
রহমত বরকত মাগফেরাত
রোজা যথাযথভাবে রাখলে তাকওয়া অর্জিত হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করা যায়, অফুরন্ত রহমত লাভ হয়, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কুপ্রবৃত্তি দূর হয়, অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি অর্জিত হয়, অতীতের গুণাহর ক্ষমা পাওয়া যায় এবং শরীর ও মন সুস্থ ও সতেজ হয়।
শারীরিক কল্যাণ
মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত রোজায় শারীরিক কল্যাণ লাভ হয়। ডায়বেটিস, হার্ট ডিজীজ্, হাইপারটেনশন, গ্যাসট্রিক এসিডিটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দেহে গড়ে ওঠে। রোজা শরীরের অতিরিক্ত ওজন হ্রাস করে, বিপাক ক্রিয়া শক্তিশালী করে, করোনারী ধমনীকে চর্বিমুক্ত করে, জমে থাকা চর্বি দূর করে, রক্ত প্রবাহে বাধা দূর করে। রোজা হার্টের রোগীদের জন্য কল্যাণকর, শারীরিক রোগ প্রতিরোধে ঢালের মতো, অস্বাভাবিক গ্যাসট্রিক এসিডিটি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনে, পেপটিক আলসার থেকে রোগীকে পরিত্রাণ দেয়।
মানসিক কল্যাণ হাসিল
রোজার মাধ্যমে মানসিক কল্যাণ হাসিল হয়। মনের মধ্যে স্বর্গীয় প্রশান্তি প্রবাহিত হয়। আধ্যাত্মিক কল্যাণ লাভ হয়। মহান আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রোজায় পরকালীন কল্যাণও আছে। রোজার কারণে দেহ ও মন স্রষ্টার সন্তুষ্টি পেতে উদগ্রীব হয়। খনিজ দ্রব্য উত্তোলন করেই কাজে লাগানো যায় না, আর্দ্র ভূমিতে ফসল উৎপন্ন হয় না। রোজা আমাদের মনকে স্রষ্টার সন্তুষ্টি পাবার উপযুক্ত হিসেবে তৈরী করে।
নফসকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা
সংযম ও সাধনার মাধ্যমেই আসে মুক্তি। রোজা অতি গাফিল ও দাম্ভিকদেরকে স্বীয় অপারগতা, দুর্বলতা ও দারিদ্রতাকে উপলব্ধি করায়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যা্স্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। নফস বা আত্মার মূল দাবি তিনটি- ১. ক্ষুধার দাবি ২. যৌন আবেগ ৩. শান্তি ও বিশ্রাম। রোজার মাধ্যমে নফসকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন হয়।
খাদ্য নিয়ন্ত্রণ
কম খাওয়া, কম কথা বলা, কম ঘুম- নফস নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। কম খাওয়ার কল্যাণ হচ্ছে, এটা স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল এবং দীর্ঘ জীবন লাভে সহায়ক। হিপোক্রেটস বলেছিলেন, অসুস্থ দেহে যতই খাদ্য দেবে রোগ বালাই ততই বাড়তে থাকবে। কম খাওয়া মেদ কমাতে অধিক কার্যকারী। স্বাস্থ্যের জন্যে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিক কার্যকর।
কম ও পরিমিত খাদ্যই সুস্থতার চাবিকাঠি। অধিক খাওয়ায় প্যারলাইসিস হয়, ডায়াবেটিসের সূত্রপাত হয়, ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি পায়, দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়, তাড়াতাড়ি বার্ধক্য নেমে আসে, দেহ মোটা ও স্থুল হয়, পায়খানা প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে, হৃদপিন্ডকে বর্ধিত শক্তি ক্ষয় করতে হয়।
সুস্থ দেহ ও সুন্দর মন
নফসের চাহিদার শেষ নেই। তাই নফসে আম্মারাহ থেকে নফসে মুতমাইন্নার পর্যায়ে নিজের নফসকে উন্নীত করতে হলে প্রশিক্ষণ, পরিশোধন ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করা জরুরি। রোজা যেমন নফসকে নিয়ন্ত্রণের মানসিক শক্তি জোগায় তেমনি শরীরের জন্যেও কল্যাণ বয়ে আনে। রোজা সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের মানুষ হিসাবে রোজাদারদেরকে প্রস্তুত করে।
আবেগ ও অনুভূতি উন্নত হয়
রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়, আবেগ ও অনুভূতি উন্নত হয়। মানুষের পবিত্র অনুভূতি শক্তি জাগ্রত করার জন্য রোজা একটি প্রভাবশালী রুকন। এর মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক কল্যাণ অর্জিত হয়। রোজার তাৎক্ষণিক প্রভাব পরিস্থিতি পরিবর্তন করে। আত্মত্যাগের প্রবণতা তৈরি হয়।
ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা সৃষ্টি
আত্মত্যাগের মতো বিরল গুণ রোজা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। স্থায়ীভাবে পরের জন্যে ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা সৃষ্টি হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোজা সত্যবাদিতা শিক্ষা দেয়। মানুষকে সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও সংযত জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে ক্রমান্বয়ে আলোর পথে ধাবিত করে। রোজা আদর্শনীতি ও খোদাভীতি শিখায়। রোজা অহমিকাবোধ দমন করে। ক্রোধ, মানসিক উত্তেজনা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ এবং অশোভন ক্রিয়াকর্ম বহুলাংশে কমিয়ে দেয়।
নৈকট্য ও ভালোবাসা সৃষ্টি
রোজার মাধ্যমে পারস্পরিক নৈকট্য ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। রোজা পারস্পরিক নৈকট্যলাভের সেতুবন্ধন। রোজাদার দ্বিধাহীন চিত্তে দান করেন, মানুষকে সাহায্য করেন, সৎ পরামর্শ দেন- এসবের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। উদারতার ফলে কার্পণ্যতা, সংকীর্ণতা ও শঠতা দূর হয়।
আত্মপূজা ও আত্মপ্রীতি কমায়
রোজা প্রার্থনা ও আত্মসমর্পনের স্বাদ এনে দেয়। এতে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়। রোজা অহমিকা দূর করে। আত্মপূজা ও আত্মপ্রীতি কমে যায়। হিংসা বিদ্বেষ ও অহংবোধ দূর হওয়ার ফলে মানুষের অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। রোজা সময় সচেতনতা বাড়ায়, সময়ের সদ্ব্যবহার করতে শিখায়, জটিলতা দূর করে। জীবনকে সহজ, সরল ও গতিময় করে। এতে নফসের তারবিয়াহ তথা তাসাউফের চর্চা করাটা সহজ হয়।
মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন করে
প্রকৃত নিয়মে রোজা রাখলে দুনিয়া ও আখেরাত দু’জাহানের কল্যাণই লাভ হয়। রোজা গণতন্ত্র শিখায়, মানবপ্রেম জাগ্রত করে। অন্যকে সম্মান করা এবং অপরের মতামতকে শ্রদ্ধা করার মনোভাব তৈরি হয়। রোজা ক্ষুধার্ত ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভুতিশীল হতে এবং কোমল ব্যবহার করতে শিখায়। ফলে একজন মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন সামাজিক মানুষ হিসাবে নিজেকে পর হিতৈষী করে গড়ে তোলাটা সহজ হয়।
রুহ বেশি শক্তিশালী হয়
রোজার মাধ্যমে রোজাদার এমনভাবে প্রশিক্ষণ লাভ করে যে তিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির কল্যাণে নিবেদিত হবার অফুরন্ত প্রাণশক্তি সম্পন্ন মানুষে পরিণত হন। স্রষ্টা যদি রাজি খুশি হয়ে যায় এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিইবা আছে? রমজানে অনেকে যিকির, ফিকির আর শুকর বৃদ্ধি করে। ইবাদত বন্দেগীতে সময় ব্যয় করায় রুহের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়, নফসের চেয়ে রুহ বেশি শক্তিশালী হয়। নাফসের খায়েশ ও জৈবিক তাড়না থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্যই রোজা।
সাধনায় ব্যস্ত রাখা
রোজার পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্যে হারাম ও অর্থহীন কাজ থেকে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বিরত রাখা এবং অনুভূতিকে সাধনায় ব্যস্ত রাখা দরকার। যেমন- জিহ্বার রোজা হল- মিথ্যা, পরনিন্দা ও অশ্লীল কথাবার্তা থেকে বিরত রাখা। একই সাথে কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির, তাসবীহ ও দরুদ-ইসতিগফারের মাধ্যমে জিহ্বাকে সদা ব্যস্ত রাখা। চোখের রোজা হল- খারাপ কিছু দেখা থেকে বিরত রেখে শিক্ষণীয় বিষয়গুলোতে দৃষ্টি নিবন্ধন করা। কানের রোজা হল- অশ্লীল কিছু শ্রবণ থেকে বিরত রেখে কুরআন ও সত্যকে শ্রবণ করানো।
আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন
রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের নাফস এক প্রকার সংযমে অভ্যস্ত হয়, অল্পতে তুষ্ট থেকে যিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধিতে ব্যস্ত থাকে এবং আনুগত্যের শিক্ষা লাভ করে। ফলে রোজাদার ধৈর্যধারণ ও সহনশীলতা অর্জনের ক্ষমতা লাভ করে। এজন্যেই ক্ষুধার তাড়নায় পেটের কান্না সত্ত্বেও রোজাদারদের মাঝে আনন্দের নিষ্পাপ হাসি ফুঁটে উঠে। আত্ম সংযম, আত্ম নিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে রোজা অনিবার্য ও অপরিহার্য ইবাদত। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতি ও সাম্য সৃষ্টিতে, নৈতিক ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধানে রোজার ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রেমময় সমাজ গড়ার অনুশীলন
আসুন আমরা রোজার প্রকৃত শিক্ষাকে নিজেদের বাস্তব জীবনে অনুশীলন করি। বিপদগ্রস্তকে সহায়তা করি, দু:খীদের পাশে দাঁড়াই, বঞ্চিত ও নির্যাজতিতদের মুখে হাসি ফুঁটাতে সচেষ্ট হই, নিজে ভোগের চেয়ে পরের জন্যে ত্যাগ স্বীকারকে গুরুত্ব দেই। নিজে সংযমী হই এবং পরের প্রতি উদারতা ও সহমর্মীতা পোষণ করি। সকল সংকীর্ণতা ও নীঁচুতার উর্ধ্বে ওঠে শান্তিময় আবাসের নিশ্চয়তা বিধানে সচেষ্ট হই। প্রেমময় সমাজ ও মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলি।