রুচির সমাজতত্ত্ব ও রুচিশীলের মনস্তত্ত্ব

কোনো সমাজের মানুষের আচার-আচরণ, পোশাক, ব্যবহার, অনুষ্ঠানাদি ইত্যাদিই সমাজের রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বেঁচে থাকার জন্য বা টিকে থাকার তাড়নায় সামগ্রিক কনশাসনেস বা চেতনা আসে। রুচির ক্ষেত্রে আকাঙ্খা গুরুত্বপূর্ণ। কী ধরনের রুচি কে অর্জন করবে সেক্ষেত্রে প্রভাবিত করে সমাজ-সংস্কৃতি ও যেসব মানুষের সাথে তার মেলামেশা-ওঠাবসা।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

রুচি নির্ধারন করে কে?

কখনো রুচি নির্ধারন করে দেয় ধর্ম, কখনো রুচি নির্ধারন করে দেয় শিক্ষা, কখনো রুচি নির্ধারন করে দেয় পারিবারিক ঐতিহ্য ও চর্চা। রুচির নিয়ন্ত্রণ যে সব সময় ব্যক্তির কাছে থাকে তা কিন্তু নয়; কখনো সিনেমা-নাটক-উপন্যাসের কোনো ক্যারেক্টারের মতো হতে চাওয়া, কখনো ইতিহাসের কোনো নায়োকোচিত ইমেজ মনে-কল্পনায় ধারণ করে তাকে অনুসরণ করার কাজ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় চলতে থাকে।

আকাঙ্খিত রুচি

বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশনা-উপস্থাপনার মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতা-পাঠকদের মধ্যে সৌন্দর্য-স্মার্টনেট-প্রয়োজনীয়তার ধারণা পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। যেভাবে আকাঙ্খা তৈরী করা হচ্ছে, তা তাকে স্বাধীন চিন্তা থেকে বিরত রাখছে এবং কনটেন্টের সাথে সংশ্লিষ্টদের আকাঙ্খিত রুচি তৈরীতে ভূমিকা রাখছে।

সমাজের রুচির মানদন্ড

যে জিনিস বা আচরণ নিম্নরুচির তা অসুন্দর, যা উচ্চরুচির তা উচ্চমানের সৌন্দর্যময়। সমাজের চোখে রুচিশীল মানে সমাজের চোখে ভালো-সুন্দর-গ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত, যা অসুন্দর-অরুচিকর বা নিম্নরুচির নয়। রুচি ব্যাক্তিভেদে আপেক্ষিকতা প্রদর্শন করলেও সমাজের সামগ্রিক রুচির অলিখিত-প্রচলিত মানদন্ড থাকে।

রুচি তৈরী ও নিয়ন্ত্রিত হয়

যেসব সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর মধ্যে রুচি তৈরী ও নিয়ন্ত্রিত হয়, সেক্ষেত্রে মিডিয়া-সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কনটেন্টের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলে যারা নিয়ন্ত্রক তারা যদি স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব ব্যবহার করে তখন তাদের প্রত্যাশিত রুচির দিকে অন্যদেরকে নিয়ে যায়। রুচি বদলাতে উত্তম বিকল্প দিতে হবে। মুনাফার প্রয়োজনে রুচি তৈরী এবং তা ব্যবহার করলে সমাজের অনেক ক্ষতিও হতে পারে।

গরীবের রুচিবোধ  ও রুচির ভালো-মন্দ

যে ধনী বিশ্বাস করবে গরীবের রুচি নাই আর যে ধনী বিশ্বাস করবে গরীবের রুচিবোধ আছে; গরীবদের ব্যাপারে দুজনের বিপরীত ধারণা আচরণেও প্রভাব ফেলবে! যে শিক্ষিত মনে করবে অশিক্ষিত মাত্রেই নিম্নরুচীর, আর যে শিক্ষিত মনে করবে অশিক্ষিতরও রুচি আছে- দুজনই একইভাবে অশিক্ষিতদের সাথে ব্যবহার করবে না। দিনমজুরের রুচিও ফিল্মের নায়কের রুচির চেয়ে ভালো হতে পারে।

ভিন্ন রুচিতে ভিন্ন  চিন্তা-কর্ম

একজনের রুচি নিয়ন্ত্রণে টেলিভিশন ভূমিকা রাখছে, আরেকজনের রুচি নিয়ন্ত্রণে উন্নততর প্রোগ্রামগুলো বা তার চোখে আইকন এমন ব্যক্তিত্বরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। দুজনের কিছু কমন মিল থাকবে, আবার কিছু অমিলও থাকবে। যার আদর্শ হযরত মুহাম্মদ সা. আর যার আদর্শ মাইকেল জ্যাকসন দুজনের চিন্তা-কর্ম একইরকম হবে না।

রুচির অধঃপতন ও  বিকৃত রুচি

কখনো কখনো সামাজিক রুচি উন্নত হয়, কখনো কখনো সামাজিক রুচির অধঃপতনও ঘটে। রুচির অধঃপতন সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। কেউ বিকৃত রুচির হলে সে মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে, এত কুৎসিৎ মনের হতে পারে, এত কদর্য কাজ করতে পারে; যার নির্লজ্জতা-অমানবিকতা-পাশবিকতা-রুচিহীনতা অন্যদেরকে বিস্মিত-অবাক করে।

রুচির স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড

যখন রুচি নিয়ে এত বিতর্ক-আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখন প্রশ্ন ওঠতেই পারে- ভালো রুচির স্ট্যান্ডার্ড কে নির্ধারণ করেন? অধিকাংশের রুচি হলেই তা ভালো রুচির মানদণ্ড হতে পারে কী? কোনো স্ট্যান্ডার্ড বা সাধারণীকরণ দিয়ে উত্তম রুচি খুঁজে বের করা সম্ভব কী?

 রুচি বিচারের ক্ষমতা অধিকার দায়িত্ব

কোনো বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠী বা অধিকাংশের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিই কী সবসময় সঠিক? শিল্পবিচারের বৈধতা কী কোনো বিশেষ শ্রেণির কাছেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নিজের পছন্দ দিয়ে অন্যের রুচি বিচার করার ক্ষমতা বা অধিকার বা দায়িত্ব কে কাকে দিয়েছে?

বৈধ রুচি ও সার্বজনীন রুচিবোধ

কেউ কেউ মনে করেন- এলিট শ্রেণীর রুচিই হচ্ছে সমাজের বৈধ রুচি; অথচ এক শ্রেণীর রুচি সকল শ্রেণীর জন্য বৈধ রুচি হতে পারে কী? এমন সার্বজনীন রুচিবোধ কী কী আছে যা নিয়ে সার্বজনীন ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত?

রুচির সাথে সম্পর্ক

মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, মানবিক-নৈতিক অবস্থান, জীবনযাত্রার মান-মর্যাদা, চিন্তা-কর্মের গতিশীলতার সাথে রুচির সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাগুলি থেকেই সামাজিক রুচির ধারণাকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।

রুচির বৈচিত্র্যতা

কাজকর্মের মাধ্যমে প্রকাশিত রুচিকে জানা না গেলে বা অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিতিদের ভূমিকা বুঝতে না পারলে বা বিভিন্ন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন রকম রুচি দেখতে না পারলে সমাজে বিভিন্ন সোশ্যাল ক্লাসের রুচির বৈচিত্র্যকে অনুধাবন করা যাবে না।

রুচির বদল

আমরা সাধারণত রুচি বলতে উত্তম রুচিকে বুঝি আর খারাপ রুচি বলতে গ্রহণযোগ্য মান থেকে অবনতি বুঝি। খাদ্যাভাসে ভাজা-পোড়া থাকলে কারো কাছে তা অরুচিকর, দৈনিক ফার্স্টফুড-জাঙ্কফুড-রীচফুড খাওয়া কারো কাছে অরুচিকর। রুচি বারবার বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়, সময়ে-অসময়ে বদলায়।

রুচির গ্রহণযোগ্যতা

কারো কাছে ঢিলেঢালা ডিজাইনের পোশাক বেশি রুচিসম্পন্ন, কারো কাছে আটোসাটো-পাতলা পোশাক বেশি রুচিসম্পন্ন! কারো কাছে বোরকা-হিজাব নতুন ট্রেন্ড, কারো কাছে বাতিল ট্রেন্ড। যার যা ভালো লাগে, যার যা পছন্দ- তার কাছে তাই রুচিসম্পন্ন মনে হলেও প্রকৃত অর্থে রুচির ব্যাপারটি কালচারালি-সোস্যালি গ্রহণযোগ্য হতে হবে!

রুচির সীমানা

ব্যক্তির পছন্দ বা বাছাই গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা নৈতিকতা-সামাজিকতা-মানবিকতা-আইনের সীমানা কখনোই অতিক্রম করে যেতে পারবে না। খাবার সুস্বাদু হলেও তাতে শূকরের মাংস ব্যবহৃত হলে মুসলমানদের কাছে রুচির হবে না। নগ্নতা-অশ্লীলতা-বিকিনি পাশ্চাত্য সমাজে যে মাত্রায় গ্রহণযোগ্য প্রাচ্যে সেই মাত্রাকেও একইভাবে দেখা হবে না।

রুচির প্রকাশ

সমাজে রুচি প্রকাশ পায় বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে। কেউ পানীয় হিসেবে মদ খেলে, আর কেউ ডাবের পানি খেলে- দুটো একই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। আমেরিকায় যেটি ফ্যাশন, সৌদি আরবে সেটি অপরাধ বলেও বিবেচিত হতে পারে। একসময় যা নিষিদ্ধ থাকে আরেকসময় তা বৈধও হয়ে যায়। ফলে স্থান-কাল-পাত্রভেদে রুচির ধরন বদলায়, রূপ বদলায়, ধারণা বদলায়।

পাত্রভেদে রুচি

যে সঙ্গীত একজন শিশুর মুখে শোনতে বেমানান, তাই আরেকজন বয়স্কের মুখে মানানসই মনে হয়। এক গোষ্ঠীর মধ্যে যা আন্তরিকতা-আতিথেয়তা হিসেবে পরিগণিত, আরেক সমাজে তা বেয়াদবি বা শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ বলে চিহ্নিত! এক জাতির মধ্যে যে পণ্য জনপ্রিয়, আরেক জাতির বাজারে তা নিষিদ্ধ। যেই ধরনের শিল্পকর্ম এক ধর্মের অনুসারীদের কাছে সমাদৃত হবে, তাই হয়তো আরেক ধর্মের অনুসারীদের কাছে নিন্দিত হবে।

রুচির বাইরে বা রুচি পরিপন্থী

কখনো রুচিকে প্রভাবিত করছে ধর্ম, কখনো রুচিকে প্রভাবিত করছে প্রচলিত রীতি-নীতি। কিন্তু যে ধর্ম মানে না, সামাজিক নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না তার কাছে রুচি নির্ধারণের তেমন কোনো সূচক-নির্ধারক নেই। ফলে সে ভাবে সে যা করছে তাই রুচিসম্মত, আর তার অপছন্দ অথচ অন্যরা করছে সবই রুচির বাইরে বা রুচি পরিপন্থী।

রুচি নির্মাণ-বিনির্মাণ

রুচি নির্মাণ-বিনির্মাণ, রুচির বিচার তৈরি, রুচির উদ্ভব, রুচির সাথে সংঘাত-বন্ধুত্বের ব্যাপারটিকে শিকড় থেকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। সংশ্লিষ্টদের আদর্শ-বিশ্বাস-চর্চা ও অতীত অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অর্থ-উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে হবে।

রুচিবোধের পরিবর্তন পরিবর্ধন

সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে নতুন রুচি গড়ে ওঠে, বিদ্যমান বা পুরাতন রুচিবোধের পরিবর্তন-পরিবর্ধনও হয়। আজ যে টেলিভিশন-কম্পিউটারকে শয়তানের বাক্স বলছে, কাল প্রয়োজনে তা গ্রহণ করছে বা ব্যবহার করছে।

এলিট ও নন এলিট

যে দস্তরখানা বিছিয়ে পাটিতে বসে খাওয়াকে একসময় সুন্নাত বলে চর্চা করতো, তারও কনজিউমার চয়েসগুলিতে পরিবর্তন আসার পর সোফা-ডাইনিং টেবিল এর ভোক্তা হচ্ছে। অট্টালিকায় থাকা ধনীক শ্রেণি বস্তিবাসীকে যা মনে করে, বস্তিবাসী নিজেদেরকে তা মনে করে না। আবার বস্তিবাসী এলিট শ্রেণিকে যেভাবে মূল্যায়ন করে, এলিট শ্রেণি নিজেদেরকে সেভাবে ভাবেও না দেখেও না!

রুচিতে পার্থক্যের দেয়াল

শিক্ষিত সমাজ, ভদ্র সমাজ, সভ্য সমাজ- বলে পার্থক্যের দেয়াল একদিনে তৈরি হয়নি। শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে যা কিছুকে সুন্দর লাগে, মালিকের দৃষ্টিকোণ থেকে তা অসুন্দর লাগতেও পারে! বাড়িওয়ালার জন্য যা ভালো, ভাড়াটিয়ার জন্য তা খারাপও হতে পারে! সেবাগ্রহীতার কাছে যা মূল্যবান, সেবাদাতার কাছে তা মূল্যহীনও মনে হতে পারে!

রুচি সম্পন্ন বা রুচিহীনতা

ফলে শুধুমাত্র একজনের ভালোলাগা-মন্দলাগা বা পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে রুচি সম্পন্ন বা রুচি সম্পন্ন নয় এমন জাজ করা রুচিহীনতারই নামান্তর! সামগ্রিক বা সার্বিক দিককে বিবেচনায় নিতে হবে! ব্যক্তি পর্যায়ের বোধ-বিবেচনা যেমন ব্যক্তির রুচিকে স্পষ্ট করবে, গোষ্ঠীর মানুষ একটি ব্যাপারকে কিভাবে জাজ করছে তা দেখে বোঝা যাবে সেই গোষ্ঠীর রুচি।

রুচি ও ভোগ

রুচি ও ভোগ এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রুচি ভোক্তাদের পছন্দকে প্রভাবিত করে, চাহিদা তৈরি করে। নতুন কেনা বিখ্যাত ব্রান্ডের নয়া মডেলের দামি গাড়ি দেখে বলে আপনার রুচি আছে। সাপ্লাই বাড়ানোর মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভোগের জাগিদা বাড়িয়ে টেস্ট-রুচির সৃষ্টি করা হয়। একটি অপ্রয়োজনীয়-অদরকারী-অনাবশ্যক পণ্যকেও প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত করা হয় রুচি পাল্টানোর মাধ্যমে।

রুচির তারতম্য ও রুচি নিয়ে কটাক্ষ

একজনের কাছে যা খারাপ রুচির লক্ষণ, আরেকজনের কাছে তা ভালো রুচির লক্ষণ। এখন কে কোন রুচিকে দমনে কাজ করবে বা কে কোন রুচির উত্থানে কাজ করবে? সাধারণত সামাজিক শ্রেণীভেদে রুচির তারতম্য হয়, তবে সংকট-সমস্যা বাধে তখন যখন এক শ্রেণীর দ্বারা আরেক শ্রেণীর রুচি কটাক্ষের শিকার হয়; নিম্ন মর্যাদার মানুষের রুচি ও উচ্চ মর্যাদার মানুষের রুচি বলে আলাদা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়।

শ্রেণীভেদে রুচি

উচ্চবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তরা সবার চেয়ে সেরা ভাবতে পারে, কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা নিম্নবিত্ত শ্রেণীসেভাবে নাও ভাবতে পারে। শ্রেণী-ভিত্তিক রুচির ধারণা যথার্থ নয়, কারণ কিছু পছন্দ একই শ্রেণীর সবার পক্ষে সমানভাবে সম্ভব নয়। খারাপ রুচি নরমাল সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পড়ে না; একেক সমাজে, একেক সময়ে একেক রকম হয়।

রুচি আছে  রুচি নেই

কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান হলে রুচির দুর্ভিক্ষ আসবেই। যার রুচি নেই সে যে সেক্টরেই থাকবে সেই সেক্টরই নষ্ট হবে। যার রুচি আছে সে গালিগালাজ করে না, অপরাধ করে না, অন্যকে অযথা ধিক্কার দেন না, শালীনতা বজায় রেখে রুচিসম্মত ও আরামদায়ক পোশাক পরেন এবং স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস গড়ে তোলেন।

মানুষের রুচি ও সমাজের রুচি

শিশু রুচি সাথে নিয়ে জন্মে না, সমাজে বড় হতে হতে সে রুচি অর্জন করে; তাই মানুষের রুচি আসলে সমাজের রুচি। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নাগরিক হিসেবে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে, কারো মানবীয় মান-মর্যাদাকে আঘাত-ক্ষুন্ন করার অধিকার কারো নেই।

জনগণের রুচি ও রুচির খরা

রুচির দীনতা ও রুচির খরা নিয়ে যারা বলেন রুচির উন্নয়নে ব্যর্থতার জন্য তাদের রুচিবোধ নিয়েও কথা ওঠতে পারে। কারণ রুচির দুর্ভিক্ষ মানে- অন্যের রুচিকে অসম্মান করা, নিজের ভাবনা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া, অশিক্ষিত-গরিব-দরিদ্রদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা, সাধারণ জনগণের রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলা।

রুচির অপ্রমাণিত শ্রেষ্ঠত্ব

নিজের রুচির অপ্রমাণিত শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা নিম্নরুচির বহিঃপ্রকাশ; যা বিবেচনাবোধের দুর্ভিক্ষ বা বিবেকহীনতার জয়জয়কার বলা যেতে পারে। রুচির মানদন্ড না থাকায় শ্রেণীর মানদণ্ডেই যেন সবকিছুর বিচার-বিবেচনা চলছে।

কালের বিবর্তনে  রুচির পরিবর্তন

কালের বিবর্তনে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়। দর্শকের রুচি যেমন বদলে যায়; তেমনি কনটেন্ট নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্টদের রুচিরও বদল হয়। পাঠকের রুচি যেমন পাল্টে যায়; লেখকের রুচিরও তেমন পরিবর্তন ঘটে। শ্রোতাদের রুচি যেমন পাল্টে যায়; বক্তাদের রুচিরও অনেক পরিবর্তন ঘটে।

বয়স ও অঞ্চলভেদে ভিন্নতর রুচি

একই বয়সী মানুষদের রুচিও ভিন্নতর হয়। একই অঞ্চলের মানুষের রুচিও ভিন্নতর হয়। একই শ্রেণির মানুষদের রুচিও নিজ নিজ পছন্দ-ভালোলাগার ওপর ওপর নির্ভর করে। অবশ্য একই পরিচয়ে পরিচিতদের মধ্যে কমন কিছু মিলও খুঁজে পাওয়া যায়!

রুচি তৈরি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা

রুচি তৈরির একচ্ছত্র ক্ষমতা যেমন কারো নেই, তেমনি অন্যদের রুচি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও কারো নেই। যেহেতু শ্রেণি ভিন্নতা আছে, অবস্থানগত ভিন্নতা আছে, দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতা আছে; সেহেতু কিছু মানুষের রুচির মিল পাওয়া গেলেও সবার রুচি একই ধরনের হবে- এমনটি চিন্তা করাও যৌক্তিক নয়।

রুচির ভিন্নতায় বহুবিধ বাস্তবতা

আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জীবনযাপন প্রণালী- এসবে ভিন্নতা যেমন বাস্তবতা; রুচির ভিন্নতাও তেমন বাস্তবতা! কেউ অবসরে চোখ রাখবে বইয়ের পাতায়, কেউ চোখ রাখবে স্মার্টফোনে, কেউ ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে, কেউ টেলিভিশনের পর্দায়!

সময় কাটাতে কেউ যাবে সিনেপ্লেক্স, কেউ যাবে সিনেমা হলে, কেউ যাবে ক্লাবে, কেউ যাবে গ্রামে, কেউ যাবে বিদেশে! যারা ঘুরতে বিদেশে যাবেন তাদেরও কারো পছন্দ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, কারো ইউরোপের কোনো দেশ, কারো আমেরিকা, কারো এশিয়ার কোনো দেশ!

একই গ্রন্থাগারে বসেও একেকজন ভিন্ন বই হাতে নিবে; কেউ নিবে গল্পের বই, কেউ নিবে উপন্যাস, কেউ নিবে কবিতার বই, কেউ নিবে প্রবন্ধের বই। সবাই এক ধরনের বই পছন্দ করবে না, একই লেখকের লেখা সবার ভালো লাগবে না- এটাই স্বাভাবিক। অনেকে পড়ে-দেখে-শোনে নিছক সময় কাটাতে, অনেকে জ্ঞান অর্জন করতে, অনেকে বিনোদন পেয়ে বিনোদিত হতে, অনেকে পরীক্ষার বৈতরণী পাড় হতে! ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকলে আচরণে-কর্মে ভিন্নতা থাকবেই!

 ভালোলাগায় রুচিগত ভিন্নতা

একই শপিংমলে একই দোকানেও ক্রেতা ভিন্ন কালারের ভিন্ন ব্রান্ডের ভিন্ন ধরনের কাপড় বাছাই করবে! রেস্টুরেন্ট বাছাইয়ে, খাবারের মেন্যু বাছাইয়ে, ঘুরাঘুরির জন্য পর্যটন স্পট বাছাইয়েও- সবার ভালোলাগা এক হবে না। যানবাহন বাছাইয়েও সবার ভালোলাগা একরকম নয়! এসব রুচিগত ভিন্নতা থাকবেই।

নষ্ট রুচি বা রুচিহীনতা

যদি কখনো কুরুচি বা বিকৃত রুচি দেখা যায়- তা অগ্রহণযোগ্য হবে! নষ্ট রুচি বা রুচিহীনতা যাই বলি তা যদি খারাপ হয়- সেটা যে শ্রেণি বা পেশার মানুষই করুক না কেন তা সমাদৃত হবে না! হতদরিদ্র বা ধনী, এলিট বা দিনমজুর- বিনোদন সবাই উপভোগ করবে নিজ নিজ রুচি ও সামর্থ্যের আলোকে।

রুচির অমিল

কেউ নজরুল সংগীত পছন্দ করবে, কেউ রবীন্দ্র সংগীত পছন্দ করবে! কেউ ওয়াজ মাহফিলকে অপছন্দ করবে, কেউ কনসার্টকে অপছন্দ করবে! কারো কাছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে সাহিত্য পাঠ অনাবশ্যক। কারো সাংস্কৃতিক বিনোদনের মাধ্যম শুধুই চলচ্চিত্র ও ক্যাবল টিভি। সবার রুচি একজায়গায় কখনোই মিলবে না, একরকম হওয়ার আশা করাটাও সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তা হবে না।

রুচির সামর্থ্য ও সুযোগ

মানুষের রুচির পরিবর্তনের সাথে সামর্থ্য ও সুযোগের সম্পর্কও তীব্র। একসময় যে কাজ করতে একজনের রুচিতে বাধছে সেই মানুষটিই সময়ের ব্যবধানে দেদারছে সেই কাজ করছেন। শ্রেণি পরিবর্তনের পর অনেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি, চাল-চলন, বলন-বসন, বোধ-বিবেচনা পাল্টে যায়!

রুচির পরিবর্তনে উপকরণ বদল

রুচিরও ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে উপকরণ বদলে যায়, প্রয়োজন বদলে যায়, সুস্থতা-স্বাভাবিকতার ধারণাও বদলে যায়। যখন বিজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে, অশ্লীল চলচ্চিত্র-সিরিয়াল উপভোগ করে; তখন অপসংস্কৃতির প্রভাবে শালীনতার স্বাভাবিক বোধ ভোঁতা হতে থাকে।

অপসংস্কৃতিতে বিপদগামী রুচি

অশালীন-বিকৃত স্থূল অপসংস্কৃতি রুচিকে বিপদগামী করে, বিপথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে; তাই এটিকে ঠেকাতে হবে। জনসচেতনতা এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে জোয়ারের স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে না গিয়ে সচেতনভাবে গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান সম্ভব হয়। দেশ-কাল ও সমাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু বাঁধাহীনভাবে গ্রহণ করা যাবে না।

বিকশিত ও পরিশোধিত রুচি

ব্যক্তির রুচি বোঝা যায়- তার পোশাকে, তার কাজে, তার কথায়, তার লেখায়, তার ব্যবহারে। মানুষের রুচি বিকশিত ও পরিশোধিত হলে সে খারাপ হয় না; জঘন্য অপরাধ করা কোনো দিন তার ধ্যানেও আসে না। সত্যিকারের মানুষ মাত্রই আশরাফুল মখলুকাত; যার মার্জিত কৃষ্টিকালচার থাকে।

রুচির পরিচয়

দেশের বাইরে টাকা পাচার করা, ঋণখেলাপি হওয়া- কোনো রুচির মধ্যেই পরে না। একটি রাজনৈতিক দল আরেকটি রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করার সময় রুচির পরিচয় দিতে পারে না। একদল আলেম আরেকদল আলেমের বিষেদাগার করার সময় রুচি ঠিক রাখতে পারে না।

রুচির দীনতা থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ

রুচির দুর্ভিক্ষতো সর্বক্ষেত্রে। রুচি সম্পন্ন কেউ- রাতের আধারে ভোট করতে পারে না, আত্মসমালোচনা না করে পরের সমালোচনা করতে পারে না, নিজের দায়িত্ব পালন না করে অন্যকে দায়ী করে আক্রমণ করতে পারে না। কার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে আর কার রুচি ঠিক আছে- তা নিয়ে বলার অধিকার কার রয়েছে! দুর্বল কেউ অন্যের রুচি নষ্ট করতে এলে সবলরা তা ঠেকাতে চান! কিন্তু সবল কেউ অন্যের রুচি নষ্ট করলে দুর্বলরা কী তা ঠেকানোর সাহস রাখেন!

পরিবর্তিত রুচি

যিনি লেখাপড়া জানেন কিন্তু ঘুষ খান তিনিও কারো বিবেচনায় রুচিহীন। যোগ্য যার মানুষকে ঠকানোর-প্রতারণার স্বভাব আছে; তার সেই ধান্ধাবাজি কয়জনের রুচিতে বাধে! ক্লাবে বসে মদ খাওয়া কারো কাছে রুচির কাজ হলেও কারো কাছে অরুচিকর হতেই পারে! নাইট ক্লাব, পরকিয়া, লিভটুগেদার ও পর্নোগ্রাফিকে মেনে নেয়ার মতো পরিবর্তিত রুচি আরেকজনের কাছে রুচিহীন হতেই পারে।

প্রকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষদের দায়িত্ব

একজন আরেকজনের রুচিকে বিচার-বিবেচনা করে সেরা-শ্রেয় রায় দেয়ার অধিকার-বৈধতা না পেলেও মতামত জানাতেই পারে! একজন ধনাঢ্য বলে তার বিরক্তিকর গানকেও রুচি সম্পন্ন বলতে হবে, আরেকজন গরিব বলে তার শ্রেণিতে বিনোদিত হবার নাটক বানানোকে অরুচিকর বলতে হবে- এমনটি ঠিক নয়। রুচি নষ্ট করছে বলে না চিল্লিয়ে রুচি ভালোর দিকে চেঞ্জ করায় ভূমিকা রাখাই হবে প্রকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষদের নৈতিক-সামাজিক দায়িত্ব।

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *