অনেক কিছুই বদলে যায়, বদলে না আব্বা-মায়ের ভালোবাসা। অনেক অনেক ভালোবাসি তোমাদের দু’জনকেই। ভালো থেকো আব্বা, ভালো থেকো মা; দূরে কিংবা কাছে সবসময়।
দাদার মৃত্যুর পর নিজের ছোট তিন ভাই, দুই বোন ও মায়ের সংসারের হাল খুব ছোটবেলাতেই ধরেছিলেন আমার আব্বা। ক্লাশের মেধাবী ছাত্র হয়েও চতুর্থ শ্রেণিতেই বন্ধ হয়েছিল শিক্ষাজীবন।
খেলায় আনন্দে মেতে থাকার বয়সেই গরু ও লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করতে হয়েছে। জীবন কী তা বুঝার আগেই সংসারের দায়িত্ব নিয়ে জীবিকার জন্য কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে।
পরিবারের ভরণপোষণ মেটাতে আদাবাড়িতে এবং ঢাকার কারওয়ান বাজারে সামান্য মাইনেতে মুদি দোকানে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছেন। মা ও ভাই-বোনের মুখে আহার তুলে দেয়ার মানবিক চেতনাবোধ ও আন্তরিক সহমর্মিতার কারণে আনন্দহীনভাবে কেটেছে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য।
বিয়ের পর পাথরঘাটা-কামালিয়া চালা-চাকদহ-রাজবাড়ি-নাকশালা-করটিয়ায় এক হাট থেকে আরেক হাটে কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। পায়ে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। রাতে ডাকাতের কবলে পড়েছেন, বৃষ্টিতে ভিজেছেন, ঝরেছে ঘাম, ভেজা কাপড় শুকিয়েছে শরীরেই।
বছরের পর বছর সন্তানদের পড়ালেখা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাটিয়েছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। প্রথম প্রবাস জীবন শুরু করাটা মোটেও মসৃণ ছিল না। থাকার ঘর থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও বিক্রি করতে হয়েছিল।
সদা কর্মব্যস্ত ও পরিশ্রমী মানুষটি সারা দিন রোদে পোড়া খাঁটুনির পরও ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
সম্ভবত পৃথিবীর সব বাবারাই সন্তানকে এগিয়ে যেতে দেখেই সুখী হন, সন্তানের মুখে হাসি দেখেই তৃপ্ত হন; সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকারের মাঝেই আনন্দ খুঁজে পান।
আর ঘরে ছনের ছাউনি, মাটির বেড়া, সময়মত নতুন ছন লাগাতে না পারায় ঘরের ভেতরে বৃষ্টির পানি; তবু কেরোসিনে জ্বালানো হারিকেন আর কুপির নিভু নিভু আলোতেই সন্তানদের লেখাপড়া করায়েছেন মা।
সলতেটা ঠিক করা, কালো চিমনিটা পরিষ্কার করা, কেরোসিন মজুত আছে কিনা তা নিয়ে মাকে ভাবতে হয়েছে। মা কখনো কোনো সৌখিনতা করেননি, সংসারের প্রয়োজনে নিজের গহনাও হাসিমুখে বিক্রি করেছেন।
সন্তানদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে হাস-মুরগি-গরু পালন, ফলের গাছ লাগানো ও শাক-সবজি নিজে চাষ করেছেন। নিদারুণ সংকটের মধ্যেও সন্তানদের জন্য দুধ-ডিম-মাছের ব্যবস্থা করেছেন।
আব্বা বিদেশে থাকা অবস্থায় ধান মাড়াই, ধানের মলন দেয়া, খড়ের পালা দেয়া কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ নিয়েও চিন্তা করতে হয়েছে মাকে। মাকে সাহায্য করার মতো বড় হবার পর আমাকে পড়ালেখার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছেন।
৮-১২ টাকা কেজি দুধ কিংবা ৬-৮ টাকা হালি ডিম নিয়ে যাকে ভাবতে দেখতাম তিনিই মাসে কয়েক হাজার টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।
আজো বিদায় বেলায় মায়ের চোখের অশ্রু দেখি, নিজে বাবা হবার পরও আমাকে নিয়ে মায়ের উদ্বেগে পরিবর্তন দেখি না। ঠিকমতো খেয়ে নিও, শরীরের প্রতি খেয়াল রেখো ইত্যাদি।
চার বছরের মেয়েকে নিয়ে আমার যে উদ্বেগ আর আমাকে নিয়ে এখনো মায়ের যে উদ্বেগ তাতে তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না।
যেভাবে সবার প্রতি খেয়াল রেখেছেন, মায়ের প্রতি তেমনভাবে খেয়াল রাখতে পারিনি কখনোই। এভাবেই এগিয়ে থাকেন মায়েরাই, ত্যাগ স্বীকার
করেন মায়েরাই; আর ঋণী করেন সবাইকে।