শিশুরা পৃথিবী নামক উদ্যানের সুরভিত পুষ্প; পুষ্পসদৃশ সুন্দর সম্ভাবনাময় মানবকলি। সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠলে তারা নিজেদের সৌরভে বিমোহিত করে তুলে পৃথিবী। সংসার জীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ আবর্তিত হয় শিশুকে কেন্দ্র করে। মানবকাননের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও সুরভিত পুষ্প হচ্ছে শিশু।
পিতার মৌলিক দায়িত্ব
সন্তানের প্রতি পিতার মৌলিক দায়িত্বগুলো হলো- সন্তানকে একজন দ্বীনদার, আদর্শ মা উপহার দেওয়া। জন্মের সপ্তম দিনে তার মাথার চুল মুণ্ডিয়ে ফেলা। সপ্তম দিনে সন্তানের সুন্দর, অর্থবহ ইসলামি নাম রাখা। সন্তানকে ইসলাম ধর্মের মৌলিক জ্ঞান প্রদান করা। বিয়ের বয়স হলে উপযুক্ত তার বিয়ের ব্যবস্থা করা।
প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল; তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে।
নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের তথা তার সম্পদ ও সন্তানের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে।’ (বুখারী:৭১৩৮; তিরমিযী : ১৭০৫)
আগুন হতে বাঁচা ও বাঁচানো
কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (তাহরীম : ০৬)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আলী (রা.) বলেন, ‘অর্থাৎ, তাদেরকে আদব শিক্ষা দাও এবং ইলম শেখাও।’ (তাফসীর ইবন কাসীর, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
নৈতিক শিক্ষাদান
বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় তথা নৈতিক শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে তাদেরকে নামাজের নির্দেশ দাও, তাদের বয়স দশ বছর হলে এ জন্য তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরের বিছানা পৃথক করে দাও।’ (আবূ দাউদ: ৪৯৫; মুসনাদ আহমদ: ৬৬৮৯)
সন্তান পিতা-মাতার কাছে আমানত
ইমাম গাজালী রহ. বলেন, ‘জেনে রাখ, শিশু প্রতিপালন পদ্ধতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর সন্তান তার পিতা-মাতার কাছে আমানত স্বরূপ। তার পবিত্র অন্তর অমূল্য মাণিক্য, যেকোন নকশা বা ছবি থেকে যা মুক্ত। ফলে তা যেকোন নকশা গ্রহণে প্রস্তুত এবং তাকে যার প্রতিই ধাবিত করা হবে সে দিকেই সে ধাবিত হয়।
তাই তাকে ভালোয় অভ্যস্ত করা হলে, সু-শিক্ষায় প্রতিপালন করলে, সেভাবেই সে গড়ে উঠবে। ইহকালে ও পরকালে সে সুখী হবে। তার নেকীতে তার পিতা-মাতা এবং তার প্রত্যেক শিক্ষক ও শিষ্টাচারদানকারীই অংশীদার হবেন। পক্ষান্তরে তাকে খারাপে অভ্যস্ত করা হলে, তাকে পশুর ন্যায় অবহেলা করা হলে, সে হবে হতভাগ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এর দায় বর্তাবে তার কর্তা ও অভিভাবকের ওপর।’(ইহয়াউ উলুমিদ্দীন:৩/৬২)
ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
নবী সা. বলেছেন, ‘যখন তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হয় তখন তাদের নামাজের প্রশিক্ষণ দাও।’
মহানবী (সা.) বলেন,‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতা-মাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিজি)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘প্রতিটি শিশু (ইসলাম) ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতা-মাতাই তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়।’ (বুখারী :১২৯২; ইবন হিব্বান :১২৯; বাইহাকী :১১৯১৮)
কঠোরতা পরিহার
নবীজির শিক্ষা হলো, কোমলতা অবলম্বন করো। কঠোরতা পরিহার করো। (মুসলিম, হাদিস : ১৭৩২)
ছোটকে স্নেহ, বড়কে শ্রদ্ধা
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন; ‘যে ছোটকে স্নেহ-মমতা করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি)
নারীকেও সম্মান
আল্লাহ বলেছেন, ‘অনেক পুরুষ নারীর সমকক্ষ নয়।’ (মারিয়াম: ৩৬)
সুবিচার প্রতিষ্ঠা
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো, সন্তানদের ভেতর সুবিচার প্রতিষ্ঠা করো।’ (বুখারি: ২৫৮৭)
দোয়া করা
আল্লাহ তা‘আলা সন্তানের জন্য এই দোয়া শিখিয়েছেন; ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’। (ফুরকান : ৭৪)
মিথ্যা না বলা
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.)-এর বর্ণনা, একবার আমার আম্মা কিছু একটা দেবেন বলে আমাকে কাছে ডাকলেন। নবীজি (সা.) তখন আমাদের বাড়িতে বসা ছিলেন। তিনি আমার আম্মাকে বললেন, তুমি কি সত্যিই তাকে কিছু দেবে? আম্মা বললেন, হ্যাঁ! তাকে খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। নবীজি বললেন, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তবে তোমার এ কথাটি মিথ্যা বলে গণ্য হতো। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯১)
সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা
শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমার সন্তানকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল রেখে যাওয়া অনেক ভালো।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭৩৩)
সদ্ব্যবহার করা
মায়ের সন্তান গর্ভধারণ, প্রসব ও বুকের দুধদানের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে পবিত্র কুরআনে সন্তানকে পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে পিতা-মাতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে গর্ভেধারণ করে কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করে কষ্টের সঙ্গে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস।’ (আহকাফ – ১৫)
এক লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে জিজ্ঞাসা করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সর্বোত্তম ব্যবহার কার সাথে করব? তিনি বললেন, “তোমার মায়ের সাথে।” সে বলল, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন, “তোমার মায়ের সাথে।” তারপর লোকটি বলল, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন, “তোমার মায়ের সাথে।” সে বলল, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন, “তোমার পিতার সাথে।” [বুখারী, মুসলিম]
কন্যার কারণে বেহেশত
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘যার গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহন করলো, অতঃপর সে তাকে (কন্যাকে) কষ্টও দেয়নি, তার উপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে প্রাধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, ১:২২৩)
রাসূলুল্লাহ সা. আরো বলেন; ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে অথবা দু’জন কন্যা সন্তান বা বোন আছে। সে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেছে। তার জন্য রয়েছে জান্নাত।’ (জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৬)
আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মনঃকষ্টে তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে; তার কারণে তারা নিজ সম্প্রদায়ের লোক থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে, এই সন্তান রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট। (নাহল: ৫৮-৫৯)
রাগান্বিত অবস্থায় শাস্তি নয়
হজরত থানভি (রহ.) বলেন, ‘রাগান্বিত অবস্থায় কখনো শিশুকে প্রহার করবে না। শাস্তির প্রয়োজন হলে রাগ প্রশমিত হওয়ার পর চিন্তাভাবনা করে শাস্তি দেবে।
বান্দার হক নষ্ট না করা
মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলতেন, অন্যান্য গুনাহ তো তাওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের ওপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তাওবার দ্বারা মাফ হয় না। আগে যার হক নষ্ট করা হয়েছে, তার কাছে মাফ চাইতে হয়। শিশুর কাছ থেকে মাফ পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ নাবালেগের ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি শিশু যদি মুখে বলেও যে আমি মাফ করলাম, তবু তা গ্রহণযোগ্য নয়।
চোখে মুহাম্মদি সুরমা
মহাকবি আল্লামা ইকবাল বলতেন যে বিলাত থেকে ফেরত আসার পরও যখন আল্লাহকে ভুলিনি, তখন আশা করা যায় আর ভুলব না। যখন লোকেরা বলত, ইকবাল! বিলাতের ওই চাকচিক্য দেখেও তুমি কী করে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে পারলে? উত্তরে বলতেন, সেই ছোটকালে আমার মা আমার চোখে যে মুহাম্মদি সুরমা-ইসলামী শিক্ষা লাগিয়ে দিয়েছেন, তার বরকতে এত কিছু সত্ত্বেও আমি আল্লাহকে ভুলিনি।
ছেলেকে লোকমানের উপদেশ
প্রথম উপদেশ
হজরত লোকমান তার ছেলেকে বলেন, হে প্রিয় পুত্র, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না। নিশ্চয় শিরক হচ্ছে বড় জুলুম। (সুরা লোকমান, আয়াত ১৩)। হে পুত্র, সালাত কায়েম করো। (সুরা লোকমান, আয়াত ১৭)।
দ্বিতীয় উপদেশ
মহান আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে [সদাচরণের] নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে, তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন-তো আমার কাছেই।” [সূরা লোকমান: ১৪]
তৃতীয় উপদেশ
“আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না। এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে করবে সদ্ভাবে। আর আমার অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।” [সূরা লোকমান: ১৫]
রাসূল সা. বলেন, “আল্লাহর নাফরমানিতে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলবে না। আনুগত্য-তো হবে একমাত্র ভালো কাজে।”
চতুর্থ উপদেশ
লোকমান হাকিম তার ছেলেকে কোন প্রকার অন্যায় অপরাধ করতে নিষেধ করেন। তিনি এ বিষয়ে তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন, মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তার বর্ণনা দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা [পাপ-পুণ্য] যদি সরিষা দানার পরিমাণও হয়, অত:পর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমান সমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ।” [সূরা লোকমান: ১৬]
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, অন্যায় বা অপরাধ যতই ছোট হোক না কেন, এমনকি যদি তা শস্য-দানার সমপরিমাণও হয়, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা‘আলা তা উপস্থিত করবে এবং মীযানে ওজন দেয়া হবে। যদি তা ভালো হয়, তাহলে তাকে ভালো প্রতিদান দেয়া হবে। আর যদি খারাপ কাজ হয়, তাহলে তাকে খারাপ প্রতিদান দেয়া হবে।
পঞ্চম উপদেশ
লোকমান হাকিম তার ছেলেকে সালাত কায়েমের উপদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, অর্থাৎ, “হে আমার প্রিয় বৎস সালাত কায়েম কর”, তুমি সালাতকে তার ওয়াজিবসমূহ ও রোকনসমূহ সহ আদায় কর।
ষষ্ঠ উপদেশ
“তুমি ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ কর।” বিনম্র ভাষায় তাদের দাওয়াত দাও, যাদের তুমি দাওয়াত দেবে তাদের সাথে কোন প্রকার কঠোরতা করো না।
সপ্তম উপদেশ
আল্লাহ বলেন, “যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর।” আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যারা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ ও মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ করবে তাকে অবশ্যই কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে এবং অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। যখন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে তখন তোমার করণীয় হল, ধৈর্যধারণ করা ও ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।
রাসূল সা. বলেন, “যে ঈমানদার মানুষের সাথে উঠা-বসা ও লেনদেন করে এবং তারা যে সব কষ্ট দেয়. তার উপর ধৈর্য ধারণ করে, সে— যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা বা লেনদেন করে না এবং কোন কষ্ট বা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না—তার থেকে উত্তম।”“নিশ্চয় এগুলো অন্যতম সংকল্পের কাজ।” অর্থাৎ, মানুষ তোমাকে যে কষ্ট দেয়, তার উপর ধৈর্য ধারণ করা অন্যতম দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ।
অষ্টম উপদেশ
“আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না।”
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, ‘যখন তুমি কথা বল অথবা তোমার সাথে মানুষ কথা বলে, তখন তুমি মানুষকে ঘৃণা করে অথবা তাদের উপর অহংকার করে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না। তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে কথা বলবে। তাদের জন্য উদার হবে এবং তাদের প্রতি বিনয়ী হবে।’
কারণ, রাসূল সা. বলেন, “তোমার অপর ভাইয়ের সম্মুখে তুমি মুচকি হাসি দিলে, তাও সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে।”
নবম উপদেশ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “অহংকার ও হঠকারিতা প্রদর্শন করে জমিনে হাটা চলা করবে না।” আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” অর্থাৎ যারা নিজেকে বড় মনে করে এবং অন্যদের উপর বড়াই করে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের পছন্দ করে না।
দশম উপদেশ
নমনীয় হয়ে হাটা চলা করা। মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে বলেন: “আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।”
তুমি তোমার চলাচলে স্বাভাবিক চলাচল কর। খুব দ্রুত হাঁটবে না আবার একেবারে মন্থর গতিতেও না। মধ্যম পন্থায় চলাচল করবে। তোমার চলাচলে যেন কোন প্রকার সীমালঙ্ঘন না হয়।
একাদশ উপদেশ
নরম সূরে কথা বলা। লোকমান হাকীম তার ছেলেকে নরম সূরে কথা বলতে আদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমার আওয়াজ নিচু কর।” আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ।”
আল্লামা মুজাহিদ বলেন, ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ। অর্থাৎ, মানুষ যখন বিকট আওয়াজে কথা বলে, তখন তার আওয়াজ গাধার আওয়াজের সাদৃশ্য হয়। আর এ ধরনের বিকট আওয়াজ মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট একেবারেই অপছন্দনীয়। বিকট আওয়াজকে গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করা প্রমাণ করে যে, বিকট শব্দে আওয়াজ করে কথা বলা হারাম। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা এর জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। যেমনিভাবে—
ক. রাসূল সা. বলেন, “আমাদের জন্য কোনো খারাপ ও নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হতে পারে না। কোনো কিছু দান করে ফিরিয়ে নেয়া কুকুরের মত, যে কুকুর বমি করে তা আবার মুখে নিয়ে খায়।”
খ. রাসূল সা. আরও বলেন, “মোরগের আওয়াজ শোনে তোমরা আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ কামনা কর, কারণ, সে নিশ্চয় কোন ফেরেশতা দেখেছে। আর গাধার আওয়াজ শোনে তোমরা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কারণ, সে অবশ্যই একজন শয়তান দেখেছে।”দেখুন: তাফসীর ইবন কাসীর, খ. ৩ পৃ. ৪৪৬
আয়াতের দিক-নির্দেশনা:-
আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, যে সব কাজ করলে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হয়, পিতা তার ছেলেকে সে বিষয়ে উপদেশ দিবে।
রাসূল সা. বলেন: “আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলে না; আনুগত্য-তো হবে ভালো কাজে”।
রাসূল সা. বলেন, “তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে, তখন সে তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তার মুখ দ্বারা। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এ হল, ঈমানের সর্বনিম্নস্তর।”
শিশুদের জন্য রাসূলের সা. উপদেশ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ছিলাম, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “হে বৎস! আমি কি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দেব?” এ বলে রাসূল আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে যেসব উপদেশ দেন তা হচ্ছে:
প্রথম উপদেশ
“তুমি আল্লাহর হেফাজত কর আল্লাহ তোমার হেফাজত করবে”।
দ্বিতীয় উপদেশ
“তুমি আল্লাহকে হেফাজত কর, তখন তুমি তাঁকে তোমার সম্মুখেই পাবে।”
তৃতীয় উপদেশ
“যখন তুমি কোন কিছু চাইবে, আল্লাহর নিকট চাইবে। যখন কোনো সাহায্য চাইবে, আল্লাহ্র কাছেই চাইবে।”
চতুর্থ উপদেশ
“একটি কথা মনে রাখবে, যদি সমস্ত উম্মত একত্র হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য যতটুকু উপকার লিপিবদ্ধ করেছে, তার বাইরে বিন্দু পরিমাণ উপকারও তোমার কেউ করতে পারবে না, যদি আল্লাহ তোমার উপকার না চায়।
আর সমস্ত উম্মত একত্র হয়ে যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য যতটুকু ক্ষতি লিপিবদ্ধ করেছে, তার বাইরে বিন্দু পরিমাণ ক্ষতিও তোমার কেউ করতে পারবে না, যদি আল্লাহ তোমার ক্ষতি না চায়।”
পঞ্চম উপদেশ
“কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে ও কাগজ শুকিয়ে গেছে।”
ষষ্ঠ উপদেশ
“সচ্ছল অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর, বিপদে তোমাকে আল্লাহ স্মরণ করবে।”
সপ্তম উপদেশ
“মনে রেখো— যা তুমি পেলে না, তা তোমার পাবার ছিল না; আর যা তুমি পেলে তা তুমি না পেয়ে থাকতে না।”
অষ্টম উপদেশ
“আর জেনে রাখ, বিজয় ধৈর্যের সাথে।”
নবম উপদেশ
“বিপদের সাথেই মুক্তি আসে।”
দশম উপদেশ
“কষ্টের সাথেই সুখ।”
রাসূল সা. বলেন, “আর জেনে রাখ: ধৈর্যের সাথেই বিজয়, বিপদের সাথেই মুক্তি, কষ্টের সাথেই সুখ।”
কয়েকটি মারাত্মক অপরাধ
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ কি? তিনি উত্তরে বললেন, “আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।”
আমি বললাম, তারপর মারাত্মক অপরাধ কোনটি? তিনি বললেন, “তোমার সন্তান তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে তুমি তাকে হত্যা করলে।”
আমি বললাম, তারপর মারাত্মক অপরাধ কোনটি? তিনি বললেন, “তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করলে।” [বুখারী, মুসলিম]
রাসূল সা. বলেন, “কবিরা গুনাহের একটি বড় ধরনের কবিরা গুনাহ হল, কোন লোক তার মাতা-পিতাকে গালি দেওয়া। যেমন, সে কোন লোকের পিতাকে গালি দিল, তখন লোকটিও তার পিতাকে গালি দিল অথবা সে অন্যের মাকে গালি দিল এবং সে লোকও তার মাকে গালি দিল।” [বুখারী, মুসলিম]
প্রকৃত বুদ্ধিমান অভিভাবক
রাসূল সা. বলেন,“মানুষ যখন মারা যায় তিনটি আমল ছাড়া আর সব আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তিনটি আমল হল, সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম যার দ্বারা জাতি উপকৃত হয়, অথবা নেক সন্তান যারা তার মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া করে।”
কাজেই হে অভিভাবক! প্রথমে আপনি নিজের আমলকে সুন্দর করতে চেষ্টা করুন। আপনি যা করেন তাই শিশুদের নিকট ভালো কাজ আর আপনি যে সব কাজ করা ছেড়ে দেবেন, তাই হল, শিশুদের নিকট খারাপ কাজ। মাতা-পিতা ও অভিভাবকরা শিশুদের সামনে ভালো কাজ করাটাই হলো, তাদের জন্য অতি উত্তম শিক্ষা, এর চেয়ে উত্তম আর কোনো শিক্ষা হতে পারে না।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের কর্তব্য
১. শিশুদের لا إله إلا الله ، محمد رسول الله দ্বারা কথা শিখানো। আর শিশুরা যখন বড় হবে তখন তাদের এ কালিমার অর্থ শেখাবে। কালিমার অর্থ হল, “আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন ইলাহ নাই, তার কোন শরিক নাই।”
২. শিশুর অন্তরে আল্লাহর মহব্বত ও আল্লাহর প্রতি ঈমানের বীজ জীবনের শুরুতেই বপন করে দিতে হবে। কারণ, আল্লাহই আমাদের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও আমাদের সাহায্যকারী; তিনি একক তার কোন শরীক নাই।
৩. শিশুদের এ কথা শিখানো যে, তারা যেন সব সময় সবকিছু আল্লাহর নিকটই চায় এবং সাহায্যের প্রয়োজন হলে, আল্লাহর নিকটই চায়। কারণ, রাসূল সা. তার চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বলেন, “যখন কোন কিছু চাইবে তখন তুমি আল্লাহর নিকট চাইবে, আর যখন কোন সাহায্য চাইবে তখনও আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে।” [তিরমিযী]