বেকারত্বের সাতকাহন!

আনিসুর রহমান এরশাদ

বেকার এমন- যেন দেহ আছে কিন্তু প্রাণ নেই, বাঁচার ইচ্ছা আছে কিন্তু হায়াত নেই, দৌঁড়াবার আকাঙ্ক্ষা আছে তবে শক্তি নেই। মায়ের আশীর্বাদ,হুজুরের দোয়া আর স্রষ্টার অনুগ্রহ আশা করে অনেক বেকার। কিন্তু বেশি আশা করে বাস্তবে কম পেয়ে বেশি দুঃখ পায় বেকারই। বেকার দেখতে মানুষের মতো তবে মানুষের মতো স্বাদ-আহ্লাদ নেই, মানুষের মতো সম্মান-মর্যাদা নেই। সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ও অযোগ্য বিবেচিত মূল্যহীন মানুষ বেকার। বেকারের মুখে নীল আকাশের সৌন্দর্যও হাসি ফুটায় না, সাগরের বিশালত্ব আর পাহাড়ের দৃঢ়তাও হৃদয়ে আনন্দের উচ্ছাস জাগায় না। পূর্ণিমার রাতে জোৎস্নার আলোও মন আনন্দে ভরায় না। বেকার দরিদ্রের মধ্যে বেশি দরিদ্র, গরিবের মধ্যে অত্যাধিক গরিব, দুর্বলের মধ্যে সে দুর্বল।

বেকারের বুদ্ধিদীপ্ত কথা বিবেচিত হয় আবুলের বচন হিসেবে, তার পরোপকারী মানসিকতা বিবেচিত হয় কর্মহীনের সময় কাটানোর উত্তম উপায় হিসেবে। যার বয়স যতই হোক তার বিয়ের বয়স কখনোই হয় না সে বেকার। বেকারের কোনো শখ থাকতে নেই, সামাজিকতা রক্ষার মন থাকতে নেই। বেকার এমন এক নির্জীব অপদার্থের নাম; যে অন্যের দয়া পেতে ব্যাকুলতা দেখায়, অন্যের সান্নিধ্য পাবার আকুলতাও দেখায় কিন্তু অন্যরা তার এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাঝে ন্যাকামি ছাড়া কিছু খুঁজে পান না। বেকারের পৃথিবী খুবই ছোট। তার কাছে কেউ কিছু পাবার আশা করলেও হতাশা বাড়ে। বেকারের ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে উপেক্ষিত ভালোবাসা। ব্যস্ত নগরেও কম ব্যস্ত বেকারের যেন মানবিক অধিকার থাকতে নেই। তার প্রতি তাচ্ছিল্য কিংবা অতি মাত্রায় হাহুতাশ তাকে সংকীর্ণতার মাঝে বন্দি হবার আবেদন জানাতে থাকে। বেকারের আগমন কর্মজীবী কিংবা চাকরিজীবী অনেক পরিচিতজনদের কাছেই আনন্দের কারণ হয় না। ফলে বেকারত্বের সাথে একাকিত্বের একটি গভীর সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়।

বেকারদের আর্থিক অক্ষমতা তাদেরকে অসামাজিক হিসেবে উপস্থাপনে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখে। আর্থিক বিনিময় বা লেনদেনের অবস্থায়-পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বেকারকে উপদ্রব বা বিরক্তি উদ্রেককারী অস্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। বেকারের ভুলের শেষ নেই, বিপদের অন্ত নেই। তার সরলতাকে ভাবা হয় দুর্বলতা, আন্তরিকতাকে ভাবা হয় তোষামোদ, ইচ্ছা ও স্বপ্নকে বিলাসিতা বা আকাশ কুসুম বলে উড়িয়ে দেয়া হয়। তাচ্ছিল্যের পরিবেশে নিরুপায় দর্শক হয়ে সুখের দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনে বেকার। বেকারের কাছে সুর্যের আলো, চাঁদের আলো, বৈদ্যুতিক আলো কিংবা মোমের আলোর কোনো পার্থক্য থাকে না। কারণ আলোর পার্থক্য নির্ণয়ে যে আবেগ ও অনুভূতির দরকার হয় তা বেকারত্বের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। সুরেলা সঙ্গীত কিংবা গোল টেবিলের পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা তার কাছে অর্থহীন প্রলাপ বলে বোধ হয়। ফুলের সৌরভ, সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ, সুন্দর ভোগ্যপণ্য-দ্রব্য দর্শন তার ভেতরের অপ্রাপ্তির বেদনাকে আরও উস্কে দেয়।

কখনও কৌতুকের পাত্র আবার কখনও করুণার পাত্র হলেও বেকারত্বের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না অনেক যুবক। বেকারত্বের সময়কালীন যারা বেকারকে ক্ষমতাহীন, মেরুদন্ডহীন, সম্ভাবনাহীন এক মানুষ হিসেবে দেখেন; বেকারত্ব দূর হলে তারাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখও হন। তারপরও স্বীকার করতেই হবে বেকারের আপাদমস্তক বহুবিধ অপ্রাপ্তি, যন্ত্রণা ও গ্লানির সমন্বিত রুপ। বেকারকে ভালোবেসে কাছে টানা যায় কিন্তু দায়িত্ব দেয়া যায় না, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যায় কিন্তু স্বীকৃতি-সম্মান দেয়া যায় না। ফলে বেকার যা পারে তা করে না আর যা করে তা পারে না। বেকার যত শিক্ষিতই হোক সে মূর্খ, যত সুন্দরই হোক সে অনাকর্ষণীয়, যত শক্তিশালীই হোক সে দুর্বল। বেকারের চোখ, মুখ, কণ্ঠের চেয়ে মূখ্য হয়ে ওঠে তার মানিব্যাগ আর ব্যাংক ব্যালেন্স। অনেক সময় বংশ,বিদ্যাও তুচ্ছ হয়ে পড়ে বেকারত্বের অভিশপ্ত জীবনের কাছে। যে বেকার সে মনুষ্য সমাজে বসবাসের অযোগ্য যদিও অনেকে মনের বিরুদ্ধে মানবিক বিবেচনা প্রসূত বেকারকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন।

বেকার কখনো স্বাধীনতার স্বাদ পায় না, সুস্থতার প্রশান্তি অনুভব করে না। তার শরীর সুস্থ হলেও সে রোগী। নারী বেকার হলেও মেনে নেয়া যায় কিন্তু পুরুষ বেকার হলে সে হয়ে ওঠে তিরস্কার ও উপহাসের পাত্র। সে অন্যের ঘৃণা ও অপমান সহ্য করে, প্রতিবাদী হয়ে ওঠার হিম্মত না থাকায় লাঞ্চনা যাতনা নিরবে সহ্য করতেও দ্বিধা করে না। অস্বাভাবিক পরিবেশ স্বাভাবিক করতে কখনো আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বেকার। বেকার যা করতে চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না। ফলে বেকারের কাছে পৃথিবীটা বিশালতার নয়; সংকীর্ণতায় ভরা। আর বেকারের জীবন মানেই অস্বাভাবিক জীবন। বেকার মানুষ হলেও সে মানুষের মধ্যে একটু আলাদা। স্বভাব, প্রকৃতি ও কর্মে সে ভিন্ন। তার স্বতন্ত্রতা নেতিবাচক, স্বকীয়তা অনর্থক, যৌক্তি বোধও অর্থহীন বলে বিবেচিত। বেকারের জন্য করুণা ও দয়ার পাত্র হওয়া যতটা সহজ, সম্মানজনক ও স্বার্থক জীবন লাভ ততটাই কঠিন। তবুও এগিয়ে চলার স্বপ্ন ও অবস্থার পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই তার ভরসা।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

One Comment on “বেকারত্বের সাতকাহন!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *