বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি ভয়াবহ

ইতিহাস কোনো ষড়যন্ত্রকারীকেই ক্ষমা করে না। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকদের কারো উদ্দেশ্যই সফল হয়নি। পেয়েছে বিশ্বাসঘাতক তকমা। দুনিয়াতে ঘৃণিত হয়েছে, পরকালের পরিণাম আল্লাহ ভালো জানেন।

বিশ্বাসঘাতকরা কোনোদিনই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। অতীতে অনেকেই পারেননি। নব্য বিশ্বাসঘাতকরাও পারছেন না, পারেননি এবং ভবিষ্যতেও পারবেন না । কেউ কেউ ইতোমধ্যেই লাঞ্চিত হয়েছেন অথবা কেউ কেউ দুনিয়ায় লাঞ্চিত হবেন। বিশ্বাসঘাতকরা জালেম। আর মাজলুমের ফরিয়াদ কখনো বৃথা যায় না।

রবার্ট ক্লাইভ

লর্ড ক্লাইভের সকল সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। তিনি শেষ জীবনে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন । পরিবারের সদস্যরাও তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারান। হতদরিদ্র অবস্থায় চরম হতাশায় বাথরুমে ঢুকে নিজেই নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। মর্মান্তিকভাবে তার মৃত্যু হয়।

পলাশী যুদ্ধের পর হিরাঝিল প্রাসাদের ধনাগারটি লুটের বখরা বাবদ ক্লাইভ পান ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ তাকে আরও ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা দেন মীর জাফর। রবার্ট ক্লাইভ ৩০টি নৌকা বোঝাই করে ধনরত্ন নিয়ে যান ইংল্যান্ডে।

বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, হত্যা, রাহাজানি, ঘুষ, জালিয়াতি, নারী ধর্ষণ, বাংলার নবাব পরিবারবর্গের হত্যার জন্য লন্ডনের হাউজ অব কমন্স সভায় ক্লাইভের বিচার হয়। বিচারের রায়ে ক্লাইভের ফাঁসির হুকুম হয়। তিনি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বহু কষ্টে ফাঁসির মৃত্যুদন্ড থেকে মুক্তি পান। তবে পলাশী ষড়যন্ত্রের ঘটনা তাকে পরবর্তীতে কোনদিন মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে দেয় নাই।

মীর জাফর আলী খান

দুরারোগ্য কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কুষ্ঠ রোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এক তান্ত্রিকের পরামর্শে হিন্দু দেবী মূর্তির পা ধুয়া পানি খাওয়ার পর বেঈমান অবস্থায় ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ৭৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পূর্বে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহারাজ নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত এনে তাকে পান করতে দিয়েছিলেন। এই চরণামৃত মুখে করেই তার মৃত্যু হয়।

অসুস্থ অবস্থার প্রতিটা দিন তার মৃত্যুর চেয়ে কম কিছু ছিল না। মীর জাফরকে লোকে ক্লাইভের গর্দভ বলে জানতো। তিনি নবাব আলীবর্দী খাঁর বৈমাত্রেয় বোন শাহখানমকে বিয়ে করেছিলেন। সেই সম্পর্কে তিনি ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিকটতম আত্মীয়। তিনি কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন তার বাঙলার সিংহাসনের উপর কোনো মোহ নাই।

জগৎ শেঠ

নবাব সিরাজউদ্দৌলার ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জগৎ বিখ্যাত মাড়োয়ারী জগৎ শেঠ। তার পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৪০ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানের মূদ্রা মানে ৯০০ কোটি টাকা। বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী জগৎ শেঠকে গলায় বালির বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দূর্গ প্রাকার থেকে নবাব মীর কাশিমের আদেশে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে ডুবিয়ে মারা হয়।

ফকির দানিশ শাহ বা দানা শাহ

ফকির দানিশ শাহ বা দানা শাহ নবাব সিরাজ দৌলা কে চিনতে পেরে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিষাক্ত সাপের দংশনে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিলেন।

ইয়ার লতিফ খান

পলাশীর যুদ্ধের পর হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান ইয়ার লতিফ খান। তিনি গুপ্তহত্যার শিকর হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। তিনি পলাশী ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

ওয়াটস

ওয়াটস পাল্কীতে করে রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়ীতে গিয়ে চুক্তিতে মীর জাফরের স্বাক্ষর এনেছিলেন। যুদ্ধের পর কোম্পানি তাকে বরখাস্ত করলে ওয়াটসের ক্রমাগত স্বাস্থ্যহানী হতে থাকে। মনের দুঃখে ও চরম অনুশোচনায় ভোগতে থাকে। কোনো ওষুধেই ফল পাননি। তার হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইংল্যান্ডে করুণ মৃত্যু হয়।

ওয়াটসন

ইংরেজ নৌ সেনাপতি ওয়াটসন পলাশীর ষড়যন্ত্রকারী।ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে কোন ঔষধে ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

উমি চাঁদ

পলাশীর যুদ্ধের পরে ক্লাইভ উমি চাঁদকে চুক্তির অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানান। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি উমিচাঁদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং চিৎকার করতে করতে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কপর্দকহীন নিঃস্ব অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অকস্মাৎ তার মৃত্যু হয়। কি নিদারুণ ও দুর্বিষহ তার এই মৃত্যু!

পলাশী যুদ্ধ পরবর্তী সিরাজের পতন হলে তাকে নবাব সম্পত্তির চার আনা অংশ দিতে হবে বলে ইংরেজদের সঙ্গে এক জাল চুক্তি পত্র সই করে এই উমিচাঁদ। ইংরেজ নৌ-সেনাপতি ওয়াটস ছিলেন এই চুক্তিপত্রের প্রধান ব্যক্তি। লাল কাগজ ও সাদা কাগজে এই দুটি চুক্তিপত্রের সই হয়। পরবর্তীতে সিরাজের পতনের পরে ওয়াটস প্রদত্ত এই চুক্তি জাল বলে প্রমাণিত হয়।

উমিচাঁদ নবাবের ধনরত্ন ও সম্পদ থেকে মোট ৪০ লক্ষ টাকা টাকার দাবীদার ছিলেন, যা’ বর্তমান মুদ্রামানে ৯০০ কোটি টাকার সমান। উমি চাঁদ এই জাল দলিলের জন্য সিরাজের সম্পত্তির কোন অর্থ পান নাই। এই অর্থের শোকে উমিচাঁদ বদ্ধ পাগল হয়ে রাস্তায় নেমে যান। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে আকাশের দিকে মুখ করে লম্ফ দিতে দিতে সর্বদাই লাল কাগজ ও সাদা কাগজ বলে চিৎকার করে বেড়াতেন।

মীর কাসিম আলী খান

ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে যান। দিল্লী পালিয়ে গিয়ে অর্থ কষ্টে পথে পথে ঘুরতে থাকেন। বনে জঙ্গলে পথে প্রান্তরে ছুটে বেড়াতে থাকেন। তার নাবালক দুই সন্তান দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তার জন্য খাবার সংগ্রহ করতো। তারা এক সন্ধ্যায় ভিক্ষা করে ফিরার সময় ইংরেজ সৈনিকদের গুলিতে নিহত হয়।

মীর জাফরের জামাতা ও মীরণের ভগ্নিপতি নবাব মীর কাসিম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অর্থ কষ্টে অনাহারে দিল্লী জামে মসজিদের নিকট করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৭৭ সালের ৬ জুন মীর কাশিম দিল্লীর রাজপথে এক বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকেন।

ভগবান গোলায় পলাতক ছদ্মবেশী নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মীর কাশিমই সর্বপ্রথম ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি বাঙলার নবাব হন এবং এসময় ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাঁধে। কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। বহু প্রস্তুতি বহু প্রচেষ্টা, যুদ্ধ সংগ্রাম করে বৃটিশ শক্তির কাছে পরাজিত হন।

 মীরন

মীরজাফরপুত্র মীরনের বজ্রপাতে মৃত্যু হয়। সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল মীরণ। তারই নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে হত্যা করে। হত্যার সময় ঘাতকের অট্রহাসিতে কেঁপে উঠেছিল জাফরগঞ্জ প্রাসাদ, কেঁপে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ।

সিরাজউদ্দৌলার লাশকে মীরণ ক্ষত বিক্ষত করে তারই প্রিয় হাতির পৃষ্ঠে বেঁধে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। যাতে সবাই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যেনো পরবর্তীতে বাংলার বুকে বিদ্রোহ করতে না পারে।

সিরাজের মাতা আমেনা বেগম তার ছেলের লাশ দেখার জন্য দৌড়ে হাতির কাছে যেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। হাতিটা সে সময় সিরাজের লাশ তার পৃষ্ঠে নিয়ে আমেনা বেগমের সামনে বসে পড়েন। নিষ্ঠুর মীরনের নির্দেশে তার অভদ্র দ্বার রক্ষীগন চড়-কিল-ঘুসি মেরে নবাবের কন্যা ও স্ত্রী এবং সন্তানের মৃত দেহ বক্ষে ধারন করা মা আমিনা বেগমকে জোর করে জেলখানায় বন্দী করে রাখেন।

মীর কামরুদ্দিন

টিপু সুলতানের কমান্ডার মীর কামরুদ্দিন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। পচে গলে মারা যায়।

মীর আলম

টিপু সুলতানের কূটনৈতিক মীর আলম এক ধরনের বিষাক্ত রোগে আক্রান্ত হন। তার সমস্ত শরীর ফেটে গলে যায়। সে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে চলে যায়।

মহারাজা নন্দকুমার

পলাশীর ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন মীর জাফর। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধীতে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাজানো মিথ্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায় তার বিচার হয়। তাকে শেষ পর্যন্ত এই বিচারের রায়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শেওড়াগাছে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

মহারাজ নন্দকুমারের সাথে মীর জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মীর জাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজ কর্ম নন্দকুমারের পরামর্শনুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরা দেবীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন।

ঘসেটি বেগম

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতন ও মৃত্যুর পরে মীর জাফরের পুত্র মীরন ঢাকার জিঞ্জিরায় বন্দী করে রাখেন। পরে চক্রান্ত করে জিঞ্জিরার সন্নিকটে খরস্রোতা বুড়ীগঙ্গা নদীতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তাকে নৌকায় তুলে বুড়ীগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করেন। ঘসেটী বেগমের আর্তনাদ আহাজারী নদীর কিনার থেকে নিশুতি রাতে পথচারীরা শুনতে পেয়েছিল।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ঘসেটি বেগম ইতিহাসবিদদের মনোযোগ তেমন পাননি, যে কারণে তার ঢাকা জীবন সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মীর জাফরদের পুতুল হয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের কন্যা ও সিরাজের খালা।

তিনি তার পোষ্য ছেলেকে সব সময় বাংলার সিংহাসনে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। সেই জন্য সিরাজউদ্দৌলা নবাব হবাার পরই তাকে হিরাঝিল প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন। ঘসেটি বেগম প্রচুর অবৈধ ধন সম্পদেরও মালিক ছিলেন।

 রায় দুর্লভ

ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মীর কাসিমের নির্দেশে বিহারের মুঙ্গের দুর্গের চূড়া থেকে গলায় বালির বস্তা বেঁধে গঙ্গা নদীতে জীবন্ত দেহ নিক্ষেপ করে রায় দুর্লভকে হত্যা করা হয়। এভাবেই গঙ্গার বক্ষে সলিল সমাধি হয়। রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি। তিনিও মীর জাফরের সাথে সক্রিয়ভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

রাজবল্লভ

ঢাকার রাজা ছিলেন কুখ্যাত ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভ। তারও শেষ পর্যন্ত হয় অস্বাভাবিক মৃত্যু। এক অপঘাতে তিনি নিদারুণ ভাবে নিহত হন। পরবর্তীকালে তার সমূদয় কীর্তি পদ্মা নদী গ্রাস করে কীর্তিনাশা নাম ধারণ করেন।

মোহাম্মদী বেগ

নবাব সিরাজকে একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩ জুলাই নির্মমভাবে হত্যা করেন কুখ্যাত মোহাম্মদী বেগ। নবাব সিরাজ এ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চান নাই। তিনি কেবল তার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। তিনি সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

অথচ মোহাম্মদী বেগ ছিল নবাব আলীবর্দী খাঁর পৌষ্য। তাকে আলীবর্দী খাঁ কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যরূপে তাঁরই স্নেহছায়ায় সে বেড়ে উঠে। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও তার বিশেষ সখ্যতা ছিল। পরে মোহাম্মদী বেগ তার সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উম্মাদ অবস্থায় এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।

স্ক্রাফটন

পলাশী যুদ্ধের পরবর্তী সিরাজের সম্পদের লুটপাটের পিছনে স্ক্রাফটন বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন। বাংলার বিপুল ধন-সম্পদ চুরি করে বিলেতে যাবার সময় জাহাজডুবে স্ক্রাফটনের মৃত্যু ঘটে।

বিশ্বাসঘাতকরা যে উদ্দেশ্যে বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাদের হীন উদ্দেশ্য সফল হয়নি। যাদের জন্য কাজ করেছে তাদের দ্বারাই শাস্তি পেয়েছে অথবা করুণ জীবনযাপন করতে করতে ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছে। মানুষ তাদের স্মরণ করছে ঘৃনাভরে।

কেউ যদি অন্য কারো প্রতিদিনের মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে নালিশের পাত্র হয় দুনিয়ার তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই! অন্য দিকে কেউ নিজের অজান্তে অন্যের দ্বারা যদি দোয়ার পাত্র হন, তার মতো সৌভাগ্যবানও কেউ হতে পারে না!

পদ আর ক্ষমতা পাওয়ার জন্য যুগে যুগে নব্য ঘসেটি বেগম ও মীর জাফরদের আবির্ভাব হয়েছে। যারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। এদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

মানুষরূপী এসব অমানুষরা ভালো মানুষের স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। ষড়যন্ত্রের জাল বুনে সফল উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তাদের আত্মঘাতী তৎপরতা সার্থক প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দ্বার করিয়ে দিচ্ছে। অথচ প্রতিষ্ঠান গড়তে লাগে- রক্ত পানি করা শ্রম, ঘাম ঝরানো সাধনা, তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন। প্রতিষ্ঠান ভাঙতে এক মীর জাফর বা ঘসেটি বেগমই যথেষ্ট!

বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মীরজাফরের উত্তরসুরীদের ইতিহাস ভাঙনের, গড়ার নয়। অহংকার আর লোভের মোহে তারা অন্ধ হয়ে যায়। সুবিধাবাদীদেরকে ব্যবহার করে কেউ ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে। তিলেতিলে গড়ে উঠা কত সুন্দর বাগান বিশ্বাসঘাতকদের কারণে ধবংস হয়ে যায়।

বিশ্বাসঘাতকের পরিণতি কখনোই ভালো হয় না। ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকরা ইতিহাসের নর্দমায়- আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হন, মৃত্যুর পর কাক পক্ষীও তাদের নাম উচ্চারণ করে না। তাদের পরিণতি হয় খুবই ভয়াবহ, করুণ ও মর্মান্তিক।

শেষ পর্যন্ত মীরজাফরদের পরিণতি ভালো হয় না। অথচ মীরজাফরের প্রেতাত্মারা জানে না কিংবা বুঝে না অথবা মানতে/বুঝতে চায় না যে, সে একটা মীরজাফর। কারণ ঠুনকো যুক্তি তারও আছে, আর ক্ষমতার লোভ!

আসলে বিশ্বাসঘাতক হয় কাছের মানুষরাই। জীবনের সব চাইতে বড় শত্রু থাকে সব থেকে কাছের বন্ধুর মতো করে। যার উপর বিশ্বাস করেছিলেন সেই যখন নিজ স্বার্থে ঘাতক হয়ে ওঠে তখনই ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা।

মুনাফিকরা লম্পটদের সাথে চক্রান্ত করে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও নষ্ট করে, অন্যদের অভিসম্পাতও পায়, একূল-ওকূল সব হারায়। একসময় এদের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না, বলার কোনো ভাষা থাকে না। নিজেরাও অনুশোচনায় ভোগে, মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়।

বিশ্বাসঘাতকতা নতুন কিছু নয়। নিজের ভাই হাবিলকে হত্যার মাধ্যমে আদমপুত্র কাবিল বিশ্বাসঘাতকতা ইতিহাসের সূচনা করেছিল। ইসলামের প্রথম যুগে চার খলিফার মধ্যে তিন খলিফাকেই ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ।

তবে বড় সমস্যাটা হচ্ছে- কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।’ হেগেলও বলেছিলেন, We learn from history that we do not learn from history.

তথ্যসূত্র

১. আব্দুল করিম, বাংলার ইতিহাস, ঢাকা,জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০২১
২. ড. মুহাম্মদ ফজলুল হক, বাংলার মসনদ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা, ঢাকা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স, , ২০১২
৩.ইসমাইল রেহান, বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস, ঢাকা, কালান্তর প্রকাশনী,২০২২
৪. উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল, দি এনর্কি, ঢাকা, আহমদ পাবলিশিং হাউস,২০২১

৫. বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
৬. বাঙলার মুসলমানদের ইতিহাস : আব্দুর রহীম
৭. এ্যান এডভান্সড হিস্টরী অফ ইন্ডিয়া : আর, সি মজুমদার ও কালিশঙ্কর দত্ত
৮. ইতিহাসের অন্তরালে : ফারুক মাহমুদ

৯. আলীবর্দী এন্ড হিজ টাইম : কে, কে, দত্ত
১০. সিরাজউদ্দৌলা : অক্ষয় কুমার মৈত্র
১১. মুর্শিদাবাদ কাহিনী : নিখিল নাথ রায়, ১৩১৬ বঙ্গাব্দ

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *