বাল্যপ্রেম থেকে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি

গ্রামে বাড়ছে বাল্যপ্রেম। একেবারে ছোটবয়সের এই প্রেমের সবটাই মনের। আবেগ-অনুভূতির চক্করে পড়ে নিজের আখেরি সব হারাচ্ছে। চুটিয়ে প্রেম করায় উদ্বিগ্ন বাবা-মা পড়াশুনা না করিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসায়ে দিচ্ছে। স্কুলজীবনের প্রেমে হাত ধরাধরি, ম্যাসেজ চালাচালি সবই আবেগ আর স্বপ্ন দিয়ে সাজানো।

ভবিষ্যত পরিণতি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকায় একে অপরের জন্য পাগলামি অনেক সময় চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অভিজ্ঞতার অভাবে করা ভুলের মাসুল গুনতে হয় বাকি জীবন। তারা বুঝতেই পারে না কাউকে বিশ্বাস করা বা ভালোবাসার বিষয়গুলো এতো সস্তা নয়।

বাল্যপ্রেম কী?

মানব শিশুর জন্মের পর থেকেই তার যৌনতার বিকাশ শুরু হয়। পিউবার্টির (puberty) সময় পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত হয় এবং পরিপূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়। পিউবার্টি শুরু ছেলেদের ক্ষেত্রে ১০-১৫ বছর বয়সে, মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮-১৩ বছর বয়সে। পিউবার্টি শুরু হবার আগেও বাচ্চাদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রেম হতে পারে। কেননা তখনো বাচ্চাদের মধ্যে সীমিত আকারে যৌনচেতনা কাজ করে।

আমরা এটাকেই বাল্যপ্রেম বলতে পারি। এখানে শারীরিক ক্রিয়াকলাপগুলো থাকে খুবই সীমিত। অনেকে এটাকে বন্ধুত্ব বা বিশুদ্ধ প্রেম হিসেবে দেখেন। এটাকে অনেকে প্লেটোনিক প্রেমও বলে থাকেন। কিন্তু প্লেটোনিক প্রেমের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ ধরনের প্রেম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশিদিন স্থায়ী হয় না তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে বাল্যপ্রেম পরিণত বয়সে পুনরায় নতুনরূপে জেগে উঠতে পারে।

সাধারণত রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা, কখন আসবে স্কুল শেষে। বাইক নিয়ে দাড়িয়ে থেকে এক পলক দেখে সারাদিন শান্তি পাওয়া। একটু দেখা হলেই বিকালের আড্ডা, পড়ার টেবিল, কোচিং ক্যাম্পাস প্রত্যেকটা আনন্দময় মনে হওয়া । আবেগের বশে চিঠি লেখা। চিঠির ভাজে গোলাপের পাপড়ি, প্রতিটা লাইন মুখস্থ করা। এরপর জানাজানি হওয়া। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ-বিড়ম্বনা এড়াতে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন বাবা-মা।

বাল্যবিবাহ বলতে কী বুঝায়

বাল্য বিবাহ সাধারণতঃ দুই প্রকার। এক.সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয় নাই এমন একটি কন্যা শিশুকে অভিভাবক কর্তৃক বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বা তদুর্ধ্ব বয়সের কারো সাথে বিবাহ দেয়া। দুই. ছেলে বা মেয়ে উভয়ের মধ্যে বিবাহের বয়সে পৌছার আগে বা সাবালকত্ব লাভের পূর্বে উভয় পক্ষের অভিভাবক কর্তৃক বিবাহ দেয়া।

বাল্যপ্রেম বৃদ্ধির কারণ

বর্তমানে টিভি ও মিডিয়ার কল্যাণে বাল্যপ্রেম বাড়ছে। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও বাল্যপ্রেমের প্রসার এতটা ছিলো না। বর্তমান ৯৯% নাটক-সিনেমায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটাই কাহিনি প্রেম করতে হবে।

উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের আবচেতন মনে এগুলো দেখে প্রেম একটা ফেন্টাসিজমের মতো কাজ করে, যে প্রেম করতেই হবে। বর্তমান মোবাইলের কারণে কথিত প্রেম ভালোবাসা পানির মত সহজ হয়ে গিয়েছে।

অল্প বয়সে প্রেমের নানা কারণ

অল্প বয়সে প্রেমের বিয়ের মতো ভুল করার পেছনেও সামাজিক ও পারিবারিক নানা কারণ রয়েছে। মুঠোফোনে অপরিচিত কারও সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করা, ফেসবুকে অপরিচিতদের সঙ্গে আবেগী সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আবার পারিবারিক কারণে একাকিত্ব বা হতাশায় ডুবে থাকা কিংবা অসত্ সঙ্গে জড়িয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়া থেকেও এটা ঘটতে পারে। মা-বাবার চোখের সামনে থেকেও যেন আড়ালে হারিয়ে যায় এসব কিশোর-কিশোরী।

 আবেগী প্রেমে জড়ানোর কারণ

মনোচিকিত্সক নীলিমা চৌধুরীর মতে, কিশোর বয়সে আবেগী প্রেমে জড়ানোর অন্যান্য কারণের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা না পাওয়া অন্যতম। এমন কিশোরীরা খুব সহজেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। চোখের নেশায় মুহূর্তেই ভুলে যায় সবকিছু। এ সময়ে মানসিক রোগাক্রান্তও হয়ে পড়তে পারে কেউ কেউ।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক নীলিমা জানিয়েছেন, ‘পারিবারিক শিক্ষা, ভালোবাসা আর পরিমিত নিয়ন্ত্রণই পারে এমন কিশোরীদের অল্প বয়সে প্রেম এবং বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয় থেকে দূরে রাখতে। সব মা-বাবাই সন্তানকে ভালোবাসেন, তা ঠিক। কিন্তু উঠতি বয়সে তার মনোজগতে কী ঘটছে, সে বিষয়ে একটু বাড়তি খেয়াল রাখুন। রাগ না করে বুঝিয়ে বলুন সবকিছু। অভিভাবক হয়েও ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো খোলামেলা কথাবার্তা বলুন।’

অল্প বয়সে বিয়ের সুবিধা

অল্প বয়সে বিয়ে হলে  অনেক সুবিধাও হয়। একটা ছেলে ও একটা মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হলে তাদের সন্তান তাদের বাবা-মাকে অনেক সময় কাছে পায়। কিন্তু বেশি বয়সে বিয়ে হলে- ছেলে-মেয়ে অনেক সময় বাবা-মাকে বেশি সময় কাছে পায় না। বাল্যবিবাহ বন্ধ করে নতুন সিস্টেমে যে প্রজন্ম আসবে তারা কিন্তু বাবা-মাকেই কম সময় পাবে।

সামাজিক নিরাপত্তার জন্য দরকার টাকা-পয়সা বা আর্থিক সংস্থান। একজন বাবা চাকরিতে থাকা অবস্থায় তার সন্তান যদি চাকরিতে ঢুকে যায়, তখন ঐ পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা অধিক শক্তিশালী হয়। কিন্তু বেশি বয়সে সন্তান নিলে বাবা বৃদ্ধ বা অসুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু সন্তান তখনও ছাত্র। এ ধরনের বিষয়গুলো সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করে।

বাল্যবিবাহ বন্ধ করার যতগুলো কারণ আছে, তার মধ্যে অন্যতম- “কম বয়সে বিয়ে হলে বেশি সন্তান হবে।” আজকাল অনেকেই বলে, “বেশি সন্তান হলে এতগুলো ছেলে-মেয়ে মানুষ করতে পারা যায় না।” কিন্তু আমাদের দাদী-নানীরা ঠিকই ১০-১২টা সন্তান মানুষ করেছে, কেউ নষ্ট হয়নি।

আজকাল বাবা-মা বৃদ্ধ হলে বৃদ্ধনিবাসের কথা উঠে। এটা কাদের জন্য ? সেই সব ফ্যামিলির জন্য তাদের সন্তানের সংখ্যা কম। এক-দুই জন ছেলে মেয়ে হলে কারো না কারো সমস্যা থাকতেই পারে, কিন্তু সন্তানের সংখ্যা যদি ৫-৬টা হয়, তখন ? কেউ না কেউ অবশ্যই বাবা-মাকে দেখে।

বাল্যবিয়ে নিয়ে বিতর্ক

আমরা এখন যে সামাজিক ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আছি, সেটাতে বাল্যবিবাহও ছিলো, অধিক সন্তানও ছিলো। কিন্তু এখন যারা পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনে বিয়ের বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছে, সন্তানের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে, তারা কি পশ্চিমা সামাজিক বন্ধন বা অবস্থার দিকে তাকিয়েছে ?

আমরা যে সামাজিক বন্ধন ও ব্যবস্থা লালন করছি, সেটা দেখে পশ্চিমারা হিংসা করে। ওরা কিন্তু আমাদের মত বাবা-মা-দাদা-দাদী-নানা-নানীরসহ ফ্যামিলির স্বাদ পায় না, আর ভবিষ্যতে পাবেও না। কিন্তু ওদের কথা শুনে আমরা আমাদের এতদিনের লালন করা সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ওদের সমাজ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, এটা কি আদৌ ভালো করছি ? এখনও সময় আছে, ভেবে দেখুন।

বাল্যবিয়ে বন্ধে করণীয়

বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হলে আগে বাল্যপ্রেম বন্ধ করতে হবে। বাল্যপ্রণয় ও ছোটবেলার ভালোবাসা নষ্টামি বন্ধ না করা গেলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাবে না। কারণ পরিবারের মান-সম্মান  ও ইজ্জ্বত বাঁচাতে অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন।

পারিবারিক শিক্ষা, ভালোবাসা আর পরিমিত নিয়ন্ত্রণই পারে কিশোরীদের অল্প বয়সে প্রেম আর বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয় থেকে দূরে রাখতে। রাগ না করে বুঝিয়ে বলুন। অভিভাবক হয়েও বন্ধুর মতো খোলামেলা কথা বলুন তাদের সাথে।

বাল্যপ্রেমের ফলাফল

বাংলাদেশে প্রতিদিন অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের কারণে কয়েক ডজন নবজাতক শিশু ডাস্টবিন, নালা, নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়। জন্মের পর পরই নবজাতককে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে মা। খোঁজ নেয় না বাবাও। অসহায় নবজাতকের কান্না পৌঁছায় না কোন পথচারীর কানে।

দেশে নবজাতক হত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ডাস্টবিন ও রাস্তায় যেসব অজ্ঞাত শিশুর লাশ পাওয়া যাচ্ছে তাদের ৯৯ ভাগই নবজাতক। এদের পরিকল্পিতভাবে জন্মের পরেই রাস্তায়, ডাস্টবিন-ভাগাড় কিংবা ঝোপঝাড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে। যাদেরকে জীবিত পাওয়া গেছে, তাদের মূলত হত্যার উদ্দেশ্যেই সেখানে ফেলে দেয়া হয়েছিল।

সমাজবিজ্ঞানীরা এ অবস্থাকে সমাজের চরম নৈতিক অবক্ষয় হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, নারী-পুরুষদের অবৈধ মেলামেশার ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে তা সমাজ এবং তাদের পরিবার মেনে নেয় না। ফলে জন্মের পরপরই এসব নবজাতকদের ঠাঁই হচ্ছে ডাস্টবিনে।

তবে বৈধ সম্পর্কের ফলে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের ক্ষেত্রেও যে এমনটা ঘটছে না তা নয়। অনেক পরিবারে পুত্র সন্তান আশা করছে। কিন্তু জন্ম নিচ্ছে কন্যা সন্তান। তখন অনেকে সেই কন্যা সন্তানকে পরিত্যাগ করতে তাকে ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। কেউ মারা যাচ্ছে। কেউ বা বেঁচে যাচ্ছে ভাগ্যগুণে।

মাতৃমৃত্যু ও  শিশুমৃত্যু

অল্প বয়সে বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যু প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর মূল কারণ কিশোরী বয়সীদের মা হওয়া। কিশোরী মায়ের মৃত্যুঝুঁকি প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চারগুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে।

অনেকক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়ে মা হওয়ায় কিভাবে শিশুকে পরিচর্যা করবে সে সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকে না। এর ফলে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুও ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।

নীরব গর্ভপাত বৃদ্ধি

গর্ভপাতের ঘটনা বেশি ঘটছে। অথচ যারা বেশি বেশি গর্ভপাত করায় তাদের ভবিষ্যতে অনেক রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ তাদের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ ভবিষ্যতে আর সন্তান নাও হতে পারে৷ জরায়ুতে সংক্রমণ হতে পারে৷ গর্ভপাত করালে পিরিয়ড নিয়মিত না হওয়াসহ অনেক রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে৷

অটোমেটিক গর্ভপাত হয়ে গেলে, সেটা তো আর হত্যার শামিল বলা যাবে না৷ কিন্তু যেখানে অবৈধভাবে গর্ভাপাত করায়, সেখানে অনৈতিকতার প্রশ্ন আছে৷যারা অবৈধভাবে গর্ভপাত করান বা আনহাইজেনিকভাবে গর্ভপাত করান, তাদের বা আনসেফ গর্ভপাতকে অবশ্যই নিরুৎসাহিত করা উচিত৷

নাবালিকা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে গর্ভপাতের হার যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা আশঙ্কাজনক। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং হাতুড়ে বা আনাড়ি ডাক্তার দিয়ে গর্ভপাত করাতে গিয়ে অনেক মেয়ে মারা যাচ্ছে, অনেকের স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে৷ অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্বসহ নানা মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গর্ভে থাকা ভ্রুণও জীবন

গর্ভে থাকা ভ্রুণকেই ইসলাম জীবন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়৷  সূরা আল-মায়দাহের ৩০তম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘যে বা যারা একটি আত্মার জীবনকে হত্যা থেকে বিরত থেকেছে, সে বা তারা যেন সব মানুষের জীবনকে হত্যা থেকে বিরত থেকেছে৷ যে বা যারা একটি আত্মাকে হত্যা করেছে, সে বা তারা যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করেছে৷’’

ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতের কুফল

গর্ভপাত বলতে সন্তান প্রসবের আগে, সাধারণত গর্ভধারণের প্রথম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে, জরায়ু থেকে ভ্রণের অপসারণ ও বিনষ্টকরণকে বোঝায়। অনেকেই এটিকে সরাসরি শিশুহত্যা বলছেন। কেননা ভ্রণ মানেই হচ্ছে শিশুর আকার। অনেক গর্ভপাতই ঝুঁকিপূর্ণ।   নবজাতক হত্যা হোক কিংবা  ভ্রুণ হত্যা হোক- সবই ক্ষতিকর।

ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতের ফলে নারীর বন্ধ্যাত্ব, শারীরিক, মানসিক সমস্যাসহ মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেক। পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করার আগেই মায়ের গর্ভেই শিশুকে হত্যা করা সহজাত প্রকৃতি বিরোধী। কাজেই সচেতন থাকতে হবে নারী-পুরুষ উভয়কেই। অনেকে মনে করেন, পৃথিবীর রং, গন্ধ, ফুল, পাখি দেখার অধিকার রয়েছে ভ্রুণ শিশুর।

বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক

বাল্যবিবাহের ফলে মা জন্ম দেয় হয় মৃত শিশুর, না হয় রুগ্ন, বিকলাঙ্গ বা জড় বুদ্ধি শিশুর৷ ভেঙে পড়ে নাবালিকা মায়ের স্বাস্থ্য৷

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও নভেরার প্রতিষ্ঠাতা ফারজানা মৌসুমি ইটভাটার নারী শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, নারীদের শরীর ও মন ১৮ বছরের আগে বিয়ে এবং ২০ বছরের আগে সন্তান ধারণের উপযোগী হয় না। সুস্থ জীবন পেতে হলে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে এবং সন্তান ধারণকে না বলতে হবে। এতে মা ও শিশু উভয়েই সুস্থ সুন্দর জীবন পাবে।

বাল্যবিয়ের কারণ

সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও দারিদ্র্য বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের অন্যতম বড় কারণ। যৌতুক প্রথা আজও ব্যাপকভাবে বিরাজমান আমাদের সমাজে। যৌতুক আতঙ্কে অনেকক্ষেত্রে মেয়েকে দ্রুত পাত্রস্থ করার প্রবণতা দেখা যায়।

বাল্যপ্রেমও বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ। বাবা-মা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে এবং মেয়েকে শিক্ষিত করতে আগ্রহী হলেও বাল্যপ্রেমের কারণে অনেক সময় তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিতে বাধ্য হন।

বাল্যবিয়ে  প্রতিরোধে সচেতনতা

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে প্রচার-প্রচারণাগুলো চালানো হয়, সেখানে মূলত তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়: ১. মেয়েটির অনিরাপদ মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ২. মেয়েটির অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন এবং ৩. নারীর বিঘ্নিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন।

নারীর জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন

বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা সৃষ্টির পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নেটওয়ার্ক ‘গার্লস নট ব্রাইড’ নারীর জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে: ১. নারীর ক্ষমতায়ন ২. নারীর প্রতি পরিবার ও সমাজের সচেতনতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ৩. নারীর কর্মসংস্থান ৪. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ।

বাল্যবিয়ে  শাস্তিযোগ্য অপরাধ

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ অনুযায়ী ১৮ বছরের নীচে কোন মেয়ে এবং ২১ বছরের নীচে কোন ছেলের বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রাাপ্ত বয়স্ক বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় আদালতের নির্দেশে বিবাহ হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না।

আইনের এ বিধান বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মনে করে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।  আইনটির বৈশিষ্ট হলো পূর্বে বলবৎ থাকা ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ছেলেদের বিবাহের বয়স ছিল ২২ বছর এবং মেয়েদের বয়স ছিল ১৮ বছর।

বাল্যবিয়ে  মানবাধিকার লংঘন

ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের এশিয়া অঞ্চলের সুশাসন ও ন্যায়বিচার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মসুচি বিশেষজ্ঞ নাভস্মরণ সিং বলেন, বাল্যবিবাহ মানবাধিকার লংঘন, শিশু অধিকার লংঘন,আন্তর্জাতিক সনদের লংঘন। অনেক দেশে এটি ফৌজদারী অপরাধ। বাল্যবিবাহ বাকি জীবনের সব আনন্দ নষ্ট করে দেয়। ব্যক্তিগত জীবন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে বাল্যবিয়ে

ইসলামী আইন বিশেষেজ্ঞ (ফকিহ)গণ নাবালক নাবালিকা ছেলেমেয়েদের উল্লেখিত দু ধরনের পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়ার বিষয়ে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে ফতোয়া প্রদান করেছেন। একদল সাধারণভাবে বাল্যবিবাহ নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম আবু হনিফা (র.) এর সমসাময়িক ইরাকী ফকিহ (ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ) ইমাম ইবনে শুবরুমা এবং কাজি আকুবকর আল আছাম।

যে সমস্ত ফকিহ বাল্যবিবাহ সম্পাদন নিষিদ্ধ করার পক্ষে তাদের শরয়ী দলিল হলো কুরআন মজিদের সুরা আন নিসার ৬ নং আয়াতের প্রথম অংশ। “ওবতালুল ইয়াতামা হাত্তা ইযা বালাগুন্নিকাহা” অর্থাৎ তোমরা এতিমদের কে পরীক্ষা করতে থাক যতদিন না তারা বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছে যায়। আয়াতংশটি আইনগত অভিভাবক পিতা, পিতার অভাবে দাদা বা বিকল্প অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে থাকা সম্পদ এতিমদের দায়িত্বে কখন প্রত্যার্পণ করা যাবে সে বিষয়ে নাজিল হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ হলো এতিমরা বিবাহের বয়সে না পৌছা পর্যন্ত তাদেরকে সম্পত্তির দেখা শোনার দায়িত্ব অর্পণ করা যাবে না। উদ্ধৃত আয়াতাংশটিতে ছেলে মেয়েদের বিবাহের জন্য একটি বয়স নির্ধারিত আছে মর্মে বুঝা যায়। আর সেটা হলো বুলুগ বা সাবালকত্ব।

ছেলেরা যখন এমন বয়সে উপনীত হয় যে সময়ে তাদের ইহ্তিলাম বা স্বপ্নদোষ হয়। এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে যখন তাদের মাসিক হায়িয বা মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়। ইসলামী শরিয়তে সেটাই হলো ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়স। এই ধারার ফকিহগণের আর একটি যুক্তি হলো আরবী নিকাহ্ (বিবাহ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো যৌনমিলন শব্দটি নিয়ে। যেহেতু বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈধ যৌন মিলন। একজন নাবালক ও নাবালিকার মধ্যে বা একজন সাবালক বা সাবালিকার সাথে আরেকজন নাবালিকা বা নাবালকের মধ্যে বিবাহ সম্পাদন করা হলে বিবাহের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। ফলে বিবাহটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। নাবালক ও নাবলিকার বিবাহ সম্পাদন করা গেলেও তারা সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তাদের উপর শরয়ী আইন প্রয়োগ করা যায় না। সে কারণে এ ধরনের বিয়ে অপ্রয়োজনীয় বা পরিত্যক্ত।

উল্লিখিত মতামতটির বিপরীতে ফকিহগণের অধিকাংশের ফতোয়া বা মতামত হলো নাবালক ও নাবালিকার মধ্যে বা কোন নাবালিকা মেয়ের সাথে যে কোন বয়সের সাবালক পুরুষের সাথে সম্পূর্ণরুপে জায়েজ বা বৈধ। এ মতটির সাথে যেসব ইসলামী আইনবিদ ঐক্যমত পোষণ করেছেন তারা হলেন ইমাম আবু হানিফা (র.), ইমাম শাফেয়ী (র.), ইমাম মালিক বিন আনাস (র.), ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল (র.) এবং তাদের অনুসারী পরবর্তী যুগের ইসলামী আইনবিদগণ। শীয়াহ্ বা জাফরী ফিকহের অনুসারীগণও এ মতের সাথে ঐক্যমত পোষন করেন। এই ধারার ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদগণের অভিমত হলো ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক নাবালক ছেলেমেয়েদের বিবাহ তাদের পক্ষে অভিভাবকগণ সম্পাদন করতে পারেন। ইসলামী শরীয়তে এধরনের বিবাহ সম্পূর্ণরুপে জায়েজ মর্মে তারা মত দিয়েছেন।

তাদের এ মতের স্বপক্ষে তারা পবিত্র কুরআনের সুরা আত তালাকের ৪ নং আয়াত এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণের কতিপয় আসার (কর্মধারা বা আমল) দলিল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সুরা আত তালাকের ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যেসব স্ত্রীলোকের মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে তোমাদের যদি সন্দেহ হয় (জেনে নাও) তাদের ইদ্দতকাল হলো তিন মাস(পরবর্তী বিবাহের জন্য বা স্বামীর সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য)। আর যাদের মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়নি তাদের জন্যও একই নির্দেশ। যেসব আসার (কর্মধারা) এ মতের স্বপক্ষে পেশ করা হয়েছে তা হলো

এক. কুদামা ইবনে মাজউন (রা.) যুবাইর (রা.) এর সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। বিবাহের পর কুদামা ইবনে মাজউন (রা.) ঘোষনা দেন যে তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে যুবাইর (রা.) এর উক্ত কন্যা তাহার ত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিশ বা মালিক হবে।

দুই. হযরত ওমর (রা.) তার এক নাবালিকা কন্যার সাথেসাবালক ওরওয়া ইবনে যুবাইর (র.) এর বিবাহ দেন।

তিন. ওরওয়া ইবনে যুবাইর (র.) তার এক ভাইয়ের তরফের নাবালক পুত্রের সাথে অপর এক ভাইয়ের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন।

চার. এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান (র.) এর সাথে তার নাবালিকা কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দেয়। তিনি ঐ প্রস্তাব জায়েজ হিসাবে গ্রহনপূর্বক উক্ত নাবালিকাকে গ্রহন করেন।

পাঁচ. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সাথে একজন মহিলা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঐ মহিলার প্রথম স্বামীর তরফের নাবালিকা কন্যার সাথে সাবালক মুসাইব ইবনে নাখবার সাথে বিবাহ দেন। আব্দুলল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বিবাহটিকে জায়েজ বা বৈধ ঘোষনা করেন। উল্লেখিত দুটি ধারার ফকিহগণের মতামত পর্য়ালোচনার পর দ্বিতীয় ধারার ফকিহগণের মতামত শরয়ী দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী।

রসুলুল্লাহ (দ.) মুসলিম উম্মাহকে তাদের ছেলেমেয়েদের যৌবনকালে বিবাহ দেয়ার বা করার বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। বাল্যবিবাহ ফরজ বা সুন্নাত এই মর্মে কোন ঘোষনা কুরআন মজীদ কিংবা হাদীসে রসুলে বর্ণিত হয়নি। কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের মুসলমানরা যদি সম্পূর্ণরুপে বাল্যবিবাহ সম্পাদন থেকে বিরত থাকে তাতে গোনাহ হবে বা ইসলামী শরীয়া লংঘন হবে এমন কোন কথাও কোরআন হাদীসে বর্ণিত হয় নাই।

ইসলামে সাধারণভাবে নাবালক ও নাবালিকাদের বিবাহ দেয়া বা করানো বৈধ বা জায়েয। কিন্তু এ ধরনের বাল্যবিবাহ সম্পাদন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত কোনটিই নয়। সাবালক পুরুষদের বিবাহ করা কোন কোন ক্ষেত্রে ফরজ। আবার কোন ক্ষেত্রে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। সুরা আন্ নিসার ৩ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন“ফানকিহু মা ত্ববা লাকুম মিনান নিসায়ী” অর্থাৎ তোমরা বিবাহ কর মেয়েদের মধ্য থেকে যাকে তোমার ভাল লাগে। বিবাহ করার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে গিয়ে নবী করীম (দ.) বলেন যে, হে যুবকদল তোমাদের মধ্যে যে বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। আর যে বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে না সে যেন রোজা রাখে। রোজা যৌন মিলনের ইচ্ছাকে দমন করে। সহীহ বুখারী,হাদিস নং ৫২৯২।

তথ্যসূত্র

www.prothomalo.com
bn.quora.com
www.bbc.com
www.dailyinqilab.com
banglanews24.com
www.dw.com/bn
bangla.bdnews24.com
www.jugantor.com
www.bbc.com/bengali
www.dailynayadiganta.com
somewhereinblog.net
opinion.bdnews24.com/bangla

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *