আনিসুর রহমান এরশাদ
বেহেশতে যেয়ে খুরমা খাবার আশায় দুনিয়ায় না খেয়েও সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা কাউকে এগিয়ে দিতে পারবে না। এটাও ঠিক যে আমাদের দেশে সমাজের অনগ্রসর মানুষকে এগিয়ে নিতে ধনাঢ্য ও স্বচ্ছলদের চেয়ে অস্বচ্ছলদেরই চিন্তা বেশি। যদিও বাস্তবে গরীব নি:স্বদের জন্যে কাজ করে এমন অনেকেরই কেবল নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন হতেই দেখা যায়।
জুম্মার নামাজ উপলক্ষে একত্রিত মুসলমানগণ স্রষ্টাকে স্মরণ শেষে মসজিদ হতে বের হবার সময় ভিক্ষুক দেখতে পান। ভেতরে হুজুর দানের টাকার পরিমাণ বেশি হলে যেমন জান্নাতের দরজায় পৌঁছায়ে দেন, তেমনি ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতরাও ২/১ টাকার জন্যে আল্লাহ রাসুলের নামকেও ব্যবহার করতে ছাড়েন না। দানকারীর টাকা হালাল কিংবা হারাম সেই প্রশ্ন অবান্তর। এই নেয়ার মানসিকতা সংকীর্ণ মানসিকতা আবার যেই লোক এত সস্তায় জান্নাত ক্রয়ের আশায়ও পকেট থেকে ২ টাকার বেশি বের করতে পারেন না তার মানসিকতাই বা কেমন? আসলে ভাববাদী মুসলমানের বস্তুবাদীদের দয়া দাক্ষিণ্য পাবার লোভ দেখে শয়তানও আশ্চর্য হয় কিনা তা অজানা। মুসলমান যখন ভিক্ষা নেয় আর অন্য জাতি যখন ভিক্ষা দেয়- মুসলমান তার জাতির কপালে কলংক তিলক পরায় আর দানকারী তার জাতিকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করে। একই কথা অন্য জাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
যে দান করে সে উপরের মানুষ, উচুঁদরের মানুষ আর যে নেয় তার স্তর নীচে। সে দাতাগোষ্ঠী/ দাতাসংস্থাই হোক আর ব্যক্তিই হোক। নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত কর সবে- ভুলে মুসলমানরা দাতার আসন ছেড়ে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ধর্মের নামে ভিক্ষাকারী যেমন নির্লজ্জ তেমনি সমাজে এমন অবস্থা বিরাজ করলে সেটাও নির্লজ্জ সমাজ। যদি ছিন্ন বস্ত্র পরিধান কারী কেউ কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে ভিক্ষা করে বিধর্মী বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে হাত পাতে এটা যে মুসলমান জাতিরই অপমান, ধর্মের অপমান- এটা কয়জনে বুঝে? কেউ যদি বলেন মালয়েশিয়ার, সিঙ্গাপুরের এমন অবস্থায় আসতে ছোট এনজিও লাগলো না আর আমরা বড় বড় এনজিও বানায়েও ভিক্ষুকমুক্ত দেশ বানাতে পারলাম না। আসলে সঙ্কটতো দৃষ্টিভঙ্গির, সবার মনের মধ্যে ভিক্ষার লোভ, হাত পাতার বিকৃত আনন্দ। অন্যকে দিতে গেলে সক্ষমতা লাগে, সামর্থ্য লাগে, উদ্যোগ লাগে, পরিশ্রম লাগে, বুদ্ধি লাগে। কিন্তু নিতে গেলে দুটো হাত থাকলেই হয়; আর যদি চোখে পানি, রোগাক্রান্ত দুর্বল দেহ থাকে তবে তা’ প্লাস পয়েন্ট। কেউ মাজার বানিয়ে ভিক্ষা করে, কেউ ইসলামিক গান-ধর্মগ্রন্থ শুনায়ে ভিক্ষা করে, কেউ নবী রাসুল কাউকেই ভিক্ষা পাবার উদ্দেশ্য সফল করণে ব্যবহার করতে ছাড়ে না, কেউ নিজের দেশকে ছোট করে- জাতিকে ফকির মিসকীন হিসেবে প্রমাণ করে লেখা প্রজেক্ট প্রোপোজাল নিয়ে ভিক্ষা করে। যে কাজ করতে লজ্জা হওয়া উচিৎ তাই করে যদি কারো গর্ব অনুভূত হয় সে আর সত্যিকারের মানুষ থাকে না।
অনেক সময় বিদেশিরা বাংলাদেশে কাজের লোক, মুচি-মেথর-নাপিত-শ্রমিক এদের কম মজুরি দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। বিদেশে একজন প্রফেসরও বাসায় কাজের ছেলে মেয়ে রাখতে পারে না, তাকে নিজের প্রায় আয়ের সমপরিমাণ দিতে হবে বলে। বড় অফিসারও নিজের গাড়ি নিজে চালায় ড্রাইভার থাকে না, অফিসেও নিজের চা বানিয়ে খায়। তারা বড়লোক হয়েও গরিবী হালতে যিন্দেগী যাপন করেন আর এদেশে ছোটলোক হয়েও বড়লোকি জীবন পরিচালনা করে। ভিক্ষা করে ঘি খাওয়া আর ঘি বানিয়ে ঘি খাওয়া যে একই কথা নয় এটা যেন অনেকেই বেমালুম ভুলে যায়। ফলে গরীবের বন্ধু সুদের মাধ্যমে গরীবের রক্ত চোষেও নিজে আরাম আয়েশে থাকে, মেহনতী মানুষের প্রাণের স্পন্দনও নির্বাচিত হয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেউ যদি ভোট ভিক্ষা করে গম চুরির আশায় সেতো ভিক্ষুকের চেয়েও নিৎকৃষ্ট।
কথায় বলে মাছ খাওয়ায়ে কাউকে সন্তুষ্ট করতে চাইলে আমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয় আর প্রতিদিন মাছ খাবে এমন ব্যবস্থা করতে মাছ চাষ শেখাতে হয়। অনেক হুজুর অন্যের বাড়িতে দাওয়াত পেলে আনন্দিত হন, খেয়ে তৃপ্তি লাভ করেন, আর অন্যকে নেক কাজে আঞ্জাম দেয়ায় গর্বিত হন। অথচ রাসুলের (সা: ) অনেক সাহাবী নামাজ পরিয়েছেন আবার বড় ব্যবসায়ীও ছিলেন। মানুষ যখন শুধু পেয়ে আনন্দিত হয় তখন সে শুধু নেয়ার ধান্ধায় থাকে, দেয়ার আনন্দ সে বুঝে না। যে কষ্ট করে না, চিন্তা ভাবনা করে চলে না তারপক্ষে বহু বছরের অর্জিত মান সম্মান কয়েকমিনিটেই নষ্ট করা সম্ভবপর হয়। কোনো মানুষ যদি ভোগ বিলাস আর পাশবিক উন্মাদনায় ১০ বছরের সঞ্চয় ১০ মিনিটে খরচ করে তখন সে আর স্বাভাবিক মানুষ থাকে না। উত্তরণ অনেক কঠিন, উপরে ওঠার জন্যে পরিশ্রম ও চেষ্টা সাধনা লাগে কিন্তু অবতরণ খুবই সহজ।
সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক কিংবা ডেসটিনির কেলেংকারীর সাথে সম্পৃক্ত কোন ব্যক্তিকেও আপনি জিজ্ঞেস করেন আপনি কি মুসলমান? বলবে হ্যাঁ। এরশাদ শিকদার, মুরগি মিলন কিংবা বাংলা ভাই যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে- আপনি কি আল্লাহ আছে বিশ্বাস করেন? সম্ভবত তারা উত্তর দিতেন- হ্যাঁ। আর্সেনিক যুক্ত পানি উত্তপ্ত করলেও বিষের মাত্রা যেমন বাড়তেই থাকে, বিমান দুর্ঘটনায় যেমন রিকসা দুর্ঘটনার চেয়ে বিপদের ঝুঁকি বেশি থাকে তেমনি ভেতরের ঈমান যদি বাইরে কাজ না করে তবে তার দ্বারা ক্ষতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতেই থাকে। আপনি জিজ্ঞেস করবেন- কি ভাই আপনারা কেন মারামারি করছেন; আপনারা কি ইসলাম ধর্মের অনুসারী? বলবে- হ্যাঁ। আপনারা কি বাংলাদেশের নাগরিক?-বলবে হ্যাঁ। উত্তর শুনে কেউ যদি মনে করেন ধর্ম ও দেশের চাইতে তাহলে বড় কিছু আছে। সেটা কি দল কিংবা অঞ্চল, বংশ কিংবা বর্ণ? যদি বলেন- হ্যাঁ। তবে কি এসব কোনটাই না হয়ে যে মানুষ হয়েছে সেই বেশি শ্রদ্ধার পাত্র হবে না?
যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামও অনেক উন্নত হয়ে যায় পরিশ্রমী নারী পুরুষের অবদানে। বৈষম্য জিইয়ে রেখে আমরা নারীকে অর্থমূল্য আছে এমন উৎপাদনশীল কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখি। যদিও এর সুফল হিসাবে ইভটিজিং ও ধর্ষণমুক্ত সমাজের নিশ্চয়তা বিধান হয় না। বাংলাদেশের পর্দানশীল নারী মালয়েশিয়ার পর্দানশীল নারীর মতো গাড়ির ড্রাইভার হেলপার হয় না। বিধর্মের দেশেও দিন রাত ২৪ ঘন্টা শংকামুক্তভাবে নারী অবাধ বিচরণ করতে পারে কোন যৌন হয়রানির আশংকা ছাড়াই। শুনেছিলাম ডেনমার্কে ৪২ বছর আগে ১টি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, ৪২ বছরে ১টিও অস্বাভাবিক মৃত্যুর রেকর্ড নেই! বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য প্রদানকারী জাপান বাংলাদেশ থেকে ৠণের একটি টাকাও ফেরৎ নেয়নি এদেশে এখনো চরম দরিদ্র ও নি:স্ব মানুষ আছে বলে, নিয়মানুযায়ী সরকার ৠণের টাকার কিস্তি বৎসরে দেয় কিন্তু তারা স্বেচ্ছায় তা আবার ফেরৎ দেয় এই দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্যে। এখন কারো যদি অভদ্র ঈমানদারের চাইতে ভদ্র মানুষদের (বেঈমান) বেশি ভালো লাগে তা কি খুবই অযৌক্তিক হবে?
আমার খুব কষ্ট লাগে যখন শুনি যে দেশে জুম্মার নামাজের পর কতল কার্যকর করার জন্যে জল্লাদ রেডি থাকে সেখানেও গৃহকর্মীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সৌদি আরবের কথা বাদ দিলেও পৃথিবীতে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম দেশ। অথচ এখানে এমন অবস্থা বিরাজমান যে দৈনিক গড়ে খুন হয় ১১টি, আত্মহত্যা হয় ২১টি। ফকির থেকে বড়লোক হবার জন্যে একেকজন একেক ধরনের মেশিন ব্যবহার করেন। যে মেশিনের একদিক দিয়ে শূণ্য পকেট ও খালি হাতে ঢুকলেও আরেকদিক দিয়ে পকেট ভর্তি টাকা ও হাত ভর্তি ফুলের মালা নিয়ে বের হওয়া যায়। যেমন: রাজনীতি মেশিন, এনজিও মেশিন, মাজার মেশিন ইত্যাদি। কেউ যদি জাতে ফকির আর ভাবে জমিদার হয় তার যে দশা আমাদের অনেকেরই সেই দশা। যেই সুইডেনের কেউ ৩০ বছর কোনো কাজকর্ম না করলেও রিজার্ভের টাকায় চলতে পারবে তাদের পরিশ্রমে জাত যায় না অথচ আমাদের অনেকে নিজের জুতাটা নিজে কালি করেন না, নিজের মশারি নিজে টানান না, নিজের চা নিজে বানিয়ে খান না। এমন অনেকে আছেন ভিন দেশে যেয়ে ভিন জাতির জুতা কালি করেন, হোটেলে কাজ করেন, গাড়ি পরিষ্কার করেন, টয়লেটগুলোকে ব্যবহার উপযোগী রাখতে পারদর্শীতা দেখান অথচ নিজ দেশে গোপনীয় লোম কাটতেও পারলে পরের সাহায্য নেন। আসলে এটি বিকৃত রুচি ও বিকৃত চিন্তা।
নরওয়ের মানুষ একসময় সমুদ্রে মাছ ধরতো। সিঙ্গাপুর ছিলো গরীব জেলেদের আবাস, খুবই খারাপ অবস্থা হওয়ায় মালয়েশিয়া সাথে রাখেনি। তারা কোথায় গেছে? কেউ হয়তো বলবেন, আমরা কম কিসে? আমাদের বসুন্ধরা শপিংমলে দুই ঈদেইতো ১০ হাজার কোটি টাকার শপিং হয়। এক গ্রামীণ ফোনইতো ৩৫০ কোটি টাকা দৈনিক আয় করে। আমরা পার্লামেন্ট চালাইতেই ঘন্টায় ১৫ লাখ টাকা খরচ করি। আরো কত কি বলার! যখন বলা হবে এক বিল গেটসের একবছরের আয় দিয়েই তো বাংলাদেশ ১১ বছর চালানো যায়। তখন হয়তো অনেকে চোখ উপরে তুলবেন। আমরা বলি বেশি করি কম। আর যারা শুধু স্বপ্ন দেখেন কিন্তু অলস তাদের বলা ছাড়া আর করার কিইবা আছে? কথাকেই কেউ বড় কাজ মনে করলে আর কি কিছু বলার থাকে? বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশে সরকারি কর্মকর্তাকে জনগণের স্যার বলে সম্বোধন করতে হয় না বরং জনগণকেই তারা স্যার বলে। কারণ তাদেরকে জনগণই বেতন দেন, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের অন্ন-বস্র-বাসস্থান-চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। অথচ ছোটবেলায় পড়া আজব দেশের বাস্তব উদাহারণ যেন বাংলাদেশ। এখানে সব উল্টো।
যোগ্যতার চেয়েও বড় কথা নূন্যতম প্রয়োজন। এদিকে খেয়াল নেই, খেয়াল শুধু ঝামেলা পাকানো আর গোলমাল বাঁধানোর দিকে। মহাত্মা গান্ধীর ছবি ওবামার অফিসেও এমনি এমনিই টানানো থাকে না। তিনি ভারতীয় হয়েও পাকিস্তানের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে অনশন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেই কাজটি শুরু করো যা শেষ করতে পারো। যে সৃষ্টিকে ভালোবাসে না অথচ বলে আমি স্রষ্টার প্রেমে পড়েছি সে আসলে মিথ্যা বলে, আসলে সে বেহেশতের প্রেমে পড়েছে কিংবা দোজখেরে ভয় পেয়েছে। অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকলে ব্যক্তির ক্ষমতা থাকে না, সে মনের দিক দিয়ে ছোট হয়ে থাকে, মর্যাাদা নিয়ে বাঁচতে পারে না। তাই মনের ভেতরের বাধাটাকে আগে দূর করতে হবে। যখন দেখবেন কেউ মুসলমানের খারাপটা দেখে না আর অমুসলমানের ভালোটা দেখে না, কিংবা নিজ দলের শুধু ভালোটাই দেখে আর অন্য দলের শুধুই খারাপটা দেখে, নিজের লাভের জন্যে সবই করে পরের ক্ষতি ঠেকাতে কিছুই করে না তখন বুঝবেন তারা ছোট দাজ্জাল, দাজ্জালের প্রেতাত্মা। উভয়ের মধ্যকার মিল হচ্ছে দাজ্জালের এক চোখ অন্ধ হওয়ায় সে শুধু এক চোখে দেখে, আর এদের মনের চোখ বন্ধ হওয়ায় শুধু চর্মচোখে দেখে। এদের আর দাজ্জালের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে, এরা যেহেতু দাজ্জালের আগে এসেছে ফলে এরাই দাজ্জালের পূর্বসূরী।