আনিসুর রহমান এরশাদ
বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কেউ কেউ শুধু ক্ষমতাবানদের পক্ষে তদবির করে, কেউ কেউ ক্ষমতাহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য লড়াই করে। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বৈচিত্র্যময় ভূমিকা থাকলেও সাধারণত এরা উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিকামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হন। অনেকে সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রায়ণ, দুর্নীতিমুক্তকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমানো ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন।
অনেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী উদ্যোগ আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকেন। অনেকে থিংক ট্যাংক হিসেবে গবেষণা ও নীতি পর্যালোচনা করেন; বিজ্ঞান চক্র, সাক্ষরতা আন্দোলন ইত্যাদি কাজ করেন। অনেকে দুর্নীতি, বৈষম্য, বঞ্চনা, অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সোচ্চার থাকেন এবং প্রতিরোধ সৃষ্টিতে সক্রিয় থাকেন। ফলে সুশীল সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল মূল প্রতিষ্ঠানের ওপর সামাজিক নজরদারির দায়িত্ব পালন করেন, ন্যায়-সুন্দর-কল্যাণের পক্ষে সংগ্রাম চালান।
সাধারণত সরকার বা শাসকশ্রেণী সুশীল সমাজের সদস্যদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবি দিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেন। এমন পোষমানা সুশীল সমাজ চান- যারা সরকারের প্রতিটি কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করবে, সরকারি দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের সব কথা-কাজকে সমর্থন দিবে, যাবতীয় অপকর্মকে আড়াল করবে। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ সেবক ও ক্যাডার বুদ্ধিজীবীদের কাছে দেশ-জাতি-জনগণের স্বার্থ বড় না হয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়। ত্যাগের মানসিকতা না থাকায় সুবিধাবাদীদের পক্ষে জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় না। যারা বড় বড় পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান, ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের আনুকূল্য চান, নিজের এনজিও তে মোটা অঙ্কের ফান্ড চান, আবাসিক এলাকায় প্লট চান, সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে খুব বড় বড় স্যুটকেস নিয়ে বিদেশ সফর করতে চান, জাতীয় পুরস্কার চান; তাদের গা-বাঁচিয়ে চলতে হয়, সরকারকে স্বস্তিতে রাখতে হয়।
সুশীল সমাজের কণ্ঠস্বর যাদের স্বার্থে আঘাত করে, তারা বিচলিত ও ক্ষুব্ধ হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করলে রাজনৈতিক গোষ্ঠী জবাবদিহির দাবির মুখে সুশীল সমাজকে প্রতিপক্ষ মনে করে। যারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতে চান না, সরকারের ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করেন, অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেন, প্রয়োজনে সাধ্যমতো প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন, তৎপরতায় জনগণের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটান; এদের ওপরই সরকারের ক্ষোভ, অসৌজন্যমূলক ভাষায় সমালোচনা। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজনৈতিক সমাজ সর্বদাই অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার সুশীল সমাজকে পাশে পেতে চায়। নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতারা, দরকার হলে বুদ্ধিজীবীদের কিনতে পাওয়া যায় বলে।
উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিকামী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত বলা হলেও অনেক সময় জনগুরুত্বপূর্ণ বা বৃহত্তর গণমানুষের কাছে আলোচিত ইস্যুতেও নিরব থেকে সমালোচিত হন। আমার মনে হয়- সুশীল সমাজের মধ্যে যারা সামাজিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় হয়েও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিজেরা কাজ করেন কিংবা রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংগঠনকে ব্যবহার করেন, তারা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা হারান। সুশীল সমাজের সংগঠন যদি কার্যত রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়, তখন ভালো পদক্ষেপও অকার্যকর-কলুষিত -বিতর্কিত-প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সর্বসাধারণের উন্নতি বিধান এবং টেকসই উন্নতির জন্য গৃহীত কার্যক্রমে সুশীল সমাজকে রাজনৈতিক অঙ্গনে অবতীর্ণ হতে দেখা যাওয়াটা দুর্বলতার পরিচায়ক। অথচ ‘আওয়ামীপন্থি’ নিরপেক্ষ, ‘বিএনপিপন্থি’ নিরপেক্ষ ভাগে স্পষ্টতই চিহ্নিত হয়ে গেছেন এদের অনেকেই!
বাংলাদেশে যারাই ক্ষমতায় যান তাঁদের মধ্যেই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা তৈরি হয়। সিভিল ও রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার হয় না; জেনেও সুশীল সমাজের খুব কম জনই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের সামনে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে পারে। মুখে যে যাই বলুক কার্যত- নিরপেক্ষতা রক্ষা করা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কর্ম সম্পাদন ভীষণ দুরূহ। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে গেলে ঝুঁকি বেশি, অধিকতর সাহসিকতার প্রয়োজন হয়। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কারও ওপর নাখোশ হলেই তার অসম্মানিত হওয়া ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। নিজের মান-সম্মান ও পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দিতে পারে নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষেরাই। এমন সাহসী ও পরিচ্ছন্ন মানুষ বড়ই কম। ফলে শুধু সুশীল সমাজের মানুষদের উপর ভরসা করে বিদ্যমান জাতীয় সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজা অবাস্তব।
আপনি সুদের ব্যবসায় নিয়োজিত থাকবেন, অনুদান এনে ঋণ দিবেন, কিস্তি না দিলে টিনের চাল খুলে নিবেন-গরু ছাগল নিয়ে যাবেন, সুযোগ পেলে ক্ষমতার মসনদে আরোহণের খায়েশ রাখবেন, স্বার্থে আঘাত লাগলে দেশবিরোধী তৎপরতা চালাবেন, ঋণ খেলাপী ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন, সাম্রাজ্যবাদী দাতা গোষ্ঠীর ইচ্ছার পৃথিবী গড়ে তোলবেন, তাতে সাধারণ মানুষের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না; অথচ কেউ কিছু বলবে না- এটা কেন আশা করেন! সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি কাঠামো শক্তিশালী করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা দরকার, নেতৃত্বের উত্তরাধিকার সৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভাবার বিকৃত রুচি সম্পন্নদের প্রচন্ড অহমিকা মানুষকে অন্যের মর্যাদা, অধিকার ও গুণাবলীর প্রতি অন্ধ করে তুলে। বিরোধিতা কিংবা সমর্থন, পক্ষে কিংবা বিপক্ষে থাকবেন তা’ নির্ধারিত হতে হবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে বিবেচনা করে। ব্যক্তিস্বার্থ, পারিবারিক স্বার্থ, দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সামষ্টিক-সার্বিক-সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিলে চলবে না।
সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে-কিছু নেতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজ করেন, রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংগঠনকে ব্যবহার করেন। এনজিও ও ডোনার কেন্দ্রিক হওয়ায় জনগণ এবং গণতন্ত্রের পক্ষে শাসকদের সঙ্গে আলোচনা, দর কষাকষি এবং প্রয়োজন হলে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন না। মানুষের সেবার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের সেবায় নিয়োজিত থাকেন, দুর্নীতির আশ্রয় নেন। ফলে তাদের কথাকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া অসচেতন জনগণ দ্বারাই সম্ভব। দেশের সবসমস্যার টেকসই ও সম্মানজনক সমাধান শুধু এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না- এই রকম, ‘না, না’ সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই হবে না। ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলা তারই সাজে যে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যও ঘুষ দেন না, মিথ্যা তথ্য দিয়ে আয়কর ফাঁকি দেন না, উৎকট দুর্গন্ধ মুখোশে ঢেকে রাখেন না, ইনকামের সাথে খাওয়া-দাওয়া-চলা-ফেরা-বিলাস-ভ্রমণে সামঞ্জস্য থাকে না। বাইরে এক রকম, ভেতরে ভেতরে একেবারে ভিন্ন রকম- এটাতো যৌক্তিক নয়। দেশের খাবেন, দেশের পরবেন কিন্তু কাজ করবেন বিদেশিদের- তারপরও দেশপ্রেমীর তকমা লাগাবেন। প্রকৃত সুশীল সমাজের কাজ এসব হতে পারে না।