এখন শহরের আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে গ্রাম। শহরের সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামেও। বদলে গেছে গ্রামীণ জীবন। হাতে হাতে স্মার্টফোন। ব্যবহার করছে ইন্টারনেট। ঘরে ঘরে বিদ্যু। বাসায় বাসায় টেলিভিশন। ডিশ লাইন দেওয়া হচ্ছে রুমে রুমে।
চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ততা
গ্রামবাংলার জীবনযাপন পাল্টে গেছে। আগে যেখানে পুরুষরা অধিকাংশই কৃষি কাজ করতো। জমি-জমা চাষ করতো। খুব কমজনই পড়ালেখা শিখে চাকরিতে যুক্ত হতো। এখন অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হচ্ছে।
ক্ষেতে-খামারে কাজের জন্য দিনমজুর-শ্রমিক এলাকায় আর পাওয়া যায় না; অন্য জেলা থেকে এই গ্রামে কাজ করতে আসে। আগে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে দেখা যেত, এখন আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাওয়ার মতো ভিক্ষুক দেখা যায় না।
স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেকেই
আগে খুব কমই বাণিজ্যিকভাবে হাসঁ-মুরগী ও গরু-ছাগল পালন করতে দেখা যেত। এখন অনেক খামার হয়েছে, খামারি বেড়েছে। এখন মাছ চাষও করা হচ্ছে। অনেকেই স্বাবলম্বী।
যে বাড়িতে মাটির ঘরটিও খুব দুর্বল-নাজুক ছিল, সেই বাড়িতেও পাকা বা আধাপাকা ঘর দেখা যায়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছু্ই গ্রামে পৌঁছে গেছে।
আয়বর্ধক কাজে নারীর যুক্ততা
প্রান্তিক পর্যায়েও বদলে যাচ্ছে সবকিছু। এখন ঘরে ঘরে চমৎকার সব ডিজাইনের সোফা সেট। আগে যিনি দিনমজুর ছিলেন এমন অনেকের ঘরেও এখন দামি দামি ফার্নিচার।
আয়বর্ধক কাজে নারীর যুক্ততাও বেড়েছে। নারীরাও সংসারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। গ্রামেও এখন এমন অনেক পরিবার রয়েছে যে পরেবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী-কর্মজীবী।
গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তন
পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই যে পরিবর্তন; এর পেছনে বড় ভুমিকা রাখছে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। পড়াশোনা করে চাকরিতে যুক্ত হয়েও অনেকে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাচ্ছে।
বহু ধরনের পেশায় নিজেদের যুক্ত করে জীবন বদলে নিচ্ছে। এক সময় অন্যের জমিতে শ্রম দিতেন বদলে গেছে তাদেরও জীবনযাত্রার মান। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় এখন আর অজপাড়াগাঁ নেই। পালাবদল ঘটেছে গ্রামীণ অবকাঠামোতে, খাদ্যের প্রাপ্যতায়, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে।
পাকা রাস্তায় বদলে গেছে দৃশ্যপট
এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাতায়াত করছে শতভাগ। নিজের করা বাগানের সবজিসহ উৎপাদিত নানা পণ্য নিয়ে সহজেই যাতায়াত করছেন; ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি এসেছে আর অর্থনৈতিক উন্নয়নও হচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও কাঁচা রাস্তার কারণে এলাকার মানুষ বেকার সময় কাটাতেন। বর্ষাকালে হাঁটুসমান কাদায় পরিণত হতো রাস্তাটি। পাকা রাস্তার কারণে বদলে গেছে গোটা গ্রামের চিত্র।
কৃষিতেও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া
গ্রামীণ পরিবেশও পাল্টে গেছে। যিনি কুঁড়েঘরে থাকতেন তিনিও এখন টিনের ঘরে থাকেন। বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন লাঙ্গল-জোয়ালের বদলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।
নানামুখী কর্মে নিয়োজিত হচ্ছে এলাকার মানুষ। আয় বাড়ায় অনেকেই দারিদ্র্যকে জয় করে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছেন। আর্থ-সামাজিক অবস্থাও বদলে গেছে।
ঘুমন্ত গ্রাম এখন জাগ্রত গ্রাম
যারা অন্যের জমিতে কাজ করতেন তাদের অনেকেই ছোটখাটো ব্যবসা বা বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করছেন। কেউ কেউ অটোরিক্সা বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালিয়েও জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সন্ধ্যার পর যেসব এলাকা হতো ‘ঘুমন্ত গ্রাম’; এখন সেসব এলাকায়ও রাত দশটারও বেশি সময় পর্যন্ত বাজারে টেলিভিশন চলে, চায়ের দোকানে আড্ডা আর গল্প হয়।
আয়ের নানান পথ খুলছে
যাতায়াতের সঙ্কট দূর হওয়ার পর অনেকে বিভিন্ন ফসল-সবজি আবাদ করছেন। অনেকে এখন মোটরসাইকেল, সিএনজি, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা ভাড়ায় চালিয়েও আয় করছেন।
যাতায়াত সহজ হওয়ায় অনেকের আয়ের পথও খুলছে। যুবকরা কেউ কেউ পোল্ট্রি বা গরুর খামার করছেন। বিভিন্ন ধরনের রাইস মিল করছেন। অসুখ-বিসুখে হাসপাতালে যেতে পারছেন।
বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা
গ্রামীণ চিত্র পাল্টে গেছে। লালমাটির বিখ্যাত টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক গ্রামের মানুষের কাছে বিদ্যুত কিংবা পাকা সড়ক ছিল স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু।
যাতায়াতের ভালো রাস্তা না থাকায় কেউ সহজে যাতায়াত করতে পারত না। বর্তমানে রাত জেগে বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা হচ্ছে প্রতিটি ঘরেই। হারিকেনের আলো বা কুপির আলোতে পড়াশোনার দৃশ্য দেখা যায় না।
বাড়তি আয়ের সুযোগে ঘুরেছে ভাগ্যের চাকা
গ্রামের রাস্তাঘাট আর খুব একটা কাঁচা নেই। সংসারে বাড়তি আয় করার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। শীতে যাদের ঘরের মধ্যেই কুয়াশা পড়ত, ঠান্ডা বাতাসে থাকবার পারতেন না; এমন মানুষজনেরও ভালো বাসস্থান হয়েছে। যারা তিনবেলা গরম ভাতও খেতে পারতেন না, তাদেরও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। যারা খেয়ে না খেয়ে দিন-রাত কাটিয়েছেন; ঘুরেছে তাদেরও ভাগ্যের চাকা।
গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নতি
পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও গোসলখানা রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির এই পরিবর্তনের পেছনে রেমিটেন্স, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নতি, কৃষির বহুমুখীকরণ ও পোশাক খাতের মতো শ্রমনির্ভর খাত ভূমিকা রেখেছে।
নন-ফার্মিং কাজও বাড়ছে। পাল্টে গেছে প্রান্তিক জীবন, পাল্টে গেছে গ্রাম। ফলে অনেক শহরবাসী মনের অজান্তেই স্বপ্ন বুনেন শহর ছেড়ে গ্রামে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার।
ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ও ব্রডব্যান্ড সুবিধা
ইন্টারনেট কানেকটিভিটিতে বদলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রাম হাতীবান্ধা। আগে ফরম হাতে পূরণ করতে হতো, কিন্তু এখন সব অনলাইনে। ব্রডব্যান্ড সুবিধাও আছে। তক্তারচালায় দোকানে আগে মডেম দিয়ে অনলাইনে বিভিন্ন ফরম পূরণ হতো। ভালো ইন্টারনেট সুবিধা না-থাকায় একটা ওয়েবপেজ লোড হতেই তিন চার মিনিট লাগত। আর ফরম পূরণে সময় লাগত এক ঘণ্টার মতো।
কমে যাচ্ছে ডিজিটাল বিভেদ
ফাইবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবায় মানুষ নতুন আলো খুঁজে পেয়েছে। ওয়াইফাই লাইন আসার পর থেকে এখন ফরম পূরণ করতে বেশিক্ষণ লাগে না। অনলাইনে বইও অর্ডার করেন।
বইয়ের পিডিএফ কপি ডাউনলোড করেও পড়া যায়। আগে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের অভাবে গ্রামের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ তেমন ছিল না। এখন দিনদিন শহর ও গ্রামের ডিজিটাল বিভেদ কমে যাচ্ছে।
প্রযুক্তির কল্যাণ ও প্রযুক্তির ছোঁয়া
প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রামীণ জনপদ বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা পৌঁছে যাচ্ছে। কম্পিউটার কম্পোজ, ই-মেইল, ইন্টারনেট, ছবি তোলা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সরকারি ফরম পূরণ, জমির খতিয়ানের জন্য আবেদন ও সরবরাহ, মোবাইল ব্যাংকিং, ফটোকপি, জীবনবীমা, প্লাস্টিক আইডি কার্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম পূরণ, লেমিনেটিং, ভিডিও ফোন, জন্মনিবন্ধন, নেট ব্রাউজিং, পাবলিক পরীক্ষার ফল দেখা, কৃষি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তথ্য প্রদান, বিদেশে যাওয়ার রেজিস্ট্রেশন, ছাপার কাজ ও বিদ্যুৎ বিল গ্রহণ করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক জনপদগুলোতে ঘরে বসেই স্বল্পমূল্যে আধুনিক জীবনযাত্রার সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। তথ্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে এলাকাগুলো এবং খুবই অল্প সময়ে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল পদ্ধতির সব ধরনের আদান-প্রদান।
গ্রামেও পৌঁছেছে সৌর বিদ্যুত
গ্রামীণ এলাকার গ্রামীণ জনপদ সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই এখন সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে৷ সোলার প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ ব্যাটারির স্টোরেজে জমা হয়। কিন্তু একবার সেই ব্যাটারির ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে গেলে সোলার প্যানেলের বাকি বিদ্যুৎ আর জমা হয় না ।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। একসময় গ্রাম অঞ্চলে হারিকেনের আলো ছিল একমাত্র ভরসা। কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্যপট এখন বদলে গেছে গ্রামীণ জনপদের। সড়কে সৌরবাতি আর বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে গ্রামে। গ্রামের পথঘাট ও হাটবাজারে ভূতুরে অন্ধকার আর নেই।
সৌরবাতির আলোয় আলোকিত হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তাঘাটসহ সর্বত্র। সোলার স্ট্রিট লাইট, যা সারাদিন সূর্যের আলো সঞ্চয় করে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত আলোকিত করে রাখছে গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আর এতে নিরাপদে চলাফেরা করছে এলাকার মানুষ। কমেছে চুরি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।
প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত
গ্রামীণ জনপদে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে! কল সেন্টারের নামে ফোন করে প্রতারণা করে। বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণার জাল বিস্তার করে। লোভনীয় অফারের ফাঁদে প্রতারিত হয় গ্রামের মানুষ। নানা লোভ দেখিয়ে, প্রলুব্ধ করে ফাঁকা চেকে সই নিয়ে প্রতারণা করেন।
কেউ চাকরির টোপে প্রতারণা করে। নানা ভুল-মিথ্যা পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে। বিভিন্ন ভাতা দেয়ার নাম করে প্রতারণা করে। বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা করে। তথ্য প্রযুক্তি অপব্যবহার করে প্রতারণা করে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণা হয়। বিভিন্ন ইন্সুরেন্সের প্রলোভনে প্রতারণা হয়।
জনহিতকর সেজে প্রতারণা হয়। সমবায় সমিতির নামে প্রতারণা করে। মোবাইল টাওয়ার বসানোর নামে প্রতারণা করে। ফেসবুক-ইউটিউবে প্রতারণা করে। ঋণ দেয়ার কথা বলে জামানতের টাকা নিয়ে উধাও হয়। ব্যবসার নামে প্রতারণা হয়! ঘটকালির আড়ালে প্রতারণা হয়! প্রশিক্ষণের নামে প্রতারণা হয়!
চলবে