বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ ঘরবাড়ি

এবারের ঈদে আগের ঈদগুলোর তুলনায় একটু বেশি সময়ই গ্রামে কাটলো। টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার তক্তারচালা থেকে কামালিয়াচালা ও হানারচালায় এবং মির্জাপুরের দড়ানীপাড়া গ্রাম প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ফুরসত মিললো। আড্ডা, আলাপচারিতা ও মতবিনিময়ের সুযোগও পেলাম বেশ।  গ্রামীণ ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছুর বদলে যাওয়া ভালোভাবেই অনুধাবন করলাম। আলহামদুলিল্লাহ!

বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ ঘরবাড়ি

গ্রামীণ ঘরবাড়ির (Rural Housing) নির্মাণ কাঠামো ও বিন্যাস প্রকৃতি অনেকটাই বদলে গেছে। দৃষ্টিনন্দন বাড়িগুলোই বলে দিচ্ছে অধিবাসীদের রুচি ও পছন্দ বদলেছে। আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে বলেই বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল আর দেখা যায় না। শনের বা খড়ের চৌচালা ছাউনি ও বাঁশের বেড়াও চোখে পড়ে না।

মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনির গৃহ মনে হয় বিলুপ্তই হয়েছে। ছন গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। একসময় গ্রামীণ এলাকার গরীব-মধ্যবিত্তর বাড়িঘরের ছাউনি ছন। সেকালে ছন মাটি কিংবা বেড়ার ঘরে ছাউনি হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। ঘর বাঁধা কিংবা কুটীর নির্মাণে কুঁড়েঘরে ধানের খড় কিংবা পাটকাঠির প্রচলন ছিল তিন/চার দশক পূর্বে।

মাটি আর ছনের তৈরি ঘর ঐতিহ্য

এখন বাঁশ, খড়, শন, পাটকাঠি, গোলপাতা, মাটি ব্যবহার করে ঘরবাড়ি তৈরী আর নেই বললেই চলে। কালের বির্বতনে হারিয়ে যেতে বসেছে ছনের চালের মাটির ঘরবাড়ি। ছন দিয়ে ছাউনি দেওয়া (ছাওয়া) মাটির ঘর বিলুপ্তির পথেই বলা যায়। অথচ একসময় বাড়িঘরে পুরাতন ছন সরিয়ে নতুন ছন ব্যবহার করা হতো।

তবে এখন পাকা-আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত মানুষ। ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে টিনকে। ফলে গ্রামবাংলা থেকে ছনের ব্যবহার ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার সফরনামায় মাটির ঘরে বসবাসকারীদের কথা লিখেছিলেন। মাটি আর ছনের ব্যবহার আবহমানকালের বলে মাটির তৈরি ছনের ঘর ঐতিহ্যের দাবি রাখে।

বাড়ছে পাকা ও সুদর্শন বাড়িঘর

সামর্থ্যবান গৃহস্থরা ঘর তৈরীতে ঢেউটিনই বেশি ব্যবহার করছেন। ঘরের খুঁটি, রুয়া, পাইড় তথা ঘরের কাঠামো তৈরীতে বাঁশ কিংবা কাঠের ব্যবহার এখনো একেবারে উঠে যায়নি। ঘরের সম্মুখভাগে ছোট বারান্দা ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলছে।

আগে অবস্থাসম্পন্নরা বারান্দাসহ কাঠের দোতলা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করতো এবং ঘরের চৌকাঠগুলি নানা ধরনের খোদাই করা নকশায় সজ্জিত করতো। এখন ধনী ও সচ্ছল লোকেরা গ্রামেগঞ্জেও শহরের ন্যায় একতলা থেকে শুরু করে ইট দিয়ে বহুতল ভবন করছেন।

প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে পাকা ও সুদর্শন বাড়িঘরের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। ইট, বালু, সিমেন্ট, লোহার প্রচলন বেশ বেড়ে গেছে।

পরিবর্তনের জোরালো হাওয়া

আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন গ্রামেও খাবার পরিবেশন করা হয় ডাইনিং টেবিলে। সোফা, ফ্রিজ, টেলিভিশন ও ডিসের লাইন ঘরে ঘরে। খাদ্যাভাসে, রান্নার রেসেপি ও খাবার আইটেমেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। রুচির পরিবর্তন দৃশ্যমান হয় হাতে হাতে দামি স্মার্টফোনে, অভিজাত আসবাবপত্রে।

অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষ গ্রামে না থাকলেও চমৎকার বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন, বাড়ির আঙিনায় নানা ধরনের ফল ও ফুল গাছ লাগিয়ে সৌখিন বাগান গড়ে তুলছেন। সাইদ কাকার সৌখিন বাগানে শোভা বর্ধন করছে ত্বীন ফল। যেসব গাছপালা রাতে বাতির আলোতে কিংবা চাঁদের আলোতে অপরূপ সৌন্দর্যময়  হয়ে উঠে।

গ্রামীণ জনপদে শহর বা বিদেশের প্রভাব

গ্রামীণ জনগণ ঘরবাড়ি নির্মাণে যে আকার, নকশা ও রূপকে নির্ধারণ করছেন তা শহরের কিংবা বিদেশের বাড়িঘরের প্রভাব পড়েছে। থাকার ঘর বেশিরভাগই পূর্বমুখী ও দক্ষিণমুখী করে নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে আয়তাকার কিংবা বর্গাকৃতি উঠান।

জামান মঞ্জিলের পশ্চিম পাশে রয়েছে পুকুর। গ্রামীণ এলাকার অনেক বাড়িঘরের কাছে পুকুর রয়েছে। বসতবাড়ির চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল ও কুলের মতো বহুবর্ষজীবী গাছ লাগানোর রীতিও রয়েছে। রান্নাঘর, গোয়ালঘর, হাঁসমুরগির ঘর পৃথক করে নিম্নমানের উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়।

ঘর কী এবং কেন

ঘর মানুষের বসবাসের জন্য নির্মিত কাঠামো। গৃহ শব্দ থেকে ঘর শব্দটি এসেছে। ঘর শব্দের অন্যান্য সমার্থক শব্দগুলো হচ্ছে – ভবন, আলয়, আবাস, নিবাস ইত্যাদি। ঘরের ভিতর বৃষ্টির পানি প্রবেশ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন রকম ছাদ নির্মাণ করা হয়ে থাকে। ঘরের ভিতরে থাকা জিনিসপত্র এবং বাসিন্দাদের চোর বা অন্যকোন ক্ষতিকারক প্রাণি বা মানুষের থেকে সুরক্ষার জন্য তালা লাগিয়ে রাখা হয়।

পশ্চিমা ঘরনার সকল বাড়িগুলো এক বা একাধিক শয়ন কক্ষ, বাথরুম, রান্নাঘর এবং বসার কক্ষ থাকে। কিছু বাড়ীতে আলাদা খাওয়ার ঘর অথবা খাওয়ার কক্ষ অন্য ঘরের বর্ধিত অংশে থাকতে পারে। কিছু বাড়িতে বিনোদন কক্ষের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। কৃষি প্রধান এলাকা গুলোতে গৃহপালিত পশু-পাখির জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা রাখা হয়।

ঘরের প্রকারভেদ

ঘরের প্রকারভেদ হিসেবে – কুঁড়েঘর, টিনের ঘর, দালান, মাটির ঘর, আধা-পাকা ঘর ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়। ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার উপর ঘরের স্তরগুলো লক্ষ্য করা যায়। সামাজিকভাবে নিজস্ব ঘরকে বাড়ী এবং যারা অন্যের বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকেন, তাদেরকে ঘর শব্দের পরিবর্তে বাসা হিসেবে আখ্যায়িত করতে দেখা যায়।

ব্যক্তি হিসেবে পুরুষ তার স্ত্রীকে ঘরনী কিংবা গৃহলক্ষ্মী হিসেবে দেখে থাকে। গৃহিণী হিসেবে পুরুষের সাথে থাকাকে ঘর করা বলে। এছাড়ও, বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের উপযোগী বংশ অন্বেষণকে ঘর খোঁজা বলে। দুঃখজনক সংবাদ হিসেবে ঘর ভাঙানো শব্দটি সত্যিকার অর্থেই বেশ কষ্টকর।

কুমন্ত্রণা, ব্যক্তির চরিত্র, মানসিক ভারসাম্য ইত্যাদি ঘর ভাঙানোর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী। ঘরের রক্ষণাবেক্ষনে পুরুষের ভূমিকাই বেশি। তবে সাংসারিক শান্তিসহ সামাজিক ভারসাম্যতা রক্ষার্থে স্ত্রীর ভূমিকাও কোন অংশেই কম নয়। একটি বাড়ির সামনে বা পিছনের অংশে উঠান থাকতে পারে, যেখানে বাসিন্দারা আরাম বা খেতে পারে।

ঘরের ব্যুৎপত্তি

ইংরেজি শব্দ হাউস প্রাচীন ইংরেজী শব্দ হাস থেকে সরাসরি আগত, যার অর্থ “বাসস্থান, আশ্রয়, ঘর, বাড়ি”, যেটি প্রোটো-জার্মানি হুশান শব্দ থেকে উদ্ভূত (ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ দ্বারা পুনর্গঠিত)। প্রোটো-সেমেটিক হায়ারোগ্লাইফিক প্রতীকে ঘর বোঝাতে ইংরেজি ‘বি’ প্রতীক ব্যবহারিত হত।

প্রতীকটিকে বিভিন্ন ভাষায় “বেয়েত”, “বাজি” বা “বেথ” বলা হত এবং পরবর্তীতে রোমান হরফ বিটার উৎপত্তি হয় এই প্রতীক থেকেই। আরবিতে “বেয়েত” অর্থ ঘর, এবং মাল্টিজ বেইয়েত বলতে মুলত বাড়ির ছাদকে বোঝানো হয়।

ঘরের নকশা

স্থপতিরা ঘরে বসবাসকারীর চাহিদা মত করে ঘরের নকশা করে থাকেন। “ফেং শুই” মূলত বৃষ্টিপাত এবং ক্ষুদ্র জলবায়ুর মতো বিষয়গুলির উপর ভিত্তি করে বাড়িঘর সরানোর একটি চীনা পদ্ধতি, সম্প্রতি বাড়ির অভ্যন্তরের লোকদের উপর ইতিবাচক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ জায়গাগুলির নকশার পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে, যদিও এর আদৌ কোন প্রভাব আছে কিনা তা প্রমাণিত নয়।

ফেং শুই বলতে অনেকসময় ঘরের চারিদিক বেষ্টিত করে রাখা অথবা রিয়েল স্টেট পরিভাষায় অন্দর-বহিরাঙ্গন প্রবাহ বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাড়ির গ্যারেজ এবং অন্যান্য ব্যবহারিত স্থানগুলি বাদ দিয়ে বাকি প্রতি বর্গ ফুট স্থানগুলো “বাসযোগ্য জায়গা” হিসেবে ধরা হয়। ইউরোপীয় রীতিতে বাড়ির গ্যারেজ এবং অন্যান্য ব্যবহারিত স্থানগুলি বাদ দিয়ে ঘরের চারপাশে দেয়াল বেষ্টিত প্রতি “বর্গ মিটার” স্থানকে বাসযোগ্য জায়গা ধরা হয়।

ঘরের স্তর বা তলার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্কয়ার ফুটের তারতম্য হয়ে থাকে। প্রায়শই গৃহপালিত বা বন্য প্রাণীর জন্য মানব আবাসের সংস্করণগুলির অনুরূপ ছোট ঘর বানানো হয়ে থাকে। মানব নির্মিত প্রাণী ঘরগুলোর মধ্যে আছে, পাখির ঘর, মুরগির ঘর, কুকুরের ঘর এবং কৃষি কাজে প্রয়োজন হয় এমন পশু-পাখির জন্য আছে খামার ঘর।

ঘরের অংশ সমূহ

অনেক বাড়িতে বিশেষায়িত সুবিধা সহ কয়েকটি বড় কক্ষ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি ছোট কক্ষ বিদ্যমান থাকে। এর মধ্যে একটি বাস / খাওয়ার কক্ষ, একটি ঘুমানোর কক্ষ এবং (যদি উপযুক্ত সুযোগসুবিধা এবং পরিবেশ বিদ্যমান থাকে) পৃথক বা সংযুক্ত ধোলাই কক্ষ এবং প্রক্ষালন কক্ষ থাকতে পারে।

বেশিরভাগ প্রচলিত আধুনিক বাড়িগুলিতে কমপক্ষে একটি শয়নকক্ষ, বাথরুম, রান্নাঘর বা রান্নার জায়গা এবং একটি বসার ঘর থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি বাড়ীতে যে সকল অংশ বিদ্যমান থাকে তা হলঃ কুঞ্জকুটির, অলিন্দ ঘর, চিলেকোঠা, নিচ তলা, স্নানকক্ষ, শয়নকক্ষ, গুদাম ঘর, সংরক্ষণাগার, খাবার কক্ষ, পারিবারিক কক্ষ, উনান, হলঘর, সম্মুখ কক্ষ, গ্যারেজ, হলওয়ে, আখা, পড়ার কক্ষ, রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর, ধোপাখানা, গ্রন্থাগার, বসার ঘর, মাচা, বৈঠকখানা, বারান্দা, বিনোদন কক্ষ, ইবাদাত কক্ষ, সিঁড়ি ঘর, সূর্যঘর, সুইমিং পুল ও জানালা ইত্যাদি।

ঘরের ইতিহাস

ঘর আশ্রয়স্থল হিসেবে সু-প্রাচীনকাল থেকে বিবেচিত হয়ে আসছে। রোমান স্থপতি ভিট্রুভিয়াসের গাছের শাখা এবং মাটির সমন্বয়ে তৈরি ঘরের কাঠামোকে প্রথম বাসযোগ্য ঘরের স্থপনা হিসেবে বিবেচিত হয়, এটি কুড়ে ঘর নামেও পরিচিত।

ফিলিপ ট্যাবর এর মতে ১৭ শতকের ডাচ বাড়িগুলোই হচ্ছে আধুনিক বাড়ির ভিত্তি। বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে যত দূর ধারণা পাওয়া যায় তাতে বাড়ির বাড়ি বলা হয় নেদারল্যান্ডকে। নির্মাণের বুৎপত্তির ইতিহাস ১৭ শতকের এক-তৃতীয়াংশ ধরে ডাচদের আলাদা আলাদা বাড়িকে একত্রীকরণ এর মাধ্যমে নগর নির্মাণ দিয়ে শুরু হয়।

মধ্য যুগে বিভিন্ন চাহিদা অনুযায়ী ম্যানর ঘর তৈরি করা হত। ঘরগুলিতে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, কর্মচারী, চাকরিজীবী এবং অতিথি সহ অসংখ্য লোকের বসবাস ছিল। তাদের জীবনধারা অনেকাংশেই সাম্প্রদায়িক ছিল, কারণ বড় খাওয়ার ঘরে ও সভাকক্ষে নিজস্ব রীতিনীতি অনুসরণ করা হত এবং সৌর ঘুমানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল।

১৫ এবং ১৬ শতকে ইতালীয় রেনেসাঁ পালাজ্জোতে প্রচুর ঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ম্যানর হাউসগুলির গুণাবলী এবং ব্যবহার বিচিত্রের বিপরীতে, পালাজোর বেশিরভাগ কক্ষের কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল না, তবুও বেশ কয়েকটি দরজা লাগানো থাকত। এই দরজাগুলি সংলগ্ন কক্ষগুলি রবিন ইভান্স “পৃথক পৃথকভাবে সংযুক্ত চেম্বারের ম্যাট্রিক্স” হিসেবে বর্ণনা করেন।

এই ধরণের বিন্যাস ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে বসবাসকারী বাসিন্দারা অবাধে অন্যান্য কক্ষে বিচরণ করতে পারত, ফলে গোপনীয়তা রক্ষা হত না। একবার ভিতরে প্রবেশের পরে দালান থেকে বের হতে হলে একটি ঘর থেকে অন্য ঘরে এবং এভাবে পাশের ঘর দিয়ে যাওয়ার দরকার হত। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও নানা প্রয়োজনেড় কারণে ঘরের বাসিন্দাদের কাছে ঘরের আলাদা একটি গ্রহণযোগ্যতা সর্বদা বিদ্যমান ছিল।

ঘরের কক্ষগুলি পৃথকিকরণ এবং গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ফলস্বরূপ কক্ষ বর্ধনের প্রথম উদাহরণ ১৫৯৭ সালে নির্মিত লন্ডনের চেলসির বিউফর্ট হাউস। এটি ইংরেজ স্থপতি জন থর্প ডিজাইন করেছিলেন, যিনি তাঁর পরিকল্পনায় লিখেছিলেন, “সকলের মধ্যে দীর্ঘ প্রবেশ”। ঘর থেকে চলাচলে পথের এই বিচ্ছিন্নতার ফলস্বরূপ করিডোর এর কার্যকারিতার বিকাশ ঘটেছিল। সেসময় এই পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে, যেখানে প্রতি ঘরে আলাদা দরজা ব্যবহার করা হত এবং সকল ঘরে যাতায়াত এর জন্য দরজাগুলোর সামনে পথের ব্যবস্থা ছিল।

ইংরেজ স্থপতি স্যার রজার প্র্যাট বলেছেন “বাড়ির পুরো দৈর্ঘ্যের মধ্যভাগের পথটি ঘরের অন্যান্য বাসিন্দাদের অনবরত প্রবেশ আটকিয়ে গোপনীয়তা নিশ্চিত করে”। ১৭-শতাব্দীর মধ্যে স্থপতিরা উচ্চবিত্তদের এবং তাদের অধীনস্থ চাকরদের কক্ষ আলাদা ভাবে নকশা করতে সক্ষম হয়। প্রাট এর মতে ‘পরবর্তীতে কর্তা ব্যাক্তিদের আরও গোপনীয়তা দেয়ার লক্ষে এমন ধরনের নকশা করা হয় যাতে সাধারণ কর্মচারীরা কখনই প্রকাশ্যে তাদের অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত হতে না পারে।’ ১৯ শতকের মধ্যে এই কক্ষ বিভাজনের মাধ্যমে ধনী গরিবের মধ্যকার দূরত্ব শারীরিক ভাবেও বাড়িয়ে দেয়।

সমাজবিজ্ঞানী উইটল্ড রাইব্যাকজেনস্কি লিখেছেন, ‘দিন ও রাতের জন্য আলাদা কক্ষ এবং অভিজাত ও সাধারন এলাকা বিভাজনের প্রক্রিয়া এখান থেকে শুরু হয়।’ ভিন্ন ভিন্ন ঘরের জন্য ভিন্ন প্রবেশ পথের প্রচলন ঘর গুলোকে উন্মুক্ত থেকে গোপনীয় করে তোলে।

ইংল্যান্ড এবং রেনেসাঁর বৃহৎ বাড়ির তুলনায় ১৭ শতাব্দীর ডাচ বাড়িগুলো ছিল যথেষ্ট ছোট এবং চার থেকে পাঁচ জনের বসবাস উপযোগী ছিল। এটি কারণ ছিল যে তারা দাসদের উপর নির্ভরতার বিপরীতে “স্বনির্ভরতা” গ্রহণ করেছিল এবং পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা শুরু করেছিল। ডাচ দের কাছে পারিবারিক স্থল এবং কর্মস্থল আলাদা করা আবশ্যক ছিল যেখানে ঘর ছিল কাজের পর আরাম-আয়েশ করার জায়গা।

১৭ শতাব্দীর শেষার্ধে ঘরের নকশা কর্মস্থল মুক্ত হয়ে উঠে যা ভবিষ্যৎ গৃহনির্মাণ পদ্ধতির নতুন দ্বার উন্মোচন করে। এর ফলে শিল্প বিপ্লব উপকৃত হয় যেখানে বড় আকারের কারখানার উৎপাদন এবং অধিক শ্রমিক অর্জন করা সম্ভব হয়। ডাচদের ঘরের নকশা এবং এর কার্যকারিতা আজও পূর্বের মত বহাল আছে।

১৯ এবং ২০ শতকে আমারিকান রীতিতে কিছু পেশাজীবীদের (যেমনঃ চিকিৎসক) ঘর এমন ভাবে তৈরি করা হত যেখানে ঘরের সামনের অংশ অথবা দুইটি কক্ষকে কর্মস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হত, কক্ষগুলো মুল বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকতো। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামগুলির বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসকগন স্থান পরিবর্তন করে অফিস বা হাসপাতাল থেকে কাজ পরিচালনা শুরু করেন।

গৃহ অভ্যন্তরে প্রযুক্তি এবং ইলেক্ট্রনিক পন্যের ব্যবহার ঘরের গোপনীয়তা এবং ঘর থেকে কাজের বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্রমান্বয়ে নজরদারি এবং যোগাযোগের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ব্যক্তিগত অভ্যাস ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি প্রভাব ফেলছে।

ফলস্বরূপ, “ব্যক্তিগতটি আরও জনাথন হিলের মতে “এভাবে গোপনীয়তা আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে এবং ব্যাক্তিগত জীবনযাপনের আকাঙ্খা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে যা সামাজিকতা ধ্বংসের জ্বালানী হিসেবে কাজ করছে।” যোগাযোগ হ্রাস পেলেও, পৃথক কাজ এবং জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা প্রকট হচ্ছে। অপরদিকে, কিছু স্থপতি এমন বাড়ির নকশা করেছেন যেখানে খাওয়া, কাজ এবং জীবনযাপন একত্রে করা হচ্ছে।

ঘরের নির্মাণ

বিশ্বের অনেক জায়গায় ভেজানো উপকরণ ব্যবহার করে ঘর নির্মিত হয়। ম্যানিলার পায়েটাস এলাকার বস্তির ঘরগুলি কাছাকাছি অবস্থিত আবর্জনার স্তুপ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বানানো।  ডাকারের বাড়িগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী দিয়ে তৈরি যেখানে ছাদ এবং ভিত্তি হিসেবে আবর্জনা ও বালুর মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এই আবর্জনা-বালির মিশ্রণটি ঘরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক বাড়ি নির্মাণের কৌশলগুলির মধ্যে হালকা ফ্রেম নির্মাণ (যেখানে কাঠের সরবরাহ আছে) এবং রামড আর্থ নির্মাণ (যেখানে কাঠ সহজলভ্য নয়) উল্লেখযোগ্য। কিছু অঞ্চলে একচেটিয়া ভাবে বাড়ির ভিত্তি হিসেবে ইট এবং খাঁজকাটা পাথর ব্যবহারিত হয়। কতক বাড়ী তৈরিতে নিয়মিত উপকরণের পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়াম এবং লোহা ব্যবহারিত হয়।

ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় বিকল্প নির্মাণ সামগ্রীসমূহের ভিতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, অন্তরক কংক্রিট ফর্ম (কংক্রিট দিয়ে ভরা ফেনা), কাঠামোগত উত্তাপ প্যানেল, হালকা গেজ ইস্পাত এবং ইস্পাত ফ্রেমিং। প্রায়শ লোকেরা হাতের কাছে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে অথবা নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপকরণ দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে থাকে।

সুতরাং পুরো শহর, অঞ্চল, কাউন্টি বা এমনকি রাজ্য / দেশগুলি একই ধরণের উপাদান দিয়ে নির্মিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান বাড়ি তৈরিতে একটি বড় অংশ কাঠ ব্যবহার করে, অন্যদিকে বেশিরভাগ ব্রিটিশ এবং অনেক ইউরোপীয় বাড়ি তৈরিতে পাথর, ইট বা কাদা ব্যবহার করা হয়।

বাঁশ ব্যবহার করে বাড়ি নির্মাণ করা হয়। চীন, জাপান এবং অন্যান্য এশিয়া এন দেশে বাঁশের তৈরি বাড়িগুলি জনপ্রিয়, কারণ এগুলো ভূমিকম্প ও হারিকেন প্রতিরোধ করে।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে কিছু বাড়ির ডিজাইনার প্রাক-উৎপাদন ব্যবহার শুরু করেছিলেন। সিয়ার্স, রোবাক এন্ড কো ১৯০৮ সালে সর্বপ্রথম তাদের সিয়ারস ক্যাটালগ বাড়ি সাধারণ মানুষের কাছে বাজারজাত শুরু করে। ঘর নির্মাণে প্রিফ্যাব কৌশল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

এই পদ্ধতিতে প্রথমে ছোট ছোট কক্ষগুলি ফ্রেমিংয়ের পরে পুরো দেওয়াল পূনঃনির্মাণ করে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ধরনের ঘর নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে ভালো আশ্রয়স্থলে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া।

অতি সম্প্রতি নির্মাতারা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে সহযোগিতা শুরু করেছেন যারা উচ্চ বায়ু প্রবাহ এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য প্রিফ্যাব্রিকেটেড ইস্পাত ফ্রেমযুক্ত বাড়ি নির্মাণের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই উদ্ভাবনের ফলে কম জনবলে অধিক মজবুত টেকসই এবং দ্রুত নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্ভব হবে।

সল্প-ব্যবহারিত নির্মাণ পদ্ধতি সাম্প্রতিক সময়ে পুনরায় জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। যদিও ব্যাপক ব্যবহার না হলেও এই পদ্ধতিগুলো নির্মানে সক্রিয়ভাবে জড়িত মালিকদের দিনে দিনে আকৃষ্ট করছে। যেগুলো হলঃ হ্যাম্পক্রিট নির্মাণ, কর্ডউড নির্মাণ, জিওডেসিক ডোম, স্ট্র-বেল নির্মাণ, ওয়াটল ও ডাব, কাঠের ফ্রেমিং এবং কাঠামো নির্মাণ।

উন্নত বিশ্বে ঘরের নকশায় শক্তি-সংরক্ষণের গুরুত্ব বেড়েছে। গৃহায়ন কার্বন নিঃসরণের একটি বড় কারণ (গবেষণায় দেখা গেছে এর হার যুক্তরাজ্যে গড়ে ৩০%)। সল্প শক্তির গৃহনির্মাণের প্রচলন দিনে দিনে বাড়ছে।

বাড়ির নামকরণে বাসিন্দাদের আবেগ অনুভুতি

কিছু বাড়ির নামকরণের সাথে বাসিন্দাদের আবেগ অনুভুতি জড়িয়ে থাকে। একটি বাড়ি তার বাসিন্দা বা নির্মাতার রুচি বা অবস্থা প্রকাশ করে থাকে। সুতরাং একটি বৃহৎ এবং অভিজাত বাড়ি মালিকের সুস্পষ্ট সম্পদশালী হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে।

ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ বাড়িগুলো তথা বিখ্যাত ব্যাক্তিদের বাসভবন অথবা সুপ্রাচীন কোন বাড়ি একটি এলাকার নগর পরিকল্পনায় ঐতিহ্যবাহী বাড়ি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই জাতীয় বাড়িগুলো স্মৃতি ফলক দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়। বাড়ির মালিকানা অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির একটি সাধারণ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।

তথ্যসূত্র

archive.ittefaq.com.bd
bn.wikipedia.org
bn.banglapedia.org
www.bd-journal.com

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *