ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস অনুসারে হযরত আদম (আ.) ছিলেন আল্লাহর সৃষ্ট প্রথম মানব। আল্লাহ তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেন। তারপর তার দেহে প্রাণ সঞ্চার করেন। সৃষ্টিকালে তার উচ্চতা ছিল ৬০ কিউবিট। আদমের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণের জন্য তার বাম পাঁজরের হাড় থেকে হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়। সৃষ্টির পর তাদের আবাস হয় বেহেশত বা জান্নাতে।
আল্লাহ হিন্দুস্থানে/সিংহলে (বর্তমান শ্রীলংকায় ‘আদম পাহাড়’ নামে পরিচিত) একটি পাহাড়ের উপরে আদমকে (আ.) নামিয়ে দেন। হাওয়াকে (আ.) নামানো হয় বর্তমান সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের নিকটে হিজাযে। বিরাট পৃথিবীতে অজানা-অচেনা পরিবেশে অনেক দূরত্বের ব্যাবধানে দুজন দুজায়গায় এসে পড়েন। একশ বছর একনাগাড়ে হিন্দুস্থানে একাকী জীবনযাপন করেন আদম। এ সময় তিনি মাথা নত করে হাত দুটি মাথায় রেখে ভুলের জন্য শুধু কেঁদে বেড়াতেন। দুজনের কেউ কারো ঠিকানা জানতেন না। কিন্তু তারা জানতেন যে, তার অপর সাথীও এ ভূখণ্ডেরই কোথাও না কোথাও এসেছেন।
সুন্দর নীল আকাশ, সবুজের অপরূ রূপের বাহার, তরু-মরু-পাহাড়-নদী-ঝরনা-সাগরের অনুপম সৌন্দর্য, জল-স্থল-অন্তরীক্ষের মাছ-পশু-পাখির বসবাসেও শূন্যতা অনুভব করতেন। একাকিত্বের এ যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে তারা একে অপরকে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরতে লাগলেন। আদম (আ.) শ্রীলংকা হতে হাঁটা শুরু করলেন হাওয়ার খোঁজে, ওদিকে হাওয়াও আদমের (আ.) খোঁজে জেদ্দা হতে এগুতে থাকলেন। এভাবেই দুইশত বছর পরে স্রষ্টার অপার অনুগ্রহে তাদের পরস্পরের দেখা হলো মক্কার চৌদ্দ কিলোমিটার দূরের খোলা মাঠ আরাফাতে। নতুন করে দু’জনের জানাজানি হলো, সাক্ষাৎ হলো।
আদি পিতা ও আদি মাতা একত্রিত হয়ে সর্বপ্রথম মানুষের পরিবার সূচনা করেছিলেন। নিজের কনে খুঁজে বের করতে, তার সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে একটি পরিবার গঠন করতে হযরত আদম (আ.) শ্রীলংকা হতে আরাফাত পর্যন্ত ৪৬৩১ কি.মি. বা ২৮৮৭ মাইল হেঁটেছেন, আর হাওয়া (আ.) জেদ্দা হতে আরাফাত পর্যন্ত ১১৬ কি. মি. বা ৭২ মাইল হেঁটেছেন; অর্থাৎ হাওয়া (আ.) যতটা পথ হেঁটেছেন, আদম (আ.) হেঁটেছেন তার চল্লিশ গুণ বেশি পথ! সেই সময়টা ছিল খাদ্য সংগ্রাহক যুগ। খাদ্য উৎপাদনের দরকার হতো না। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাদ্য-শস্য, ফল-মূল ও পশু-পাখি-মাছ সংগ্রহ করে খেতে হতো।
হাওয়া (আ.) এর গর্ভে একসাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান যমজভাবে জন্মগ্রহণ করতে লাগলো। তাদের ৮০ জোড়া থেকে ১৪০ জোড়া সন্তান হয়। বিভিন্ন সময়ের বা গর্ভের সন্তানদের তথা প্রথমবারের পুত্রের সাথে দ্বিতীয়বারের কন্যা ও দ্বিতীয়বারের পুত্রের সাথে প্রথমবারের কন্যার বিবাহ হতো। এভাবেই আদম-হাওয়ার পরিবার গড়ে উঠলো। সারা পৃথিবীতে ছিল একটি মাত্র পরিবার। আলোচিত সন্তানগণ হলেন: হাবিল, কাবিল, আকলিমা, গাজাহ। তাদের সন্তান শিস (আ.) পরবর্তীতে আল্লাহর একজন নবী তথা বাণীবাহক হয়েছিলেন।
আদম (আ.)-এর হায়াতের জিন্দেগি শেষ হয়ে আসলে তিনি তার সকল পুত্র-কন্যা ও পৌত্রদেরকে ডেকে পরস্পর সমভাবে ও সৎপথে থাকার চলার উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন যে, তার মৃত্যুর পর শিস তার প্রতিনিধি হবেন। তার উপদেশ মত চলার জন্য সকলকে পরামর্শ দিয়ে চির বিদায় নিলেন। আমরা সবাই আদম (আ.)-হাওয়ার (আ.) এর বংশধর; তাদের থেকে সবার জন্ম। সবাই আমরা আদম সন্তান, এক আদম থেকেই আমরা সবাই পৃথিবীতে এসেছি।
হযরত আদম (আ.) এর বড় ছেলের নাম ‘হাবিল’। বিয়ের বয়স হলে হাবিলের জন্য যে মেয়েটিকে পছন্দ করা হয়েছিল তার নাম ‘আকলিমা’। এদিকে কাবিল আর আকলিমা একসাথে একই জোড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিল। আকলিমা লিওজা অপেক্ষা সুন্দরী ছিলেন। হাবিলের সাথে আকলিমার এবং কাবিলের সাথে লিওজার বিবাহ স্থির হলে কাবিল জেদ ধরে বসলো, সে লিওজাকে বিয়ে করবে না, আকলিমাকেই বিয়ে করবে। কিন্তু আদম নবীর উপর স্রষ্টার ওহি হলো- জোড়া ভেঙে বিয়ে দিতে হবে। একই জোড়ার কাউকে বিয়ে করা যাবে না। স্রষ্টার এই আদেশ কাবিল কিছুতেই মানতে রাজি হলো না।
আদম (আ.) হাবিল ও কাবিলকে স্রষ্টার নামে কিছু উৎসর্গ (কুরবানি) করতে বললেন। যার কুরবানি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে, সেই আকলিমাকে বিবাহ করবে। দুই ভাই রাজি হলো। হাবিল কিছু শস্যদানা এনে একজায়গায় রেখে দিল। আর কাবিল একটা মোটা-তাজা পশু একটু দূরে বেঁধে রেখে দিল। কিছুক্ষণ পর আসমান থেকে একটা অগ্নি এসে হাবীলের শস্যদানাগুলোকে পুড়িয়ে ছাই-ভস্ম করে দিল।
এতে বুঝা গেল- হাবিলের কুরবানী স্রষ্টা কবুল করেছেন। এই ঘটনায় হাবিলই যে আকলিমাকে বিবাহ করবেন তা নির্ধারিত হয়ে গেল, কাবিল খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সে আকলিমাকেই বিয়ে করতে অনেক ভেবেচিন্তে হাবিলকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল। হাবিল ছিল সহজ সরল প্রকৃতির এবং ধর্মপ্রাণ। আর কাবিল ছিল শয়তানের অনুগামী হিংসুক। একদিন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে সুযোগ মত জঙ্গলের মধ্যে একটি বিরাট পাথর দিয়ে হাবিলের মাথায় আঘাত করলো কাবিল। এতে হাবীল মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, তার মৃত্যু হলো।
হাবিলকে হত্যা করার পর কাবিলের মনে ভয় হল যে, পিতা জানতে পারলে, এর বিচার করবেন। হাবিলের লাশ কোথাও দূরে নিক্ষেপ করে ফেলা যায় কি না, তা চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় অদূরে দুটি কাক মারামারি করতে করতে একটি কাকের মৃত্যু হলো। জীবিত কাকটি গর্ত করে মৃত কাকটিকে মাটিতে ঢেকে দিল। এ দৃশ্য মনোযোগ সহকারে দেখে কাবিল তার ভ্রাতার লাশকে লুকাবার ব্যবস্থা করলো। আর সে নিজে খুবই লজ্জিত হয়ে গেল। আদম (আ.) হাবিলের নিহত হওয়ার সংবাদে ভীষণভাবে দুঃখ পেলেন। কাবিল শাস্তির ভয়ে কোথাও নিখোঁজ হয়ে গেল এবং আল্লাহর অবাধ্য ও নাফরমান হয়ে রইল।