আনিসুর রহমান এরশাদ
একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর-স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধ পরিবারই একটি সুস্থ সমাজ ও সভ্যতার জন্ম দেয়। পরিবারই একজন মানুষকে ধাপে ধাপে তৈরি করে। একটা মানুষ সেভাবেই বেড়ে উঠে পরিবার তাকে যেভাবে গড়ে তুলে। পরিবার হচ্ছে পাঠশালা, পরিবার হচ্ছে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পারিবারিকভাবে যদি একটি শিশু সঠিকভাবে গড়ে ওঠে ওই শিশু বড় হয়ে সঠিক পথেই থাকবে। তাই পরিবার প্রথা ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তি নিশ্চিত করে।
আসলে মানবতার ভবিষ্যত রচিত হয় পরিবারকে কেন্দ্র করেই। পারিবারিক জীবনে অনাবিল শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে পরিবার হয়ে ওঠে সব উদ্যম, প্রেরণা ও প্রশান্তির ক্ষেত্র। তাই সন্তানকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে এবং স্বামীকে স্ত্রীর আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত করে টেকসই উন্নয়ন হবে না।
সুন্দর জীবনের অন্যতম শর্ত সুন্দর পারিবারিক সম্পর্ক। একেকটি পরিবার যেন কতগুলো হৃদয়ের সমষ্টি, যেখানে আছে জীবনের প্রবাহ, আছে স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালোবাসা, আছে উষ্ণ আবেগ, যত্ন-আত্তি-পরিচর্যা, আছে নিরাপত্তা, মিলেমিশে থাকার প্রবল বাসনা, আছে সহনশীলতা এবং একে অন্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা। পরিবারহীন জীবন হচ্ছে বিরাট শূন্যতা ও চরম অসম্পূর্ণতায় ভরা জীবন। পরিবারহীন মানুষ নোঙরহীন নৌকা বা বৃন্তচ্যুত পত্রের মতোই স্থিতিহীন।
তবে পরিবারে নারীর মতামতের যদি গুরুত্ব না থাকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিশু বা নারীর মোটেই অংশগ্রহণ না থাকে, জেন্ডার অসমতা থাকে এবং কন্যা হওয়ায় বৈষম্যের শিকার হয় ও নারী পুরুষের সহিংসতার শিকার হয়- তবে টেকসই উন্নয়ন হয়েছে বলতে পারি না। পরিবার যদি নারী সদস্যদের সমাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে তবে টেকসই উন্নয়নে উপনীত হওয়া অবশ্যই সম্ভব হবে।
বর্তমানে দুর্বল ভারসাম্যহীন পরিবার সমাজে ঘুণ ধরাচ্ছে। এক দুই যুগ আগেও মানুষের আশা-আনন্দ-বিনোদনের কেন্দ্র জুড়ে ছিল পরিবার। এখন পারিবারিক সম্পর্কগুলো খুব ঠুনকো, খুব অনাত্মীয়ধর্মী। বর্তমান সমাজে পারিবারিক বন্ধন নেই বললেই চলে। পরিবারে রক্তের ও বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধন ভুলে গিয়ে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হচ্ছে। মূল্যবোধ লোপ পাওয়ায় নিজেদের পরিবারের প্রতিও আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করছি।
গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না পরিবারের বড়দের। স্নেহসুলভ আচরণ করছে না বড়রা ছোটদের প্রতি। পারিবারিক জীবনে সুষ্ঠুতা না থাকায় সামাজিক জীবনের সুষ্ঠুতা ব্যাহত হচ্ছে। এমতাবস্থায় যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য এবং অন্যসব অধিকার নিশ্চিত না করায় কারো ভবিষ্যৎ জীবন সফল না হলে টেকসই আগামী রচিত হবে না।
দরিদ্র পরিবারের মেয়েটিও দীর্ঘতর সময় বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে কি না, তুলনামূলক দেরিতে বিবাহিত জীবন শুরু করে কি না, তুলনামূলক কম সন্তান নেবে কি না, প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাবে কি না, সহিংসতা ও নিপীড়নমুক্ত জীবন যাপন করতে পারবে কি না, নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ও ক্ষমতা পাবে কি না ইত্যাদি বিবেচনায় রাখতে হবে।
পরিবার প্রথার বন্ধনকে আকড়ে ধরে রাখা না হলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়ে যাবে। পরিবার প্রথায় বিপর্যয় নেমে এলে সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটবে। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, দেরিতে বিবাহ, পারিবারিক সহিংসতা, জেন্ডার বৈষম্য, পারিবারিক বন্ধনে দুর্বলতা, পারিবারিক ভাঙনে শিশু-নারী-বয়স্কদের ছিন্নতা কমায়ে সবার সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতেই আমাদের প্রয়াস।
মানুষের শরীর, মন ও আত্মাকে সুস্থ রাখতে পরিবারকে যথাযথ মানে টিকিয়ে রাখা এবং বিকশিত করতেই আমাদের সকল আয়োজন। আমরা মনে করি- যেহেতু ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, আর সমাজ থেকে একটি দেশ বা রাষ্ট্র।
সেহেতু একটি পরিবার যদি ভালো হয়, ব্যক্তি ভালো হবে, ব্যক্তি ভালো হলে দেশ বা রাষ্ট্র ভালো চলবে। এক্ষেত্রে কোনো পরিবারের তারুণ্যের শক্তি এবং এই শক্তি যথাযথ বিকাশ ও ব্যবহার যদি নিশ্চিত না হয় তবে সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
সবার মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে; ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনে অসমতা তৈরি হলে তাতেই স্পষ্ট হবে টেকসই উন্নয়ন হয়নি। একটি ন্যায্য ও টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল অবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সহিংসতার ফলে নারী ও শিশু গৃহহীনতা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
আমরা চাই পরিবার ও পারিবারিক জীবন হবে প্রেম-ভালোবাসা, দরদ-মায়ায় ভরপুর। থাকবে না দ্বন্দ্ব-কলহ, সন্দেহ, অমিল-অশান্তি, পারিবারিক নির্যাতন। ‘ফাদার ডে, ‘মাদার ডে’ আর ‘ফ্যামিলি ডে’ পালন করাই শুধু নয়, পরিবার ও পারিবারিক জীবনে সুখ থাকবে প্রতিদিন, নিরাপদ অভিবাসন থাকবে।
গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, সত্যবাদিতা, পরস্পরে শ্রদ্ধাবোধ, আদব-কায়দা থাকবে; পরিবার ব্যবস্থায় থাকবে না অত্যাচার, লাঞ্ছনা, অন্যায় ও অবিচার। প্রত্যেকে তার প্রাপ্য অধিকার পাবে।
প্রত্যেকে লাভ করবে পারস্পরিক নির্ভরতা, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট থেকে পাবে কর্মের প্রেরণা এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে অগ্রসর হয়ে যাবে উদ্যমপূর্ণ গতিতে; যা মানবতার বৃহত্তর অগ্রগতিকে সম্ভবপর করবে। মানব প্রকৃতির মধ্যকার কাক্সিক্ষত উপাদানগুলো আলোড়িত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠবে।
লেখক : সহ-প্রতিষ্ঠাতা,সেভ দ্য ফ্যামিলি- বাংলাদেশ