পরিবারের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ্য : ওবামা

লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘মোর’ এ প্রকাশিত নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পরিবার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘স্ত্রী ও দুই মেয়েই আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্যই আজ আমি এই অবস্থানে। আমার এই কঠিন কাজগুলোর পরে তারাই আমার আশ্রয়স্থল। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে পরিবারকে ঠিকমত সময় দিতে পারি কিনা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে হোয়াইট হাউসে বসবাস আমাদেরকে যেকোনো সময়ের চেয়ে স্বাভাবিক জীবন উপহার দিয়েছে।

মালিয়ার জন্মের সময় সৌভাগ্যবশত আমি ও মিশেল তিনমাস একসাথে মেয়েটির সঙ্গে সময় কাটাতে পেরেছিলাম। কিন্তু এরপরই মিশেলকে তার কাজে ফিরে যেতে হয়। আমাকে শিকাগোর ল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ফিরতে হয়। প্রায়ই আমাকে তিনদিন পর্যন্ত পরিবার থেকে দূরে থাকতে হতো। বাসা শিকাগোতে হলেও রাষ্ট্রের আইনজীবী হিসেবে কাজ করায় প্রায়ই স্প্রিংফিল্ডে মিটিংয়ের জন্য উপস্থিত থাকতে হতো।

আমরা চাকরিজীবী হওয়াতে বেশকিছু সুবিধা ছিল। আমরা হয়তো বাচ্চাদের খেয়াল রাখার জন্য কাউকে নিয়োগ দিতে কিংবা বাইরে খাওয়া-দাওয়া করার সুযোগ পেতাম; অন্যান্য পরিবারের মতো অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবে আমাদের দুজনেরই অনেক ঋণের বোঝা ছিল। অর্থাৎ আমরা যখন বিয়ে করি , বিয়ের পর আমরা একসঙ্গে দরিদ্র হতে শুরু করি। তাই বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বিলের জন্যই খুব হিসাব করে খরচ করতাম। কারণ আমাদের শিক্ষাঋণ পরিশোধ করা থেকে শুরু করে বেবিসিটারের টাকাও যেন ঠিকমতো দিতে পারি। এতকিছুর চাপ অনেক সময়ই আমাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠতো। সাশা’র জন্মের পর মিশেল ও আমার পরিশ্রম অনেক বেড়ে যায়।

মিশেল তখন বাসাতেই সম্পূর্ণ সময় দেয়া শুরু করে। তাই ঘরের বাইরের কাজগুলোর সম্পূর্ণ দায়িত্বই আমার কাঁধে এসে পড়ে। আমার তখন নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। কিন্তু আমি যতই পরিশ্রম করি না কেন দিনদিন আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্ব ঘটছিল। আমাদের বোঝা শুধু বাড়ছিল। আর বেশিরভাগ বোঝাই পড়ত মিশেল’র কাঁধে; যেমনটা প্রত্যেকটি পরিবারেই হয়। তবে আমরা সৌভাগ্যবান যে আমার শাশুড়ি মারিয়ান সেসময় আমাদের অনেক সাহায্য করেন। তিনি আমাদের বাড়ির খুব কাছেই বাস করতেন। তাই প্রায়ই তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করতেন। তবুও মিশেলের উপর অনেক চাপ ছিল এবং সে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিল।

আমি যখন সিনেটর নির্বাচিত হই তখন পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে যায়। আমাকে প্রতি সপ্তাহেই ওয়াশিংটন যেতে হতো। প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনের সময় আমাদের জীবন একদমই ওলোট-পালট হয়ে যায়। তখন আমাকে বেশিরভাগ সময়ই রাস্তায় থাকতে হতো। মিশেলের উপর তখন আরো চাপ বেড়ে যায়। সময় যেতে যেতে তার বোঝার পরিমাণও বাড়তে থাকে। এজন্যই আমি মিশেলকে আমাদের পরিবারের স্তম্ভ বলি। কারণ সে সত্যিই তাই এবং সবসময় তাই ছিল।

তখনও আমি সত্যিই জানতাম না যদি আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারি তবে কি করব। জানতাম, পরিবারে আমি অনেক কমই সময় দিতো পারব। জানতাম, মালিয়া ও সাশাকে তাদের স্কুল ও বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসাটা অনেক কষ্টের হবে। তাই আমরা মারিয়ানকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসি। কারণ আমি বা মিশেল তাদের সঙ্গে না থাকলেও মারিয়ান তাদের সময় দিতে পারবে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে যাই যে হোয়াইট হাউসে আসার পরই আমরা সবচেয়ে বেশি সময় একসঙ্গে থাকতে পারি। আমার দুই মেয়ের জন্মের পর কখনোই আমরা পুরো পরিবার একসঙ্গে এতটা সময় কাটাইনি। প্রায় প্রতিরাতেই আমাদের একসঙ্গে থাকার সুযোগ হয়। আমি আর মিশেল দুজনই বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখাই। মালিয়ার টেনিস ম্যাচে কিংবা সাশার নাচের ক্লাসেও উপস্থিত থাকতে পারি আমি। সাশা আমাকে তাদের বাস্কেটবল দল ‘দ্য ভাইপারস’কে কোচিং করাতে সাহায্য করে। দলটি চ্যাম্পিয়নও হয়।

সব বাবার মতো আমিও তাদের ফলাফল নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকি। যখন আমার মেয়েকে হিল পড়ে প্রথম প্রম নাইটে যেতে দেখি তখন পৃথিবীর সব বাবা’র মতো আমার মনও নার্ভাস থাকে। কিশোরী মেয়েদের বাবা হওয়াটা সবসময় সহজ না কিন্তু তাদের সঙ্গে সময় কাটানো সবসময়ই সুখের। চরম ব্যস্ততার দিনেও মিশেল ও আমি পরিবারের জন্য একটু সময় বের করার চেষ্টা করি যেটা আমাদের করতেই হবে। যেমন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে যত ব্যস্তই থাকি না কেন আমি সব কাজ ফেলে উপরে চলে যাই এবং পরিবারের সঙ্গে খেতে বসি। কখনোই এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে না।

আমার সহকর্মীরা সবাই এটা জানে এবং জাতীয় পর্যায়ের জরুরি কিছু না হলে তারা আমাকে এসময়ে বিরক্ত করে না। নিশাচরের মতো আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি এবং পরবর্তী দিনগুলোর জন্য কাজ করতে থাকি। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে ডিনারে আমার পুরো কাজটাই থাকে তাদেরকে ঘিরে। আমি সাশা ও মালিয়াকে আদর্শ বাবার মতো চিরাচরিত প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে থাকি। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি যে তাদের স্কুল কেমন ছিল কিংবা তার বন্ধুদের কি খবর, হোমওয়ার্ক করেছ কিনা? কিন্তু তারা উত্তরে  আমার বড় কান ও পোশাক নিয়ে মজা করতে থাকে। আর মিশেলও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এখন তাদের এমন বয়স যে তারা সবকিছুই বোঝে। তাই প্রায়ই তারা আমাকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করে

অন্যান্য তরুণের মতো তারাও পরিবেশ নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাদের প্রজন্মের সব তরুণদের মতো তারা বিশ্বাস করে সমাজে বর্ণ কিংবা লিঙ্গ বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাদের বয়সী যেকোনো সাধারণ মেয়ের মতোই তারাও বেশকিছু প্রত্যাশা নিয়ে বড় হচ্ছে। তারা বড় হয়ে যেটা হতে চায় সেভাবেই বড় হতে পারছে। আমি শুধু তাদের চিন্তাগুলোকে নিয়েই ভাবি এবং বোঝার চেষ্টা করি যে তারা কতটা বুদ্ধিমতি ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। তাদের নিয়ে চিন্তা করলেই আমি আরো চাঙা হয়ে উঠি এবং নতুন লক্ষ্য খুঁজে পাই। বাবা হওয়া সত্যিই আনন্দের। আর সন্তানের কাছ থেকে বাবা ডাক শোনার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। সন্তানের সঙ্গে সময় বের করার ক্ষেত্রে মিশেলও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে; আর এটি একটি বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। যেমনটা আমি বলেছি সেই আমাদের পরিবারের স্তম্ভ। আমি জানি যাই ঘটুক না কেন, তারা সবসময়ই আমার পাশে থাকবে এবং আমিও তাদের পাশে থাকব। এখনকার সময়ে মেয়েগুলো প্রায়ই রাতের সময়টা মিস করে কারণ তারা স্কুল ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

অন্যান্য সব বাবা-মার মতো আমিও আমার মেয়ের কলেজে ভর্তি হয়ে দূরে চলে যাওয়া নিয়ে শূন্যতা অনুভব করি। স্কুল শেষে মালিয়া দূরে গেলে টেবিলে একটি খালি চেয়ার দেখবো বলে আমি এখনই শিউরে উঠি। তাই যতক্ষণ সম্ভব আমি পরিবারকে সময় দেয়ার চেষ্টা করি। এক ছাদের নিচে পরিবারের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করতে চাই।’

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *