নেতা পরিবর্তনের রূপকার। বৃহত্তর পরিবর্তনের স্বার্থেই নেতার নেতৃত্ব বিকশিত হয়। জাতির উত্থান পতন অনেকাংশে নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপর। নেতৃত্ব হচ্ছে নিজেকে জানা, দক্ষ যোগাযোগ, পারস্পরিক আস্থা ও প্রয়োজনীয় কাজের মাধ্যমে সহযোগীদের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা এবং পরিস্থিতি জয় করার সামর্থ্য। তিনিই নেতা যিনি পথ জানেন, অনুসরণ করেন ও দেখান। নেতা ঘুমালে পুরো সমাজ ঘুমায়। নেতা নিথর-নিস্তব্ধ হলে সমাজও হয় নিথর-নিস্তব্ধ। নেতা দেখেও না দেখার ভান করলে সমাজও অন্ধত্ব ধারণ করে। নেতা ভালো মন্দ পার্থক্য করার শক্তি হারালে সমাজে বধিরের সংখ্যা বেড়ে যায়। নেতা আত্মকেন্দ্রিক হলে জনসাধারণও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে নিমগ্ন হয়।
যোগ্য নেতার কর্মের মধ্য দিয়েই কর্মীরা খুঁজে পায় তাদের কাজ, দায়িত্ব ও কর্তব্য। নেতা নিজে যেভাবে কর্ম সম্পাদন করবেন, কর্মীবাহিনীর মাঝেও কর্ম বন্টন করে দিবেন। না হলে কর্মী বাহিনী কাজের অভাবে হবে সমালোচনামুখর, নিস্তব্ধ ও অযোগ্য। নেতার নেতৃত্ব যেমনি পুরো সমাজ পরিবর্তন করে দিতে পারে, তেমনি জাহাজের পাটাতন কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার মতো সমাজটাকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে। নেতৃত্বের বলিষ্ঠতায় অধীন ও কর্মীবাহিনীর মাঝে কর্ম সম্পাদনে ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। নেতার এক পা অগ্রসর হলে কর্মী বাহিনীর দুই পা অগ্রসর হয়। নেতার এক মিনিটের কাজ, কর্মী বাহিনীর শত মিনিটের কাজ।
নেতা সকল কর্মীকে কাজে লাগাতে পারলে এক ঘন্টার কাজ সম্পন্ন হবে এক মিনিটে। সেজন্য নেতাকে কাজ করা থেকে কাজ বের করার চিন্তাই বেশি করতে হয়। চিন্তাহীন ও অকর্মণ্য নেতা মানেই গতিহীন সবকিছু।তাই নেতাকে হতে হয় প্রজ্ঞাবান। প্রবল প্রচেষ্টার মাধ্যমেই নেতা হিসেবে তুলে ধরতে হয় এবং সর্বজনীন কাজ সম্পন্ন করার জন্য মানুষের সহায়তা ও সমর্থন লাভ করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক লক্ষে পৌঁছনোর জন্য অন্তর্বর্তী ও বাহ্যিক পরিবেশে প্রাপ্ত সম্পদকে সফলভাবে সমন্বয় সাধন করতে পারে। কার্যকর নেতা যে কোনো পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে সফল হওয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং কোনো সংস্থা বা সমাজের প্রত্যাশা পূরণকারী হিসেবে স্বীকৃতি পান।
নেতাদের থাকতে হয়- শোনার ও পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা, সব স্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনা শুরুর ক্ষমতা, উত্সাহদানের জন্য দক্ষতাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা, জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে নিজেদের মূল্যবোধ ও দূরদর্শিতাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা। নেতৃত্ব মানে কর্মসূচি স্থির করা, সমস্যা চিহ্নিত করা এবং শুধুই পরিবর্তনের সঙ্গে সামাল দিয়ে না চলে নিজেই এমন পরিবর্তনের সূচনা করা যা উল্লেখযোগ্য উন্নতির পথ প্রশস্ত করে।
নেতৃত্বের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল চালনাশক্তি (কৃতিত্ব, প্রেরণা, উচ্চাশা, প্রাণশক্তি, উদ্যোগ এবং লেগে থাকার ক্ষমতা), নেতৃত্বের প্রেরণা (নেতৃত্ব দানের ইচ্ছা), সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মবিশ্বাস, অনুধাবনের ক্ষমতা এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান। সহজাত দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং নমনীয়তা থাকে। সফল নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার চাহিদা বেশি থাকবে, সংযোগের চাহিদা কম থাকবে, এবং উচ্চমাত্রায় সক্রিয়ভাবে বাধাদানের ক্ষমতা থাকবে।প্রতিটি ক্ষেত্রে দলের নেতা দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রশংসা ও সমালোচনা, এবং দলের কাজের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনটি শৈলী অনুসারে নিজের প্রভাব খাটিয়েছিল। এই তিনটি শৈলী হল: কর্তৃত্বপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং অবাধ স্বাধীনতাপূর্ণ।
নেতার দায়িত্ব অধস্তনদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা, দলের মধ্যে প্রচণ্ড আবেগসঞ্চার করা, দলকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া এবং সবার কাজে গতি আনা। ভালো নেতা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রাখেন না, অধস্তনদের পরামর্শ বা উদ্যোগকে প্রশ্রয় দেন, সহচারীদেরকে বিশ্বাস করেন, আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত-গ্রহণকে পছন্দ করেন, দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দেশ দেন, দলের সহযোগিতা লাভ করেন, তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছান এবং দলকে কার্যকরী ও ইতিবাচকভাবে উদ্বুদ্ধ করেন।
নেতা হলেন একজন মানুষ যিনি একদল মানুষকে একটি নির্দিষ্ট ফলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করেন। অন্যদের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের ক্ষমতা, স্পষ্ট যোগাযোগস্থাপন এবং লেগে থাকার ব্যাপারে তাঁদের দায়বদ্ধতা, এই ক্ষমতাগুলির দ্বারা একজন নেতাকে চিহ্নিত করা হয়। ব্যক্তি নেতৃত্বের বিপরীতে কিছু প্রতিষ্ঠান দলগত নেতৃত্বকে গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন দক্ষতা সম্পন্ন এবং প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অংশ থেকে একদল মানুষ একটি প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে একজোট হন।
নেতৃত্ব হল বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা, মানবিকতা, সাহস, ও শৃঙ্খলাবোধের বিষয়। শুধু বুদ্ধিমত্তার উপর ভরসা করলে বিদ্রোহী মনোভাব দেখা দিতে পারে। শুধু মানবিকতার ব্যবহার দুর্বলতার জন্ম দেয়। অবিচল বিশ্বাস থেকে দেখা দেয় মূর্খতা। সাহসের শক্তির উপর নির্ভরতা রূপ নিতে পারে হিংসার। অতিরিক্ত শৃঙ্খলাবোধ এবং কঠোরতা থেকে জন্ম নিতে পারে নিষ্ঠুরতা। যখন এসব গুণ একত্রিত হয়, প্রতিটি গুণ নিজের কাজের প্রতি যথাযথ হয়, তখনই একজন মানুষ নেতা হয়ে উঠতে পারেন।